বন্ধনের মানুষেরা (২)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১১/০৪/২০০৮ - ৯:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আহত আর ভীরু মন নিয়ে আমার পাখি চোখ বারে বারে এপাশ ওপাশ দেখে আর আমি একটা ঘূর্ণিতে আটকে পরি। সেই ঘূর্ণির ভয় কমাতে আমি এবার নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসি। অনেক আকাশ কুসুম ভাবনায় নিজেকে আবৃত করে রাখি। আমার সেই আড্ডার সাথীরা আমার ভাবনার সাথী হতে চায়। আর আমি ভয় পাই আবার না সেই মরুঝড় দেখতে হয় আমাকে। আড্ডার সাথীদের কেউ কেউ আমায় দোষারোপ করে Ñ কেউ কেউ আমায় ব্রহ্মান্ড চেনাতে আসে Ñ কেউ কেউ আমায় ধমকায়। আমার পাখি মন বিক্ষিপ্ত হয় Ñ বিরক্ত হয়। কিন্তু দূরে সরাতে পারে না। পারে না এই জন্য যে, ওরা তো কোন কৃত্রিমতা দিয়ে আমায় ভোলাতে আসে না। বরং আমার ডানাগুলোর সুস্থতা দেখতে চায় Ñ তাই হয়তো বা নিয়মের বিধিমালা গুলো আমার ওপর চাপায়। কিন্তু আমার যে বয়স বেড়ে গেছে Ñ কারও বিধিমালা চলে আর চড়তে পারি না আমি। তবুও একা হয়ে যাবার ভয়ে ওদের সাথে ভাব রাখি। আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা তো এই বিধিমালার ফাঁকে ফাঁকে আনন্দও দেয় আমাকে। আমি সেই নিংড়ানো আনন্দেরও তো কাঙাল।

আমার কাঙালীপণার জেরে ওরা যা বলে আমি তাই তাই করার চেষ্টা করি। ওরা যখন বলে ওড়ো তখন আমি উড়ি আর যখন বলে এখন যাও বিশ্রাম নাও। আমি একটু ভেবে বিশ্রাম নিয়ে নেই। ওরা হয়তো তাতেই খুশি হয় বা খুশির ভাণ করে। আর আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। বিধিমালার ফাঁকে ওরা আমাকে কিছুদিন রেখে তারপর ছাড় দেয়। আমি ফুরুৎ করে নিয়মের বেড়া গলে উড়ে পালাই। আনন্দ আর আনন্দে কাঁটে আমার জীবন। কিছুদিন মুক্ত হাওয়ায় রোদের রঙে আমার পালক হলুদাভ হয় Ñ সবুজ লেগে লেগে বুকটুকু সবুজ আর শ্যাওলা ধরা কৃষ্ণ জলের দীঘি দেখে দেখে চোখ বাদামী হয়। এবার ওদের চোখেও চমক লাগে। আমাকে জানায় যে, ওদের তৈরি বিধিনিষেধগুলো আসলে ভুলই ছিল। আমি সুখী হই। আবার ওদের আপন লাগে। একেবারে ওদের শরীরের কাছাকাছি চলে যাই। এমন এক সময়ে এই বনের পাখীটিকে একদিন আড্ডার একজন বনে আমন্ত্রণ জানায়। আমি সংসার ভুলে উড়ে উড়ে যাই। বুনো বাতাস নিতে Ñ পাতার নিঃশব্দ ধ্বনি কান পেতে শুনতে। চারপাশে মৌ মৌ গন্ধে আমি মাতোয়ারা হয়ে উঠি। আমার ডানায় বনের হাওয়াগুলো শিরশিরিয়ে যায়। আমি শিহরিত হই Ñ রোমাঞ্চিত হই। আচমকা সেই রোমাঞ্চে কাঁপুনী লাগে। আমার বয়স আবিষ্কার করায়, ওর আর আমার চাওয়া বন ভিন্ন। ও চায় বনে এসে সৌরক হতে আর আমি চাই বনপাখী হতে। ওর কুৎসিত চেহারা আমাকে বিভ্রান্ত করে Ñ আমার স্বপ্নে দেখা বনটি এক নিমিষে হয়ে যায় খড়ির কাঠ প্রাপ্তির স্থানে। আমি থমকে যাই Ñ বিস্মিত হই Ñ ওর দেয়া অপমানের বিছুটি আমার মনকে খর করে। আমি দিকভ্রান্ত হয়ে আবার ঘূর্ণির পাঁকে পরি। তীব্র কষ্ট বেদনা ভুলতে আমি উচ্ছ্বসিত হবার ভাণ করি। আর করি আবার একটা ভুল।

উচ্ছ্বসিত হবার অভিনয় করতে গিয়ে আনন্দে মাতি সবার সাথে যখন তখন। আড্ডার আরও একজন আমাকে নষ্ট পাখি নামে ভাবে। আর ভেবেই ক্ষান্ত হয়না সে, আমার চারপাশে ফুল Ñ লতা Ñ বৃক্ষকে চিৎকার করে বলতে থাকে যে আমি একটা নষ্ট পাখি। আমি একটা নষ্ট পাখি। আমায় ঠাঁই যেন ওরা কখনও না দেয়। বৃক্ষ Ñ লতা Ñ পাতা থমকায়। অবিশ্বাসী চোখে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে। ওদের বিস্ময়ের চোখ আমাকে কুপিত করে। আমি আহত হই Ñ আহত হই Ñ আহত হই। আমার আহত চোখ দেখে, কি জানি কেন Ñ ওদের মায়া হয়। ওকে উপচে আমায় কাছে টেনে নেয়। কিন্তু তবুও আমার সেই পুরনো মন আর ফেরে না। আর আমি একাকী হয়ে Ñ বিস্মিত হয়ে চুপ করে বসে থাকি।

একাকী সময়ের কষ্ট এড়াতে কতভাবে না নিজেকে কাজে জড়াই। কাজ, কাজ আর কাজ দিয়ে ভুলিয়ে রাখি নিজেকে। নষ্ট পাখি নামদাতা আর সৌরককে এড়াতে সবুজ বুকখানি একটু কেটে ওদের নাম ধারণ করা কালচে রক্ত ফেলে দেই। আমার আরও প্রিয় মানুষেরা আমায় দোষারোপ করে বলে যে, দুদিন পর ওদের নামের রক্তগুলোও ফেলে দেব। ওরা ভাবে যে আমার আড্ডার বন্ধুরা আমার স্বার্থের প্রয়োজনের আর আমি থমকানো মন নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বন্ধু কখনও স্বার্থের প্রয়োজনে হয় এ তো কখনও ভাবিনি। আমার কষ্ট পাওয়া মনের জড়ানো কথাকেই ওরা সত্য বলে আকড়ে ধরে আর আমাকে আঙুল তুলে দেখায় যে, স্বার্থপর! স্বার্থপর! স্বার্থপর! আমি উদ্বাস্তু মন নিয়ে ঘুরে বেড়াই। একসময় কাঁটাতারের বেড়ার নীড় গড়ি নিজের মনের গহীনে।

ক্যামেলিয়া আলম


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

উচ্ছ্বসিত হবার অভিনয় করতে গিয়ে আনন্দে মাতি সবার সাথে যখন তখন।

হয়তো বা তাই
আমরা হাসি না
হাসার অভিনয় করি অন্যের সাথে
আর মাঝে মাঝে দেখি নিজেও নিজের সাথে হাসছি জোর করে

অতিথি লেখক এর ছবি

'একসময় কাঁটাতারের বেড়া গড়ি নিজের ভেতরে....'

গড়ি হয়তো অনেকেই কিন্তু কয়জন তা বলতে পারি মুখ ফুটে?

অতিথি লেখক এর ছবি

ক্যামেলিয়া আলম
আপনার নামটা জানান না ভাইÑÑÑÑÑ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।