একটি সমকালীন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছোটগল্পের অনুবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২০/০৪/২০০৮ - ২:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের সামনের রাস্তায় যেদিন থেকে বাস চলা শুরু করলো

আমাদের সামনের রাস্তায় প্রথম যেদিন বাস চলল সেদিন আমরা ভাবলাম পৃথিবীটা সত্যিকার অর্থেই ছোট হয়ে আসছে, খুশী হলাম, এবং মাত্র আধমাইল দুরবর্তী আদমপুর বাজারে যাবার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুঝলাম প্রখর রৌদ্রে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। তাছাড়া বাসগুলোতে নতুন নতুন হিন্দী গান বাজছিল বলে আরেক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করলাম মনে, প্রকৃতপক্ষে বাসের চারটি চাকা মানুষকে যার যার গন্তব্যে নেয়া ছাড়াও আর কি কি করতে সম সেটা উপলব্ধি করতে পারিনি আমরা, সেজন্যে মাথায় গতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন হিসাব নিকাশ ক্রমাগত ঘুরতে লাগলো, যদিও বাসে উঠামাত্র “মেরা পিয়া ঘর আয়া...” শুনে আমাদের কিছুটা খটকা লেগেছিল, যেভাবে খেতে বসে ঝাল তরকারীর ভিতর মিষ্টি স্বাদ আবিষ্কার করে আমরা চিন্তিত হয়ে উঠি।

এভাবে ঘুম থেকে উঠার আগে পোঁ পোঁ ইত্যাদি শব্দ চিৎকারের নতুন উপনিবেশে জীবনে নতুন মাত্রা এনে দিল, আমাদের কয়েকজন বন্ধু প্রথম কয়েকদিন এমনি এমনি বাসে উঠতো, তারপর গ্রামের শেষমাথায় এসে “ড্রাইভার লামাও! ও ড্রাইভার” বলে তড়িৎ গতিতে নেমে যেতো আর ফিরে আসার পথে হাত-পা শরীর দুলিয়ে “মেরা পিয়া ঘর আয়া...” গাইতে গাইতে ...

পার্শ্ববর্তী তিলকপুরে জনৈক জনের শ্রাদ্ধে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে নতুন ফেইচুম পাঞ্জাবী পরিহিত কুঞ্জ খুড়া দৌড়াতে দৌড়াতে সড়কে উঠে কোনরকম বাসে উঠার জন্য পা তুলতেই ফেইচুমের কোণায় পা দিলেও সম্ভাব্য দুর্ঘটনা থেকে এ যাত্রায় রেহাই পেলেন। তবে স্বল্পবয়সী এক তরুণী যে প্রায় ড্রাইভারের কাছ ঘেঁষে বসেছিল সে খুড়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিতেই কুঞ্জ খুড়া ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠেন ‘নির্লজ্জ মেয়েছেলে, মিয়াঙের সাথে কেমন গা ঘেষে বসেছে, হু!’। সিটে বসার পর হাতের বামপাশে বসা লালরঙা নারীটিকে দেখে তিনি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, সেকথা গল্পচ্ছলে আমাদের বলেছিলেন। এরকমই তিনি, এভাবেই বয়ান করে যান জীবনের ছোট বড় নানান অভিজ্ঞতার কথা, এর কিছুদিন পর আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়না - তার বখে যাওয়া কুপুত্রকে এরকম একটি বাসের ড্রাইভার বানানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন তিনি। আমরাও স্বপ্ন দেখা শুরু করি, তবে তার পুত্রকে নিয়ে নয়, আমাদের নিজেদের জন্যে, আচ্ছা আমরাও তো দেখতে পারি; আদমপুর বাজার টু মৌলভীবাজার বাসের ষ্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে “মেরা পিয়া ঘর আয়া...”, আহ্ !

কিন্তু বাসের চারটি চাকা আদমপুর থেকে ভানুগাছ, ভানুগাছ থেকে মৌলভীবাজার, মাঙখেইমাঙ থেকে তিলকপুর এবং তিলকপুর থেকে ঘোড়ামারা পৌঁছে দিচ্ছিল। মাত্র ৩/৪ টাকায় এই সেবার মাধ্যমে আমরা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হলেও এ সেবার মাধ্যমে আমাদের আর কি কি উন্নয়ন ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে প্রথম প্রথম আমাদের কোন ধারনা ছিলনা। যদিও বাসস্ট্যান্ডে উঠতি তরুন সম্প্রদায়ের ব্যস্ততা দিন দিন বেড়ে চলেছিল, এবং কালো চশমা হাই হিল জুতাওয়ালী দু'একজন অচিনপুরর স্বর্গ থেকে ইন্দ্রাভিশপ্ত অপ্সরার মতো নেমে আসলেও চোখের তারা কাঁপছিল। সেরকম আমাদের কুমাড়াও এমন একজনকে দেখে বাড়ী ফিরে জ্বর বাঁধিয়ে বসে। জ্বর তীব্র হলে তার মুখ থেকে নিঃসৃত আশ্চর্য রসদগ্ধ বাক্যরাশির লজ্জায় ও অপমানে, শিয়রে বসা জননী চোখে অন্ধকার দেখে। আমরাও দেখি, আপসোসে, ইস কেন আমরা দেখলাম না , আমরা কয়েকজন তখন থেকে রোজকার ডিউটি ঠিক করে ফেলি পিয়া ঘর আয়া ... এবং আমাদের মধ্যে যাদের পুরোনো প্রেমিকা ছিল, নিঃসঙ্গ দুপুরে উরুৎ ফুরুৎ বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে তারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতো।

* ফেইচুম - ধুতির মণিপুরী সংস্করন
* মিয়াঙ - অমণিপুরী
* কুমাড়া - জনৈক তরুনের নাম

(২য় পর্বে সমাপ্য)

গণ্পকার : শুভাশিস সিনহা সমীর। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার কবি, গণ্পকার ও নাট্যকার। জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলায়। প্রকাশিত গ্রন্থাবলী : ছেয়াঠইগির যাদু(২০০২), সেনাতম্বীর আমুনিগৎতো সেম্পাকহান পড়িল অদিন (২০০৩), নুয়া করে চিনুরি মেয়েক (২০০৫) ইত্যাদি।
মুল গণ্পের লিংক: এখানে
অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ

--------------------------------------------------
নিবন্ধন নাম: কুঙ্গ থাঙ
ই-মেইল:


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

শুভাশিষ সিনহাকে স্বাগতম।
আদমপুর, তিলকপুর জায়গাগুলো খুব চেনা।
পরের পর্বের অপেক্ষায়...
-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অতিথি লেখক এর ছবি

বিষ্ণুপ্রিয়ার নাম থাকলেই লেখাটা দেখতে চলে যাই।ভলো লাগে।আশা করি আরো এরকম গল্প ,কবিতা(আগে পোষ্ট করেছিলেন) অনুবাদ করবেন।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

রানা মেহের এর ছবি

শুভাশিস সিনহা সমীর।
প্রিয় নাম এখানে ভালো লাগলো।
আরো লেখার অপেক্ষায়

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভাশিসের গণ্প এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার সাহিত্য আপনাদের ভালো লাগছে এটা জেনে উৎসাহ বোধ করছি। প্রথম কোন ছোটগল্প অনুবাদ করছি। ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দেবেন । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও বাংলার মধ্যকার বাক্যরীতির পার্থক্যের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুবাদে সমস্যা থেকে গেল।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।