লঘুগল্প ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৬/২০০৮ - ১১:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লঘুগল্প ২
দেবাশীষ কাকন

লঘু আর গুরুর পার্থক্য শব্দগত নয় কেবল। মজ্জাগত। আমার এ লেখা কোন মতেই গল্প নয়। তবুও প্রাণপনে সেটাকে গল্প বানানোর বৃথা চেষ্টা। পেট বাঁচানোর দায়ে আমাকে এই ছোট্ট দেশটার এখানে ওখানে প্রায়ই যেতে হয়। সাল ২০০৮। প্রথম সপ্তাহ। বান্দরবান গেলাম। চট্টগ্রাম পার হতেই পাহাড়ের জন্য মনটা আকুপাকু করতে থাকে। গাঢ় ঘন সবুজের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে প্রায় নাগরিক মন। বান্দরবান নিয়ে এর আগে আর বার দুয়েকের স্মৃতি আছে মগজের ভিতরে। প্রথমবার বেশ আগে। রিপোর্টার হিসেবে। তারপর নতুন বছর উদ্যাপনে ক্যাওকারাডং অভিযাত্রা। সেবার বান্দরবানের শরীরটা চিনেছিলাম। দুর্গম পাহাড়, সবুজ বৃক্ষ, নাম না জানা অজস্র ফুল, সাঙ্গু নদীর ছলাৎ ছলাৎ, সাম্পান চাঁদের গাড়ি আর দীর্ঘ অতিক্রান্ত পথ। এবারের উদ্দেশ্য ভিন্ন। বান্দরবানের হৃদয় চেনা। যদিও আমার কাছে হৃদয়ের আরেক ভিন্ন অর্থ আছে। হৃদয় এখানে মগজের সমার্থক। রাতটা হোটেলে কাটাই। বান্দরবানের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন আর ক্ষত চেনার জন্য সবচেয়ে যুতসই পদ্ধতি কোনটি হবে। কি জিজ্ঞেস করবো। কথা বুঝতে পারবো তো। আমাদেরকে তারা আপন ভেবে ঘরে ঢুকতে দেবে তো- এমনতর হাজার প্রশ্ন ভীড় করে আমার মাথায়। কেননা আমরা কোনদিনও তাদের সাথে আপনের মতো ব্যবহার করিনি। তাদের কাছ থেকে দ্বিধাহীন ব্যবহার আশা করি কিভাবে?
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে সাত সকালে পৌঁছে যাই রোয়াংছড়ি থানার তংপ্রু পাড়ায়। এখানে পাড়া আর গ্রাম সমার্থক। তংপ্রু পাড়া মূলত মারমা গ্রাম। তবে তংপ্রু পাড়াকে একটা ছোট নালা দুভাগে ভাগ করেছে। নালার আরেক পাশে তংচঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। আদিবাসীদের সব পাড়ায়ই একজন করে গ্রাম প্রধান থাকেন। তাকে ‘কারবারি’ বলা হয়। কারবারি গ্রামের সবকিছূ দেখাশোনা করেন। শুরুতেই গিয়ে উপস্থিত হই কারবারির বাড়িতে। পাকাঘর। উপরে টিনের ছাদ। এ পাড়ায় এই একটিই পাকা ঘর । বাকি সব বাশেঁর মাচাং। যেমনটি আমরা ক্লাশ থ্রি-ফোর-ফাইভের সমাজ বইতে পড়ে থাকি। মাটি থেকে বেশ উচুঁতে বাশেঁর ঘর। একটি পরিবার একটি ঘরেই বাস করে। কথা হয় কারবারির স্ত্রীর সাথে। কারবারি মারমা কিন্তু তার স্ত্রী চাকমা সম্প্রদায়ের। তাদের একটি সন্তানও আছে। জীবনজীবিকা আর গ্রাম চালানোর নানান কথা আমরা জেনে নেই তার কাছ থেকে। আমার চোখের সীমানায় বাড়ির মুরগি আর শুকরগুলো মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খুঁজে খায়। এ গ্রামে প্রায় ৯০ ঘর মারমার বসবাস আছে। আর এক ঘর বাঙ্গালি। কারবারির বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এবার ঢুকে পড়ি গ্রামে। যারা কাজে যাবার তারা কাজে চলে গেছে। বাকিরা গৃহস্থলী কাজে নিয়োজিত। আমরা কয়েকটা পরিবারের সাথে কথা বলি। তীব্র ক্ষুধা আর জীবনযাপনে ন্যুনতম মানবিক সুবিধা বঞ্ছিত মানুষেরা চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনযাপনের প্রক্রিয়া এখানে এখনো সরল। আমাদের যান্ত্রিক নাগরিক জীবনের কোলাহল, ব্যস্ততা আর শঠতা এখানে অনুপস্থিত। এখানে হরতাল, ধর্মঘট, সংস্কার, জরুরী অবস্থা - কিছুই নেই। মারমা মানুষগুলোর হাড় জিরজিরে শরীর জুড়ে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আর অপ্রাপ্তির হাহাকার। তেমন কোন চাওয়া নেই তাদের। এই একটু বিশুদ্ধ খাবার জল, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা আর খাবারের নিশ্চয়তা। এ বছর পাহাড় জুড়ে ইদুরের বন্যা। তার মানে দুর্ভিক্ষ হবে। বড় বড় ধেড়ে ইদুরগুলো সাবাড় করে দেবে জুমের ক্ষেত। উজার হবে ফসল। মারমা মেয়ের স্বপ্ন। কদিন পরেই সাংগ্রাই উৎসব। নববর্ষের অনুষ্ঠান। যুবক-যুবতীদের মনে খুশির রং। ক্ষুধা আর ভালবাসার চিরন্তন লড়াইয়ে কখনো কখনো ভালবাসা জয়ী হয়। সর্বগ্রাসী ক্ষুধার মানচিত্রে জল ঢেলে দেয় প্রেম, উৎসব। আপাতত: মারমা জনগোষ্ঠীর চোখে সেই উৎসবের রঙ লেগে আছে।
পাড়ার চায়ের দোকানে কথা হয় কারবারির সাথে। রাস্ট্রীয় সুবিধার বিন্দুমাত্র তাদের জন্য নয়। আমার গল্প এইখানে লঘু হয়ে যায়। নিরাপত্তার অজুহাতে ভীত আর সন্ত্রস্থ মুখগুলো শুকিয়ে যায়। মূলধারার জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলোর স্বাধীনতা বড় ঠুনকো, বড় অসহায় এখানে নিরুপদ্রব জীবনযাপন। পাহাড়ি ঢলের মতো বাঙ্গালিদের আগমন এখনো অব্যাহত। এখনো অব্যাহত অত্যাচার আর পীড়ন। সুখী বাংলাদেশের স্বপ্নটা তংপ্রু পাড়ায় এসে ম্লান হয়ে যায়। এইখানে এসে নতুজানু হয় স্বাস্থোজ্জল বাংলাদেশের আশা। মারমা শিশুর রুগ্ন শরীরের কাছে নতজানু হয়ে আসে জাতিসংঘ সনদ, সংবিধানের ধারাগুলো। স্রেফ জাতিগত পরিচয়ের কারণে মারমা নারীর চোখ নত হয়ে আসে। সে কি করে ভুলে যায় কয়েক দশকের উপদ্রুত জীবন? পালিয়ে থাকার স্মৃতি। তার জমির দখল নিজের থাকেনা। আমরা ফিরে আসি শহরে। মারমা রাজার সাথে কথা বলি। প্রায় শতবর্ষী এই রাজা তার লম্বা জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বয়ান করে আমাদের মোহিত করেন। কথা হয় আবার তংচঙ্গা শিক্ষকের সাথে। শান্তিবাহিনী সন্দেহে তার উপর করা অত্যাচারের দাগগুলো আজও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে। আর তার হৃদয়ের গহীন কোনে যে ক্ষত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি উপহার দিয়েছে - সে ক্ষত আমি দেখেছি। আদিবাসীদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে। পাহাড়ের সবুজে জ্বলে উঠেছে হিংসা। দশমিক কিংবা ভগ্নাংশ রাজনীতির এই জটিল খেলায় সবসময় তারাই শিকার হবে-যারা দশমিক, যারা ভগ্নাংশ। দেশের প্রায় এক দশমাংশ ভূমির ঐতিহ্যগত অধিকার যাদের, তাদেরকে অনুন্নত রেখে বাংলাদেশ উন্নত হবে কোন কালে? এই নির্মম, রুঢ় বাস্তব প্রশ্নটি আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয়। এ প্রশ্নের উত্তর তো আমি কবেই জানি। আমি শহরে ফিরে আসি। এই সব লঘু মানুষের স্মৃতি নিয়ে পা বাড়াই কাপ্তাইয়ের দিকে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে পাহাড় আবৃত। পাহাড়ে পাহাড়ে চেকপোষ্ট। মারমা জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের চেকপোস্টগুলো রক্তাভ হয়ে ওঠে। এই খানে একটু শুশ্রুষা দরকার। একটু নিরাপত্তা দরকার। এই সব লঘু মানুষদের গল্পে গল্পে আমার ভ্রমনকাহিনী এইখানে লঘু গল্প হয়ে ওঠে। আমি পা বাড়াই আরেক পাহাড়ি জনপদ রাঙ্গামাটির দিকে।

লেখক: দেবাশীষ কাকন
১০ মে, ২০০৮

kundudev@yahoo.com


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।