সংগীত নির্ভরতা ও সংগীত নিধন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৫/০৬/২০০৮ - ৪:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

”... মানুষ হ, মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ...
... বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ...”
গুরু সদয় দত্ত অনুভব করেছিলেন সোজা হয়ে দাঁড়াবার জন্যে নিজের পা ভিন্ন অন্য কোন মাধ্যম উপযুক্ত হতে পারে না। মাটির প্রতি দায়িত্ববোধ সহজ নয়; মাটিকে আশ্রয় করে যে মানুষ শেঁকড় ছড়িয়ে তরতর করে বেড়ে ওঠে তাঁর মাটি -বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচবার অদ্ভূদ কৌশলটি লেজকাটা শেয়ালের সেই পুরোনো গল্পের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। অন্ততঃ অনুভূতির জায়গাটিতে দেশ-মাটি-সংস্কৃতির একটি অনবরত চর্চার বিররীতে কপর্দকশূণ্য নরপতির বেশে, সব হারানোর বেদনায়- লিঙ্কিন পার্ক, সেপুলচুরার হেভি মেটালে বেশ মানিয়ে নিচ্ছি-জাতীয় অন্তসারশূন্য সংস্কৃতি চর্চা কোন ইঙ্গিত বহন করে থাকলে সেই ভয়াবহতার উপলব্ধি একান্ত দরকার। কারণ সঙ্গীত মর্মস্পর্শী। সংগীত রচনা করে সাংস্কৃতিক পরিচয়, নির্দেশ করে বোধের ঠিকানা। কিন্তু একইসাথে বিষয়টি অন্যভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা আলোচনা করছি সঙ্গীত নির্ভরতা বিষয়ে; বিষয়টির কেন্দ্রে একটি প্রচ্ছন্ন আহ্বান পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করবেন। যে কারণে গুরু সদয় দত্তকে ডেকে আনবার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। অর্থাৎ নিজস্ব কিছু আছে কি নেই সে বাস্তবতা উপলব্ধির অন্ততঃ একটা লে ম্যান ভিউ পয়েন্ট এক্সপেরিমেন্ট বেশ করা যেতে পারে। অভিজ্ঞ পন্ডিতসম ওয়াহিদুল হক বলেছিলেন ’তা আছে।’ কিন্তু আমরা বুঝি কীভাবে? মমতাজ গান করেন, বারী সিদ্দিকীও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। রবীন্দ্র-নজরুল-পঞ্চকবি কেউই শোনছেন না সেটাও বলা যায় না। মিলা-কনা’র সিডি নিশ্চয়ই একটা ভালো পরিমানে বিক্রি হয় বা ইভা রহমানেরও কদর নিশ্চয়ই রয়েছে। আর তরুণ প্রজন্মের থ্রাস কিংবা হেভি মেটাল নিদেনপে ইংরেজি/বাংলা হার্ড রক তো রয়েছেই। হিন্দি গানের জনপ্রিয়তা নাগরিক মাত্রই জানেন। আর বিশুদ্ধ,শাস্ত্রীয়,ক্যাসিকাল বলতে উচ্চমার্গের বিবেচনায় বা এগুলো বোঝার জন্যে যে ধরণের ওরিয়েন্টেশান দরকার তা না থাকায় আপন ভাবার অবকাশ হয়না। অন্ততঃ আমার েেত্র সেরকমই ঘটেছে। তাহলে সংগীত নির্ভরতার জায়গাটিতে একটি স্পষ্ট মেরুকরন রয়েছে যা কিনা এমনকি শ্রেনীদ্বন্দে গিয়ে ঠেকেছে শেষ পর্যন্ত। যদিও আমাদের ল্যচ্যুত হবার অবকাশ নেই।

গুরু সদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের স্রষ্টা। পরিপূর্ণ মানুষের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। মাটির কাছাকাছি থাকতে চেয়েছেন। এ মাটি নিঃসৃত রসে সিক্ত হয়েছেন। রাঢ় বাংলার রায়বেঁশে বা এই বাংলার ঢালী’র পৃষ্ঠপোষকতা এর দুটি প্রকৃষ্ট উদাহরন। এ দুটি লোক নাচে এত বিশুদ্ধ শিল্পরস থাকতে পারে তা কলপনাতেও ছিল না। ঘটনাক্রমে নাচ দুটি প্রত্য করার সুযোগ হলে এর শিল্পমান আমাকে স্তম্ভিত করে। অসময়ে বিষয়টির অবতারণা এই কারনে যে, কী নেই সে বিষয়ে আমরা যতটা সরব, যা আছে তা বোঝার বা দেখার েেত্র আসলেই কী কোন ফাঁক রয়েছে। না হলে সংগীতের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে কেন? বিশ্ব সংগীতের কোন ধারাকেই অবহেলা বা তুচ্ছ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও সরাসরি বিদেশি সংগীত আমাদের মেজাজে উপস্থাপন করেছেন। সেটা আমাদের নব সম্পদ হিসেবেই গৃহিত হয়েছে। যা হোক সংগীতের েেত্র একটি বিশ্বজনীন অবস্থান প্রত্যাশা করা যায় না। বাঙালি মাত্রই সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারাতেই আগ্রহ দেখাবেন সেটাও বোধকরি কোন যুক্তিযুক্ত সমাধান নয়। তবে জাতি হিসেবে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎস সন্ধানে অমনযোগী হওয়ার অবকাশ নেই। এবং আমাদের সংগীত সেই সংস্কৃতিরই একটি শক্তিশালি অংশ।

আবদুশ শাকুর বলেছিলেন, একমাত্র সঙ্গীতই পারে সম্মিলিত মানুষকে একত্রে আনন্দ দিতে। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে সেটি কষ্টকর। পুস্তক পাঠে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন বা চিত্রকর্ম দর্শনেও তেমনি। এবং সঙ্গীতই একমাত্র মাধ্যম যাতে মাথা না খাটিয়েই পাওয়া যায় অনেকখানি। নানাবিধ নাগরিক লম্ফ-ঝম্ফ শেষে তাই সঙ্গীত নির্ভরতা জোড়ালো। মিলা-কনা-জানা-অজানা কেউই কোন সমস্যা নন হেভি ইন্স্ট্রুমেন্টের ধুম-ধুম আওয়াজ বেরোলেই নিশ্চিত প্রশান্তি। তাহলে বিশুদ্ধ রসের জায়গাটি আপাততঃ শিকেঁয় তুলে রাখাই বেশ নিরাপদ নয় কি?


মন্তব্য

অচেনা কেউ এর ছবি

লেখা অসাধারণ হয়েছে।
আপনি কে ভাই ? পরিচয়টা তো দিলেন না আমাদের।
শুভকামনা রইল।

রণদীপম বসু এর ছবি

লেখা বিষয়ক মন্তব্যের আগে দু'টো বিষয়-
১. লেখার শুরুতে বা শেষে আপনার নামটা টাইপ করে দিলে আপনাকে না চেনার কষ্টটা পোহাতে হতো না আমাদের।
২. আপনি যদি লেখাটি ওয়ার্ডে টাইপ করে পরে অরূপ-মুর্শেদের বাংলা টুল্স দিয়ে ইউনিকোডে রূপান্তর করে থাকেন, তবে অবশ্যই ইউনিকোড টুলসে 'ক্ষ' বর্ণটি টাইপ করে দিতে হবে। ওই সফটয়ারের ক্ষ বর্ণটি দিয়েই ক্ষিদে নিবারণ করে থাকে।

যাক, আপনার লেখাটি আমি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি কি না জানি না। তবে আমার মনে হয় নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি মানুষের নাড়ির টান সহজাত। আপনি গত দুদশকের ইতিহাস টানুন, দেখেন আমাদের লোকায়ত ও শাস্ত্রীয় সংগীত অক্ষুন্ন আছে। নেই কেবল ওগুলোই।
লোক বাংলার সাধারণ মানুষের প্রাণ কিন্তু সরে যায় নি। আবার শিল্প-শিক্ষিত শ্রোতার হার শাস্ত্রীয় সংগীতে আগের মতোই আছে। হৈ চৈ সংগীত কিন্তু এমনিতেই হারিয়ে যায়।
লোকায়ত সুর ও কথাকে বেজ করেও কোন কোন পপ বা এজাতীয় শিল্পীরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার ব্যবসায়িক প্রয়াস যে আগে থেকেই করে আসছেন, ওটা কীসের ইঙ্গিত ?
আমি নৈরাশ্যবাদী নই।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

লেখক মডারেটর কেউ হইবো। কয়দিন আগেই না কিছু আইন পাশ হইলো। বে নামে লেখা যাইবো না- আইনটা কি ছিলো? ভুইল্যা গেসি।

আগ্মগোপনকারীর লেখা ভালো হইসে। তবে ব্রতচারী আন্দোলনের দিন শ্যাষ। এখন সবাই পলাইয়া গোশ খায়। অনেককিছুই খায়। নানা জাতের হাবিজাবি খাইয়া ব্রতচারী আন্দোলন করা হয় না। সংগীতও এখন টুংটাং সর্বস্ব। আজকে এই শিল্পী তো কালকে অন্যজন।

কাজেই নতুন মাধ্যম সন্ধান করলে মনে হয় আমরাও উপকৃত হইতাম।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অতিথি লেখক এর ছবি

তাহলে বিশুদ্ধ রসের জায়গাটি আপাততঃ শিকেঁয় তুলে রাখাই বেশ নিরাপদ নয় কি?

আমার মতে এ শুধু নিরাপদ ই নয় এক মাত্র কর্তব্য। কারন সংখ্যাগরিষ্ঠ ্যেখানে হুজুগে মাতাল সেখানে আপনার বা আমার বাঙ্গালী সংস্কৃতি বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে মুখে ফেনা
তুললেও তা অপাত্রেই দান হবে।
বিশ্লেষণধর্মী লেখাটার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।

রাফি

অতিথি লেখক এর ছবি

@ রণদীপম
নাম জুড়ে দেয়া নিয়ম কিনা আমার জানা ছিল না। যা হোক তা যদি একান্ত নিয়মই হয়ে থাকে তা হলে নাম বলতে দ্বিধা কিসের।

আপনার মন্তেব্যর সাথে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। সঙ্গীত ধ্বংশ হলে মানুষ বাঁচে কীকরে। কিন্তু উতকন্ঠার বিষয় হলো সঙ্গীত-বিযুক্ত মানুষ তৈরির একটা প্রক্রিয়া আমাদের সমাজে ক্রিয়াশীল। উদাহরণ হিসেবে উত্তরবঙ্গের ভাোয়াইয়া কথা চিন্তা করুন। মানুষের মধ্যে একটা স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল লক্ষ্যনীয়। কিন্তু আজকের দিনে সেটা ইতিহাস হয়ে গেছে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

সিনা চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

@ জুলিয়ান
কীসে আপনার এত আপত্তি? ব্রতচারী কার কোন অনিষ্টের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলুন। পারলে একটা সংগঠনের নাম বলুন যেটি বাংলার নিজস্ব কোন সংস্কৃতির ধারা বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ব্রতচারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বরং এই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কিছু ধারা বেঁচে গেছে। সারা বিশ্বে যেগুলো নুতন আসন পেতে চলেছে।
আরেক দিন যাওয়া যাবে সে আলোচনায়।

আর আমি ব্রত নিয়ে তা মানছি না সেটা কি ব্রতচারি আন্দোলনের দোষ।
প্রসঙ্গত, আমি ব্রতচারী করি না।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

@রাফি।
এক্করে আউলাইয়া ফালাইসেন দ্যাখতাছি!
১. সময়টা মনে রাখেন নাই।
২. যাঁরা ব্রতচারী, তাঁরা সাধক প্রকৃতির ছিলেন।
৩. এখন সাধন ভজনের মানুষ কম।
৪. নতুন শিল্পীরা একটু আ আ করতে পারলে রেকর্ডিং স্টুডিও ভাড়া কইরা ফালায়।
৫. আপনার "কীসে আপনার এত আপত্তি? ব্রতচারী কার কোন অনিষ্টের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলুন।" কথাটা বুঝতেই পারলাম না ক্যাম্নে কী!

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

কী নেই সে বিষয়ে আমরা যতটা সরব, যা আছে তা বোঝার বা দেখার ক্ষেত্রে আসলেই কী কোন ফাঁক রয়েছে।

সব দেশেই সঙ্গীত তথা শিল্প দাঁড়িয়েছে নিজ নিজ ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে এবং অবশ্যই তাতে সংযোজন করে। আর আমরা দাঁড়াতে চাই অস্বীকার করে। মাটিকে অস্বীকার করলে ডালে ঝুলন্ত থাকতে হয়। আমরা বোধ হয় বাদুড়ের মতো ঊর্ধ্ব পা মাথা হেঁট দশাতেই মঙ্গল বলে সাব্যস্ত করে নিয়েছি।
লেখাটা ভাল লাগলো।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

অনেক কথা বলার ছিল কিন্তু আসছে না
আপাতত সিনা চৌধুরী কে ধন্যবাদ এই ব্লগের জন্য
মুল লেখক , বসু আর ফারুকের সাথে একমত

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ফারুক ও মানিক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।