স্ট্যালিন বিরোধী মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে-২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৬/১১/২০০৮ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্ট্যালিন বিরোধী মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে-২
পূর্ব প্রকাশের পর..

সত্য প্রকাশিত হওয়ার ৫২ বছর আগের পরিস্থিতি
ইউক্রেন সম্পর্কে নাৎসিরা যে মিথ্যা প্রচার শুরু করেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের সাথেসাথেই কিন্তু তা শেষ হল না। নাৎসিদের হাত থেকে এবার এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল মার্কিন গুপ্তচর বাহিনী সিআইএ এবং ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনী এমআই-৫। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এই সময়ে পুঁজিবাদী দুনিয়ার প থেকে যে ব্যাপক প্রচারযুদ্ধ চালানো হয়, তার অন্যতম হাতিয়ারই ছিল এই দুই গুপ্তচর সংস্থার যোগানো সাজানো তথ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ৫০’এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন সেনাপতি জেনারেল ম্যাক আর্থারের নেতৃত্বে পূর্ব এশিয়ায় এ্যান্টি কমিউনিস্ট উইচ হান্টের নামে যে ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয়, তার পে যুক্তি খাড়া করার জন্যও কিন্তু সেই ইউক্রেনে ল ল মানুষের অনাহারে মৃত্যুর খবরকেই ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বিষয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়। এই বইটির নাম ছিল ‘ব্ল্যাক ডিডস্ অফ ক্রেমলিন’। বইটি প্রকাশের জন্য অর্থের যোগান দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ইউক্রেনীয়রাই। বাস্তবে এদের পরিচয় কী ছিল? এরা হল ইউক্রেনের সেইসব নাগরিক, যারা যুদ্ধের পুরো সময়টা নাৎসিদের প হয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আর যুদ্ধের শেষদিকে এরা নাৎসিদের সাথে সাথে দেশ থেকে বিতাড়িতও হয়েছিল। পরবর্তীকালে এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে এবং বিশ্বের সামনে নিজেদের গণতন্ত্রী বলে দাবি করতে থাকে।
রোনাল্ড রেগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে, ১৯৮০-র দশকে তিনিও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে প্রায় অঘোষিত যুদ্ধ চালাতে থাকেন। এইসময় ইউক্রেনের সেই দুর্ভিরে খবরটিকে নতুন করে আবার পরিবেশন করা শুরু হয়। ১৯৩০’র দশকের সেই নাৎসি অপপ্রচার ১৯৮৪ সালে এসে আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়, তবে এবারে একটি অত্যন্ত নামী মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড়ক গায়ে দিয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এই সময় ‘হিউম্যান লাইফ ইন রাশিয়া’ বলে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইতে সেই পুরনো মিথ্যাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হয়। ১৯৮৬ সালে আরও একটি বই প্রকাশিত হয়, ‘হারভেস্ট অফ সরো’। এই বইটির লেখক হলেন রবার্ট কনকোয়েস্ট। ইনি ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনীরই প্রাক্তন সদস্য। পরবর্তীকালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। অধ্যাপক পরিচয়েই তিনি এই বইটি লেখেন। বইটির জন্য ওই দেশত্যাগী ইউক্রেনীয়দের সংগঠন ইউক্রেন ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের প থেকে পুরস্কার বাবদ তিনি প্রায় ৮০ হাজার ডলার পান। এই একই সংগঠন ১৯৮৬ সালে ওই একই বিষয়ে ‘হারভেস্ট অফ ডেসপেয়ার’ বলে একটি সিনেমা প্রযোজনা করে। সেই সিনেমাতে আবার ওই রবার্ট কনকোয়েস্টের বইয়ের তথ্যই ব্যবহার করা হয়। তবে ইউক্রেনে ওই তথাকথিত দুর্ভিরে মৃতের সংখ্যা এবার লাফ দিয়ে বেড়ে যায়। এতদিন ধরে প্রচারিত ‘ল ল’ সংখ্যাটি এখানে হঠাৎ লাফ দিয়ে বেড়ে হয়ে যায় ‘দেড় কোটি’। আর এই আমেরিকাতেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ডেভিসের ‘মিশন টু মস্কো’ বইটি চিত্রায়িত করতে গিয়ে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের মতো বিখ্যাত সিনেমা সংস্থাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। কারণ ডেভিসের ওই বইতে স্ট্যালিনের যোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশংসা ছিল।
অবশ্য সেই পুরনো নির্জলা মিথ্যা কথাগুলিই নতুন ভাষায়, নতুন আঙ্গিকে বলা ছাড়া পূর্বোক্ত বই বা সিনেমাতে খুব বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। কানাডিয়ান সাংবাদিক ডগলাস টট্ল ১৯৮৭ সালে টরেন্টো থেকে ‘ফ্রড, ফেমাইন এন্ড ফ্যাসিজম Ñ দি ইউক্রেনিয়ান জেনোসাইড মিথ ফ্রম হিটলার টু হার্ভার্ড’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইটিতে তিনি ধরে ধরে প্রতিটি মিথ্যা তথ্যকেই বিশ্লেষণ করে তাদের স্বরূপ তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে, ওই বইতে দুর্ভিরে স্যাপ্রমাণ হিসাবে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে, সেগুলোরও পর্যন্ত ওই ঘটনার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। অনাহারকিষ্ট শিশুদের যেসব ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো বান্তবে ১৯২২ সালে তোলা। ওই সময়ে বাস্তবিকই সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণে বিপর্যস্ত বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে কয়েক ল মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল যুদ্ধে ও অনাহারে। কিন্তু এর কারণ কী ছিল? সোভিয়েত কর্তৃপরে ঘাড়ে এর দায় চাপানো কি সততার পরিচায়ক? ১৯১৮ থেকে ’২১ সালের মধ্যে সদ্য বিপ্লবোত্তর শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে ১৪টি বিদেশী শক্তি সেদেশের অভ্যন্তরে আগ্রাসন চালায় এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবিপ্লবীদের সরাসরি সাহায্য করে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এর ফলেই দেশের এক বড় অংশে ওই সময় সত্যি সত্যিই এক খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
১৯৩৪ সালের দুর্ভিরে যেসব রিপোর্ট পশ্চিমী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, ডগলাস টট্ল ধরে ধরে তাঁর বইতে সেগুলি বিশ্লেষণ করে দেখান, কিভাবে হার্স্ট প্রেসের প্রত্য মদদেই ওই সমস্ত নির্জলা মিথ্যাগুলি জন্ম নিয়েছিল। যেসব সাংবাদিক ওই সময় হার্স্ট প্রেসের তরফ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে উপস্থিত থেকে ওইসব সংবাদ ও ছবি পাঠিয়েছিলেন, তাদেরই অন্যতম হলেন টমাস ওয়াকার। তিনি নাকি দীর্ঘদিন ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নে অবস্থান করেন এবং ইউক্রেন ঘুরে ঘুরে সেখানকার ভয়াবহ দুর্ভিরে খবর সংগ্রহ করেন। ডগলাস টট্ল দেখান যে বাস্তবে ওয়াকার সারাজীবনের কখনোই ইউক্রেনে যাননি। শুধু তাই নয়, মস্কোতেও তিনি ছিলেন সাকুল্যে মাত্র পাঁচদিন। এই তথ্যটি আসলে ফাঁস করেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক লুই ফিশার। তিনি ছিলেন আরেকটি মার্কিন সংবাদপত্র ‘দ্য নেশন’-এর মস্কো সংবাদদাতা। এটুকুই শুধু নয়, ফিশার আরও দেখান যে হার্স্ট প্রেসের প্রকৃত মস্কো সংবাদদাতা ছিলেন অন্য আরেক জন, তার নাম এম. প্যারেট। কিন্তু প্যারোট মস্কো থেকে যে সংবাদ বা ছবি পাঠাতেন তা কখনোই ছাপা হত না। তিনি ওই সময় অর্থাৎ ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নে কৃষির েেত্র যে বিপুল অগ্রগতি ঘটেছিল তা প্রত্য করেছিলেন। ইউক্রেনেও সে সময় কৃষিেেত্র ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু মিস্টার প্যারোট যতই কৃষি-উন্নয়ন-সংক্রান্ত রিপোর্ট পাঠান না কেন, সেসব ছবি ও রিপোর্ট ছাপার যোগ্য বলেই সেদিন বিবেচনা করা হয়নি। টট্ল আরও প্রমাণ করেন যে, ইউক্রেনে তথাকথিত ভয়াবহ দুর্ভিরে মিথ্যা ছবি ও রিপোর্টগুলির উদগাতা যে টমাস ওয়াকার, তার এই টমাস ওয়াকার নামটিও আসলে ঠিক নয়। তার প্রকৃত নাম হল রবার্ট গ্রিন। আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের আদালত তাকে একটি ঘটনায় অপরাধী সাব্যস্ত করে ও কারাদন্ডের নির্দেশ দেয়। সেখানকার রাজ্য কারাগার থেকে তিনি জেল ভেঙে পালান। পরে তিনি আবার দেশে ফিরে গেলে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং মার্কিন আদালতে জেরার মুখে তিনি স্বীকার করতেও বাধ্য হন যে তিনি জীবনে কোনোদিন ইউক্রেনে যাননি। এইভাবে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত ডগলাস টট্লের বইতে পরিষ্কারভাবেই প্রমাণ পাওয়া যায় Ñ ‘স্ট্যালিনের সরাসরি নির্দেশে সৃষ্ট ইউক্রেনের ওই তথাকথিত ভয়াবহ দুর্ভিটি’ আসলে কী বস্তু! কী মারাত্মক রকমের নির্জলা মিথ্যা কথাকেই এতদিন সত্য বলে চালিয়ে আসা হয়েছে! কিন্তু তারপরও আজকাল এই মিথ্যার চাষ বন্ধ হয়ে গেছে ভাবলে ভুল হবে। একের পর এক নতুন নতুন বইয়ে নিঃসন্দেহে মিথ্যা প্রমাণিত ওই তথ্যগুলিকেই ফের সত্য বলে তুলে ধরা হচ্ছে। আর দণিপন্থী অগণতান্ত্রিক শক্তির স্বার্থে নীতিহীন এ কাজ করার জন্য এইসব বইয়ের লেখকরাও আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত অনেকগুলো রাজ্যেই সেদিন প্রচারমাধ্যম জগতে হার্স্ট-প্রেসের অবস্থান ছিল অনেকটাই একচেটিয়া। পাশাপাশি তাদের মালিকানাধীন নিউজ এসেন্সিগুলিও সারা পৃথিবী জুড়ে সংবাদ যোগান দেওয়ার কাজ করত। ফলে সব মিলিয়ে নাৎসি গেস্টাপো বাহিনীর মাইক হিসাবে তারা যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে কাজ করতে শুরু করে। প্রচারমাধ্যম জগতে তাদের একচেটিয়া আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে নাৎসি মিথ্যাচারকে তারা ডজন ডজন সংবাদপত্র, রেডিও এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে ‘সত্য’ বলে প্রতিভাত করার চেষ্টা চালিয়েছে। দুনিয়া জুড়ে চলেছে তাদের প্রচার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এইসব মিথ্যা খবরের উৎস যে নাৎসি গেস্টাপো বাহিনী, তার অবলুপ্তি ঘটল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হার্স্ট গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমের টানা কুৎসা রটনা একদিনের জন্যও ছেদ পড়ল না। এবার তাদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। ফলে মার্কিন প্রচারমাধ্যমে কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার আগের মতোই পুরোদমে চলতে থাকল।
রবার্ট কনকোয়েস্ট Ñ মিথ্যার অন্যতম হাতিয়ার
এবার রবার্ট কনকোয়েস্ট নামক ব্যক্তিটির বিষয়ে একটু মনোযোগ দেওয়া দরকার। পুঁজিবাদী প্রচারমাধ্যম বিভিন্ন েেত্র এ সংক্রান্ত লেখায় তাকে উদ্ধৃত করে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ল ল মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে যে সমস্ত বইপত্র লেখা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি ‘প্রামাণ্য’ গ্রন্থের রচয়িতা ইনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বজুড়ে সোভিয়েতবিরোধী যেসব কুৎসা নিরন্তর প্রচার করা হয় এর অনেকগুলোরই জন্ম তার হাতে। তার ভয়ঙ্কর কমিউনিজমবিরোধী দুটি বই হল ‘দ্য গ্রেট টেরর’ (১৯৬৯) ও ‘হারভেস্ট অব সরো’ (১৯৮৬)। মূলত এ বইদুটির জন্যই তিনি বিখ্যাত। এ বইগুলিতে একদিকে যেমন ইউক্রেনের সেই তথাকথিত দুর্ভিলে অনাহারে ল ল মানুষের মৃত্যুর পুরনো মিথ্যাটিকেই নতুনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার অভিযোগ আনা হয়েছে যে ১৯৩৬-৩৮ সালে গ্রেট পার্জের সময় শুদ্ধিকরণের নামেও গুলাগ লেবার ক্যাম্পগুলিতে একইরকম ব্যাপক হত্যাকান্ড ও বল্গাহীন অত্যাচার চালানো হয়। এসব লেখার তথ্যগুলি তিনি মার্কিন আশ্রিত দেশত্যাগী ইউক্রেনিয়দের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। এই ইউক্রেনিয়রা বেশিরভাগই ছিল সোভিয়েতবিরোধী দণিপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এরা দেশদ্রোহিতা করে নাৎসিদের প নিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। পরবর্তীতে, নাৎসিদের পরাজয়ের পর তারাও দেশ থেকে বিতাড়িত হয় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় লাভ করে। কনকোয়েস্টের বইয়ের অনেক নায়কই বাস্তব জীবনে যুদ্ধাপরাধী বলে গণ্য হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, ১৯৪২ সালে নাৎসি অধিকৃত ইউক্রেনে ইহুদিদের যে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয় তাতে তারা সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে একজন হল মিকোলা লেবেদ। নাৎসি অধিকৃত ইউক্রেনের লভোভ শহরের প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক ছিল এই ভদ্রলোক। যুদ্ধশেষে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে তার বিচার হয় এবং দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে কারাদ-ও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে সে জেল ভেঙে পালায় এবং সিআইএ’র সহযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যায়।
১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট টেরর’ বইটিতে কনকোয়েস্ট বলেছেন যে ১৯৩২-৩৩ সাল নাগাদ ব্যাপক দুর্ভিে সারা সোভিয়েত ইউনিয়নে নাকি ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষের অনাহারে মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে অর্ধেক মৃত্যুই নাকি ঘটেছিল ইউক্রেনে। ১৯৮৩ সালে তিনি আবার লেখেন, ওই দুর্ভি নাকি চলেছিল ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? এবারে তার হিসাব অনুযায়ী দেখা গেল, মৃত্যুর সংখ্যাও একলাফ দিয়ে বেশ বেড়ে গেছে। এবার তিনি বললেন, ওই দুর্ভিরে শিকার নাকি মোট ১ কোটি ৪০ ল মানুষ। তা এসব কথার পুরস্কারটাও তিনি অবশ্য ভালই পেলেন। ১৯৮৬ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় তিনি রোনাল্ড রেগানের হয়ে নির্বাচনী প্রচারপত্র লিখে দেওয়ার দায়িত্ব পেলেন।
১৯৮৭ সালের ২৭ জানুয়ারি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, অধ্যাপনার কাজে যোগ দেওয়ার আগে কনকোয়েস্ট ছিলেন ব্রিটিশ গুপ্তচর সংগঠনের ইনফরমাল রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট বা আইআরডি’র এজেন্ট। ব্রিটিশ গুপ্তচর সংগঠনের এ বিভাগটি সাধারণত মানুষের কাছে ‘তথ্যবিকৃতি বিভাগ’ নামেই বেশি পরিচিত। (ইরাক যুদ্ধের অজুহাত তৈরিতে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের মিথ্যাচারের ইতিহাস বর্তমানে সবাই জানে)। ১৯৪৭ সালে বিভাগটি প্রথম তৈরি হয়। সে সময় অবশ্য এর নাম ছিল ‘কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো’। তখন এর প্রধান কাজই ছিল ওই সময় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা কমিউনিজমের প্রভাবকে যে-কোনো মূল্যে আটকানো। এ উদ্দেশ্যে তারা নানা রকম বানানো গল্প ছাড়তে শুরু করে ও নানাভাবে সেগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে এবং এর সাহায্যে মূলত বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী মহলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা শুরু করে। এসব মানুষদের প্রথমে প্রভাবিত করে, তারপর তাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনোভাবকেও বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে চালিত করা। উদ্দেশ্য যে খুবই মহৎ তা নিয়ে সন্দেহ কি!
আইআরডি’র কাজকর্ম কিন্তু শুধু গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিদেশের মাটিতেও এদের লোকজন নানা রকমের কুৎসা ছড়ানো এবং আরও নানা ধরনের দুষ্কর্মের সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৭৭ সাল নাগাদ যখন আইআরডি’র কীর্তিকলাপ সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়, দেখা যায় সারা ব্রিটেন জুড়ে ১০০ জনেরও বেশি বিখ্যাত সাংবাদিক তাদের সাথে যুক্ত। এই সাংবাদিকরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে যে সমস্ত প্রবন্ধ লিখতেন তার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য তারা ওই আইআরডি’র কাছ থেকেই নিয়মিতভাবে পেতেন। বিভিন্ন নামকরা ব্রিটিশ সংবাদপত্রেই এসব সাংবাদিকদের লেখা নিয়মিত বেরুত। এসব সংবাদপত্রের মধ্যে এমনকী ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’, ‘দ্য টাইমস’, ‘ইকনমিস্ট’, ‘ডেইলি মেল’, ‘ডেইলি মিরর’, ‘দ্য এক্সপ্রেস’ বা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতো নামজাদা ও মনেদি কাগজও রয়েছে। ফলে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে ভালমতোই বোঝা যায়, কীভাবে সিক্রেট সার্ভিসের এসব কার্যকলাপ বাস্তবে জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত করা হচ্ছিল এবং এেেত্র তারা কী পরিমাণ সাফল্যও অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে যখন আইআরডি প্রথম তৈরি করা হয়, সে সময় থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রবার্ট কনকোয়েস্ট এ সংগঠনের সাথেই যুক্ত ছিলেন। সেই সময় কনকোয়েস্টের মূল কাজই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের তথাকথিত ‘কালো’ ইতিহাসের নামে নানারকম রুদ্ধশ্বাস গাল-গল্প তৈরি করা। এ গল্পগুলোই এরপরে ‘সত্য’ বলে দাবি করা হত এবং নানা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের হাত করে তাদের মাধ্যমে সংবাদপত্রে রিপোর্ট বা প্রবন্ধের আকারে পরিবেশন করা হত। এইভাবে তারা সহজেই জনমতকে অনেকটা প্রভাবিত করতে সমর্থও হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি যখন সরকারিভাবে আইআরডি ছেড়ে চলে যান তারপরও তিনি আইআরডি’র নির্দেশন মতোই বই লেখা চালাতে থাকেন। বলাই বাহুল্য, সেেেত্রও তথ্যের জন্য তিনি ওই গুপ্তচর সংস্থার যোগানো খবরের ওপরই নির্ভর করতেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট টেরর’ বইটি বাস্তবে আইআরডি’র হয়ে কাজ করার সময়ে তার রচিত বিভিন্ন গল্পকথারই পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ। বইটি লেখার সময় ও প্রকাশ করার েেত্রও আইআরডি থেকে তাকে সাহায্য করা হয়। শুধু তাই নয়, সেদিনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে চলতে থাকা শ্রেণীসংগ্রামের ওপর চরমতম দণিপন্থি দিক থেকে আলোকপাত করা এই বইটির স্বত্বের এক তৃতীয়াংশই কিনে নেয় প্রেজার প্রেস। এই প্রেজার প্রেসের অন্য একটি পরিচয়ও আছে। সিআইএ’র মদতে ও তাদের যোগানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত বই ছাপা হত, তাদের অনেকগুলোর েেত্রই সাধারণত এসোসিয়েট প্রেসের দায়িত্ব বর্তাতো এদেরই উপর।
আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন
৩০-৪০ দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নে তথাকথিত লাগামছাড়া অত্যাচার ও বন্দিশিবিরে নিহত বা বন্দি ল ল মানুষের বিষয়ে আরও বহু বই ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এসব বইয়ের লেখকদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন। তিনি নিজেও অবশ্য রাশিয়ারই মানুষ। তাঁর বহুল প্রচারিত বই ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’। এ বইটির জন্র ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তাঁর নাম সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি নিজে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপের দায়ে ৮ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন ও একটি লেবার ক্যাম্পে তাঁকে প্রেরণ করা হয়। সোভিয়েত-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই তাঁর এই দন্ড।
সোলঝেনিৎসিনের নিজের মত ছিল এই যে, হিটলারের সাথে সোভিয়েত সরকার একটু সমঝোতা করে নিলেই নাকি নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা এড়ানো সম্ভব ছিল। সেটা না করে সোভিয়েত সরকারই নাকি আসলে সেদেশের জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। আর স্ট্যালিন ছিলেন, তাঁর মতে, এমনকী হিটলারের চেয়েও খারাপ। নাৎসিদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি গোপন করতেও সোলঝেনিৎসিন এতটুকু চেষ্টাও করেন নি। এসব কারণেই তাঁর কারাদন্ড হয়।
১৯৬২ সালে সোলঝেনিৎসিনের প্রথম বই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই প্রকাশিত হয়। এই বইটির নাম ছিল ‘ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একটি দিন’। একজন কারাবন্দিকে নিয়েই এ গল্পটি। ক্রুশ্চেভ তাঁর স্ট্যালিন-বিরোধী সংশোধবাদী কর্মসূচিতেও সোলঝেনিৎসিনের লেখাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। ১৯৭০ সালে সোলঝেনিৎসিন তাঁর ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’ বইটির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর থেকে পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও তাঁর বই বিপুল পরিমাণে প্রকাশিত ও বিক্রি হতে শুরু করে। আর সেই সঙ্গে দ্রুত তিনিও হয়ে ওঠেন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। ১৯৭৪ সালে সোলঝেনিৎসিন এমনকী সোভিয়েত নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন এবং সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেন। এরপর তিনি পাড়ি দেন আমেরিকায়। এই সময় পুঁজিবাদী দুনিয়ার গণমাধ্যমে তাঁকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রায় সর্বশ্রেষ্ঠ সৈনিকের মর্যাদা দেওয়া হতে থাকে। নাৎসিদের প্রতি তাঁর খোলাখুলি সহানুভূতির কথাও তখন এই প্রচারের ঝড়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে শুরু করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোলঝেনিৎসিনকে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হতে থাকে। তাঁর ওইসব বক্তব্য ছিল প্রায়শই অত্যন্ত উস্কানিমূলক ও হিংস্র। তাঁর মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানই এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হত। যেমন, ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের পরও তিনি দাবি তুলেছিলেন যে, আমেরিকার আবার আরও বেশি প্রস্তুতি নিয়ে ভিয়েতনাম আক্রমণ করা উচিত। শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে পর্তুগালের সেনাবাহিনীর বামপন্থি মনোভাবসম্পন্ন অফিসারদের বিদ্রোহের ফলে যখন ৪০ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে তখনও তিনি দাবি তোলেন, আমেরিকার অবিলম্বে সে-দেশে সামরিক হস্তপে করা দরকার। তা নাহলে নাকি পর্তুগাল খুব শীঘ্রই ওয়ারশ জোটে (রাশিয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধবিরোধী জোট) যোগ দেবে। আফ্রিকাতে পর্তুগালের বিভিন্ন উপনিবেশগুলি স্বাধীন হয়ে যাওয়ার দুঃখও তিনি সারাজীবনে ভুলতে পারেননি। তাঁর বক্তৃতায় বারেবারেই তিনি এ বিষয়ে তাঁর আপে প্রকাশ করেন।
কিন্তু তাঁর অধিকাংশ বক্তৃতায় তিনি বলতে গেলে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধই ঘোষণা করেন। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে-কোনো রকমের অভিযোগকেই তাই তিনি সানন্দে লুফে নেন ও তাঁর বক্তৃতায় নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে চলেন Ñ তা সে সোভিয়েত ইউনিয়নে ৩০-এর দশকের দুর্ভিে ও অত্যাচারে ল ল মানুষের মৃত্যুর অভিযোগই হোক, বা উত্তর ভিয়েতনামে কয়েক ল মার্কিন সেনাকে বন্দি করে রেখে অকথ্য অত্যাচার চালানোর গল্পই হোক Ñ সবই তাঁর বক্তব্যে হয়ে ওঠে নির্ভেজাল সত্য। বলে রাখা ভাল, উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের বন্দি করে রেখে দাস শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করার যে অভিযোগ সোলঝেনিৎসিন তোলেন, জনপ্রিয় হলিউড ফিল্ম ‘র‌্যাম্বো’ তার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, যেসব মার্কিন সাংবাদিক এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তির বাতাবরণ তৈরির সপে মতপ্রকাশ করেন, সোলঝেনিৎসিন তাঁদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলেন। তিনি এ সময় সর্বত্র সোভিয়েতকে রুখবার উদ্দেশ্যে মার্কিন পরে ব্যাপকতর সমর-প্রস্তুতির পইে মত প্রকাশ করতে থাকেন এবং এই বিষয়ে জনমত গঠন করতেও উদ্যোগী হন। কারণ তাঁর মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন যে বিপুল সমরায়োজন শুরু করেছিল তাতে নাকি সাধারণ এবং পারমাণবিক উভয় রকম অস্ত্র শক্তিতে তারা অতি শীঘ্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে দ্বিগুণ, তিনগুণ এমনকী পাঁচগুণ পর্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠতে চলেছিল। বস্তুত, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্যগুলিতে আমরা উগ্র দণিপন্থার কণ্ঠস্বরই শুনতে পাই। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই ব্যাপারে এতটাই দণিপন্থি হয়ে ওঠেন যে, প্রকাশ্যেই ফ্যাসিবাদের পে মত প্রকাশ করতেও তাঁকে খুব একটা কুণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি।

চলবে..............


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।