মুক্ত বাজারে সংকট মেটে না

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০২/০২/২০০৯ - ১২:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অর্থনীতির েেত্র নব্বই দশকের পর থেকে বিশ্বায়ন সংক্রান্ত ধারনা ছিল প্রচার-আলোচনার কেন্দ্রে। মুক্ত বাজার নীতি বিবেচিত হয়েছে অর্থনীতির েেত্র বিকশিত প্রক্রিয়া হিসেবে। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন করে প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনে মুক্ত বাজারের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই- এর পে জনমত গড়ে তুলতে অর্থনৈতিক শক্তিগুলো ছিল তৎপর। যারা সে মতের বিরোধিতা করেছিল তাদের বলা হযেছিল- সংস্কারগ্রস্ত, সেকেলে। সে প্রচারণা শুরুর পরে আজ দেড় যুগের ওপর পার হয়ে গেছে। সেই সব উদারীকরণ-সংস্কার আর খোলা বাজারের সবগুলো শ্লোগান এখন মূল্যায়ন করার সঙ্গত কারণ নিশ্চয়ই দেখা দিযেছে। কারণ বিকশিত অর্থনৈতিক ধাপটি যে তার প্রতিশ্র“তি রাখতে পারেনি তা আজ অনেকটাই স্পষ্ট।

তত্বগত মোড়কে এক অদ্ভূত ধারনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পৃথিবীতে। তা হল- ব্যক্তির শক্তি আর তাদের নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতাই পারে মানব সভ্যতাকে এগিযে নিতে। প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ আর মুক্ত বাজার গড়ে দেবে ব্যক্তির মতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের পটভূমি। অবাধ বাণিজ্য নীতির মূল কথা হল- প্রতিটি জাতি বা ব্যািক্তকে তার নিজের যে বিশেষ দতা তা নিয়ে কাজ করতে দাও তাতে সকলেরই মঙ্গল। বেশি করে আমদানি করলে জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাবে, সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যাবে; আর বেশি করে রপ্তানি করলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, তৈরি হবে অনেক চাকরির বাজার । তোমার দেশের যা উৎপাদন হয় সেটা রপ্তানি কর, যা হয় না তা আমদানি কর। নিজের জাতীয অর্থনীতির দিকে তাকানোর দরকার নেই, বিশ্ব বাজারের কথা চিন্তা কর।
বর্তমান বিশ্বে মুক্ত বাজারের ধারনার ঠিক উল্টোটি হল- জনপ্রিয় সংরণবাদ বা পপুলার প্রটেকশনিজম। নামটা মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারি রবার্ট জোয়েলিকের দেয়া। ব্রাজিল, ভারত এবং চীন যার উদাহরন। বাজারকে একদম হাট করে খুলে দেয়ার বিরোধী এরা। এরা চায় নিজেদের স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতিকে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে জায়গা করে নিতে। এরকম নীতির বিরুদ্ধে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সমালোচনা আর নিন্দার যেন শেষ নেই। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একদিকে মুক্ত বাজারের শ্লোগান অন্যদিকে সংরণবাদী রাষ্ট্র দুটোই আছে। দুটো ধারাই পুঁজিবাদী কাঠামোরই দুটো রূপ কিন্তু প্রশ্ন হল কোন পদ্ধতিটা বেশি কার্যকর বলে নিজেকে প্রমান করেছে?

বিশ্ব বাজারে এখনো চলছে অতি উৎপাদন সংকট। যে পরিমাণ উৎপাদন করা যায় সে পরিমান বাজার নেই, ফলে বাড়তি উৎপাদন নিয়ে বেকায়দায় পড়ে অর্থনীতির সংকটে হিমসিম খাচ্ছে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোই। বাজারের প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা আরও তীব্রতর হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানি গঠিত হয়েছিল বাজারের বিস্তুতির কথা মাথায রেখেই। সেটাও পর্যাপ্ত না হওয়ায় তারপর এল ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানি। কিন্তু দেখা গেল তাদের পণ্যের বিক্রিটাও সীমিত নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে খুব একটা বেশি ছড়ায়নি। সারা বিশ্বে যখন অতি উৎপাদন, মন্দাভাব আর পরিবেশ বিপর্যয় চলছে তখন জাতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার বদলে আরও বেশি প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের বিবেচনার চেয়ে জাতীয় পুঁজির নিরাপত্তাই প্রাধান্য পেয়েছে। ফলশ্র“তিতে বেড়েছে যুদ্ধ-অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা। বিশ্বায়ন আর মুক্ত বাণিজ্য যে বাস্তবতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল বাস্তবতা তার থেকে অনেক দুরে অবস্থান করেছে। বিশ্বজুড়ে দারিদ্র আরও বেড়েছে, বেড়েছে অসাম্য।

যারা পুঁজির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের পে ওকালতি করে গেছেন তাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে অর্থনৈতিক ধ্বসের। অর্থের বিশ্বাযন ঘেেটছে উৎপাদনের বিশ্বায়ন থেকে দ্রুত গতিতে। এর ফলে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। এশিয়ান অর্থনৈতিক সংকট, আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সংকট এটা আরও স্পষ্ট করেছে। দুটো উদাহরনই ঘটেছে সর্বতোভাবে মুক্ত বাণিজ্যের চর্চা করতে গিয়ে। থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী থাকসিনকে যে জনগন প্রতিরোধ করল তার পেছনে অন্যতম কারণই হচ্ছে তিনি তাড়াহুড়ো করে আমেরিকার সাথে এফ টি এ সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন। এই উদাহরন অন্যান্য দেশের আন্দোলনকারীদেরও উৎসাহিত করেছে। খোলা বাজারের সবচেযে বড় যে প্রচারক সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কি আসলে অর্থনীতিতে তার ঘোষিত নীতির বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে? মুখে বিশ্বায়নের কথা বললেও আসলে সে সংরণবাদী নীতি নিয়েই এগিয়েছে। তার নিজের অর্খনীতির অবস্থাটাও কিন্তু এখন খুব ভাল নয়। আমেরিকান শ্রমিকরা, বর্তমান মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতির স্বীকার, বেকারত্বের স্বীকার। তাদের মাঝ থেকেই শ্লোগান উঠেছে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে। এখন আবার আমেরিকা নিয়েছে আরেক নতুন পদপে। উত্তর ও দণি আমেরিকায় নিজের বাজারের ব্যবস্থাটা আরও পাকাপোক্ত করতে গঠন করতে যাচ্ছে ‘আফটা’ মানে অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট। মোট ১২ টি জাতির সমন্বয়ে তৈরি হওয়া এই বাণিজ্যিক জোট সেই মুক্ত বাজারের শ্লোগানের আলোকেই তৈরি। এবং মূলত সে কারণেই তাতে যোগ দেয়নি ব্রাজিল।

আর বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে তৈরি হওয়া প্রতিবাদটাও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বহন করে। সারা বিশ্ব জুড়ে শত শত জাতির ল ল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র আর আদিবাসী বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। সিয়াটলে ১৯৯৯ তে, প্রাগে ২০০০ এ এবং জেনোয়াতে ২০০১ এ মুক্ত বাজার কার্যকর করার প্রতিষ্ঠান বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরুদ্ধে প্রবল বিােভ করেছিল ল ল মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি চাপিয়ে দেয়ার পর থেকে ঐ বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলনে সঙ্গত কারণে যুদ্ধবিরোধী নতুন মাত্রা যোগ হয়। ২০০৩ এ কানকুনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যাযের বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যাওযা, ২০০৫ এ হংকং বৈঠকও ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হওয়া এবং তারপর থেকে বড় শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যকার নানা জটিলতায় পড়ে অবাধ বিশ্ব বাজারের ধারনা গভীর সংকটে পড়ে যায়। আমেরিকার সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীনের সাথে আমেরিকা, জাপানের সাথে উত্তর কোরিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবার আভ্যন্তরীন এমনি অসংখ্য বিরোধ দিসকে দিন নতুন মাত্রা পাচ্ছে; সমাধানের কোন লণই চোখে পড়ছে না।

বিশ্বায়নের নামে ব্যবসায়ী কর্পোরেশনগুলোই যেন বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এখনো বিশ্ব অর্থনীতির বড় শক্তিগুলো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফ টি এ বা ফ্রি ট্রেড এরিয়া গঠন করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু অন্যদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন আরও কড়াকড়ি করেত উঠেপড়ে লেগেছে। যার মূল কথা হল জ্ঞান বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই পয়সা ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না এমনকি জানাও যাবে না।

মুক্ত বাজারে ধারনাকে সবচেযে বেশি পিছু হটতে হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায়। আমেরিকান বড় জ্বালানি কোম্পানির দ্বারা দীর্ঘদিন শোষিত হওযার পরে বলিভিয়া তার সব খনিগুলো জাতীয়করন করেছে। আর্জেন্টিনা সরকারও তার দেশের অর্থ পুঁজির রাস টেনে ধরার উদ্যোগ নিযেছে। ভেনিজুযেলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ বলিভিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোকে নিযে একটা জোট গঠন করতে চাইছেন। যে জোট হবে তার ভাষায় মুক্ত বাণিজ্যের ভিত্তিতে নয় সত্যিকারের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। তিনি বলছেন ‘এটা পুঁজিবাদের চেয়ে এগিয়ে থাকা যুক্তি।’

এখন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বিশ্বায়নের ধারনা পুঁজিবাদের কোন অগ্রসর পদপে নয়। বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকটের কারণেই ঐ ধারনা প্রচার করে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হযেছিল। ৭০ আর ৮০’র দশক জুড়ে চলা মহামন্দা কাটানোর জন্য সে ছিল এক মরীযা চেষ্টা। ফলে অর্থনীতি পড়েছে আবার প্রায় মৌলিক এক সংকটে। শুধু বাজার আর পণ্যের হিসেব নিকেশকে কেন্দ্র করে যত নতুন নতুন পদপেই নেয়া হোক না কেন ফলাফল আসবে সে একই। নতুন পদেেপর মনযোগের কেন্দ্র অবশ্যই বাজারকে ছাড়িয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।

লেখক: কালস্রোত
মেইল:


মন্তব্য

প্রফাইল [অতিথি] এর ছবি

বাজার বন্ধ করলেও কি সঙ্কট মেটে? সোভিয়েত সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মত ভেঙে গেছে, উত্তর কোরিয়া ধূকে ধূকে কোনরকমে টিকে আছে। ক্ষুদ্র কিউবার সামান্য সম্পদ বন্টনে ভাল বলে বদনাম নেই। চিন বাজার খুলে খুল্লামখুল্লা হয়েছে বলেই না এত রমরমা অবস্থা। ধনী দেশের আমজনতা ঐ খোলা চিনের ওপরই ত' টিকে আছে। চিন বাজার বন্ধ করলে সঙ্কট কোথায় গিয়ে ঠেকত ভেবে দেখুন।

আর সাম্প্রতিক লাটিন ভোটে বাম উত্থান কি ঐ এলাকার বাজার বন্ধ করে দিয়েছে। না। ঐ সরকারগুলো বন্টন সুষম করার দিকে ঝুঁকেছে। বাজারের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বন্টনের দিকটায় নজর দিলে আশাকরি সঙ্কট ফসিল হিসেবে যাদুঘরে যাবে। তবে যারা শুধু বাজারের কথা বলে তারা ধনীর সম্পদ বৃদ্ধির দিকেই নজর দেয়।

আমি খুলে রাখার নীতি স্বাস্থ্যকর বলে মনে করি। অর্থনীতির শরীর ও মন উভয়ের জন্যই।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমি খুলে রাখার নীতি স্বাস্থ্যকর বলে মনে করি। অর্থনীতির শরীর ও মন উভয়ের জন্যই।

সহমত। ভাল-মন্দ থাকবেই, কিন্তু মুক্তি জিনিসটা "স্বাস্থ্যকর" অনেক। বাজারের বেলায়ও প্রযোজ্য। বাজার মন্দ হলেও ভোক্তার মন ভাল থাকলে অনেক কিছুই উৎরে যাওয়া যায়। বাজারের শরীর ভাল রাখতে একটু নিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই অবশ্য।

প্রফাইল [অতিথি] এর ছবি

বাজারের শরীর ভাল রাখতে একটু নিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই অবশ্য।

বাজারকে পুঁজিপতিরা নিজেদের বাপদাদার সম্পত্তি মনে করে, আর তাই সবকিছু চেটেপুটে বা পকেটস্থ করার জন্য যা যা দরকার করে থাকে। বাজারকে ঐসব দানবের হাত থেকে মুক্ত করতে 'রেগুলেশনের' বিকল্প নেই।

উল্লেখ্য, মার্কসীয় সারপ্লাস ভ্যালুর ধারণা কিন্তু ঐসব দানবের কাণ্ড দেখেই এসেছে। পুঁজিবাদের মূল কনসেপ্ট আসলে সবকিছুকে পুঁজি হিসেবে দেখা। সেক্ষেত্রে মানুষ দাস বা শ্রমিক থেকে ক্রমশ অ্যাডাম ষ্মিথের "পুঁজি" হয়ে উঠবে। তার মূল্য, দরকষাকষির ক্ষমতা, গণ্ডি, স্বাধীনতা এই প্রক্রিয়ায় অনেকখানি বেড়ে যাবার কথা। মানুষের এই ট্রান্সফর্মেশন সার্বজনীন 'মজুর'করণের চাইতে অনেকখানি ভাল।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? দানবেরা অ্যাডাম ষ্মিথের লেইসেজ ফেয়ারের শুধু লেজটাই দেখায় আখের গোছানোর জন্য।

পুরুজিত এর ছবি

আশংকাজনক এই অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও ভেনেজুয়েলার দিকে তাকিয়ে আছি কিছু নির্ভেজাল বিনোদনের আশায়। তেলের সাগরে দাঁড়িয়ে শ্যাভেজ বিস্তর হম্বিতম্বি করেছে, এখন আবার সুর নরম হতে শুরু করেছে তেলের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে। আর কিছু দিন এই অবস্থা থাকলে শ্যাভেজ মিথের ধ্বংস অনির্বার্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।