প্রান্তিক ধ্রুবতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৯/০৬/২০০৯ - ৯:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহুদিন নিস্তব্ধতায় কেটেছে তার নিয়নের রাতগুলি, মেঘের সকাল সমূহ। নিটোল পুকুরের কালো কৈ মাছের ডাঙ্গায় ভ্রমণের ছটফটানিতে তার সারা গোধূলী অস্থির হয়েছে অসংখ্যবার। এই সব অস্থিরতার আড়ালে বেঁচে থাকার আকুলতা কখনো কখনো ফিরে এসেছে, কখনো জীবন্মৃত্যুর জটিলতার ড্রয়ারে তালাবদ্ধ রাখতে হয়েছে সূর্যালোকের প্রেমপ্রার্থী অবান্তর ইচ্ছেগুলোকে। অন্ধকারে একটি উজ্জ্বল ঘরের জন্ম হয়েছে গোপনে গোপনে। কিছু কৌতুহলী ফুল ও তাদের সবুজ পাতারা এভাবেই শুকিয়ে ফ্রেমের শিল্প হয়; বিগত যৌবনের স্মৃতির গল্পে ভরিয়ে রেখে রেখে, অক্ষমতার ঋণ শোধ করে করে বার্ধক্যবরণ! কিন্তু, এ গল্প বেঁচে ওঠা এক প্রজাপতির গল্প।

একদিন রাত্রির অন্ধকারে শিশির এসে তার বন্ধ দরজায় টোকা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,” আলো প্রবেশ করতে দাও! এই মৃত্যু তোমার জন্যে নয়। তোমার গোপন কাঠে ঘুণ ধরেছে, তাকে এবার কংক্রিটে বাঁধাও। ক্ষয়ে গেলে আর সময় থাকবে না! এখনো সময় আছে!”
গহীন ঘুমের অন্ধকারে কন্ঠস্বর পৌঁছায়, স্পর্শ পৌছায়! প্রজাপতি জেগে ওঠার জন্যে, আবার আঘাতের সহ্য শক্তি অর্জনের জন্যে প্রস্তুত হয়।
এ গল্প ওই দুজনার-মৃত্যুকামী এক প্রজাপতি আর তার স্পর্শদাতা শিশিরের।

শিশির তাকে তীব্র আলিঙ্গনে বেঁধে বেঁধে বসন্তের আলাপ শোনায়। অসহ্য মধুর বিস্তারে তার শ্রবণেন্দ্রিয় অন্ধ করে দিয়ে হঠাৎ বাস্পের আদোরে মিলায়। আবার ফিরে আসে, আবার গল্প বলে, আবার হারায়-কিছু না বলেই। সে কোনো প্রতিবাদ করে না শিশিরের এই দুর্বধ্য মতিগতির। চিরন্তন শেকলে সে বাঁধা পড়ে যায়। অনাকাঙ্খিত আত্মসমর্পণে সে তার প্রিয়তম শিশিরের ক্রীতদাস হিসেবে নতুন জীবন শুরু করে।

তার দিন চলে একা একা, তাদের রাত্রি আসে দুজনার। কীরকম একা থাকা, কোনভাবে তা দুজনার সে ঠাহর করতে পারে না। ইন্দ্রিয় তাকে কিছু বলে না, হৃদয় ব্যর্থ হয়, তাদের সম্মিলিত উপস্থিতি ঠিক ধরতে পারে না। কখনো রোদের উজ্জ্বলতায় চোখ যায় প্রতিবেশীর দীর্ঘ চুম্বনের দৃশ্যে; কখনো জোর করে পরিস্কার করতে হয় বাগানের অবাঞ্চিত আগাছা, তাদের রূপসী ফুলেদের। সুন্দরকে বিলুপ্ত করতে তার বুকে পেরেক বেঁধার মত ব্যথা অনুভূত হয়। অথচ বাগানের আর সব ফুলেদের তো ছেড়ে দিতে হবে তাদের অধিকার। তাদের পাতাদের জল দেয়া, তাদের কুঁড়িদের ফুটতে দেয়া খুব বড় এক দায়িত্ব। অতএব, তাদের অন্যরকম গল্পে এরাও সামিল হয়- আগাছারা, তাদের দুঃখী ফুলেরা এবং যত্নে কেনা দামী ফুলেদের গাছেরা। এখানে মাটির ভূমিকাও গৌণ নয়। তাদেরও কিনে আনতে হয়।, সাধারণ মাটিরা অসাধারণ ফুল ফোটাতে পারেনা। তারা শুধু আগাছা ও ঘাসেদের স্বাস্থ্য বাড়ায়।

অসাধারণ দামী মাটিরা তাকে শাসায়,” এভাবে নয়, অন্যভাবে! সকাল বিকাল জল না দিলে আমিও ওই উষর মাটির মতন নিস্ফলা হয়ে যাব; আর তখন তোমার উদাসীনতা ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা!”

সে তখন ধাঁধাঁয় পড়ে যায় তার বিগত ও বর্তমানের জীবন নিয়ে। ভেবে ঠিক করতে পারে না অন্ধকার ভালো ছিলো নাকি আলোর চুম্বন ভালো। শিশিরের প্রতি তার গোপন অভিমান, সুপ্ত অভিযোগগুলো আবার তাকে নিরন্তর অস্থির করে তোলে, অন্যরকম-নতুন অস্থিরতা! সে ঠিক করে বাগান বাড়াবে না, গাছেদের জল দেবে না, জানালা বন্ধ করে রাখবে যাতে প্রতিবেশীর দীর্ঘ চুম্বনের দৃশ্য অবলোকন করতে না হয়! অথচ, বাগান বাড়তে থাকে, পাতাদের কাঁপুনী বাড়তে থাকে; বিষাদিত মানুষদের আকৃষ্ট করতে লোকেদের চুম্বন-আলিঙ্গনের বিজ্ঞাপণ বাড়তেই থাকে। স্বেচ্ছামৃত্যুর গহবরে শিশিরের স্পর্শ পাওয়া দুঃখী প্রজাপতির মধ্যে দুর্দমনীয় জীবন তৃষ্ণা ঘর-বারান্দা-দাওয়া ছাপিয়ে প্লাবনের মতন বাইরে আসতে থাকে। শিশিরের গোপন সঙ্গমে সে উজ্জীবিত হয়, চরম অবহেলায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। বাস্পায়িত শিশিরের স্পর্শের ক্ষতগুলো পরম আদোরে ঘষতে ঘষতে প্রজাপতি আবশেষে তার গল্পের শেষাংশে পৌঁছাতে পারে। তার অপমৃত্যু যেমন অস্বাভাবিক ছিলো, তার এই বেঁচে থাকার গল্পও তেমনি স্বাভাবিক নয়, বুঝতে পারে সে।

তবু সেই বোকা প্রজাপতি বেঁচে থাকার ধ্রুবতাকে মেনে নেয়; অবাঞ্চিত আগাছার অবলুপ্তিকে মেনে নেয়, শিশিরের প্রস্থানকেও সে মেনে নিতে পারে। সমস্ত দিনযাপনের আনন্দ এবং বিষন্নতাটুকুকে সে আমন্ত্রণ জানায় নিজের গল্পে প্রবেশের। গল্পের প্রান্তিকে পৌঁছে বুঝতে কোনই কষ্ট হয় না যে এ গল্প তার শুধুই একার গল্প!


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

লেখকের নাম কই?

সাইফ এর ছবি

পাঠকদা, মনে হয় আমার মত বেকুব, নাম দিতে ভুলে যায়। চোখ টিপি

সাইফ এর ছবি

আমার অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি, তাই কিছুই বুঝতে পারলাম না, চেষ্টা চালায় যাইতে থাকব, ভাষা বেশ কঠিন লাগ্ল আমার কাছে

ফারহানা এর ছবি

ফারহানা সিমলা

আহা !!!! বহুদিন পর একটা অসাধারণ লেখা পড়লাম। কোথায় যেনো মিলে যায় নিজের সাথে। লেখাটা পড়তে পড়তে বারবার নিজেকেই আবিস্কার করছিলাম। কাঁটাবনে ফুল ফোটাতে যেয়ে কতো প্রজাপতিই না জানি এভাবে ব্যথা পায়, আহত হয় !!!!!

এরকম অসাধারণ লেখা আরও আ-র-ও চাই।

ফারহানা সিমলা

ফারহানা এর ছবি

ফারহানা সিমলা

জীবন থেকে সুন্দর সময় গুলো এভাবেই বোধহয় হারিয়ে যায়। তখন শুধু অভিমান হয় ফেলে আসা জীবনের সেইসব দিনগুলোর উপর ; যা ছবির মতো ভেসে ওঠে মানসপর্দায়। তবু মানুষ বেঁচে থাকে; আবার প্রথম থেকে আমরা শুরু করি ব্যর্থ জীবন। নতুন করে শিখি বাল্যশিক্ষা, অ,আ, ক, খ ।।।।। সুবোধ বালকের মতো আবার হাতে খড়ি নিই , শিশুর মতোই হাঁটা শিখি, একটু একটু করে শিখি কথা বলা । কবি মহাদেব সাহার মতো বলি
" আবার প্রথম থেকে ভালোবাসতে শিখি ।"

ফারহানা সিমলা

ফারহানা সিমলা

মণিকা রশিদ [অতিথি] এর ছবি

নাম দিতে ভুলে গেছি। নাম দিয়ে হবেই বা কী! লেখাটা কারো কারো ভালো লাগলেই হলো। ধন্যবাদ পড়ার জন্যে।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

খুব ভাল লাগল মণিকা, বেশ কঠিন বাংলায় লিখেছেন, আরো লিখেন চলুক

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

একুশ তাপাদার  [অতিথি] এর ছবি

অসাধারন! আগে একবার পড়েছিলাম এখন আবার পড়লাম। শব্দের বুননগুলা দারুন হয়েছে - নিমিষেই আত্নস্থ হয়ে যায় - প্রতিটি শব্দের গায়েই কেমন জানি মায়া জড়িয়ে আছে, যেন আলতো করে ছোঁয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিটি অক্ষরকে।
বিষাদিত মানুষ হতে ইচ্ছে করে খুব! হয়ত আমি, আমরা সবাই বিষাদিত মানুষই। নিজেদের একান্ত স্বপ্নের জায়গায় নিজেদেরই বিসর্জনের গর্ব টইটই করে হয়তবা!

এই অদ্ভুত সুন্দর অনূভুতি জাগিয়ে দেয়ার জন্য দিদি তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ

আবারো বলছি দিদি তোমার দারুন দিন যাচ্ছে, বেশি বেশি করে লিখতে থাকো । তোমার কাছ থেকে অনেক অনেক লেখা চাই

মণিকা রশিদ [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে

তানবীরা এর ছবি

মনিকা, আমি বাক্যহারা।
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।