পুরাণ থেকে নেয়াঃ একটি বাস্তব গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/০৮/২০০৯ - ১১:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল গল্পটি নেয়া হয়েছে প্রথম শতকের রোমান কবি ‘ওভিদ’ এর রচনা থেকে।
গল্পের পটভূমি সে সময়ের গ্রীস, যখন জিউসের অধীনে অলিম্পাসে বসবাস করতেন বারোজন শ্রেষ্ঠ অলিম্পিও দেবদেবী।

১।

মলিন বিষাদময় প্রভাত। সেই বিষাদের এক ক্ষুদ্রাংশ বাতায়ন পথে আসিয়া পড়িতেছে পিগম্যালিয়নের শয্যাকোণে। রাতভর একটানা ক্লান্তিকর খাটুনি শেষে গভীর নিদ্রায় শায়িত পিগম্যালিয়ন। রাজ্যের সমুদয় বিষাদও তাহার এই নিদরাজ্যে হানা দেবার ক্ষমতা রাখে না। তবে অতিশীঘ্রই বিষাদকে হার মানাইয়া রাস্তার গৃহাভিমুখী আওরাতদের তীক্ষ্ম কিন্নরী কন্ঠ পিগম্যালিয়নকে তাহার নিদরাজ্য হইতে মর্ত্যলোকে টানিয়া হ্যাঁচড়াইয়া আনিয়া আছড়াইয়া ফালাইলো। অর্ধজাগ্রত পিগম্যালিয়ন ঘুমের ঘোরেই গাল পাড়িলো, “হতচ্ছড়া বেশ্যার দল। রাতভর ফুর্তি করে এখনো বেজন্মাগুলির দম ফুরায়নি”।

বাহিরে খানিকটা শান্ত হইতেই আবারো পিগম্যালিয়ন ঘোড়া ছুটাইয়াছিল তাহার নিদরাজ্যে। কিন্তু বিধিবাম। দুর্দান্ত এই সহিসকে বৃধাঙ্গুল প্রদর্শনপূর্বক ঘোড়ার লাগাম টানিয়া ধরিয়া কপাটে সজোরে কড়া নাড়িলো কোন এক অর্বাচীন। পুনরায় দুদন্ড গাল পাড়িলো পিগম্যালিয়ন। অশ্বচালনা আজ আর হইতেছে না তা সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছে। গাত্রোত্থান করিয়া কপাট খুলিয়া দেখিল দাঁড়াইয়া আছে আনারিয়া।
-হ্যা আনারিয়া, বল কি বলবে??
-আপনি গতরাতে যাননি কেন??
-‘এরস’ এর উৎসবে? ও ব্যাটা কামদেবতার আখড়ায় গিয়ে আমার কি কাজ?? ওর আশীর্বাদ আমার দরকার নেই। যাই নি তাই।
শুনিয়া সহসাই অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিল আনারিয়া। ধরা কন্ঠে মৃদুস্বরে বলিলো-
-আমি সারারাত আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি এলেন বলে। ঠায় বসে ছিলাম একলা। আর সব মেয়েরাই সঙ্গী খুজে নিয়েছে। আমি নেই নি। কখনো নিবও না। জেনে রাখবেন, আমার কুমারিত্ব অন্য কারো জন্য নয়।

বলিয়াই পেছন ফিরিয়া দ্রুত পদক্ষেপে প্রস্থান করিল। সেদিকে চাহিয়া তাচ্ছিল্যভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলো পিগম্যালিয়ন- “নাদান মেয়েলোক!!!”।

২।

সমগ্র গ্রীক সাম্রাজ্যের সর্বজনবিদিত নামজাদা ভাস্কর পিগম্যালিয়ন। স্বর্গীয় আশীর্বাদপুষ্ট এই তরুণের নারীবিদ্বেষও তাহার মতোই সর্বজনবিদিত। এই কারণে তাহার নিকট একে একে প্রত্যাখ্যাত হইয়াছে আনারিয়ার ন্যায় বহু নিটোল যৌবনা তরুণীই। বলাবাহুল্য, তাহার এই আচরণে রুষ্ট হইয়াছিলেন বহু দেবতাই।

পাঠকেরা হয়তো ভাবিবেন, এ হইতেছে তরুণের নিজস্ব অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য। অতিউৎসাহীরা তাহার গোপন অক্ষমতার সন্দেহও করিতে পারেন বৈকি। কিন্তু প্রকৃত হেতু ভিন্ন। বস্তুত পিগম্যালিয়নের নিকট নারী অসম্পূর্ণ এক সৃষ্টি। এ বিকলাঙ্গ প্রজাতির নিকট ধরা দেবার মত নির্বুদ্ধিতা সে করিতে পারে না। তাই ললনাপ্রীতি হইতে ললিতকলাপ্রীতি তাহার বহুগুন বেশি। বাস্তবতা হইল, নিজের সমুদয় প্রতীভা আজ সে নিযুক্ত করিয়াছে শিল্পকলার সর্বোচ্চ নিদর্শন সৃষ্টিতে। এ নিমিত্তে দূরদেশ হইতে আনাইয়াছে উৎকৃষ্ট মার্বেল পাথর, আনাইয়াছে আইভরি। তাই দিয়া দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়া গড়িয়া তুলিতেছে তাহার শ্রেষ্ঠ কীর্তি- ‘অনিন্দ্যসুন্দর এক নারীমূর্তি’। হাঁ, নারীমুর্তিই বটে।

এ নির্মান কর্মের উদ্দেশ্য প্রতিভা প্রদর্শন নহে। উহা সে বহুবারই প্রদর্শন করিয়াছে। বরং তাহার ইচ্ছা, এই নারীমূর্তি হইবে পূর্নাঙ্গ, উৎকর্ষতার সর্বোচ্চ, যাহা আনারিয়ার ন্যায় নারীদের স্পষ্ট দেখাইয়া দিবে তাহাদের বিকলাঙ্গতা, বন্ধ করিবে তাহাদের অমূলক আস্ফালন।

৩।

যথাসময়ে সমাপ্ত হইল সে নির্মাণ। সৃষ্টি হইল অপরূপ খোদাইকর্ম। দেবতাতুল্য উহার সৌন্দর্য। সরু কটিদেশ, ঈষৎ কুঞ্চিত কেশদাম যেন হার মানায় স্বয়ং আফ্রোদিতিকে। আর চক্ষুতে যেন ভর করিয়াছে রাজ্যের মায়া। বাকি সকল বর্ণনা করিবার ধৃষ্টতা করি না। পাঠক তাহার মানস পটে সেসব আঁকিয়া লইবেন।

এদিকে পিগম্যালিয়নের হইয়াছে নতুন ব্যারাম। সারাবেলা সে ঠায় বসিয়া বসিয়া অবলোকন করে প্রস্তরমূর্তির অনিন্দ্য সৌন্দর্য আর আনমনে কহিয়া উঠে , “গ্যালিতিয়া, তুমি সৌন্দর্যের সর্বশেষ”। হাঁ, উহার গ্যালিতিয়া নামকরণ পিগম্যালিয়নকর্তৃকই বটে।

ধীরে ধীরে পিগম্যালিয়নের আচরণ কেমনতর শিশুবৎ হইয়া পড়িল। গ্যালিতিয়া তাহার নিকট হইয়া উঠিল ছোট্ট শিশুর খেলনাসদৃশ। সে উহাকে সজ্জিত করে উজ্জ্বল পরিচ্ছদে, আনিয়া দেয় বহুমূল্য অলংকার, কিনিয়া দেয় নানাবিধ উপহার। প্রতি রাত্তিরে উহাকে সে শোয়াইয়া দেয় উষ্ণ শয্যায়। তারপর শিয়রে বসিয়া মৃদু কন্ঠে গান ধরে, ঘুমপাড়ানী গান।

অবাক এ নারীমূর্তির সৌন্দর্য বিমুগ্ধ পিগম্যালিয়ন একদিন উপলব্ধি করিল, সে প্রেমে পড়িয়াছে, প্রেমে পড়িয়াছে স্বীয় সৃষ্টির। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ছিল পিগম্যালিয়নের উপর রুষ্ট দেবতাকুলের প্রতিশোধ। কারন তাহার এই জড়-প্রিয়ে কখনোই তাহার গলা জড়াইয়া ধরিত না, তাহার বুকে মাথা রাখিত না, এমনকি তাহার একেকটি উষ্ণ চুম্বনের প্রত্যুত্তর করিতেও সে ছিল অপারগ।

৪।

পিগম্যালিয়ন নির্বোধ নহে। সে বুঝিল, এই নির্বাক প্রস্তর-সঙ্গ তাহাকে দগ্ধই করিবে কেবল। বহু ভাবিয়া দেখিল, রুষ্ট দেবতাকুলের কেবল প্রনয়দেবী আফ্রোদিতি হয়তো তাহাকে সহমর্মিতা দেখাইতে পারেন। এই ভাবিয়া সে উপস্থিত হইল দেবীর মন্দিরে, শুনাইলো তাহার মর্মযাতনা। দেবী কিন্তু কিছু কহিলেন না। পিগম্যালিয়ন ফিরিয়া আসিল।

গৃহে ফিরিয়া যারপরনাই বিস্মিত হইল পিগম্যালিয়ন। তাহার ঘরময় ঘুরিয়া ফিরিতেছে কোন এক অচেনা নারী, হাসিতেছে কিন্নরী কন্ঠে। ছুটিয়া গেল পিগম্যালিয়ন। দেখিবে এতো বড় আস্পর্ধা কাহার?? কিন্তু হতবাক পিগম্যালিয়ন আবিষ্কার করিল, এ আর কেহ নয়, এ তাহার গ্যালিতিয়া, একজন পূর্ণাঙ্গ নারী। দেবী তাহাকে হতাশ করেন নি। দেবীকে ধন্যবাদ জানাইলো সে।

অতঃপর কিছু সময় কাটিল ঝড়ের বেগে এবং যাহা হইবার তাহাই হইল চোখ টিপি । সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইব না 

এমনি করিয়া একদা পিগম্যালিয়ন ও গ্যালিতিয়ার চমকপ্রদ প্রণয় পরিণতি পাইলো। স্বয়ং আফ্রোদিতি তাহাদের বিবাহে উপস্থিত থাকিয়া তাহাদের আশীর্বাদ করিলেন।

৫।

এরপর কাটিয়া গিয়াছে বহুবছর। পঞ্জিকা বলিবে তাহা প্রায় বছর পাঁচেক। কিন্তু পিগম্যালিয়নের গণনায় তাহা ঢের বেশি। সময়ের সাথে সাথে অতীতের কড়কড়ে উষ্ণতা আজ শীতল থেকে শীতলতর হইয়া হিমাঙ্কের নিচে পৌঁছাইয়াছে। আজ তাই আর গ্যালিতিয়ার আলিঙ্গন পিগম্যালিয়নকে মাতাল করিয়া তুলে না। অতীতের সেই উষ্ণতার ছিঁটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই ওতে। যেন গ্যালিতিয়া পরিণত হইয়াছে এক হীমশীতল প্রস্তরখন্ডে। তদুপরি সারাবেলা ঘরময় উহার হাঁকডাক পিগম্যালিয়নের কর্ণকুহরে নিদারূণ উৎপাতের কারণ হয়। ভাবে, বরং বধির হইয়া যাই, না না, উহাকেই বরং নির্বাক করিয়া দেই...ইত্যাদি ইত্যাদি সকল অলুক কল্পনা। আর গ্যালিতিয়ার ক্রমবর্ধমান বর্তুলাকার দেহবল্লরী পিগম্যালিয়নকে কিরূপ বিচলিত করে সে ব্যাপারে বোধকরি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। সর্বোপরি এই হেভিওয়েট রূপসী যখন তাহাকে আলিঙ্গনপিষ্ট করিয়া চুম্বন করে তখন ওষ্ঠাগত-প্রাণ পিগম্যালিয়নের মনে হয়, “এহেন খসখসে আর কিছু কি হয়? ঐ ওষ্ঠাধর একসাথে ঘষিলে স্ফুলিঙ্গ ছুটিলেও ছুটিতে পারে।”

এতবিধ বক্তব্য শুনিয়া আপনাদের মনে হইতে পারে, পিগম্যালিয়ন বুঝিবা সম্পূর্ণই বদলাইয়া গিয়াছে। তা নহে। সময়ের সাথে সাথে অতীতের বহু অভ্যাস হারাইলেও কিছু আজও শাশ্বতরূপে বজাইয়া রহিয়াছে পিগম্যালিয়নের। এখনো তাই সে নিত্যনতুন উপঢৌকন কিনিয়া আনে প্রিয়তমার জন্যে। আজও অতীতের মত প্রিয়তমার শিয়রে বসিয়া মৃদুকন্ঠে গান ধরে সে, একে একে গায় সেই সব ঘুমপাড়ানী গান। আর তার বুকে মাথা রাখিয়া তম্ময় হইয়া সেই গান শুনে প্রিয়তমা......আনারিয়া...। হাঁ, আনারিয়া তাহার কথা রাখিয়াছে। সে তাহার কুমারিত্ব অন্য কাহারো নিকট বিসর্জন দেয় নি।

সবশেষে জানিবেন, সকলেই তাহারা ভালো আছে। কেবল আফসোস......আজ পিগম্যালিয়নকে ঘুমপাড়ানী গানও গাইতে হয় চাপা কন্ঠে, গোপনে।
***************************************************************

ওভিদের মূল রচনাটি গল্পের ২য় হইতে ৪র্থ খন্ডে বর্ণিত। গল্পের শেষে ওভিদ বলিয়াছিলেন , “অতঃপর উহাদের কি হইলো তাহা সবিস্তারে জানা যায় না”। পারতপক্ষে উহা জানাইবার তাড়না হইতেই এই রচনার অবতারণা। সে লক্ষ্যেই আনারিয়া চরিত্রটি সৃষ্টি।

বোধকরি ইহা কোন মৌলিক রচনা নয় এই অর্থে যে, ইহার ২য় হইতে ৪র্থ খন্ড ‘পুরান থেকে নেয়া’, বাদবাকি ‘জীবন থেকে নেয়া’।

#ওসিরিস


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

ওহে ওসিরিস! ফাটানো হয়েছে। হাসিতে হাসিতে পেট ধরিয়া আসিল। কিছু ধরে ধরে না ছিদ্রাইলেই নয়!

অতঃপর কিছু সময় কাটিল ঝড়ের বেগে এবং যাহা হইবার তাহাই হইল । সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইব না 

কে বলিয়াছে এটার সবিস্তার বর্ণনা ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটাইবে?

কেবল আফসোস......আজ পিগম্যালিয়নকে ঘুমপাড়ানী গানও গাইতে হয় চাপা কন্ঠে, গোপনে।

হো হো হো বোধকরি ইহাই সকল শের এর ভবিতব্য!

বোধকরি ইহা কোন মৌলিক রচনা নয় এই অর্থে যে, ইহার ২য় হইতে ৪র্থ খন্ড ‘পুরান থেকে নেয়া’, বাদবাকি ‘জীবন থেকে নেয়া’।

কস্কি মমিন!

অতিথি লেখক এর ছবি

বোধকরি ইহাই সকল শের এর ভবিতব্য!

দাড়ান, গলাটা একটু পরিষ্কার কইরা নেই......OK
...হালুম......

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

#ওসিরিস

স্নিগ্ধা এর ছবি

ভালো লাগলো গল্প! হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।