কুমারীপূজা । শুদ্ধতা এবং মানবিক শক্তি প্রদানের অধ্যায় / শেখ নজরুল

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৬/০৯/২০০৯ - ৩:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুর্গা শক্তির দেবী । মর্ত্যলোক ধারণকরে তিনি তার চার সন্তান লক্ষ্নী, স্বরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশকে নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। পূরাণপাঠে আমরা জানতে পারি, অত্যাচারী এবং দাম্ভিক মহিষাসূরকে বধ করে তিনি স্বর্গ এবং মর্ত্য লোকের শান্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় চন্দ্রের ৭মী, অষ্টমী এবং নবমীতে বছরে একবার দেবীদুগা মর্ত্যলোকে আগমন করেন। মহালয়ার দিন থেকে দেবী বিসর্জনের দিন পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায় নানা আচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবীকে বরণ এবং বিসর্জন দেন।

এই আচারানুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় কুমারীপূজা নামে পরিচিত। এটি কুমারীদের মধ্যে মহাশক্তির অনুপ্রবেশিত ক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন কুমারীকে দেবীর বর দেয়া হয় তেমনি মানব কল্যাণ সাধনে যার যার প্রার্থিত বিষয় দেবীর কাছে নিবেদিত হয়।

এই প্রক্রিয়ায় এক বছর থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত কুমারীদেরকে দেবীর শক্তি দান করা হয়। তার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে কুমারীর শক্তি প্রদান একটি অন্যতম বিষয় হিসাবে ধরা হয়। এই পূজা প্রকৃতপক্ষে একজন কুমারীর শুদ্ধতা এবং মানবিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

রামকৃষ্ণ বলেছেন, কুমারী হচ্ছে দেবীর পূর্বরূপ। তিনি নিজে স্বরদা মাকে এই রূপে দেখেন। মহাভারতে অর্জুন কুমারী পূজার কথা বলেছেন। পুরাণেও এই পূজাকে চন্দিকা নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কুমারীকে যেহেতু দেবী দূর্গার পূর্বরূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয় সেহেতু ধর্মীয়ভাবে তার প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এটিকে খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় এবং কুমারী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

কুমারীকে দেবীরন্যায় আত্মার শুদ্ধতার বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কারণ একটি মাত্র অভিযোগে একজন উজ্জ্বল কুমারীর শুদ্ধরূপ বিলীন হতে পারে।

কুমারীর বয়স অনুসারে বিভিন্ন রকম বর প্রদান করা হয়।

এক বছরের বালিকাকে দেয়া হয় সন্ধ্যার দেবী।

দুই বছরের বালিকাকে স্বরসতী দেবী নামে অবহিত করা হয়।

তিন বছরের বালিকা পায় ত্রিনডা কর্মের নামকরণ,

চার বছরের কুমারীকে কলিকা নামে বর প্রদান করা হয়।

পাঁচ বছরের বালিকে সুভোগা এবং ষষ্ঠ বছরের কুমারীকে কর্ম বর দেয়া হয়।

সাত বছরের বালিকাকে মালিনি

এবং আট বছরের বালিকে কুজ্জোকা কালসুন্দরতা নমে অভিহিত করা হয়।

দশ, এগারো এবং বারো বছরের বালিকাকে যথাক্রমে অপরাজিতা, ভৈরবী, বার মহালীর বর প্রদান করা হয়।
তের বছরের বালিকাকে বলা হয়, পিতা।

নেইকা বরে অভিসিক্ত হন চৌদ্দ বছরের কুমারী

পনের এবং যোল বছরের কুমারীদ্বয়কে তরাগী এবং আম্বিকা বরে সিক্ত করা হয়।

কুমারী পূজা অষ্টমী দিন অনুষ্ঠিত হয়। মাঝে মাঝে নবমীতেও এটি পালন করা হয়। অর্ণপূর্ণা এবং জগধাত্রী নামে এই আরাধনা অনুষ্ঠিত হয়।

গঙ্গার জল দিয়ে কুমারীকে স্নান করিয়ে লাল বেনারশী শাড়ি পরানো হয়। তাকে ফুল এবং গহনায় সাজানো হয়। পায়ে আলতা মাখানো হয়। কপালে সিন্দুরের তিলক এঁকে দেয়া হয়।

কুমারী পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত কুমারীকে একটি সাজানো চেয়ারে দেবীর সামনে বসিয়ে রাখা হয় এবং দেবীর হাত থেকে তার হাতে একটি ফুল দেয়া হয়। নৈবদ্য হিসাবে পাতা, বেল, মোমবাতি ব্যবহার করা হয়।

চারদিক ঢোলের বাজনার সাথে পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করতে থাকেন। পুজার পর কুমারীকে উদ্দেশ্য করে দূর্গার শক্তি এবং শুদ্ধতার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তাকে সাধ্যমতো তাকে সোনা, রৌপ্য এবং নতুন কাপড় প্রদান করা হয়।

কুমারী পূজা প্রথম শুরু হয় ১৯০২ সালে। অবশ্য এই সাল নিয়ে মতান্তর আছে। কারো কারো মতেএটি শুরু হয়েছিলো ১৮৯০ সালে যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড়ে প্রথম এই পূজা করান। সে সময় নয় জন কুমারীকে করিয়েছিলেন। সেই ধারা এখনও বিদ্যমান। রামকৃষ্ণ মিশনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এই কুমারী পূজা।

অদম্য কৌমারী শক্তির পরিচায়ক এই পূজা কুমারীদেরকে পরিণতির পথে প্রধান শক্তি হিসেবে সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মাস্টার(শিব) এবং এনার্জি(কৌমারীর্) হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

বেশ কিছু অজানা জিনিস জানতে পারলাম, রণ'দা।
অনেক ধন্যবাদ।

রণদীপম বসু এর ছবি

অনিকেত দা, আপনার ধন্যবাদটা আমি নই, শেখ নজরুল ভাই প্রাপ্য।
চমৎকার কিছু তথ্য তিনি আমাদের জন্য উপস্থাপন করেছেন।
ধন্যবাদ শেখ নজরুল ভাই।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অনিকেত এর ছবি

নাম গুলিয়ে ফেলার জন্য দুঃখিত, এবং লজ্জিত।

নজরুল ভাই, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
রণ'দা, ধন্যবাদ ভুলটা ধরিয়ে দেবার জন্যে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার জানা নেই আপা। তবে জানতে পারলে অবশ্যই আপনার ভালোলাগায় যুক্ত হবে। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

কোন সমস্যা নাই। এ রকম হতেই পারে। অনেক ধন্যবাদ পাঠের জন্য। ভালো থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ দাদা। ভালো থাকবেন।

বর্ষা এর ছবি

আমি আরেকটু জানতে আগ্রহী। বয়স অনুযায়ী নামকরণ গুলোর কারণ এবং অর্থ গুলো কেউ যদি ব্যাখ্যা করতেন, আমার পড়তে ভালো লাগতো।

********************************************************
এক মৎস্যকন্যার কথিকা

********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।