স্বপ্নশীলা (১ম ও ২য় পর্ব একত্রে)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৯/০২/২০১০ - ২:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(যারা ১ম পর্ব পরেননি, তাদের সুবিধার্থে দুটো পর্ব একসাথে দিয়ে দিলাম)

রন্জু ঘুমের মাঝেই এপাশ ওপাশ করলো। ঘুমের মাঝে এপাশ ওপাশ করার মানে হচ্ছে স্বপ্ন পরিবর্তন করা, স্বপ্নের ঘটনায় কোন নতুন মোড় বা নতুন কোন চরিত্র, পছন্দ অপছন্দ। রন্জু স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবু আজ যখন চারদিক গুমোট একটা ভ্যপসা গরম, বহুদিন না বৃষ্টিতে ভিজে উত্তপ্ত সূর্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বাতাস যখন ক্লান্ত, সে সময়ের স্বপ্নগুলোও কেমন যেন হয়। রন্জু তাল মেলাতে পারেনা। মাঝে মাঝে সে বৃষ্টির সাথে ভিজতে ভিজতে ঘাসের মাঝে লুকিয়ে যায়, কখনোবা উড়তে উড়তে ধপাস করে পড়ে একরাশ বিস্তীর্ন ঝোপে। রন্জু একদমই তাল মেলাতে পারেনা।

রন্জুর ঘরটা একদম অগোছালো হয়ে আছে। স্বপ্নের মাঝে, মাঝেই মাঝেই এ ঘরে এসে ঢোকে রন্জু, কিন্তু ঘর গোছানোটা আর হয়ে উঠেনা। শীলা পারত স্বপ্নের মাঝেই ঘর গুছিয়ে দিয়ে দিতে। রন্জু শীলার আচঁলের নিচে শুয়ে শুয়ে দেখত কিভাবে তার বিবর্ণ নিস্তেজ ঘরটায় শীলা রং মাখিয়ে দিয়ে যায়- লাল, নীল, হলুদ। রন্জু হয়তো বুঝতে পারতো শীলা এগুলো জেগে থেকেই করছে, হয়তো পারতো না। শীলা আর কোনদিনই এ ঘরটায় আসবে না।

রন্জু স্বপ্নের মাঝেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই দীর্ঘশ্বাসটা ঢাকবার জন্য একটা জমজমাট স্বপ্ন দেখা যায়। প্রাগৈতিহাসিক কোন স্বপ্ন বা মোঘল আমলের যুদ্ধ যুদ্ধ স্বপ্ন। স্বপ্নে জিতে জিতে রন্জু ভীষন ক্লান্ত এখন। কি লাভ এত স্বপ্ন দেখে, সে তো শীলাকেই হারিয়ে ফেললো।

রন্জু উঠে একটু পানি খেয়ে নিল। পানি খাওয়ার পর স্বপ্নগুলো একটু থিতিয়ে আসে, শুয়ে শুয়ে চিন্তা করা যায় স্বপ্নগুলোকে নিয়ে, শীলাকে নিয়ে, এই শহরটাকে নিয়ে। একটা সময় ভাবতে ভাবতেই স্বপ্নে ডুবে যায় রন্জু, বৃষ্টির মাঝে সাতার কাটে কিছুক্ষণ, গাছের পাতায় লুকিয়ে থাকা রোদগুলোকে হাত বুলিয়ে দেয়, তারপর কিছুক্ষণ পর শরীরের চটচটে ঘামগুলো যখন পানি খাওয়ার পরিমান ছাড়িয়ে যায়, রন্জু আবার ঘোলাটে স্বপ্ন দেখা শুরু করে, ঘোলাটে এবং বিবর্ণ। ঠিক তখনই রন্জু স্বপ্ন পরিবর্তন করা শুরু করে। তবে আজকে রন্জু পানি খেয়েই ধপাস করে শুয়ে পড়লো না। ও জানে শুয়ে পড়লেই শীলা চলে আসবে ওর সামনে। শীলাকে ও কাছে চায় ন। শীলাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না রন্জু, কোনদিন না।

শীলা কি পারতো না বিয়েটা ঠেকিয়ে দিতে? এত দুর্বল ছিল ও? হয়তোবা নতুন পাত্রটাই পছন্দ হয়ে গেল ওর। নাহলে…… নাহলে রন্জুকে বললো না কেন কিছু? গত দুদিন ধরে অসংখ্যবার শীলাকে এই প্রশ্নগুলো করেছে রন্জু। শীলা শুধু বিবর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। রন্জুর বুকটা বড় খাঁ খাঁ করে। আজ রাতেই শীলার বিয়ে হয়ে যাবার কথা, কিংবা হয়েই গেছে। একটাসময় এই দিনটা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা ছিল ওদের। রন্জুর পছন্দ ছিল বিয়েটা হবে কোন পাহাড়ের চূঁড়ায়, বরফ ঘেরা কোন এক সীমানাতে। শীলা হাসতো, শীলার সবসময়ই সমুদ্র পছন্দ। কোন এক দূরতর দ্বীপ কিংবা কোন সমূদ্র সৈকতে- এই ছিল শীলার পরিকল্পনা। আজ শীলার বিয়ে হচ্ছে ওদের বাসার ছাদে। আচ্ছা, শীলার স্বপ্নগুলি কি সব গুলিয়ে যাচ্ছেনা? ও পারল মেনে নিতে? আকাশটাকে সমুদ্রভেবে ভুল করলো না তো? রন্জুর খুব ভাবতে ইচ্ছে করছে শীলা একটা বড় ভুল করেছে। শীলা যেন আসলে না বুঝেই রাজী হয়েছিল এ বিয়েতে। রন্জু একটু হাসলো- ও ইচ্ছা করলেই পারে শীলাকে তার ভুল বুঝিয়ে দিতে- স্বপ্নে। স্বপ্নে স্বপ্নে রন্জু পারে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে, স্বপ্নে রন্জু সব পারে। বাস্তবটা এত কঠিন কেন?

বাইরে খুব সুন্দর একটা বাতাস ছুটোছুটি করছে। খুব ঠান্ডা আর ভিজে, কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টিটা শীলাদের ওখানে হলে খুব ভালো হয়। শীলার খুব ইচ্ছে ছিল ওর বিয়ের দিন যাতে বৃষ্টি হয়। কিন্তু… ওর বর কি ওকে ভিজতে দেবে? রন্জুর হাত শক্ত হয়ে যায়। ওর ঠোঁট তির তির করে কাঁপতে থাকে। শীলা আরেক জনের সাথে বৃষ্টিতে ভিজছে, এটা রন্জু কল্পণাও করতে পারেনা। রন্জুর ইতস্তত ভাবনাগুলো হঠাৎ নদী তীর ছেড়ে চলে আসে, ঘাস মাড়িয়ে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া ইতস্তত পোকাদের মত। একটা খুন করলে কেমন হয়? একটা খুন করা কি খুব শক্ত কাজ হবে? একটা ছুড়ি নিয়ে বুকের ঠিক বামদিক টাতে সজোরে ছুরিটা দিয়ে এঁফোড় ওঁফোর করে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। শীলার বর চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে যাবে, যে ঘুমে কোন স্বপ্ন থাকবে না, জেগে উঠা থাকবে না. শীলা থাকবে না।

রন্জু ধপাস করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। একটা ছুড়ি খুঁজতে হবে। ওর ভেতর যে উ্ত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে তা ধরে রাখতে হলে একটা ছুড়ি দরকার। সেদিনই তো একটা আপেল কাটলো ছুড়ি দিয়ে। কোথায় ওটা? দেয়ালের কিনারে হাড়ি পাতিলের স্তুপের পাশে খুঁজলো রন্জু, তারপর তাকগুলোর উপরে, কাপড়ের বোঁচকায়, বাথরুমের আয়নার সামনে। রন্জু ইচ্ছে করলেই স্বপ্নের মাঝে ছুড়িটাকে খুঁজে নিতে পারে। কিন্তু রন্জু এখন ঘুমুবে না।

আচ্ছা মিশেল এর দেয়া সেই নেলকাটারটা নিলে কেমন হয়। বার্মিজ নেলকাটার, সাথে যে ছুড়িটা আছে তা কম ধারালো নয়। ধার দেখতে গিয়ে রন্জু হাত কেটে ফেলেছিলো। হ্যাঁ, এটাই নিয়ে যাবে রন্জু। বুকের ঠিক বাঁম পাশটাতে সজোড়ে বসিয়ে দিতে পারলেই হল। রন্জু গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নেয়। দরজাটা তালা দিয়ে বেরিয়ে পরে। কতদিন পর ঘর থেকে বের হলো রন্জু? বেরুবার পথের সরু করিডোরগুলোতে জমাট বাধা অন্ধকার। অবশিষ্ট কেবল একটা ময়লাটে হলদে আলোর বাতি। করিডোর থেকে বের হয়ে তাই কলতলায় ঠিক সামনে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রন্জু। তারপর ভাবনায় ডুবে যায়। কেউ দেখলো না তো? কেউ সন্দেহ করলো না তো? হাসলো রন্জু। মনে মনে। এ বাসায় কি আর ফেরা হবে? খুন করে দাগী আসামী হয়ে ঘুরে বেড়াবে রন্জু, এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক খোঁয়ার হতে অন্য কোন মানুষ খোঁয়ারে। স্বপ্নে এরকম অনেকবার করেছে রন্জু। রন্জুর ভয় কি?
আচ্ছা এমন হলে কেমন হয়, শীলাও ওর সাথে সাথে ঘুরলো। একবার শীলা ওকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলো-

“মনে করো, মনে করো তুমি আর আমি
দিগন্তের ঐ নীলিমা
সাগর যেখানে মিশে হয়ে গিয়েছে শ্বেতভল্লুকের ছানা
সেইখানে আমাদের অরণ্যকুটির…..”

শীলার কি এখনো মনে আছে সেই কবিতার কথা? অরণ্যকুটিরের কথা? রন্জু ওকে নিয়ে যেতে চায় অরণ্যে, শীলা কি যাবে? একসময় চাইতো, এখন কেন এমন হলো? রন্জুর কপালের একপাশে একটা শিরা দপদপ করে উঠে। রন্জুর খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করে- “শীলা তুমি বিয়ে করোনা, তোমার বর তোমাকে কবিতা লিখতে দিবনা, তোমাকে ঘুমুতে দিবনা, সারারাত, তুমি স্বপ্ন দেখবে কিভাবে?”

রন্জু এখন আর ঘুমিয়ে নেই, ও জানে এই চিৎকার শীলার কানে পৌছুবে না। শীলা এখন যোজন যোজন দুরে। শীলা ক্রমাগত আরো দুরে সরে যাচ্ছে, রন্জুর মনে হলো শীলা যেন এখন, এইমাত্র কোন পাহাড়ের দেশে পৌছে গেছে সরে যেতে যেতে। পাহাড় এবং সমুদ্র। আর কিছুক্ষণ পর শীলা নামবে সমুদ্রে। তারপর তলিয়ে যাবে- শীলা সাঁতার জানেনা, ও নিশ্চয়ই তলিয়ে যাবে। রন্জুর চোখটা ঘোলাটে হয়ে আসে- জিভটাকে লবনাক্ত মনে হয়, শীলার সেই সমুদ্রের লবনাক্ত পানির স্বাদ টের পাওয়া যাচ্ছে। রন্জু স্বাদটা আরেকটু নেবার জন্য জিহ্বাটা একটু বের করে দেয়, তারপর পানির মাঝেই শীলাকে খুঁজতে থাকে। হয়তোবা শীলাকে ঠিকই খুঁজে পেত রন্জু, কিন্তু ঠিক তখনই বেখেয়ালী কোন পরিবেশনকারীর ভুলে রন্জুর গায়ে কিছু পানি পরে যায়। ও টের পায়, ভাসতে ভাসতে কখন যেন বিয়ের আসরে বসে গিয়েছে, দিব্যি এক গ্লাস বোরহানী সাবাড় করে দিয়েছে সে। গায়ে চিমটি কাটে রন্জু। কোনটা সত্য ও বুঝতে পারে না। ওকি ঘুমের মধ্যেই হাটতে হাটতে চলে এসেছে? ও যে নেলকাটারটা নিয়ে এসেছিলো সেটা কই? রন্জু পকেট হাতরায়, নেলকাটারটা পকেটেই। কেমন যেন ভেজা ভেজা, পুরো পকেটটাই ভেজা। সবকিছু এত ভেজা কেন? তাহলে কি সত্যিই ও সমুদ্রে নেমেছিলো? শীলা কি সত্যি সত্যি ডুবে গেলো?

বিয়ের মঞ্চের দিকে তাকিয়েই রন্জু ভুলটা বুঝতে পারে। ওই তো শীলা দিব্যি বৌ সেজে বসে আছে মঞ্চে, ওর বরের পাশে। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরে। লাল রং রন্জুর একদম সহ্য হয় না। লাল রং ওর ভেতর এক অদ্ভুত ক্রোধের তৈরি করে। রন্জু শক্ত করে নেলকাটার টা চেপে ধরে, তারপর হেটে যায় মঞ্চের দিকে। এখনই খুনটা না করতে পারলে, লালের মাঝেই ও হয়তোবা ভেসে যাবে, রন্জু সেটা হতে দেবে না, কিছুতেই না।

মঞ্চের কাছে গিয়ে রন্জু বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। ওর মাথা গুলিয়ে যায়।, অনুভূতিগুলো প্রবলভাবে আপত্তি জানাতে থাকে। এটাও কি সম্ভব? মঞ্চে শীলার পাশে যে লোকটি বসা সে হুবহু ওর মত দেখতে। রন্জু থমকে দাঁড়ায়।, শীলার সাথে ধোঁকাবাজী হচ্ছেনাতো? ওর কথা বলে, ওরই মতো কাউকে গছিয়ে দিচ্ছেনাতো?

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে রন্জু বুঝতে পারে, পাত্রটা আসলে ও নিজেই। ও আসলে এখনো স্বপ্নের মধ্যে। সেই কলতলাতে পরে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে রন্জু। তারপর দেখা শুরু সেই একই স্বপ্ন, যা গত কয়েকদিন ধরেই দেখছে, ওর আর শীলার বিয়ের স্বপ্ন। রন্জু একটা আর্তনাদ করে উঠলো, ও আর এই স্বপ্ন দেখতে চায় না। রন্জু স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, ওর ক্ষমতা কি সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? এই স্বপ্ন থেকে কি ওর মুক্তি নেই? রন্জু চিৎকার করে ওঠে- “আমি আর স্বপ্ন দেখতে চাইনা, চাইনা স্বপ্ন দেখতে”। ওর চিৎকারে কেউ ফিরেও তাকায় না… তাকানোর কথাও না।

রন্জু নেলকাটার টা শক্ত করে ধরে, ও জানে ও ঘুমের মাঝেও ঠিকই নেলকাটারটা ধরে আছে। ও এখনো ঘুমের মাঝে চলতে পারে, ও জানে। রন্জু নেলকাটারটা ধীরে ধীরে উপরে ওঠায় … তারপর সজোরে ধুকিয়ে দেয় চোখের মাঝে…।

রন্জু আর কোনদিন স্বপ্ন দেখবে না, কোনদিন না।

অংশু-কারাভান

(এই গল্পটি আসলে একটি পরীক্ষামুলক গল্প যেখানে কাহিনীর চেয়ে অনুভূতির প্রকাশ আর লেখণী কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এরকম আর লেখবো কিনা, মন্তব্য প্রত্যাশা করছি)


মন্তব্য

দীপালোক মুখার্জী  এর ছবি

কিন্তু দোস্ত, চোখ ফুটো করলেই কি মানুষ সপ্ন দেখা বন্ধ করে দিবে? অন্ধ কি সপ্ন দেখে? জানি না ! মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

সেটা আমি নিজেও জানিনা, চোখ ফুটো করাটা আসলে অন্য কিছু বোঝায়, প্রতিকী কিছু। বুঝে নেয়ার দায়িত্ব পাঠকের। লেখকের নয়... হাসি
অংশু-কারাভান

মোহ  এর ছবি

স্বপ্ন খুব রহস্যময়। আমার জীবনটা স্বপ্নের মত ছিলো। অথবা স্বপ্নটা'ই পূর্বাভাস ছিলো। এখন আমি শুধু দুঃস্বপ্ন দেখি। হয়তো বাস্তব ঘটনাগুলোকে মনে হয় দুঃস্বপ্ন।

স্নিগ্ধা এর ছবি

ভালো লাগলো গল্পটা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।