অদ্ভুতুড়ে বই : কাকমানুষের চকখড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৩/০৪/২০১০ - ৬:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কল্লোল লাহিড়ী 'কাকমানুষের চকখড়ি' গল্পের বইটি নিয়ে একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। বইটির লেখক কুলদা রায়। তিনি আট/ দশ মাস গল্প লিখছেন। সাহিত্যের লোকও না। নিতান্তই কৃষিকর্মী। মাঠেঘাটে বেড়ানো লোক। শুদ্রবংশজাত। এবং কোন সাহিত্য পত্রিকায় লেখেন নি--লেখার ইচ্ছেও করেন না। ইচ্ছে হলে লিখবেন--ইচ্ছে হলে প্রকাশ করবেন। কোনো তেলাতেলির মধ্যে নাই। অন্তর্জাল এই সুযোগটি অনেকাংশে করে দিয়েছে। সুতরাং কুলদা রায়ের লেখাগুলো সম্পূর্ণভাবে অন্তর্জালিক।
ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বইমেলায় নবীন এক প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেছে। বইটির প্রকাশনার আগে কোন পরিমার্জনা করেন নি লেখক। আর প্রকাশক অনভিজ্ঞতা চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখেছেন। যেখান লেজ থাকার কথা--সেখানে চলে গেছে ঘাড়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিল রুমাল--হয়ে গেল বিড়াল। কুলদা রায় বিদেশবাসী বলেই এই বিড়ালকে রুমালে ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ পান নি। সুতরাং বইটি এক কথায় অদ্ভুতুড়ে। হয়তো এ কারণে কুলদা রায়কে এখন পর্যন্ত প্রকাশক কোনো বই পাঠান নি।
কল্লোল লাহিড়ী কুলদা রায়ের কাছ থেকে কাকমানুষের চকখড়ি'র 'নরম লিপি'টি যোগাড় করে পড়েছেন। পড়ে নিজ উদ্যোগে একটা পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন। এর দায় কল্লোল লাহিড়ীর। পড়ে দেখতে পারেন আর শেষে কুলদা রায়ের একটি গল্পের নমুণাও হাজির করা হল।
........................................................................................

কল্লোল লাহিড়ীর পাঠ প্রতিক্রিয়া--

“নদী মরে গেলে সত্যি হারিয়ে যায়
দুপাড়ের মানুষের মন থেকে ঝড়ে পড়ে
বয়সের মতন এক একটা নিটোল স্বপ্ন
প্রতিটা গল্পের সাথে জেগে থাকে দীর্ঘশ্বাস
এরকম কথা আমাকে শুনিয়েছে একজন বুড়ো চাষি...”

না কোনো কবিতার বই নয়। কুলদা রায় লিখছেন তাঁর আখ্যানের ভূমিকা। যা আর কিছুক্ষণের মধ্যে নিছক আখ্যানের গন্ডি পেরিয়ে আপনাকে নিয়ে ফেলবে এমন এক দেশে...এমন এক পরিসরে...যা আপনার অতি চেনা। সেই সোঁদা গন্ধ...আখ্যানের চরিত্র... আপনাকে নিয়ে যাবে ফেলে আসা সময়ে...ধূলি ধূসর স্মৃতি মেদুরতায়। বারবার বর্তমান আর অতীতের সংঘাত আসবে লেখনীর গতি প্রবাহের চমকে; আবার কোথাও শিল কড়াই গাছটার মতো আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নির্বাক। যে গাছ এই টুকরো টুকরো আখ্যানের অনেক অংশের শ্রোতা...দর্শক...আবার হয়তো বা কোথাও পাঠকও বটে।

আমরা শুধু বুড়োচাষির নির্মিত প্রতীককে খুঁজে পাই না, বরং তার সাথে পেয়ে যাই আরো অন্য অনেক অনুষঙ্গ। যে অনুসঙ্গের সাথে বেড়ে উঠেছেন লেখক, যে অনুসঙ্গের সাথে একটা দেশের জল, হাওয়া, মাটি তাকে লালন পালন করেছে। সেই দেশটাকে ছেড়ে যখন অনেক দূরে কোথাও চিরদিনের মতো চলে যেতে হয়, তখন কথক মনে করেন, “এই প্রথম সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। কোনো বটগাছ, গোহাট, জিব বের করা মা কালী, ঘুম কাতুরে শিব ঠাকু্‌র, ছোট মাঠ, খাল পাড়, শিল কড়াইয়ের ছায়া, বুড়ো মিস্ত্রী, আধগড়া নৌকো, অথবা আমার ভুলু কুকুরটিও আজ জানে-যে যায় সে আর ফেরে না। ”

ফেরে না আখ্যানের কথক। কিন্তু ফিরে ফিরে আসে সব মোটিফ স্মৃতির রাস্তা ধরে। কখোনো সে লৌকিক, আবার কখোনো সে পুরাণাশ্রিত। কখোনো তাকে পাই নদীর ধারে আবার কখোনো বা কদম তলায়। চেয়ে থাকার...পথ চলার...প্রদীপ জ্বালার এই নিরন্তর আখ্যানের জাল বোনেন কুলদা রায়।

বিস্তৃত ব্যাখ্যানের সুযোগ এবং সময় এখানে নেই। শুধু আছে টুকরো টুকরো ভালো লাগা। আছে এক কথকথার সাথে পরিচয় হওয়া। যে হারিয়ে যাওয়া সময়ের পঙ্কতি নিয়ে বসে আছেন মহাকাল।

হয়তো তার পথ ধরেই অমল বধির হয়ে যায়। টম সাহেবের পরিতক্ত্য বাড়িতে হাওয়া ওঠে শন শন। একদিন প্রদ্যুম্ন জঙ্গল থেকে ফিরে আসে...সবাই অবাক হয়ে দেখে কেউ তার মাথায় গুঁজে দিয়েছে ময়ূরের পালক। বোষ্টমী খঞ্জনী বাজিয়ে গান ধরে “ তোর তরে কদম তলায় চেয়ে থাকি।” আর ঠিক তখনই কি আশ্চর্যের মধ্যে পাঠক আবিষ্কার করেন অনন্ত ফুলের পাঁপড়ি গুলো ধারণ করছে অসংখ্য নীল চিঠি।

যে চিঠি পাঠাচ্ছেন কুলদা রায় আমাদের কাছে। যে ম্যাজিক রিয়ালিজম তাঁর লেখায় বিন্যস্ত...তার পূর্ব কথন বাংলা সাহিত্যে থাকলেও এই স্মৃতিকথা...এই আখ্যান...এই সময়ে স্বতন্ত্রতার দাবী রাখে।

হে পাঠক বিশ্ব বই দিবসের সূচনা লগ্নে পড়ে ফেলুন কাকমানুষের চকখড়ি।
ধন্যবাদ দিন আমার প্রকাশনীকে। যাঁরা তাঁদের প্রকাশের সূচনা লগ্নে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। রেখেছেন স্বতন্ত্রতার আরেক আখ্যান।
ভালো থাকুন।

বই দিবস শুভ হোক।

কুলদা রায়ের গল্প
টম সাহেবের বাড়ি

বাড়িটা ছিল টম সাহেবের। লাল ইটের। দোতলা। নীচতলায় ডাকঘর। দোতলায় একটি বড়ো সড়ো ঝুল বারান্দা। সেখানে যে ফুললতা ছিল, তার নাম- ব্লিডিং হার্ট।
একটু দূরেই মধুমতি। এই নদীর পাড়ে স্টিমার থেকে একদিন টম সাহেব নেমেছিল। এর পর কেউ আর কোন দিন স্টিমারের ‘ভো’ শোনেনি। সেদিন থেকে নদীটাও বুড়ো হয়ে গেল।
এই বাড়িটার ছাদে মাঝে মাঝে চাঁদ ঝুলে থাকত। সেদিন অন্য কোথাও জ্যোৎস্না উঠত না। কেবল এই বাড়িটা ঘিরে থাকতো আলো। আর শীতল হাওয়া।
যেদিন এই ঘটনা ঘটত, সেদিন আগে ভাগে ডাক-হরকরারা কাজে বেরিয়ে যেত। আবার আগে ভাগে কাজ শেষ করে চলে যেত। দুপুরের পর থেকে ছোট্ট শহরটা থমথমে হয়ে পড়ত। এইদিনে আমাদের ঠাকুমা সন্ধ্যার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিত।
আমাদের প্রদ্যুম্ন একদিন নাই হয়ে গেল। তারপর বেশ কবার নতুন করে ফুল ফুটল আমাদের কৃষ্ণচূড়ার ডালে। কয়েকটা শিউলিগাছ ঢলো ঢলো হয়ে উঠল। কয়েকটা পাখি পালক বদলালো। আমরা যখন প্রদ্যুম্নকে ভুলে যাব ভুলে যাব করছি- সেই সময়ই সে ফিরে এলো। বন থেকে ফেরা অন্য এক প্রদ্যুম্ন। গায়ে সবুজ গন্ধ। এই নতুন প্রদ্যুম্নকে কোনো কোনো দিদি-বৌদি চুরি করে নাড়ু মুড়ি খাওয়াত। একদিন লীলা মাসি ওর মাথায় চুড়ো বেঁধে দিল। ময়ুরের পালক গুজে দিল কে জানি। এক বোষ্টুমী খঞ্জনী বাজিয়ে গান ধরল-
কালা- তোর তরে
কদমতলে চেয়ে থাকি।
সেদিন নদী থেকে একটি নতুন হাওয়া উঠল। এক রকম হাওয়া এর আগে কখনো দেখিনি। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সারা শহরটি ঘুমিয়ে পড়ল। যে শিয়ালগুলি প্রহর ঘোষণা করত- সেদিন তারাও কেন জানি চুপ করে গেল। গাছের পাতারাও শব্দহীন।
টম সাহেবের বাড়িটার পাশে একটি তাল পুকুর। কোনদিন তার জল শুকায়নি। তার পাড়ে একটি বিবাহিত অশ্বত্থ গাছ। ঝুরি নেমে এসেছে মাটিতে। আকড়ে ধরে আছে নম্র একটি বট গাছকে।
সে রাত ছিল ঘন অন্ধকার। হঠাৎ করে বাঁশি বেজে উঠল। কী যাদুময় সে সুর। অন্ধকারের ভিতর থেকে অন্যরকম আলো বের হতে লাগল। । ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে একটি চাঁদ বাড়িটার কার্নিশে ঝুলে পড়ল। দোতলার একটি জানালা খুলে গেল। সেখানে দেখা গেল একটি মুখ। ফ্যাকাসে - থরথরো। মুখটি ফিস ফিস করে ডাকল, বাবা। বাবা। চিঠিটা কি এসেছে?
কার চিঠি? কোন চিঠি? আমি অমলের দিকে তাকালাম। অমল আমার দিকে। প্রদ্যুম্ন বাঁশিতে বিভোর। এ প্রদ্যুম্নকে আমরা কখনো দেখিনি। কখনো চিনিনি। জানিনি। কোনো এক রূপের জগতে তার বাড়ি। সে রূপের জগতের সুর বাজিয়ে চলেছে। এই বাঁশির সুরে টম সাহেবের বাড়ির উপরে ধীরে ধীরে একখণ্ড মেঘ জমল। ঝির ঝির করে বৃষ্টিও ঝরল। শান্ত হাওয়া বইল। কাঠালী চাঁপার গন্ধে ভরে গেল চারিদিক।
এই সময় টম সাহবের ঝুল বারান্দার দরোজাটা খুলে গেল। একটি মেয়ে ঘোর লাগা চোখে বারান্দা থেকে হেঁটে হেঁটে নীচে নেমে এলো। হাওয়ার মধ্যে পা ফেলে ফেলে মেয়েটি তাল পুকুরটির পাড়ে এলো। ঘাঘরাটা সামান্য একট উঁচু করে ধরল। তারপর পুকুরের জলের উপর তারা কোমল শাদা পা রাখল। অমল আমার হাত খামচে ধরল। চেচিয়ে বলল, চোখ বন্ধ কর। চোখ বন্ধ কর।
চোখ বন্ধ করব কি? আমাদের চোখ কি তখন আমাদের চোখের মধ্যে ছিল? চোখগুলো সব বাইরে বেরিয়ে পড়েছে নিজের ইচ্ছেয়। মেয়েটির পিছে পিছে ঘুরছে। ফিরছে। তার গা থেকে ঝরে পড়া আলো প্রাণের মধ্যে টুক টুক করে কুড়োচ্ছে। এই চোখহীন অন্ধ চোখ-কুঠুরী থেকেই আমরা দেখতে পেলাম, তাল পুকুরের মাঝখান অবধি ছোট ছোট পায়ের ছাপ চলে গেছে। জলের মাঝখানে ফুটে আছে একটি অনন্ত ফুল। শত শত তারা সে ফুলটিকে পাহারা দিচ্ছে। তার পাপড়ি সত্যি সত্যি অনেকগুলো নীল চিঠি।
এই চিঠিগুলো কে লিখেছে? অমল? প্রদ্যুম্ন? না- আমি? কখনো কি লিখতে পেরেছি এ রকম কোনো চিঠি!!


মন্তব্য

হরফ এর ছবি

ধন্যবাদ কুলদাবাবুর লেখার সাথে পরিচয় করানোর জন্য। ম্যাজিক রিয়ালিজম আমার খুব প্রিয় বিশেষত তা যখন এমন ঝরঝরে সহজ ও সুরেলা হয়। কিন্তু লেখক আপনার নাম তো জানালেন না?

------------------------------
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

রণদীপম বসু এর ছবি

কুলদা রায়ে গল্পটি বলে দেয় তার হাতেও জাদু-বাস্তবতার ছোঁয়া আছে।
তবে তিনি নিজেকে প্রায়ই আড়ালে রেখে যে কাজটি করেন বেশি তা হলো, অন্তর্জাল ঘেটে ঘেটে ভালো ভালো লেখাগুলোর লিঙ্ক পাঠকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তামশা দেখা ! বিশ্বাস না হলে কিছুক্ষণ খোমাবইটা ঘুরে ঘুরে দেখেন, নিজেই বুঝতে পারবেন। এটাকে হয়তো তিনি তাঁর সমাজসচেতন দায়বদ্ধতা হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। অবশ্যই চমৎকার একটা স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ব পালন করছেন নিঃসন্দেহে। তবে নিজের সৃষ্টি প্রণোদনাকেও আরেকটা পরিচর্যা করার সময় দেয়া বোধ করি জরুরি হয়ে পড়েছে এখন।
নামহীন পোস্ট লেখককে ধন্যবাদ, আর কুলদা রায়ের প্রতি রইলো হার্দ্য শুভেচ্ছা।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

দ্রোহী এর ছবি

সুন্দর সমালোচনা।

কুলদা রায় একজন শক্তিশালী গল্পকার। টম সাহেবের বাড়ি পড়ে তাই মনে হলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।