চলছে যেমন - ১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৩/০৫/২০১০ - ১০:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় দুনিয়ার তাবৎ মানুষের মগজগুলোকে বের করে এক জায়গায় জড়ো করে দেখি মাত্র কতটুকু পদার্থ হয়। এত এত দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, গতি, কার্যকলাপ- সব ঘটছে মাত্র অতটুকুর ইচ্ছায়, হোক সে ঠিক বা ভুল। এবং তারপরও ওর খায়েশ মেটেনা। প্রয়োজনের কাজ শেষে ঝোঁকে অপ্রয়োজনের দিকে। বানায় সব অদরকারী, অপ্রয়োজনীয় ছলাকলার নিয়ম, কপটতার নীতি- যাতে সোজাটাকে আর ঠিক সোজা মনে না হয়। রাত বাজে দশটা। কেন্দ্রীয় শহীদ-মিনারের সামনে বসে আছি। একটা পুলিশের গাড়ি সামনে পার্ক করা- আমার ডিরেক্ট ভিউ বন্ধ করে। রাস্তাঘাট-মানুষজন সব দেখছি কৌনিক দৃষ্টিতে। জীবনটাই এমন। বানানো, চাপানো, অপ্রয়োজনীয় সমস্ত নীতি-সংস্কার-নিয়মের কারণে সোজা জিনিস আর সোজাভাবে দেখা যায় না,করা যায় না; ঘুরিয়ে খোলসে ঢেকে দেখতে, করতে হয়- কারণ ঐসব অদরকারী-অপ্রয়োজনীয় নিয়ম-নীতি-ধারণা। ঠিক যেমন আমার সামনের এই পুলিশের গাড়ি। যে অন্যায় রোধের জন্য ওটা এখানে সে সমস্ত অহরহ ঘটে ওর চোখের সামনে। বরং আরও খারাপভাবে। কারণ ওটা না থাকলে হয়ত মানুষজন বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকত। সহ্য হয়না আর এসব নিয়মের নামে অ-নিয়ম, কু-নিয়ম,বানোয়াট জিনিস। প্রায় পুরোটা সন্ধ্যা আজ কেন যেন বই এর দোকানে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। পকেটে পয়সা তেমন ছিল না বলে যেন দেখানোর জন্যই হাতে নিচ্ছিলাম সবচেয়ে দামী বইগুলো- সেগুলোতে আমার আগ্রহ থাক কি নাই থাক। কপট দুনিয়ার কপট আচরণ। আজিজ মার্কেট-টা একটা অসাধারণ জায়গা হতে পারত। যা হয়েছে তা-ও মনটাকে আমার অনেকটাই হাল্কা করে দেয়- ফ্লোরে ফ্লোরে তারুণ্যের উদ্যম-উদ্যোগ। কিন্তু আবারও সেই ভড়ং আর কপটতার কথাই চলে আসছে। এ না এসে পারে না। প্রতিটা মূহুর্তে যা দেখছি তা লাইনে লাইনে না এসে পারেনা। বেশিরভাগের ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা হল- লম্বা চুল-দাড়ি রাখা, অপ্রয়োজনের এক শাল কাঁধে ফেলা, কাঁধে ময়লা ঝোলা ঝোলানোটাকেই আলগা ভাবের প্যাশন হিসেবে নিয়েছে। ওটা যেন ক্রিয়েটিভিটির প্রাইমারী কন্ডিশন! জানে না,বোঝে না অথবা জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে থাকে যে ওগুলো অনেকের ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভিটির সাইড ইফেক্ট, নট প্রাইমারী কন্ডিশন। কারও মাথায় গামছা বাঁধা, কারও আছে আরোপিত ঢঙ্গের কোলকাতাইয়া বাংলা উচ্চারণ- দেখলেই একবার আগাপাশতলা পিটিয়ে নেয়ার ইচ্ছা দমন করতে নিজের সাথে বড্ড সংগ্রাম করতে হয়। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে হয়ত কেউ আসর কাঁপিয়ে দাবি করছে-'জীবনানন্দকে আমি ছাড়া কেউ বোঝেনি"। ইচ্ছে করে বারান্দা দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ওকে বলি- 'তুমি শালা কবিতা কাকে বলে এখনো তা-ই বোঝনি।' 'প্রথমা' টাতে অনেক বই, লোভ জাগায়। কিন্তু জায়গাটা বড় ছোট। মেয়েলি গন্ধের সাথে হাল্কা ঘামের গন্ধ মিশে যে চরম এক ইন্দ্রিয়-জাগানো গন্ধ হয় তেমন এক গন্ধের টানে ফিরে দেখি এক মূর্তিমতী টেম্পট্রেস; সে অবশ্য ওর শরীরী সৌন্দর্যে, চোখে লেগে আছে কবিতার ঘোর, দেখছেও কবিতার বই। কাটা-কাটা চোখা চেহারা, চুল উঁচু করে খোঁপায় বাঁধা। ফরসা প্রায় উম্মুক্ত কাঁধ যেন আমার মতই সবার সাড্‌ন্‌ ডেথ ঘোষণা করে নিষ্ঠুর চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল লাল রঙের শরীর কামড়ে ধরা কামিজ আর ধুতি-সালোয়ার পড়ে ও কবিতার ঘোর-লাগা চোখ নিয়ে কবিতার বই খুঁজছে। পেছন থেকে সোজা তাকিয়ে থাকতে পারলেও ওটাকে ডিরেক্ট ভিউ বলার জো নেই। সেটা হতে পারত কেবল আধ-হাত সামনে দাঁড়িয়ে ওর ঐ কবিতার ঘোর-লাগা চোখসহ সমস্তটাকে এক করে দেখতে পারলে। আচমকা আশেপাশে আরও দুইজন ক্রেতার সমাগম হতে আমার সুযোগ যেন কিছুটা বেড়ে গেল, হলাম একাবারে কাছাকাছি; প্রায় গা ঘেঁষা দুরত্বে দাঁড়িয়ে আমিও দেখছি এবার কবিতার বই আর কৌনিক দৃষ্টিতে ওর অসাধারণ টেম্পটিং চিবুক। এতক্ষণে ওর ভিউ অ্যাংগেল এর মধ্যকার একটা এলিমেন্ট হিসেবে যেন ও আমাকে খেয়াল করল। ওহ্‌‌-আবারও কপটতার গন্ধ। ওর কপাল-চিবুক আর ঠোঁটের ভঙ্গি যেন আমাকে বোঝাতে চাইল কেউ অমন করে মুগ্ধদৃষ্টিতে ওর দিকে না তাকালেই যেন ও বরাবর খুশি হয়। আমার কপটতা আবার অন্যভাবে। ওর এই কপটতা দেখেও আমার কিন্তু ইচ্ছে করেনি ওকেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে। বরং যেন বোঝাতে চাইলাম তোমার দেখানো তোমার ঐ মিথ্যে অনুভূতির কপটতাই আমাকে আরও মুগ্ধ করেছে। নাহ্‌- এতক্ষণে যেন ও কিছুটা প্রমাণ দিতে শুরু করল যে ও যা পড়ে তার কিছুটা হলেও হৃদয়ে নিতে ও পারে। আর তাই মাঝে মাঝেই যখন তাকালো তখন একেবারে গড়পড়তা মেয়েগুলোর মত সোজা সামনে তাকিয়ে চোখটাকে ঠিক নব্বুই ডিগ্রী ঘুরিয়ে চোখের পাতার কিনারা দিয়ে দেখল না, বরঞ্চ যেন অ্যাংগেল টাকে কমিয়ে পঁয়তাল্লিশ কি তিরিশ ডিগ্রীর কাছাকাছি নিয়ে এল। দৃষ্টিতে কি ওটা আগ্রহের ঝিলিক? জানি না, জানার উপায়ও নেই। বরং আগ্রহ নেই ধরে নেয়াটাই নিরাপদ। আর আগ্রহ যদি থাকেও তবু এদের পেট থেকে সে কথা বের করে নিশ্চিতভাবে জানার উপায় কোনদিন ছিল না, নেই। এমনকি কারও ক্ষেত্রে আগ্রহ থেকে সেটা যদি ক্রমে পরিণত হতে হতে বিয়ে পর্যন্তও গড়ায় তবুও এরা সারাজীবনই দাবী করে যায়-'তুমিই তো শুধু ঘুরঘুর করতে আমার পেছনে'। এতকিছু জেনেও টান টাকে অস্বীকার করতে পারিনা। পারিনা তো আরও কতকিছুই। রাস্তায় হয়ত একটা মেয়ে দেখলাম, দেখলাম বাতাসের দোলায় চুলটা কি চমৎকার ভাঁজ খেয়ে একটু উড়ল। অসাধারণ! প্রায় যেন মুভি সিন! কিন্তু আসলেও যে মুভি সিন সেটাও তো জানি; জানি চুলের ওই এক মূহুর্তের চমৎকার ওড়ার পেছনে আছে কত-শত ঘন্টার পরিশ্রম। তবু তো ভালো লাগা থামাতে পারিনা। জানি যে ওর ওই এক মূহুর্তের গ্রীবাভঙ্গি, ভুরু-ভঙ্গি, ঠোঁট চেপে দেয়া অভিজাত হাসি, নিতম্বের চমৎকার মন-মাতানো দোলা সবকিছুই কত কত রিহার্সেল এর ফসল। টান তো তাতে কমে না। আসলে দুনিয়াটা যে এখন মার্কেটিং-এর সেটা এই টাইপ-রাও ভালোই বুঝে গিয়েছে; মার্কেটিং এর নিগুঢ় সব টেকনিক, প্যাকেজিং এর গুরুত্ব সব ওরাও ভালোই রপ্ত করেছে। আমরাও তাই দেখে মুগ্ধ সব ক্রেতার মতই। তবু তো পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে যদি গিয়ে বলি যে 'আপনাদের অ্যাড টা চমৎকার হয়েছে' বা 'আপনাদের লেমিনেটেড প্যাকেজিং টা জোস্‌'- ভারি খুশি হবে ওরা। কিন্তু এই টাইপ মেয়েগুলোকে সে কথা গিয়ে বললেই সেরেছে। ঐ অ্যাড দেখা আর কপালে নেই, কখনো টোটাল প্যাকেজের আশা তো সূদুরপরাহত।তবুও যে ওদেরই বড্ড ভালো লাগে! কপটতা এখন আমরা রীতিমত ভক্তির সাথে চর্চা করি, কেউ ভালো পারলে তাকে শ্রদ্ধা পর্যন্ত করি। যাই হোক, এই কবিতা-প্রেমী কিন্তু আমার রক্তে আগুন ধরাচ্ছে। আগুন অবশ্য নিভ্‌ল। বড্ড বাজেভাবেই নিভ্‌ল। এক যুবা এসে হাজির। বয়ফ্রেন্ড না হয়েই যায় না, ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে। মূহুর্তে যেন আমার টেম্পট্রেস ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার প্রেম এবং সততার প্রমাণ দেখাতে। ব্যস্ততার মাঝেও যেন তার আড়দৃষ্টি একটা থাকলই আমার উপর। এই মেয়েগুলো যে কেন এটা করে, জানি না। এই দেখানো, হঠাৎ উথলে ওঠা প্রেমের আসল কারণটা কি? পরোক্ষে হলেও এতক্ষণের এই আগ্রহ প্রকাশের অপরাধবোধ থেকে? নাকি মুগ্ধ লোকটার মধ্যে আরও আগুন জ্বালাতে? খুব বলতে ইচ্ছা করছিল যে তোর ঐ ঠোঁট চেপে দেয়া নকল অভিজাত হাসির আড়ালে তোর আসল হাসিটা চিনতে আমার ভুল হয়নি। সেই হাসি আমারটার মতই, একটু বেশিই যেন আমার মত। তোর শরীরের যে আগুন তোর চোখের দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য হলেও অমন করে দেয় সেটার রূপ আমি ভালোই জানি। ঐ অল্পবয়সেই বুড়িয়ে যাওয়া ইনসিগ্‌নিফিক্যান্ট আর্স-হোল এর সাধ্যই নেই যে তোর আসলটার খোঁজ পায়, খোঁজ নেয়। ওর দরকার অন্য জাতের কেউ। তোকে দখল করা ওর জন্য রীতিমত অন্যায়। তুই বরং সেরকম একজনের জন্য যে তোর আগুনে নিজের আগুন মেলানোর উদ্দিপনায় সৃষ্টি করবে নতুন কিছু, ভাঙবে নিয়ম। আয় আমার সাথে- দেখবি, জানবি চুলার আগুনকে এতদিন ভুল করেছিলি সূর্যের বলে।

এহসান


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

লেখা ঝরঝরে। বর্ণনা গতিশীল। বিষয়বস্তু বহুল ব্যবহৃত। ভুল শব্দের ব্যবহার (আর্স-োল)। বাজে ফরম্যাটিং (পুরোটা এক প্যারা)।

স্বাগতম।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

Mahdi এর ছবি

লিখা সাবলিল ও প্রকাশভঙ্গি আধুনিক ।
তবে মাঝামাঝি এসে অনেকটা একঘেয়ে লাগলেও শেষের অংশ খুব ভালো লেগেছে ।
চালিয়ে যান।

রায়হান বেগ এর ছবি

আপনার টেনে নেয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। রোজ দেখা, রোজ পড়া ঘটনাগুলোকে অনুভূতিতে এনে দিতে আপনি পারেন।ফরম্যাটিং-এর ব্যাপারে আপত্তি না জানিয়ে পারলাম না। আপনার ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার দেখার আশা রইল।

রায়হান বেগ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।