মাতাল রাত্রি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৮/০৫/২০১০ - ১১:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাত প্রায় দুইটা। ল্যাম্পপোস্টটার নীচে এখনো রাহী আর তার চার বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছে। হাল্কা কুয়াশা আর ল্যাম্পপোস্টের নিওন আলো মিলে কেমন একটা রহস্যময় আবহ তৈরী হয়েছে ওদের ঘিরে। আমি দূর থেকে ওদের দলটাকে দেখতে পেলাম। কুয়াশাঘেরা এই রাতে দূর থেকে ওদের সিগারেটের জলন্ত আগুন বারবার কেন যেন ক্ষুধার্ত নেকড়েদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। অজানা কোন এক আশংকায় অবচেতন মন বলছে, ‘সাবধান’! এত রাতে আমি বের হয়েছি চা খাবার আশায়। লক্ষ্য মেডিক্যাল মোড়ের চায়ের দোকান। এখন মনে হচ্ছে একা বের হওয়াটা বড় রকমের ভুল হয়ে গেছে। তারপরও বুকে যতটুকু সাহসে কুলায়...অনেকটা না দেখার ভান করেই ওদের দলটাকে পাশ কাটাচ্ছি। এমন সময় রাহী পাশ থেকে বলে উঠল,
‘কি রে খা... পু..., এত রাতে কই যাস? ... খুঁজতে বের হইছস না কি?’
দলটার মধ্যে একটা হাসির রব ওঠে। মাঝরাতে নির্জন রাস্তায় এই হাসি কেমন যেন একটা ভয়ের সঞ্চার করে। আমার কান গরম হয়ে উঠে। তারপরও অনেকটা মেরুদন্ডহীন কীটের মত মুখ হাসি-হাসি করে বলি,
‘না...এই তো একটু চা খেতে বের হয়েছি আর কি।’
আমার কথায় দলটার মধ্যে হাসির ধুম পড়ে যায়। চা খাবার কথায় হাসির কি কারন থাকতে পারে সেটা আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমার মুখে আঠার মত কৃত্রিম হাসিটা ঝুলে থাকে আর তার পেছনে খেলা করতে থাকে বিচিত্র সব অনুভূতি। সেই দিকে না তাকিয়েই একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে অনেকটা তাচ্ছিল্যের স্বরে রাহী বলে ওঠে,
‘যা যা, গা গরম কইর‌্যা আয়!’
আমার কান আবার গরম হয়ে উঠে। দলটার মধ্যে আবার হাসির ধুম পড়ে যায়। আমি সেইদিকে না তাকিয়েই অনেকটা গ্লানিমাখা শরীরে চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। আমার মুখভরতি থু থু জমা হয়। আমি প্রবল ঘৃনায় সেই থু থু ফেলি রাস্তায়...নিজের যত ব্যর্থতা, অপমান, রাগ, ঘৃনা সব...সব থু থু এর সাথে ফেলে দিই। আমার হাঁটার গতি বাড়ে।
রাহী...রাহী আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আমার খেলার সাথী। কলেজ পর্যন্ত আমাদের দুই দেহ আর এক আত্মা। যেখানেই আমি, সেখানেই রাহী। অসম্ভব প্রানোচ্ছল এই ছেলেটা কি করে যে খোলনলচে বদলে গেল তা আমি আজও ভেবে পাই না। মনে পড়ে, স্কুল শেষে বাড়ী ফেরার পথে কত দস্যিপনা-ই না করতাম দুইজন। কলেজ শেষে একসাথে ভার্সিটিতেও ভর্তি হলাম দুই জন। প্রথম যখন আমাকে বলল, সে ছাত্র রাজনীতি করবে আমি অনেকটা না শোণার ভান করেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কাজটা ঠিক হয় নি। ও কে এভাবে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয় নি আমার। রাজনীতির ধারাল স্রোতে আমার বন্ধু রাহী এখন আর সেই রাহী নেই। এই রাহী ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ সন্ত্রাসী। গোটা ভার্সিটি এলাকা তার নাম শুনে ভয়ে কাঁপে। গত দুই বছরে এমন কোন অপরাধ নেই যে সে করে নি। আমি ভাবি। আর আমার মুখভর্তি আবার থু থু জমা হয়। চায়ের স্বাদটা কেমন যেন তেতো মনে হয়।

চা খেয়ে আমি ফিরছি। একই পথ ধরে হলে যেতে হবে। ফোনে কণার সাথে কথা বলছি। মেয়েটা যে কেন রাত জেগে জেগে ফোনে কথা বলে! কতবার বুঝিয়েছি, কে শুনে কার কথা! আমি রাহীদের গ্রুপের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। ওখান থেকে একটা ছেলে বলে ওঠে,
‘বস, দেখেন আপনার দোস্ত তো দেখি ফোনে প্রেমালাপ চালাচ্ছে।’
আমি শুনেও না শুনার ভান করে ওদের পাশ কাটাই। পেছন থেকে আরেকটা ছেলে বলে ওঠে,
‘কি রে রাহী, তোর দোস্ত তো দেখি আমাদের পাত্তাই দেয় না।’
‘এই মিশু, দাঁড়া, দাঁড়া বলছি।’
রাহীর গলাটা অনেক জাঁজালো শুনায়। আমি ফোন হাতে পিছন ফিরি।
‘কি রে খা...পু..., কথা কানে যায় না? কোন ...র সাথে ফোনে কথা কস?’
আমার কানটা আবার গরম হয়ে উঠে। ফোনটা এখনো কাটি নি আমি। ও পাশ থেকে কনা নিশ্চয় শুনতে পেয়েছে সবগুলো কথা। ভাবতেই আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেল।
‘যার সাথেই কথা বলি তাতে তর কি?’
‘ও রে ওস্তাদ, এত দেখি তেজ দেখায়!’ পাশ থেকে একটা ছেলে বলে ওঠে। মিশু বলে উঠে,
‘কি রে ... ..., তেজ দেখাস! আমাদের সাথে কথা কইতে তর ঘেন্না হয়। কথা বলার পর থু থু ফেলিস! দে... ফোনটা দে।’
‘দেখ রাহী, বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু ’
‘বাড়াবাড়ির কি দেখলি? ফোন দিতে বলছি ফোন দে। তোর ...ও জানুক আমরা তর বন্ধু।’
রাহীর দলের একজন ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই আমার মাথায় রক্ত খেলে গেল। দড়াম করে একটা ঘুষি বসালাম তার মুখে। কিন্তু পরক্ষনেই টের পেলাম আমাকে এলপাথারি মেরে মাটিতে শুয়িয়ে ফেলল ওরা। রুপালী চাঁদের আলোতে কি জানি একটা চকচক করে উঠল। আমি চিৎকার করি। ওরা সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে।

পাঁজরের নীচ থেকে বের হওয়া তরল পদার্থে পাঞ্জাবীটা ভিজে উঠে। ফোনটা এখনো আমার হাতে ধরা। ওপাশ থেকে কণার কান্নামাখা কন্ঠ শুনা যাচ্ছে,
‘মিশু, মিশু কি হয়েছে তোমার?’
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মাতাল করা রুপালী চাঁদটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।

_______________
নীল তারা।।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার বিষয়বস্তু বেশ ভাল লেগেছে।
ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি ছাত্রদের অধিকার আদায় এবং সৃজনশীলতার বিকাশ হয়ে থাকে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির চর্চা গঠনমূলক হয়ে থাকে ,তবে সেক্ষত্রে ছাত্র রাজনীতি কোনভাবেই অনাকাঙ্খিত নয়। কিন্তু বর্তমানে অর্থলোলুপতায় কেদাক্ত এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নেশায় মত্ত দলীয় রাজনীতির প্রভাবে ছাত্র রাজনীতির সৎ উদ্দেশ্য তলিয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির এরূপ মারাত্মক চর্চার প্রতি ধিক্কার !!
-তাসরিভা

অতিথি লেখক এর ছবি

সহমত ৷ ছাত্ররাজনীতির বর্তমান চিত্রের দিকে নজর রেখেই লিখতে চেষ্টা করেছি ৷

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ৷

প্রখর-রদ্দুর [অতিথি] এর ছবি

আমাদের প্রকাশ হোক অবারিত ।
ভালো লাগলো । আরো পড়তে চাই..........

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ৷

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

লেখা বেশ ভালো লাগলো।
এখনকার তরুন সমাজ এরকমই হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে... মন খারাপ

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা ভালো লাগছে জেনে খুশি হলাম ৷ তরুণ সমাজকে নিয়ে চিন্তা এই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক ৷
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ৷

___________________________
নীল তারা

নজমুল আলবাব এর ছবি

বেশ গোছানো লেখা।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

নীল তারা ।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

গল্পটি ভাল লাগল । “ছাত্র রাজনীতি”র নামে যে নীতিহীনতার চর্চা হয়, তা যে কোথায় নিয়ে যেতে পারে…

ছোটখাট যে বানান/টাইপো চোখে পড়ল,

জাঁজালো > ঝাঁঝালো
শুনায় > শোনায়
এলপাথারি > এলোপাতারি
শুয়িয়ে > শুইয়ে
শুনা > শোনা

……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল৷
ভুল বানান ধরিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ৷

______________________

নীল তারা ৷৷

অতিথি লেখক এর ছবি

লিখাটা পড়ে ভাল লাগল।


ছেড়া পাতা
ishumia@gmail.com

দ্রোহী এর ছবি

ঠিকাছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।