আমার দিনলিপি...১০.০৬.১০

নীলকান্ত এর ছবি
লিখেছেন নীলকান্ত (তারিখ: শুক্র, ১১/০৬/২০১০ - ৪:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছুটির সকাল। ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হওয়াই স্বাভাবিক। প্ল্যানও ছিল তাই। মাঝখান দিয়ে বাধ সাধলো মা।
দরজার কড়া নেড়ে নেড়ে সে বলে ওঠে, “ওঠ পলাশ, খেয়েদেয়ে আবার ঘুমাস।”।
সকালের খাবার খেয়ে আবার মেঝেতে। ঘরে বিছানা থাকলেও মেঝেতে ঘুমাই আজ বছরখানেক।
মাথায় সারাদিন কি করবো সে চিন্তা ঘুরতে থাকে। দাওয়াত আছে একটা। যদিও দাওয়াতে আজকাল তেমন একটা যাওয়া হয় না। কিন্তু আজ যাব।
কাল রাতে ব্লগ লিখে শেষ করতে পারি নাই। ভেবে খারাপ লাগে। শেষ করতে না পারার অর্থ কাজ পেন্ডিং রাখা, আর পেন্ডিং কাজ শেষ করবার ইতিহাস আমার খুব কমই। এসব ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম ভাঙ্গে গরমের চোটে, চোখ খুলে দেখি সারা গা ঘেমে একাকার, কারেন্ট নেই। মোবাইলে সময় দেখি, ১১:৫৩। বের হওয়া উচিত।
ঘরটার দিকে এক নজর দিতেই মন খারাপ হয়ে যায়। গোছাতে হবে। পুরো এলেমেলো, এত বাজে অবস্থা যে আমার জিনিসপাতি আমি নিজেই খুঁজে পাব না ।
দাওয়াত ঠাঠারীবাজারের স্টার হোটেলে। উপলক্ষ্য- বন্ধুর বিবাহোত্তর খানাপিনা।
দেখতে দেখতে বুয়েটে ৩ বছর চলে গেছে। এর মধ্যে ক্লাসের অনেকে বিয়ে করে ফেলেছে। তাদেরই একজন আজকের আয়োজক।
ঠাঠারীবাজারের স্টারে এর আগে যাই নাই। জানি না কেমনে যাইতে হয়। অগত্যা বাসা থেকে বের হবার আগে ফোন লাগাই ইমতিয়াজকে একসাথে যাবার উদ্দেশ্য।
ইমতি হলেই ছিল, চলে গেলাম ভার্সিটিতে। গিয়ে দেখি ৯-১০ জন একসাথে দাঁড়িয়ে, কিন্তু রিক্সা নাই। আধঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকি, কোন লাভ হয় না। ১০ মিনিটের মত হাঁটা দিয়ে বকশীবাজার থেকে রিক্সা নেই।
প্রচন্ড গরম, এর মধ্যে আবার ক্যাপ নাই সাথে। কাল ছাত্রের বাসায় ভুল করে রেখে এসেছি।
স্টারে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। সামনে ছোট একটা অংশ, পিছনে বড় বিল্ডিং। হোটেলের দোতলায় যাই, সেখানেই করা হয়েছে আয়োজন।
দূর থেকে বন্ধু আর বন্ধুপত্নীকে দেখি। ভালই লাগছে দুজনকে, মানিয়েছে ভাল। বন্ধুর নাম মামুন। মামুন আমাকে দেখে নিজের পরিচয় দিতে বলে। আমি ঈসৎ লজ্জিত স্বরে আমার পরিচয় দেই। লজ্জা পাবই না কেন, শজে তো কথা বলি না কারো সাথে।
ক্লাসের প্রায় সবাই এসেছে। ভালই লাগে, ক্লাসের পিকনিক বা ইফতার পার্টিতেও এত লোক হয় না আমাদের। সবাই গল্পে মশগুল, আমি থাকি এক সাইডে এক টেবিলে বসে।
দাওয়াত খেয়ে হলে আসি সাড়ে চারটায়। হলে আসার উদ্দেশ্য জিমে ব্যয়াম করা। বুয়েটের ব্যায়ামাগারটার অবস্থা চরম করুণ, কিছুই নাই। যা আছে তারও বেহাল অবস্থা।
ঘন্টাখানেক শরীর ঘামিয়ে এসে একটা গোসল দেই।
বিকালের দিকে হলে থাকলে নাস্তা হিসেবে সাধারণত মোগলাই খাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। কেন জানি জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগে।
খেতে খেতে টিভিতে গণভবনে তিন মেয়ের বিয়ের খবর দেখি। ভালো লাগে বিষয়টা। কেবল খারাপ লাগে রিপোর্টরাকে। সেটা ইথিকাল এক কারণ, অন্য কোনদিন সময় পেলে লিখবো। মোগলাই খেতে খেতে রিফাতকে দেখি, সাথে ব্যাগ। আমার ক্লাসমেট রিফাত।ও এসে বসে আমার সাথে, চা অর্ডার করে।
রিফাত যাবে ফুফুর বাসায়।
রিফাতের সাথে বাইরে বের হয়ে আসি। আশিকের দোকানের সামনে রিফাতকে বিদায় বলে বসে পড়ি দোকানে। গত বছরখানেক ধরে রাতে আড্ডা মানেই আশিকের দোকান।
আশিক চা দেয়। চা খাই আর রাজকূট দিয়ে বাতাস নিজেকে আতাস করি। অসম্ভব গরম আজ।
দেবুকে ফোন দেই, ধরে না ব্যটা। হয়তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ফোন দেই ইমরানকে, এক রিং বাজতেই ধরে ফেলে।
-কই তুই?
-এইতো পলাশীতে দেবুর সাথে। তুই কই?
-আমি আশিকের দোকানে।
-খাড়া, আইতেছি।
ইমরান, দেবু আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। স্কুল ছিল বুয়েটের পাশেই, উদয়ন।
মিনিটখানেকের মাঝেই ওরা এসে পড়ে।
ইমরানের দোকান আছে একটা, আজ দোকানের কর্মচারী আসে নাই। ইমরান বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। দশ মিনিটের মধ্যে সে চলে যায়। আমি আর দেবু বসে চা খাই। আজ সাথে কফি নাই, থাকলে কফিই খেতাম।
হঠাৎ করে কই থেকে এক ছেলে এসে হাজির হয়।
-মামা, একটা কলা দেন না, খামু।
-মানে???
-ক্ষিধা লাগছে, দেন না মামা।
আশিক দাবড়ানি দিতে যায়, আমি বাধা দেই।
-মারিস না, দাঁড়া। আমি কথা বলুম ওর সাথে। তোরে কেন খাওয়ামু আমারে ক তো?
-ক্ষিধা লাগছে তাই।
-তাইলে তো এখন থেকে যারই ক্ষিধা লাগবো তারে ধোইরা ধোইরা আমার খাওয়ানো লাগবো।
ছেলে কথা বলে না। দেবু, আশিক কথা শুনে হাসে।
-কি করস তুই?
-কিছু করি না।
-কিছু করস না মানে? পড়োস না বা কাজ করোস না?
-পড়ি, কিন্তু কাম করি না।
-কি পড়োস? কই পড়োস?
-ঐহানে ইস্কুল বহে, ঐহানে।
-তোর বাপ-মা কই?
-বাপ বাইচা নাই, মায়ে খোঁজ খবর রাহে না।
- থাকোস তাইলে কোনখানে?
-আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে।
আমি চুপ করে যাই।
একটু পরে যখন পাশে তাকাই তখন দেখি ছেলেটা চলে যাচ্ছে। জোরে ডাক দিয়ে উঠি, “ঐ পিচ্চি।”
ও শোনে, খালি পায়ে ছোট ছোট পায়ে ফিরে আসে।
জিজ্ঞেস করি
-কি খাবি? কলা না রুটি?
-কলা।
-ভাল করে ভাইব্যা বল, কলা না রুটি।
একটু ভাবে ছেলেটা। শেষে বলে।
-রুটি।
-রুটি হলেই হইবো তো?
-হ।
আশিক রুটি দেয়।
দেবু কিছু বলে নাই, খালি চেয়ে চেয়ে দেখে।
-ঐ, কোন ক্লাসে পড়োস তুই?
-ক্লাস ওয়ানে।
- কি কি শিখায় স্কুলে?
-আগের দিন নামতা হিখছি।
-ক তো দেখি।
রুটি খেতে খেতে শুকনা গলায় ছেলেটা নামতা বলতে থাকে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে ছেলেটার নাম জানি না।
-ঐ তোর নাম কিরে?
-নুরুল ইসলাম।
দেবু এসময় বলে ওঠে, “কি নাম কইলি?”
দেবু এতক্ষণ যে মনোযোগ দিয়ে সব কিছু শুনছিল তা বুঝতে পারলাম।
নুরুল নামটা আবার বলে পানি খেতে যায়। আমি খেয়াল করি না।
নুরুল ফিরে এলে ওকে বলি
-এখন একটা ছড়া ক।
-কোনটা কমু?
-তোর যেটা মন চায়।
নুরুল ছড়া বলে। সুন্দর ছড়া। আমি আর একটা বলতে বলি। ও বলে। আমাদের বুঝতে না দিয়ে দেবু ছড়া রেকর্ড করে।
পরে আমরা রেকর্ড করা নুরুলের ছড়া শুনি, নুরুল নিজের গলা শুনে নিজেই হেসে দেয়।
দেবু হঠাৎ বলে
- সারাদিন কই খাস?
-সকালে আর রাতে বিয়া বাড়ি আইটা খাই। আর দুপুরে এর ওর কাছ থেইক্যা চাইয়া চিনতে খাই।
-যেদিন বিয়া থাকে সেদিন?
-সেদিন না খাইয়া থাকি।
দেবুর মায়া হয়।
-শোন এখন থেকে এই দোকানে এসে প্রতিদিন রাতে একটা করে রুটি নিবি, আর আমি থাকলে আমার কাছে পড়া দিবি। যতদিন পড়বি ততদিন রুটি পাবি। না পড়লে পাবি না।এখন যা।
নুরুল যেন বিশ্বাস করতে পারে না। আমিও পারি না। অবাক চকখে চেয়ে থাকি দেবুর দিকে।
-রাতে পড়ার পর ক্ষিধা লাগলে তখন আইসা চাবি, আশিকে রুটি দিয়া দিব।
নুরুল খুশি মনে চলে যায়। আমি আমার বন্ধুটির দিকে তখনও তাকিয়ে।

কিছুক্ষণ পর ইমরান দেবুকে ফোন দেয়। একা দোকান সামলাতে পারছে না। দেবুকে হাত লাগাতে হবে।
দেবু চলে যায় ইমরানের দোকানে। আমি এখন একা বসে আশিকের দোকানে।
দোকানটাকে এক নজর দেখি। ফুটপাতের উপর ছোট্ট একটা দোকান। এর জন্য প্রতিদিন ওকে গুনতে হয় ২০ টাকা, সপ্তাহে ৪০ টাকা। মাসে মোট ৭০০ টাকা। এই সরকারের আগে তা ছিল প্রতিদিন ৫টাকা। ৩ গুণ বেড়ে গেছে। টাকাটা যায় পলাশী দোকান মালিক সমিতির পকেটে, সেখান থেকে কিছু পুলিশের পকেটে। বাকী মালিক সমিতির পকেটে।
আশিক থাকে রশীদ হলে, ওর বাবা রশীদ হলের বাবুর্চি। নিয়মিত পড়লে ছেলেটা এবার এইচ.এস.সি দিত ছেলেটা ক্লাস নাইন পাস। ছিল উদয়নে।
আমি গান ধরতে ধরতে বেঞ্চে শুয়ে পড়ি। বাংলার গান, “ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা”।
কখন যে আরমান এসে মাথার কাছে বসে টের পাই না। গান শেষে চোখ খুলে দেখি পিছনে ও বসে। আরমানও আমার স্কুলবন্ধু।
আর এক কাপ চা নেই। আদা দুধ চা। আশপাশ থেকে পরিচিত অনেক মুখ চলে যায়, আমি তাকিয়ে দেখি, কথা বলি। ওদের কথা শুনি। আবার এসে আরমানের সাথে গল্প করি।
চারপাশে শ’খানেক মানুষ। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট, কেউ বা শুধু গল্প করতে বসে আছে। কেউ কেউ পড়ালেখার আলোচনা করছে।“ এইটা হল হিঞ্জ।”, “ফিজিক্সের অমুক বইতে অমুক জিনিস পড়ছি”, আরো অনেক কিছু শুনি।
কেন জানি ইদানীং মনে হয় বুয়েটে ঢুকবার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। ছোটবেলা থেকে আমাদের এক ভুল জিনিস শিখানো হয়েছে, “তুমি অংকে/ ফিজিক্সে/রসায়নে ভাল, তো তুমি বুয়েটে পড়ো।” কেউ বলে না পিওর ম্যাথ, ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তে।
কেন জানি মনে হয় আমি একটা সিট নষ্ট করছি। ইঞ্জিনিয়ারিং আমার জন্য না।
ইমরান আর দেবু চলে আসে দোকান বন্ধ করে। আজকে আর ইমরানের পক্ষে দোকান চালানো সম্ভব না।
আশিককে বিল দিয়ে হাঁটা দেই বুয়েট শহীদ মিনারের দিকে।
মিনারের কাছাকাছি আসতেই শুনতে পাই, অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান হচ্ছে। দল বেঁধে গেলাম সেখানে।
আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্টেজে একটা ব্যাণ্ড গান গাইছে “জাগো...জাগো......বাংলাদেশ।”
গানটা শেষ হতেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। মনে হয় ভালো একটা অনুষ্ঠান মিস করেছি।
অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে রিক্সা নেই, বাসায় উদ্দেশ্যে। চেনা পথ ধরে চেনা জায়গায় ফেরা। পলাশী ক্রস করার সময় হঠাৎ চোখে পড়ে মোড়ের মাঝখানে লেখা "সম্রাট হত্যার বিচার চাই।" লেখাটা ফিকে হয়ে আসছে দিনকে দিন।
সম্রাটের ব্যানারে আজ একটা গান দেখলাম ল্যানে। জানিয়ে না মৌলিক কিনা গানটা তবে ভাল লেগেছে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে ১১টা বেজে যায়। বাসায় ঢুকে দেখি কারেন্ট নেই, পানিও নেই। এত বাজে অবস্থা যে হাতমুখ ধুঁতে পারি না।
কারেন্ট এলে কম্পিউটার চালাই, টিভি ছাড়ি। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখন অনুষ্ঠান দেখছি আর দিনলিপি লিখি, ‘আমার দিনলিপি’।
বড় বিচিত্র এ নগরের অতি সাধারণ এক মানুষের দিনলিপি।

পলাশ রঞ্জন সান্যাল


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আপনার লেখা কয়েকদিন পড়ে আরো ভালো, গোছালো লেখা আশা করতে শুরু করেছি। আশা করি নিরাশ হব না।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

চেষ্টা করছি ভাইয়া, গুছিয়ে লিখতে। লিখতে সব সময়ই ভালো লাগে, খালি সমস্যা একটা গুছিয়ে উঠটে পারি না।
মাহবুব ভাই, তুমি করে বললে ভালো লাগতো। অনেক জুনিয়র আমি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

পলাশ রঞ্জন সান্যাল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।