জীবনের ভীড়ে-১

নীলকান্ত এর ছবি
লিখেছেন নীলকান্ত (তারিখ: বুধ, ১০/০৬/২০১৫ - ১২:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব ১: আম্রিকা সমাচার

আম্রিকার ছোট শহরগুলোতে বসবাস করার অনেক অসুবিধার মাঝে একটি—যাতায়াতের সমস্যা। বিশেষত নিজস্ব গাড়ি ছাড়া এখানে চলাচল একেবারেই অসম্ভব। প্রথম ছ'মাসে তা বোঝা হয়ে গেছে।

শহরে আসার আগে তেমন একটা খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। এবং সে ভুলের মাসুল পরের ক'মাস দিতে হয়েছে। ভাগ্য ভাল যে বাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা বাজার করা নিয়ে। কাছের মুদি দোকান বলতে পাব্লিক্স, তাও ৪০ মিনিটের হাঁটা। কিন্তু পাব্লিক্সকে বলে এখানে বড়লোকদের বাজার। চড়া দামে প্রায় ওয়ালমার্টের জিনিস কেনা।

ওয়ালমার্ট, আলডি আর ফুড লায়ন হচ্ছে আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাজেটে চলা মানুষদের ভরসা। এবং অধিকাংশ ক্ষেতে বাজার করে সবাই সপ্তাহে একদিন। আমি প্রথম প্রথম দুই সপ্তাহে একবার করেছি। মাঝখানে আবার একমাসে একবার।

অন্যদের সাথে যেতে চাইলে দল বেধে যাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকা শহরে থাকবার সুবাদে নিজের মতো করে থাকার এবং কাজ করার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে তাতে অন্যদের সময়ের সাথে নিজের সময় মেলানো কঠিন। সুতরাং কয়েক দফা চেষ্টার পর তা বাদ দিলাম। নিজের সময়ে যাবো, কাউকে দেরি করাবো না।

কিন্তু মুদি দোকানে যাওয়া ছাড়াও অন্য কোথাও যেতে হলে আম্রিকায় গাড়ি আবশ্যক (বড় শহর আলাদা)। সুতরাং গাড়ি চালানো শেখাটা জরুরি হয়ে পড়লো। দেরি না করে, আসার এক মাসের মধ্যেই লিখিত একটা পরীক্ষা দিয়ে ১ বছরের একটা লার্নার্স লাইসেন্স নিয়ে নিলাম। লাইসেন্সটার সুবিধা গাড়ি চালাতে পারবো, অসুবিধা সাথে সবসময় একজন থাকতে হবে এবং ছ'মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যাবে না।

শুরুতে পাশের ল্যাবের এক রাশিয়ান ছেলে, মিখাইল প্রবল উৎসাহে গাড়ির খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিল। এরপর ল্যাবের পাশে ভবনেই বসবাসরত এক প্রতিবেশী, জন আমাদের দেখে বললো সে সহায়তা করবে।

সপ্তাহে একদিন করে শেখার সুযোগ, তাও শুক্র বা শনি। সেই মুদি দোকানে যাবার পথে। জন অথবা মিখাইল সাথে থাকবে, ওয়ালমার্টে যাওয়া আর আসার সময় গাড়ি চালাবো আমি, একসাথে দুই কাজ হবে তাহলে—বাজার করাও হবে, গাড়ি শেখাও হবে। তাদেরও কোন অতিরিক্ত খাঁটুনি হবে না।

প্রথম যেদিন রাস্তায় গাড়ি নিয়ে উঠলাম, প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। বিশেষত রাতের বেলা হওয়ায়। পেছনের গাড়ির দূরত্ব বুঝে উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার উপর দিক সম্পূর্ণ বিপরীত, ডান দিকের চলাচল। মানে হচ্ছে রাস্তায় দাঁড়ালে যেদিকে যেতে চাননা কেন আপনি সবসময় ডান পাশে থাকবেন। বাংলাদেশের তা বাম পাশে (অধিকংশ ব্রিটিশ কলোনি তা)।

এখানে রোড ডিভাইডার নেই বললেই চলে (ছোট রাস্তায়, যা কিনা প্রায় ছয় লেনের)। তো প্রথমবার বামে মোড় নিতে গিয়ে অন্যদিক থেকে আসা গাড়ির সাথে প্রায় মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে বাঁচতে গিয়ে ডানে সরে যেতেই একটুর জন্য পাশের গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগেনি। চারপাশে হর্নের আওয়াজ। এখানে হর্ন একেবারেই বাজায় না, যদি না মানুষকে বিরক্ত করা হয়, সেবার আমি ছিলাম বিরক্তির কারণ।

প্রথমবার চালানোর পর সাহস অনেক বেড়ে যায়। এখানে যানজট নেই বললেই চলে। যানজট বলতে যা দেখেছি তা হচ্ছে ৭-৮টা গাড়ি সিগ্নালে থেমে আছে, তাও বিকাল ৫টায়, সবাই যখন বাড়ি ফিরছে। তবে মাঝে মাঝে দুর্ঘটনার কারণে মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী যানজট লেগে যায়।

তো প্রতি সুপ্তাহে একবার করে চলতে থাকে আবার গাড়ি চালানো শেখা। অন্য কোন উপায় ছিল না। অন্যের গাড়ি নিয়ে শেখা এবং চালানোর ঝামেলা অনেক, তা যেকোন জায়গায়। সে হিসেবে জন এবং মিখাইলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষত জন, প্রত্যেকদিন চালানোর আগে বলতো, ডোন্ট বি এফরেড টু ট্রাই, সিট ক্যান হেপেন টু এনিবাডি হোয়েদার ইউ ড্রাইভ অর আই।

জনের গাড়ি নিয়ে মাসখানেক আগে পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষা নেয় বেলা ১ঃ৩০ পর্যন্ত। তো আমরা ঠিক করেছিলাম যাবো ১১টায়। যাবার পথে জন খেয়াল করলো যে, গাড়ির মোড় নেবার বাতি (টার্নিং লাইট) কাজ করছে না। বাতি কাজ না করলে পরীক্ষা দেয়া যাবে না, চালানো তো চাবেই না। বাতি ঠিক করাতে গেলাম মিস্ত্রির কাছে। গাড়ির অন্য সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে আমরা পরীক্ষা দেবার অফিসে গেলাম।

তথ্য বিভ্রাটজনিত সমস্যা আম্রিকায় বাংলাদেশের চেয়ে কম নয়। সে কাহিনীতে যাব অন্য একদিন। অনেক ঝামেলা করে বার কয়েক অফিসে যাবার পর পরীক্ষা দেবার সময় মিললো বেলা ২টায়। পরীক্ষা দেবার আগের ক'দিন জন কয়েকটা জিনিস খুব ভাল করে শিখিয়ে দিয়েছিল। কারণ পরীক্ষা নেবার সময় এগুলো দেখা হয়। যেমন পিছনের দিকে গাড়ি চালানো, চালানোর সময় সরল্রেখায় রাখতে পারছি কিনা গাড়ি; তিন বারে ঘোরা (থ্রি পয়েন্ট টার্ন); পার্কিং এর সময় গাড়ির চাকা কোনদিকে ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুরো পরীক্ষার সময় তিনটের বেশি ভুল হলে, লাইসেন্স দিবে না। কাটায় কাটায় তিনটা ভুল হলো এবং লাইসেন্স পেয়ে গেলাম।

শেখা হয়ে গেলেও এখনও পালা করে জন আর মিখাইলের সাথে বাজার করতে যাওয়া হয়। গাড়ি চালানো শেখা উপলক্ষে যে পরিচয় তা আরো ঘনিষ্ট হয়েছে। জন কয়েকমাস পর চলে যাবে কাজাকিস্তান, পেশায় ইংরেজি শিক্ষক সে। জাপান, কোরিয়া, আফগানিস্তানে আগে শিক্ষকতা করেছে। মিখাইল এখন বোস্টনে, অদ্ভূত ছেলেটা পিএইচডি করছে মেকানিক্যালে অথচ ইন্টার্ন্সিপ করছে ব্লুমবার্গে।

এখনো নিজের গাড়ি কেনা হয়ে ওঠেনি। ছাত্র বাজেটে লোহা লক্কর ছাড়া ভাল কিছু পাওয়া যায় না। এক বড় ভাইয়ের বলা এক কথা মনে পড়লো এখন, "বাংলাদেশে কষ্ট করে পড়ালেখা করে মধ্যবিত্তের পর্যায়ে উঠছিলাম অল্পবয়সে, আম্রিকায় এসে সেই নিম্নবিত্ত থেকেই আবার শুরু।"

মাঝে মাঝে দেশের রাস্তায় সাইকেল চালানো খুব মনে পড়ে। বাসে চড়ে ভীড়ের মাঝে অল্পটুকু দূরত্ব যাবার কথা মনে পড়ে। শহরটাকে মনে পড়ে। আসার সময় ভেবেছিলাম এমন কিছুই হবে না। তবু কেন জানি মনে পড়ে। এখানকার রাস্তায় সেই জীবন নেই, যেই জীবন ঢাকার রাস্তায় অনুভব করতাম। এসব প্রায়ই ভাবি, এবং ভাবতে ভাবতে নিজেকে বলি, "দ্য চোয়েসেস উই মেক"।


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চিন্তিত হুমম। সাইকেল ভালু জিনিস।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

আয়নামতি এর ছবি

গাড়ি চালানোর প্রথমদিককার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেলু!
আরে না ছাত্র বাজেটে মোটামুটি চলনসই গাড়ি পাওয়া যায় যদি ভাগ্য ভালো থাকে।
আমারটা কিন্তু এখনো সার্ভিস দিচ্ছে বেশ। হাসি
দেশে গিয়ে আবার দেখবেন এখানকার রাস্তার জন্য মন কেমন করছে!
আপনার আগামি দিনগুলোর জন্য শুভকামনা থাকলো।
----
ইয়ে কিছু টাইপো আছে পোস্টে ঠিক করেন

অতিথি লেখক এর ছবি

লোহা লক্কড় দিয়েই হাত পাকা হোউক হাসি

মোস্তফা কামাল

অতিথি লেখক এর ছবি

যস্মিন দেশে যদাচার। আফ্রিকা বিশেষত সাউথ আফ্রিকাতেও গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। আর ঘর ছেড়ে যতদুর যাবেন ততই ঘর আপনাকে টানবে কারন এযে আপনার মাটিদেশ।
----------------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি।
http://icchemotolikhi.blogspot.in/2015/05/for-blogger-to-blogger.html

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আমার প্রথম গাড়ি চালাবার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে শিউরে উঠলাম মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এত ভয় ক্যান? আম্রিকার রাস্তায় গরু-ছাগল নাই? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দুইবার শেখার চেষ্টা করে আমি যা বুঝলাম, গাড়ি চালানোর চেয়ে কঠিন কাজ দুনিয়াতে নাই মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাই, নো টেনশান; মায় একটা গাড়ি পর্যন্ত হাসি । বানানগুলো এট্টু ঠিক করে দেন না!

দেবদ্যুতি

রাগিব এর ছবি

আমি গুণে গুণে ১০০০ ডলারে একখানা নিসান গাড়ি কিনেছিলাম। ২০০৫ সালে যখন কিনি, তখন সেটার বয়স ১৪ বছর (১৯৯১ মডেল, সেন্ট্রা)। কিন্তু সেই গাড়ির বডি যতোই মরচে পড়া হোক না কেনো, ইঞ্জিন বড়ই চমৎকার। সেই গাড়ি নিয়ে আই-৮০ এর ৫০০০ ফুটের পাহাড় ডিঙিয়ে মোট ২৫০০ মাইল পাড়ি দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া গেছিলাম, ফেরত এসেছিলাম। আবার উল্টা দিকে চালিয়ে লং আইল্যান্ডে আটলান্টিক মহাসাগর অবধিও গেছি। গাড়িটা রেখেই দিতাম, ১৬৯০০০ মাইল পর্যন্ত চালিয়েছি। কিন্তু বাধ সাধলো ম্যারিল্যান্ডের বেরসিক ডিএমভি। গাড়ির এখানে বাতি কাজ করেনা, ওখানে ট্যাপ খাওয়া বলে ফিটনেস দিবে না। তাই বাধ্য হয়ে ৫ বছর চালাবার পরে ৫০০ ডলারে বেচে দিলাম। গাড়িটা আশা করি এখনো চলছে।

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।