জীবনের ভীড়ে-২

নীলকান্ত এর ছবি
লিখেছেন নীলকান্ত (তারিখ: শনি, ১৩/০৬/২০১৫ - ৫:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব ২ঃ মেগাবাস

আম্রিকায় সবচেয়ে বেশি দাম কিসের? সময়।

সময় নিয়ে হাইকোর্ট দেখানো লোকের এখানে অভাব নেই, কোম্পানির কথা নাই বা বললাম।

তো মাঝে পাসপোর্টের ঝামেলায় অন্য এক শহরে যাবার প্রয়োজন দেখা দিলো। উপায় পাওয়া গেল তিনঃ ১) গাড়ি ভাড়া ২) ট্রেন ৩) বাস

গাড়ি ভাড়া করে যাবার ইচ্ছাটা একটি ফোন কল করার পর পুরোপুরি উবে গেল। সস্তা যেসব কোম্পানি তাদের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া করবার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রথম শ্রেণির ক্রেডিট কার্ড লাগবে। আম্রিকা এসে বাকি সবকিছু করা হয়ে গেলেও ক্রেডিট কার্ড করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলাম, কিছু সঞ্চয় না হোক, অন্তত যেন ঋনাত্মক দিকে টাকা পয়সা যেন না থাকে।

তো ভাবলাম অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায় কিনা, সেক্ষেত্রে নীতিমালা কঠোর। সম্ভব না। উপায় ১ বাতিল।

ট্রেনের খরচ দেখে চক্ষু পুরা বুঝে এল। শেষ এবং একমাত্র উপায় তাই বাস, অতএব বাসই সই।

কন্তু বাস বলতে দুই কোম্পানি, গ্রেহাউন্ড এবং মেগাবাস। গ্রেহাউন্ডে আগে ওয়াসিংটন থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়া হয়েছে এবং বাস যথেষ্ট ভালই। কিন্তু সময় মেলানো কঠিন হয়ে গেল। পরিকল্পনা দিনে গিয়ে দিনের ফিরে আসা। শহর থেকে গন্তব্যস্থল ৪ ঘন্টা বাসে। খুবই সম্ভব।

রাত ২ঃ৫৫ এর টিকেট কাটলাম, বাস পৌঁছাবে ৪ ঘন্টা পর ভোর ৭টায়। ফেরার বাস ১০টায়। দূতাবাসে সাক্ষাৎ এর সময় ৮ঃ৩০ সকাল।

আগের দিন ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম কোথা থেকে বাসে উঠতে হবে, এবং কতক্ষণ আগে সেখানে থাকা লাগবে। আম্রিকাতে বাস কোম্পানিগুলো শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী ওঠায় বাসে, টিকেট কেটে নির্দিষ্ট জায়গায় সময় মতো দাঁড়ালেই হয়। তো আমাকে বলা হলো মেট্রোপলিটন বাস স্টেশন থেকে বাস ছাড়বে।

রাত বিধায় বাসা থেকে বাস স্ট্যাণ্ড পর্যন্ত ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। ট্যাক্সির আবার ক্যাচাল অনেক ক্ষেত্রেই, তা সময় মতো আসে না। তো বুঝেই ট্যাক্সি আসতে বললাম রাত দু'টোয়। বাসা থেকে যেতে লাগবে ১৫ মিনিট। ট্যাক্সি দেরি করলেও অন্য কোন ব্যবস্থা করার সময় থাকবে হাতে।

তো যাবার রাতে ট্যাক্সি এলো ঠিক সময় মতো। বাস স্ট্যান্ডে পৌছাতে সময় লাগলো ১০ মিনিট, রাস্তা পুরো খালি। কিন্তু এরপরই দেখা দিল সমস্যা। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, আশে পাশে কোন গাড়ি বা কোন কিছুই নেই। বাসস্টেশন বন্ধ, সন্ধ্যা ৬টার পর নাকি বন্ধ হয়ে যায়। বাস স্টেশনের বাইরে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক শুয়ে বসে আসে। মাতাল, আসক্ত আর বাস্তুহারা লোকজন।

আমার ক্যাব ড্রাইভারের নাম কোয়ামি, ঘানার ছেলে। ও দেখেই প্রথমে জিজ্ঞেস করলো আমার বাস কতক্ষণ পর। বললাম ওকে। ও বললো, কাজ সেরেছে। মেগাবাস সময়ের বড়জোর দশ মিনিট আগে আসবে, লোকজনও তাই। তাদের আসার আগে সময় আধা ঘন্টা হাতে। এই সময় আমার বাসস্ট্যান্ডে একা থাকা ঠিক হবে না।

কি করবো, বাসায় গিয়ে আবার আসবো, নাকি অন্য কোথাও যাবো এমনটা যখন ভাবছি, কোয়ামি তখন ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো। আমাকে বললো, ওর ভাড়াটা যেন দিয়ে দেই আর এখন ওর করার তেমন কিছু নেই। সারারাতে আমিই একমাত্র যাত্রী। সুতরাং যতক্ষণ না অন্য কেউ ওকে ফোন করছে, আমার সাথে ও গল্প করবে।

জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন হলো আম্রিকাতে। জানালো ৬ বছর, মাস্টার্স করতে এসেছিল ধর্মীয় এক কলেজে, মাস্টার্স শেষে এখানেই থেকে গেছে। একগাল হেসে বলেই ফেললো, ওটাই আসল উদ্দেশ্য ছিল।

কোয়ামি জানালো উদানীং ওর খুব বইয়ের নেশা হয়েছে। ও এই শহর ছেড়ে চলে যেতে চায়, বড় কোন শহরে, বড় কিছু করবার জন্য, নিজের মতো করে কিছু। কোয়ামি'র মতে আম্রিকায় যেকেউ চাইলেই উপরে উঠতে পারে, সবার সম্ভাবনা সমান। আর বড় হতে হলে স্বপ্ন থাকা দরকার, স্বপ্ন সত্যি করার ইচ্ছা ও বিশ্বাস থাকা দরকার।

তার হঠাৎ করে সামনে বসে থাকা ছিন্নমূল মানুষদের দেখিয়ে বললো, এখানে আসার আগে ও ভাবতো কৃষ্ণাঙ্গ বিধায় কৃষ্ণাঙ্গরা তাকে নিজেদের একজন মনে করবে। কিন্তু আম্রিকা আসার পর সবচেয়ে খারাপ সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তার কৃষ্ণাঙ্গদের কাছ থেকে। সাম্প্রতিক দক্ষিণ আফ্রিকার দাঙ্গার কথা মাথায় আসলো সাথে সাথে।

আমার সম্পর্কে জানতে চাইলো, কেন এখানে আসা, লক্ষ্য কি। কোয়ামি এখন সারাদিন পড়ে আর সারারাত বিভিন্ন কাজ করে, ঘুমের সময় খুবই কম। পড়া অথবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে। পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইবো ঠিক তখনি যাত্রীর ফোন। যেতে হবে। গল্পের মাঝে কখন যে বাসের সময় হয়ে গেছে, বুঝে উঠতে পারিনি।

কোয়ামি বিদায় জানিয়ে চলে গেল। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম হাতে গোনা কয়েকজন এসেছে, তবে গাড়ির সংখ্যা বেশি। অধিকাংশ মানুষ গাড়ির ভেতরে বসা।

সময় গড়াতে থাকে, কিন্তু বাসের কোন খবর নেই। আশেপাশের মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম তারাও একই বাসের জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। হ্যাঁ, সবার গন্তব্যস্তল এক।

এর মধ্যে দু'জন আসক্ত ব্যক্তি কাছে এসে খাবারের জন্য টাকা চাইলো। আমি চুপ করে থাকলাম অনেকক্ষণ। যখন দেখলাম আরও কয়েকজন আসতে পারে, তখন হাঁটা শুরু করলাম আশেপাশে। আমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে, তারা গেল অন্যান্য যাত্রীদের কাছে।

বাস আসতে বাজলো ৩ঃ৪৫ মিনিট।

মেগাবাস আসলেই আকারে মেগা। দ্বিতল বাস, বুকিং দেবার সময় বুঝতে পারিনি। অধিকাংশ যাত্রীর সাথে ব্যাগ। আমি খালি হাত।

বাস উঠতেই ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাবার অবস্থা। পুরো বাস হিমাগার বানিয়ে রেখেছে। ড্রাইভারকে যাত্রার শুরুর আগে জিজ্ঞাসা করলাম ঠাণ্ডা কি একটু কমানো যায় কিনা। জানালো উপায় নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, গাড়ির চালক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার সহকারি আর ধাপ এগিয়ে আমাকে বললো, "এমন ভাব করতেছো যে আগে কখনো বাসে চড়ো নাই, যাও গিয়ে বসো। একটু পর বাস ছেড়ে চলে যাবে।"

কি বলবো বুঝতে পারলাম না, গিয়ে বসলাম সিটে। পাশের সিট খালি। আমার গায়ে হাফ হাতা শার্ট আর প্যান্ট। সকালে সূর্য ওঠার পর তাপমাত্রা প্রায় ৩০-৩৩ ডিগ্রি থাকে।

মাঝখানে ড্রাইভার ১০ মিনিটের জন্য এক জায়্গায় থামলো, ধুম্রপানের জন্য। বাসে সেইরকম তীব্র গন্ধ, এই রকমটা এর আগে একবারই অনুভব করেছি, চট্রগ্রাম থেকে সিলেট যাবার লোকাল বাসে।

পৌছাতে বেজে গেল প্রায় আটটা। এই শহরের বাস স্টেশন একই কিসিমের, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী তুলছে, নির্ধারিত স্থান যদিও। সকালের বাসের মতো আসার পথেও একই রকম দেরী ১০টার বাস ছাড়লো ১১টায়। এবার পাশে বসলো এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। এবং বসার পরপরই সেই রকম নাক ডাকা। আমারও একটু নিদ্রাচ্ছন্ন ভাব আসলেও ভদ্রলোকের কনুইয়ের ধাক্কায় আবেশটুকু পুরোপুরি কেটে গেল। বাকি পথ নাক ডাকা শোনা আর রাস্তার পাশের সবুজ দেখতে দেখতে যাওয়া।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সিরিজটা চালিয়ে যাও। খুব নিয়মিত হবার দরকার নেই, তবে একেবারে গায়েব হয়ে যেও না। আজ থেকে বিশ বছর পর এই ব্লগ দেখলে অনির্বচনীয় আনন্দ পাবে, আজকের নীলকান্ত'র জন্য কষ্ট পাবে - সেসবের তুলনা নেই। তাছাড়া এগুলো পিরিয়ড পিস। তাই খুঁটিনাটি বর্ণনা একটু বাড়াও।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Amit এর ছবি

আম্রিকায় ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ক্রেডিট রেটিং বাড়াবেন কি করে? গাড়ি , বাড়ি সবকিছুতেই তো ক্রেডিট রেটিং চায়

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আমাদের এদিকে (আটলান্টা-নিউইয়র্ক) আরেকটা বাস চলে যেটাকে আমরা চায়না বাস ডাকি। মাত্র ৩৫ ডলারে কিভাবে এতটা পথ নিয়ে যায় সেটা একটা গবেষণার বিষয়। মেগা বাসের মত খুব বেশি আগে টিকিট কাটা লাগে না, আগের দিন কিনলেও একই দাম।
কিছুদি আগে এক চাচা-চাচীকে তুলে দিতে গিয়েছিলাম, দেখা গেল বাস আসে নি। একটা ভ্যান এসে কয়েকজন যাত্রীকে নিয়ে চলে গেল। কম যাত্রী থাকায় বাস দেয়নি। অনেকটা পথ ছোট ‌ভ্যানে করে নিয়ে পরে কয়েকশ মাইল দূরের বাসস্ট্যান্ডে জড়ো করে পরে সেখান থেকে বাস ছাড়বে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর লেখা আগের মতই। আর লিখে যান। বেশ এগোচ্ছে।

---------------------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/2015/05/for-blogger-to-blogger.html

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক আম্রিকার বাসে চড়তে মনছে দেঁতো হাসি

দেবদ্যুতি

আয়নামতি এর ছবি

জীবনের ভীড়ের গল্প পড়তে ভালোই লাগছে। পাণ্ডবদার কথা মতো লাইনে আসুন দেঁতো হাসি

তিথীডোর এর ছবি

ক। যা মন চায় লিখে রাখুন। বুড়োবয়সে স্মৃতিচারণে কাজে আসবে।

খ। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া শ্যামচাচার দেশে টেকা মুশকিল। ফেরার ইচ্ছে থাকলে অবশ্য না করলেও চলে।

গ। গ্রে হাউন্ডে অস্টিন যাবার টিকেট কেটে, কপালদোষে না গিয়ে ২৭৫ ডলার লস খেয়েছিলাম। ওই বিলাপ সুযোগ পেলেই করি। লেখা পড়ে আবার মনে পড়ে গেলো আর কী।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

এক লহমা এর ছবি

আমরা এইরকম একটা লস খেয়েছিলাম আগে থেকে কিনে রাখা একটা বেড়াতে যাওয়া বাতিল করে। কপালদোষে না মূর্খামি (আমাদেরটায়) সে ক্যাচালে আর না যাই। চোখ টিপি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এক লহমা এর ছবি

আমি এক্কেবারে আয়নাদিদির মন্তব্যটাই টুকে দিই। হাসি
"জীবনের ভীড়ের গল্প পড়তে ভালোই লাগছে। পাণ্ডবদার কথা মতো লাইনে আসুন" দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।