দুয়ারে দুঃসময়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৮/০৭/২০১০ - ৮:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জহিরুল ইসলাম নাদিম

ঘুমটা যখন ভাঙল তখন ঘড়ির কাঁটা ভোর পেরিয়ে প্রায় দুপুর অব্দি পৌঁছে গেছে। গত রাতটা কেটেছে সীমাহীন যন্ত্রণার মাঝে। সিগারেটের পর সিগারেট শেষ করেছি আমি। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করেছি শুধু। বুকের মাঝখানটায় একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেছি সারাক্ষণ-যতক্ষণ জেগেছিলাম। ঘুম আসবে না জানতাম। কিন্তু সারারাতের ক্লান্তিতে ভোরটা পেরুতে পারিনি। ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই ঘুম আমাকে নিয়ে এসেছে এই সময় পর্যন্ত। সাড়ে এগারোটা বাজে এখন। জেগেই উঠে পড়লাম না। বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকলাম। চোখ গেল দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটায়। সেখানে দেখলাম সবকটা তারিখকে অতিক্রম করে এসে আজকের তারিখটা কেমন জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ দেখি সেই সংখ্যাটি সংখ্যাগুলো হয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা ছেড়ে উড়ে উড়ে এসে পড়ছে ঘরের সর্বত্র। কোনোটা শূণ্যেই ঝুলে থাকছে। ছোটো থেকে বড় হচ্ছে ক্রমশঃ। যেন পুরো ঘরটাসহ আমাকে গ্রাস করে নেবে এক্ষুণি। সংখ্যাটি ব্যঙ্গ করছে আমাকে! শরীরটা কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে চিৎকার করতে গিয়ে ঘোরটা কেটে গেল। প্রায় ঘেমে গেছি তখন। আজকাল এমনই হয়। কিছুতে মনোযোগ দিতে পারিনা। ঘোর চলে আসে। হঠাৎ বসা থেকে উঠলে চোখে সর্ষে ফুল দেখি।

বাইরে বেরিয়ে দেখি রোদ বেশ তেতে উঠেছে। রাস্তা প্রায় জনশূণ্য। আমি নিরুদ্দেশের পথে হাঁটতে লাগলাম। সূর্যের তেজ মনে হলো মাথার ভেতরকার উদ্ভট বস্তুগুলোকে গলিয়ে ছাড়বে। আমিও তো তাই চাই। সূর্যতেজে স্মৃতিগুলো কেন গলে ঝরে যায় না? আজকের দিনটাকে আমি এমনি এমনি শেষ করে দিতে চাই। আজকের কোনো স্মৃতি যেন মাথায় না থাকে। আজকের দিনটা আমার জন্য বড় বিস্মরণীয় দিন। এই দিনটাকে আমি কোনোদিন মনে করতে চাই না, কোনোদিন না। আর এই দিনটাই কিনা অণির জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হলো! এমন দিন মানুষের জীবনে দুবার আসে? মাত্র কদিন আগেও ওর সুখ আমার সুখ হোত। অনির দুঃখে অভি ব্যথী হোত। আজ কার ইশারায় দুজন এমন বিপরীত আধানে চার্জিত হয়ে গেলাম?

আমি তখন জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটির ছাত্র। অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছি। ফাইনাল ইয়ার। একদিন দূর থেকে অনিকে দেখলাম। তখনো নাম জানা হয়নি। ওর ডাগর চোখের অদ্ভুত চাহনি আমার সবকিছু ওলট-পালট করে দিলো। আমার ভাবনার বৃত্তে শুধু ওর প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হয়ে গেল। আমি কখনো কবিতা লিখিনি। তেমন পড়িওনি। সেদিন রাতে জীবনানন্দ পড়তে গিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমার ভাবনার নায়িকাকে উনি এতো নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করলেন কীভাবে! বাংলায় ভালো বলে আমার সামান্য নাম ডাক ছিল। একদিন লাইব্রেরীতে ওকে ঢুকতে দেখে ঢুকলাম পিছুপিছু। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। কী বলব? ওকে নিয়ে আমি বিস্তর ভেবে ফেলতে পারি কিন্তু মুখে কি বলতে পারি সে সব? আমি কি লেখক? ওর মুখোমুখো একটা বই নিয়ে বসে থাকলাম। কিন্তু পড়াশোনার বিষয়ে ও নিজেই যখন অকল্পনীয় ভাবে এগিয়ে এলো তখন ঠিক চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দ পেয়েছিলাম।

এর পরের ঘটনাগুলো ছন্দময়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। একে অপরের কাছাকাছি চলে আসা। হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটা। কেন্টিনে আড্ডা মারা। ইত্যাদি। কিন্তু জীবনে তো সুখ অনন্তকাল থাকে না। আমাদের সম্পর্কের কথাটা ক্যাম্পাসের গন্ডি ছাড়িয়ে শহরের অলি-গলিতে প্রচারিত হয়ে গেল। যথারীতি অনির বাবার কানেও। একদিন ডাকলেন উনি আমাকে। আমি গরীব ঘরের সন্তান। লেখাপড়া কবে শেষ হবে ঠিক নেই, হলেও চাকরি জুটবে কি না তাতেও আছে সন্দেহ। অনি ধনী বাবার মেয়ে। ওদের গাড়ির শোফারও আমার চেয়ে ওয়েল অফ। ভদ্রলোক সিনেমাটিক কায়দায় আমাকে সূক্ষ্মভাবে অপমান করলেন। ওর সাথে সম্পর্কের ইতি টানতে সুপরামর্শ দিলেন। আমি রাগে ক্ষোভে চলে এলাম। একদিন শুনলাম অনির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। বছরখানেকের মধ্যে বিয়ে। এর মধ্যে অনি অবশ্য আমার সাথে একাধিকবার দেখা করেছে। কিছু সাহসী কথা বার্তাও বলেছে। আমি এগুইনি। ওর কাছে জীবনের মানে যা আমার কাছে তো তা না। আমি লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। লজ্জা অথবা বিরক্তিতে ভার্সিটি যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলাম এক সময়। এক ধরনের হতাশায় পেয়ে বসল আমাকে। ঘরে বাবা মায়ের অসহায় মুখ আর ব্যক্তিগত জীবনে পরাজয় আমাকে উদভ্রান্ত করে তুললো। রাতে ঘুম কমে গেল। প্রথম প্রথম একটা রিলাক্সেন খেলেই চলতো। এখন চারটা লাগে। একদিন যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের আশায় কজন বন্ধুর পরামর্শে নেশা ধরলাম। মদ, মরফিন ছেড়ে এখন হেরোইনে এসেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আর বেশিদিন নেই। আমি শেষ হয়ে গেছি, যাচ্ছি। দ্রুত!

এসব ভাবতে ভাবতে অনেকটা এসে পড়েছি। সূর্যের তেজটা খানিকটা বেড়েছে। ঘেমে আমার চেহারাটা এখন দেখার মতো! একটা বাস পেয়ে উঠে পড়লাম। এই শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারলে বেশ হয়। একটা কথা আছে না-আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড। আজ অনির সাথে সম্পর্কচ্ছেদের এক বছর পুরলো। আজই ও আমার কাছ থেকে চিরদিনের মতো আলাদা হয়ে যাবে। আজ যে ওর বিয়ে! কন্ডাকটর ভাড়া চাইতে এলে খুঁজে দেখি মানিব্যাগটা আনা হয়নি। তাছাড়া আজকাল ওটা খালিই থাকে। ভাড়া নেই শুনে কালো মতো লোকটা গজর গজর করতে লাগলো। অন্যদিন হলে ওর তলপেট বরাবর একটা লাথি কষতাম। আজ কেন যেন খারাপ লাগলো। পরের স্টপেজে নেমে গেলাম ভাড়া না দিয়েই। আমাকে বেশ খারাপ খারাপ গালি দেয়া হলো শুনলাম। কিন্তু রেগে গেলাম না। আশ্চর্য!

আবারো হাঁটছি। এবার বেশ খিদে পেয়েছে। হঠাৎ দেখি রাস্তাটা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলেছে। কোনদিকে যাবো? রাস্তার কিনারে মিনি পার্কগুলোতে ছোটো ছোটো ফুল ফুটে আছে। খুব সুন্দর তো! দুটো প্রজাপতি ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ডাইনের রাস্তাটা ধরলে বাসায় ফেরা যায়। বাসা মানেই যন্ত্রণা, যন্ত্রণা মানেই নেশা, নেশা মানেই মৃত্যু। আর বাঁয়েরটা ধরলে সাইনবোর্ড অনুসারে ‌'সরকারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে' যাওয়া যায়। কটা ফুল আর প্রজাপতি আমায় পথ দেখিয়ে দিলো। আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছে করছে। অনিকে আমি ভালোবাসতাম-এখনো বাসতে পারি। মানুষ কেন যে প্রেমের সাথে বিয়েটা জড়িয়ে ফেলে! সারাটা জীবন ওর শুভকামনায় কাটিয়ে দিলেই বা ক্ষতি কী? কেমন যেন একটা দৃঢ়তা এসে ভর করলো আমার পায়ে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমি বাঁয়ে যাবো। যাবোই।।


মন্তব্য

তুহিন এর ছবি

ধন্যবাদ চমতকার লেখার জন্য। সন্দেহ নেই, আমাদের যুবসমাজের সবারই যদি আনার গল্পের নায়কের মত সঠিক রাস্তা নির্বাচনের এবং সে পথেই চলার মানসিক ক্ষমতা থাকত, তা সকলের জন্যই ভাল হত। কিন্তু, মানুষ কেন যেন দেবদাসকেই মনে রাখে আর তাকেই উদাহরন হিসাবে ব্যবহার করে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তুহিন!

আনিক এর ছবি

খুব কমন কথা গুলি খুব সুন্দর করে লেখা । কিন্তু যে অনির জন্য আজ এই অবস্থা সেই অনি কিন্তু ভালই থাকবে সারাজিবন। আমরা কেন এই একমাত্র জীবন তা নস্ত করব। আপনার নতুন জীবন সুন্দর হক।

তিথীডোর এর ছবি

বাহ্‌!
পোস্টের শিরোনামে চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর আপনার মন্তব্যের জন্য। কষ্ট করে যে পড়েছেন সে জন্য কৃতজ্ঞ।

জহিরুল ইসলাম নাদিম

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

দুয়ারে দুঃসময়। ঘরে ঢুকে না বাইরে যায়?
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

বুঝতে পারিনি!

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালোই লাগলো। পড়ে এক ধরণের "ফিল গুড" ভাবটা আসে

অতিথি লেখক এর ছবি

এটা কার ফিলিং জানতে পেলে ভালো লাগতো বিশেষ।

জহিরুল ইসলাম নাদিম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।