বালকবেলা - ০

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি
লিখেছেন ত্রিমাত্রিক কবি (তারিখ: রবি, ০১/০৮/২০১০ - ৫:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেক যায়গায় শোনা কথা-'মৃত্যুর আগে নাকি মানুষের জ়ীবনের প্রায় সব স্মৃতি একবার ফ্ল্যাশব্যাক হয়', কথাটার সত্যমিথ্যা যাচাই এত তাড়াতাড়ি করতে চাইনা আপাতত।আমারও জীবনের অনেক স্মৃতি কিছুদিন ধরে ফ্ল্যাশব্যাক হচ্ছে।কারণটা অবশ্য মৃত্যু না বোধহয়।দেশ থেকে চলে যাওয়ার আগে আমার মৃত্যুর একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে!যেহেতু মৃত্যুর সময় ফ্ল্যাশব্যাকগুলা কারও সাথে ভাগাভাগি করার সুযোগ পাব না, তাই সুযোগটা এখনই নিচ্ছি।

বালকবেলার কথা মনে হলে আমার মনে পড়ে, বিকাল পাঁচটার কথা।আমাদের বাসার সামনে ছিল পুলিশলাইন।রাস্তার ঠিক উল্টাদিকে।বিকালে প্রতিদিন বারান্দায় চলে যেতাম।ঠিক পাঁচটায় পুলিশলাইন এর একটা বিল্ডিং এর মাথায় তিনটা পুলিশ উঠত।তারপর তিনজন তিনটা বিউগল বাজাত।সেইসময় পুলিশলাইনের ভিতরে যত লোক থাকত সবাইকে যে যেখানে আছে দাঁড়িয়ে যেতে হত।কারণটা জানা ছিল না আমার, কিন্তু এই দৃশ্যটা দেখতে আমার খুবই ভাল লাগত।বিউগল বাঁজার সাথে সাথে আমিও দাঁড়িয়ে যেতাম বারান্দায়।প্রায় এক মিনিটের নীরবতা পালন করতাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে।আমাদের বাসা ছিল তিন তালা, পুলিশলাইনের প্রায় পুরাটাই দেখা যেত।মাঝে মাঝে দু-একজন বিউগল শুনেও পাকনার মত হাটার চেষ্টা করত।আম্মুর কাছ থেকে শুনতাম এদের নাকি জরিমানা দিতে হত।সব পুলিশলাইনেই কি একই সিস্টেম?এই সিস্টেমের কারনটা আমার কাছে এখনও ঠিক স্পষ্ট না, কিন্তু বালকবেলার বারান্দায় দাঁড়ানো এই স্মৃতিটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে।

বাসার ঠিক বামদিকে রাস্তার উল্টাপাশে ছিল একটা রেন্ট্রি গাছ, এক্কেবারে পুলিশলাইন ঘেষা।ছোটবেলায় অবশ্য ওটাকে শীলকড়ই নামেই চিনতাম।বিশাল একটা গাছ ছিল ওটা, আর তাতে ছিল একটা বেশ বড়সর একটা কোটর।রাতের বেলা প্রায়ই শুনতাম পেঁচার ডাক।দিনের বেলা দেখা দিত না কখনও।রাতের বেলা মাঝে মাঝে কোটরের পাশে বের হয়ে আসত পেচাটা, আর ওরকম অদ্ভূত ডাকাডাকি।তখনও জীবনানন্দ পড়ার বয়স হয়নি, জীবনানন্দের নামই শোনার কথা না।কিন্তু পেঁচার সাথে আমার কেন যেন একটা প্রেম হয়ে যায়।রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকালে ওই ছোট্টবেলার পেঁচার কথা মনে পড়ে।জীবনবাবুর পেঁচাও আমারে কাছে ওই রাতের জানালা দিয়ে দেখা কড়ই গাছের পেঁচাই।কড়ই গাছটাকে খুব আপন মনে হত কেন যেন।একবার প্রচণ্ড ঝড়, বাসার অনেকগুলা জানালার কাঁচ টাচ ভেঙ্গে গেল, আর ভেঙ্গে গেল আমার ওই কড়ই গাছের একটা অনেক বড় ডাল।ওই ঝড়ের পর পেঁচাটাকে আর দেখেছিলাম কিনা, ঠিক মনে পড়ে না।তখন আমি অনেক ছোট।

তখন অনেক নিয়ম কানুনই বেশ খুশি মনেই মানতাম মনে আছে।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তাম।আব্বুকে মসজিদ থেকে ফজর পড়ে আসতে দেখেছি অনেকদিনই।আব্বুর খুব প্রিয় ছিল মধু, আমারও।রাতের রুটি বানানো থাকত।আব্বু সকালবেলা রুটি আর মধু খেত।আমিও খেতাম, কিন্তু আমি বড় রুটিগুলাকে স্টিলের গ্লাস দিয়ে একরুটি থেকে তিনটা বানাতাম কেটে কেটে।মাঝে মাঝে মনে হয় আমার জন্যে ছোট রুটিও বানানো হত।এখনকার মত অলস তখনও হইনি, আব্বুর সাথে প্রায়ই সকালে বাজারে যেতাম।মনে আছে বাসা থেকে বের হয়ে বাম দিকে যেতে হত, কড়ই গাছটার ঠিক ভেঙ্গে পড়া ডালটার নিচ দিয়ে।তখনও বোধহয় ডালটা ভাঙ্গেনি।ভাঙ্গার পর আর বাজারে গিয়েছলাম কিনা মনে পড়ে না।এত ছোটবেলার স্মৃতি দিন তারিখের হিসাব রাখে না।

বাজার থেকে আসার পথে রাস্তার ডানদিকে একটা কামারবাড়ি পরত।আব্বুর সাথে প্রায়ই দাঁড়িয়ে যেতাম ওখানে।একদিকে দেখতাম হাপর টানা আর একদিকে একটা লাল টকটকে তপ্ত লোহা বের করে এনে প্রকাণ্ড হাতুরি দিয়ে সেটাকে পেটানো।তারপর পাশে রাখা পানিতে ছেড়ে দেয়া।ছ্যাননননন একটা শব্দ, লাল থেকে আবার কাল হয়ে যাওয়া।খুবই আকর্ষণীয় মনে হত কাজটা, ওই বয়সে দু-একবার কামার হতে কি ইচ্ছে করেনি?এখন ঠিক মনে পড়ে না।শুধু মনে পড়ে সেই ছ্যানননন শব্দ আর তপ্ত লোহার লাভা লাল।

আমার ছোট চাচা তখন আমাদের সাথেই থাকত।আমরা চাচাকে কাকু বলতাম।সেই কাকু ছিল মনে হয় আমার চাইল্ডহুড হিরো।আমাদের বাসায় সাধারণত সাদা পেস্ট ব্যাবহার করা হত।তো কাকু একদিন একটা লাল জেল পেস্ট কিনে নিয়ে আসে।আমারতো আর সাদা পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করা চলে না।কাকুও আসলে তখন ছোটই ছিল।ইন্টার পড়ত মনে হয়।একটা পিচ্চি ভাইস্তার হিরো হওয়াটাকে সেও মনে হয় উপভোগ করত।আমার সাথে অনেক রকম ভাবসাব নিত।তো পেস্ট কেনার পর তার ভাবসাব আরও বেড়ে গেল।প্রতিদিন সকালে কাকুর ঘরের সামনে গিয়ে আমাকে ইংরেজীতে বলতে হত-'আঙ্কেল, আঙ্কেল ওপেন দ্যা ডোর'।স্কুলে তখনও ভর্তি হইনি, কেবল এ,বি,সি,ডি শেষ করে দু-একটা ইংরেজী শব্দ পারি কেবল, বাক্য গঠন তো দূরের কথা।কাকুকে তাই ভাবতাম ইংরেজীর জাহাজ।

আর একটা কথা মনে পড়ে ওই কাকুকে নিয়েই।একদিন কাকু একটা ছুরি কিনে এনেছে, আসলে কেমন ছিল এখন ঠিক মনে নেই, কিন্তু এটুকু মনে আছে, ওই সময় মোটামুটি ছুরিটার দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম।সুযোগ পেয়ে কাকুও ভাব নিতে ছাড়ল না।তখন সন্ধ্যাবেলা, খাটের উপর বসে, আমি আর আম্মু, ছোট ভাইবোনও নিশ্চয় ছিল, ওদের কথা ঠিক মনে পড়ছে না।কাকু আসল, হাতে ছুরিটা নিয়ে।তারপর আমাকে বলে, আমি যদি ছুরির ইংরেজি বলতে পারি আমাকে তাহলে ছুরিটা দিয়ে দিবে।আমি তো মহা ফাঁপরে পড়লাম, একদিকে ছুরিটা আমার চাইই, অন্যদিকে ইংরেজিও জানি না।তখন কেবল, বিএটি-ব্যাট, সিএটি-ক্যাট আর দু-একটা মুখস্ত বাক্য শিখছি-do so-এরূপ কর, বা, সে হয়-he is, সে (স্ত্রী) হয়-she is, ছুরি-কাঁচির ইংরেজি শেখার সময় তখনও আসে নাই।পরে আমি ছুরিটা ঠিকই পাই এবং বাজিতে জিতেই।

আজকে বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, মডু ভাইরা চাইলে আশা করি পরের পর্বে বলতে পারব খুব তাড়াতাড়িই।
__________
ত্রিমাত্রিক কবি
ই-মেইলঃ


মন্তব্য

নীড় সন্ধানী এর ছবি

‍‌স্মৃতিকথা লিখতে এবং পড়তে দুটোতেই আনন্দ। বর্ণনাগুলো এত চমৎকার হয়েছে যেন চোখের সামনেই দেখছি।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
এ ভ্রমণ, কেবলই একটা ভ্রমণ- এ ভ্রমণের কোন গন্তব্য নেই,
এ ভ্রমণ মানে কোথাও যাওয়া নয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মুস্তাফিজ এর ছবি

চলুক

...........................
Every Picture Tells a Story

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ে খুব ভাল লেগেছে!! ভাল থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

একটু কনফিউশানে ছিলাম লেখাটা দিয়ে।লিখে কেমন যেন খালি খালি লাগছিল, মনে হচ্ছিল কিসের যেন একটা অভাব।যাক, তাও আপনাদের ভাল লাগল বলে একটু তৃপ্তি পেলাম।
__________
ত্রিমাত্রিক কবি

তিথীডোর এর ছবি

ভাল্লাগলো.. হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি
__________
ত্রিমাত্রিক কবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।