শিরোনামহীন

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি
লিখেছেন ত্রিমাত্রিক কবি (তারিখ: শুক্র, ২৯/০৭/২০১৬ - ৭:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্যস্ত শহরের মধ্যে হুট করে একটা নির্জন রাস্তা আর সারি সারি নাম জানা বৃক্ষের নির্বাক দেয়াল। রাস্তার সংক্রামক নির্জনতা প্রতিদিন নিয়ম করে রাত নিয়ে আসে পৃথিবীতে। তখন সমস্ত শহর সেই রাস্তার মতো নির্জন। রাতজাগা নিয়ন বাতি আর স্পিডলিমিট অতিক্রম করে চলে যাওয়া দুই একটা মোটরকারের পদশব্দ শহরের সবুজকে আরেকটু নির্জন করে, মানবিক করে। হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে গেলেই কোনো অলৌকিক রাস্তার পাশে পার্ক করা সারি সারি গাড়ি। বাড়ির ওপর নানা ঢঙে লিখে রাখা নম্বরপ্লেটগুলো জোরে জোরে পড়তে পড়তে হাঁটতে থাকলে অনেক বাড়ির সামনে সয়ংক্রিয় বাতি জ্বলে ওঠে। নির্জন রাস্তায় হঠাৎ জ্বলে ওঠা বাতির সামনে নিজেকে পতঙ্গের বিপরীত কোনো অদ্ভুত জীব মনে হয়। মনে হয় আমাকে দেখে কি কোনো আলো জ্বলবার কথা ছিল?

এরকম চলতে চলতে হঠাৎ আলোকিত নির্জনতায় অচেনা কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যাবো। দুইজন সাইকেল আরোহী আমাকে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে যাবে। পাশের বাড়ির ভেতর থেকে একটি নাগরিক কুকুর নগরের সমস্ত নিয়ম মেনে অপরিচিত কোনো মানুষের গন্ধে কিছুটা স্মৃতিকাতর হবে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখব। হঠাৎ আমার সেই সাইকেল আরোহীদের কথা মনে হবে। মনে হবে তাঁদের হয়ত বামে যাবার কথা ছিল।

এখানে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ানো যেতে পারে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে বাড়ির সামনে জ্বলে ওঠা বাতি আবার সংক্রিয়ভাবে নিভে যাবে। তখন কিছুটা স্বস্তি। ফেরার তাড়া নেই। কেউ কোথাও অপেক্ষা করে নেই। যে বাড়িটার সামনে আমি দাঁড়িয়েছি তার সামনে ছোট্ট একটু উঠান। এখানে বোধহয় লন বলে। একটা রঙ্গিন দোলনা ঝোলানো আছে সেখানে। আর ছোট্ট কয়েকটা মূর্তি। তাদের মধ্যে একটা সান্তাক্লজের। বাকিগুলো চিনতে পারি না। ক্রিসমাস সময় নয় এখন। সম্ভবত গত বছরের উপহার। কিছুই না জেনেও শুধু একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েও বাড়ির ভেতরের গল্প কখনও কখনও অল্প অল্প জানা হয়ে যায়। কিন্তু জানা হয় না বেশিরভাগই। দোলনায় চড়ে যে ছেলেটা বা মেয়েটা আগামীকাল দোল খাবে তার এতটা নিকটে কখনও কি আসা হবে আর?

লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা বই পড়তে গিয়ে একই ধরণের অনুভূতি হয়েছে অনেক বার। পুরো বইয়ের একটি বিশেষ পাতা কেটে নিয়েছে কোনো দুর্বৃত্ত পাঠক। অভদ্ররকম বিরক্তির সাথেও জানতে ইচ্ছে হয়েছে, কী তার গল্প। বইয়ের পাতার ভাঁজে বাজারের লিস্ট। আলু, শিম, বরবটি আর ফুলকপির কথা আছে সেই লিস্টিতে। সবজির নাম দেখে বোঝা যায় এই গল্প নিশ্চয়ই শীতকালের গল্প। আমি সেই লিস্টটা বই থেকে বের করে ফেলি। আমার শেলফের কোনো একটা বইয়ের ভাঁজে তার নতুন সংসার। ঢাকা শহরের কোনো নির্জন বা ব্যস্ত কোনো গলির কোনো সুখী বা অসুখী কোনো দম্পতির সংসারের একটি ফর্দের স্মৃতি বয়ে বয়ে বেড়াবো আমি। এই কি জীবন?

আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চারদিক থেকে চারটা রাস্তা এসে মিশে গেছে। চার রাস্তার মোহনায় একটা সৌভাগ্যবান বর্গক্ষেত্র। সেই বর্গক্ষেত্রে নিরাপদে প্রবেশ করতে হলে রাস্তায় চলমান যান্ত্রিক যানদের লালের ওপর সাদা দিয়ে লেখা একটা আদেশ মানতে হয়। বর্গক্ষেত্রের চারদিকে অপেক্ষমান যন্ত্রযান। এত রাত্রে অবশ্য বর্গক্ষেত্র এই শহরের মতই নির্জন। অনেক্ষণ অপেক্ষার পর কোনো যানবাহন এলে অন্য অপেক্ষমাণ যানের জন্য দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয় না।

আমার জন্য এই বিশেষ আদেশ মানার বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়। বরং কিছুক্ষণ দাঁড়ানো যায়। এক পাশে ছোট্ট একটা পার্ক। পার্ক মানে একটা মাঠের মতো জায়গা, কয়েকটা বাচ্চাদের দোলনা আর টেনিস খেলার কয়েকটা কোর্ট। নির্জনতা ভেদ করার ব্যর্থ চেষ্টায় কয়েকটা ফ্লাডলাইট টেনিস কোর্টের দিকে মুখ করে নির্লজ্জের মতো জ্বলে আছে। একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। আবার হুশ করে চলে যায়। রাস্তার পাশের ছাইরঙ্গা বাড়িটার জানালার দিকে তাঁকিয়ে গতকালের মতো আজকেও দোতালায় রাখা টিভির পর্দায় চোখ রাখা যেতে পারে। তাঁরা কি কখনও জানতে পারবে, গভীর রাত্রে একটি সৌভাগ্যবান বর্গক্ষেত্রের সামনে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন যুবকও তাঁদের সাথে চোখ রেখেছিল একই টেলিভিশনের পর্দায়?

অবশেষে বামে যাবো, সিদ্ধান্ত হয়। সাইকেল আরোহীদের যে পথে যাবার কথা ছিল সেই পথ। লাল রঙের একটা ফায়ার ফাইড্র্যান্ট ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের বেশ খানিকটা জায়গায় কোনো গাড়ি পার্ক করা নেই, থাকার নিয়ম নেই। অদ্ভুত সব নিয়মের এই শহরে গাড়িদেরও নিয়ম মেনে চলতে হয়। একটা একটা করে বাড়ি পেরিয়ে যাই আর প্রযুক্তির কল্যাণে নিয়মিতভাবে আলোকিত হতে থাকি। আমার বারবার মনে হয়, আমাকে দেখে আসলেই কি কোনো আলো জ্বলবার কথা ছিল?


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

মাস্টার্স করার সময় আমার বাসার কাছে একটা ল্যাম্পপোস্ট আমি হেঁটে ফিরবার সময় আমি কাছাকাছি আসলেই নিভে যেত। আপনার উল্টা অবস্থা। আমি ভাবতাম ব্যাটা ল্যাম্পপোস্ট জেনে গেছে আমি দরিদ্র ছাত্র ট্যাক্স দেইনা, তাই আমার জন্য বাতি বরাদ্দ রাখে নাই।

..................................................................
#Banshibir.

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

এখন তো আর দরিদ্র নাই। বড়লোক মানুষ। এখন নিশ্চয়ই আপনার জন্যে বাতি বরাদ্দ থাকে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বাসার নিচে দিব্যি বাজার। একলা ফেরার পথে মানুষের মুখ খুঁটিয়ে দেখি- এই শালা কিংবা ওই ব্যাটারও নিশ্চয়ই গল্প আছে কোনো। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। কুত্তার মতো বাসের হর্ন বলো আর ক্যাতক্যাতে কুৎসিত কাদা বলো, সবাই মিলে মিশে ফাউল করা শুরু করে দেয়।

রাস্তায় লাগানো সোডিয়ামের বদলে এনার্জি সেভিং এর কল্যাণে হলদে আলো সাদা হয়ে গেছে। কুয়াশা জমে সেখান থেকে ডানা ঝাপটে কোনো ক্ষ্যাপাটে ভাবনা আমাদের জন্যে ছুটে আসে না। আমার শহরে আলো কেউ জ্বালে না।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আমাদের শহরে কেউ কোনো একদিন নিশ্চয়ই আলো জ্বালবে। হয়ত সুহানই জ্বালবে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মুস্তাফিজ এর ছবি

লেখা পড়ে তোমাদের এই ছবিটার কথা মনে পড়লো

...........................
Every Picture Tells a Story

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

খুবই দারুণ কয়েকটা দিন ছিল, মুস্তাফিজ ভাই। কুয়াশায় আপনার ক্যামেরা হাতে একটা সিলোউট ছিল। বাসায় ফিরে খুঁজে বের করব।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখকের বিবেচনার জন্য প্রথমে কতিপয় অযাচিত পরামর্শ দেই।
- বাতির প্রযুক্তি যেহেতু খুব দ্রুত পালটে যায় তাই 'নিয়ন বাতি' না বলে শুধু 'রাতজাগা বাতি' অথবা 'রাতজাগা বিজ্ঞাপনের বাতি' বলাযেতে পারে।
- বাজারের ফর্দের গল্প থেকে 'ঢাকা' নামটা বাদ দেয়া যেতে পারে।
- সাইকেল আরোহীদের ডানে বা বামে যাবার ব্যাপারটি খুব নির্দিষ্ট করে না বলে আরেকটু vague-ভাবে বলা যেতে পারে।
এই পরামর্শগুলো দেবার উদ্দেশ্য লেখাটিকে স্থান ও কালের ফ্রেমের বাইরে বের করে নিয়ে আসা।

পঞ্চম অনুচ্ছেদটা সম্ভবত এই লেখাটার অপারেটিং পয়েন্ট। তবে এই অংশটি একটু অস্পষ্ট হয়ে গেছে। লেখার দৈর্ঘ্য বেশি হলে এই অস্পষ্টতাটা হয়তো কেটে যেতো, কিন্তু তাতে লেখাটা ঝুলে যাবার আশঙ্কা তৈরি হতো। অস্পষ্টতার ডিমের খোলসটা হয়তো ভাঙার উপায় আছে, কিন্তু সবসময় সেটা ভাঙার হয়তো দরকার নেই।

লেখাটা যখন পড়া শুরু করি তখন প্রথম অনুচ্ছেদটা পর পর চার/পাঁচ বার পড়লাম। মনে হলো কাব্যের রস গদ্যের পরতে পরতে ঢুকে সেটাকে পরিপূর্ণ করে তুলছে। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। তাই কবি গদ্য লিখলেও সেটা কাব্যিক হয়ে যায়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চমৎকার মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এরকম মনযোগী পাঠকের মন্তব্যে সবসময়েই ঋদ্ধ হই। আপনাকে শুভেচ্ছে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

অপরিচিত বাড়ির শুধু কুত্তাটাই গায়ের গন্ধ চেনে, আকি কুত্তার মালকিনও চেনে?
স্টকিং-এর মামলা হইতে সাবধান কইলাম চোখ টিপি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

মালকিন চিনলে কি আর বোলোগ লেখার সুমায় থাকত?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

সব কিছুরই নিজস্ব একটা গল্প থাকে। কখনো কখনো সেই গল্পের সাথে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করি। অনুভব করার চেষ্টা করি।

ভিন্ন ধাঁচের লেখা!! ভাল লেগেছে।
_______________
আহমাদ মুহাইমিন

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আশ্চর্য! লেখাটা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল কিভাবে।
এরকম গদ্য বারবার পড়েও পুনরাবৃত্তির বিরক্তি আসে না।
পড়া শেষ করে একটা বাক্য মাথায় ঘুরছে - রাতজাগা শহরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পথিক।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, সন্ধানীদা। আছেন কেমন?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।