পরী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৩/০৮/২০১০ - ১০:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দরজা খুলতেই দেখলাম মেয়েটিকে; বয়স বার-তেরর বেশী হবে না। বোধহয় কাগজ কুড়াতে এসেছে। কিছুটা অবাক হলাম। এমন নয় যে হোস্টেলে সকালে কাগজ কুড়াতে কেউ আসেনা, বরং প্রায় প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভেঙে যায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের চিৎকার চেচাঁমেচিতে। শুধু আমার ঘুম ভাঙে তাও নয়; পাশের রুমের রিফাত মাঝেমাঝে দরজা খুলে কড়া বকা লাগায়, তারপর আবার দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার অবশ্য বাচ্চাগুলোর কারণে বেশ সুবিধা হয়, ভোরে ঘুম থেকে উঠে কিছুটা সময় বাইরে হাঁটাহাঁটি করে আসতে পারি, সকালের বাতাসে ভেতরের কবি ভাবটা জেগে ওঠে; ডায়রির পাতাগুলোর সদ্ব্যবহার হয়। নয়তো ঘুম ভাঙে সেই সকাল সাড়ে সাতটার সময়, উঠেই আটটার ক্লাস ধরতে টুথব্রাশ হাতে বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়; প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দাঁড়াতে হয় লম্বা লাইনে, আর যদি সেই লাইনে আলম কিংবা রাশেদ আগে থেকেই দাঁড়ানো থাকে তাহলে কম্ম সাড়া! ‘পৃথিবীর সব মহৎ চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে বাথরুমে’, এই বিশ্বাসে তারা দু‍‌জন পরম বিশ্বাসী এবং মহৎ কোন চিন্তা মাথায় আনতে তাদের মত উৎসাহী মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সেক্ষেত্রে সকালের ক্লাস অথবা প্রকৃতির ডাক, যে কোন একটা বিষয়ে ছাড় দিতেই হয় এবং সেটাই ভয়ঙ্কর; সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা আমাদের বেরসিক স্যাররা সবচেয়ে সকালে রাখেন, আর প্রকৃতির ডাক...!!! যে মানব সন্তান সে ডাকে সাড়া দিতে চেয়েও পারেনি, সে ই কেবল বুঝবে এর যাতনা। সমগ্র বিশ্ব-সংসার যেন তছনছ হয়ে যায়! তারপরও সবাই ক্লাসের আধঘন্টা আগে উঠেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়; হোস্টেলে এটাই নিয়ম। কেউ যদি মনে করে থাকে হোস্টেলে থাকলে ছেলে-পেলেরা গোছালো হয়, তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করে।

সেইদিক বিবেচনায় বাচ্চাগুলোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ওরা আমার মধ্যে একটা শৃংখলার আভাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যার দরুণ আজকাল চেচাঁমেচি ছাড়াই ঘুম ভেঙে যায়। যাই হোক, মেয়েটির কথা বলছিলাম। ভোরবেলায় ওকে দেখে অবাক হলাম কারণ প্রথমত: সে একা ছিল; বাচ্চাগুলো বোধহয় তাদের সম্পদ বেদখল হবার শোকে কাতর হয়ে ফিরে গেছে, আর দ্বিতীয়ত: তার বয়স। মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা...কিংবা কালোই বলা চলে, বেশ লম্বা, মুখশ্রী চলনসই, চোখ দু’টোয় শৈশবের সরলতা এখনো বিদ্যমান কিন্তু শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লেগে গেছে। এতবড় একটা মেয়েকে ভোরের নির্জনতায় ছাত্র হোস্টেলে ঠিক মানায় না। হয়তো তার বাবা-মা তার ব্যাপারে উদাসীন; দরিদ্র পরিবার, যেখানে অনেক গুলো ছেলে-মেয়ে থাকে, সেই সব ক্ষেত্রে দেখা যায় কারো ব্যাপারেই বাবা-মা ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারেন না; মেয়েটির ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। বাবা-মা হয়তো জানতেই পারেনি কখন সে শৈশবের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে নারীত্বের শৃংখলে বাঁধা পড়ে গেছে, অথবা সে নিজেই এখনো শৈশবের বিশাল জগৎটাকে সংকুচিত করে আনতে শিখেনি, তাই বাবা-মায়ের নির্দেশ অমান্য করে কিছু বৈষয়িক লাভের আশায় চলে এসেছে নিষিদ্ধ সীমানায়। আমি বেশীক্ষন দাঁড়ালাম না, পাছে লোকে অন্য কিছু ভেবে বসে; যদিও আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, তবুও....। ভদ্রলোকের হাজার সমস্যা। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে হাঁটতে নেমে গেলাম। রুমমেটকে নিয়ে টেনশান নেই, এখন ওর কানের কাছে এটম বোমা পড়লেও সে পাশ ফিরে কান ঢেকে ঘুমিয়ে পড়বে। হাঁটা শেষে রুমে ফিরে টুথব্রাশ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে মেয়েটাকে আর দেখলাম না।

এরপর থেকে নিয়মিতই ভোরবেলায় তার সাথে দেখা হতে লাগলো। বাচ্চাগুলো আর আসে না, তারা বোধহয় নতুন সম্পদের খোঁজ পেয়েছে; মেয়েটা একাই আসে, কখনো তাকে দেখি কাগজ কুড়াচ্ছে, কখনো দেখি ইটের টুকরো দিয়ে পাঁচ গুটি খেলছে। প্রথম প্রথম সে আমাকে দেখে খেলা বন্ধ করে দিতো, লজ্জা পেত কিংবা ভয়; তবে ধীরে ধীরে সে ভয় কাটিয়ে উঠেছিল। কোন এক অদৃশ্য আত্মার আত্মীয়তায় সে দিনে দিনে আমার আপন হয়ে উঠেছিল।

একদিন তাকে ডেকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। তার নাম ‘পরী’, তারা পাঁচ ভাই বোন, সে তৃতীয়; বাবা দিনমজুর, মা নেই, ছোট ভাইটার জন্মের সময় মারা গেছে। বড় বোনটার বিয়ে হয়েছে এক ‘জাউড়া’ রিক্সাওয়ালার সাথে, সেই ব্যাটা তার বোনকে শুধু মারধোর করে। সে ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়েছে, এরপর পয়সা রোজগারের জন্যে বেছে নিয়েছে কাগজ কুড়াবার পেশা। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সে কাগজ কুড়ায়, তারপর সেই কাগজ বিক্রি করে রেল লাইনের পাশে এক আড়তে। বস্তাপ্রতি ১০ টাকা করে দেয় ‘কাগজ মহাজন’। লোহার জিনিস দিলে টাকা বেশী, কিন্তু লোহার জিনিস সহজে পাওয়া যায় না। স্কুল, কলেজ আর হোস্টেলে পরিস্কার কাগজ পাওয়া যায় বলে এর চাহিদা বেশী। আগে পরীর সাথে আরো কয়েকটা মেয়ে কাগজ কুড়াতে আসতো, কিন্তু ওদের কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেছে, বাকিদের আর বাসা থেকে আসতে দেয় না। পরীকেও তার বড় ভাই এই হোস্টেলে আসতে নিষেধ করেছে, কিন্তু বেশী কাগজ পাওয়া যায় বলে সে আসে। ভোরবেলা চুপিচুপি এসে কাগজ নিয়ে চলে যায়।

ধীরে ধীরে অনেক কিছু জেনে ফেললাম পরী সম্পর্কে। আমার ভেতরের স্নেহ নামক বন্ধ ঘরটার সব দরজা কী অবলীলায় সে খুলে দিল! মাঝেমাঝে তাকে রুম থেকে বিস্কুট এনে দিতাম, কখনো সে খেত, কখনো তার ছোট ভাইটার জন্য নিয়ে যেত; মাঝেমাঝে অল্প কিছু পয়সা দিতাম, প্রথম দিকে নিতে চাইতো না, তবে পরের দিকে আর আপত্তি করতো না। তার মনের ভেতরেও হয়তো আমার প্রতি বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা জন্মেছিল।

পরীর কথা বলবো বলবো করেও বন্ধুদের বলা হয়ে উঠেনি। বলেছিলাম শুধু নীলিমাকে, যে মেয়েটার কাছে অনেক আগেই আমার সমস্ত সত্তা সমর্পন করেছিলাম। সে রাজনীতিবিদদের মতো করে বলেছিল, ‘শুধু তোমার সাথেই কেন প্রতিদিন সকালে ওই মেয়েটার দেখা হয়, আর কারও সাথে কেন হয় না? বল তুমি প্রতিদিন মেয়েটার সাথে দেখা করার জন্য ভোরে ঘুম থেকে ওঠ। ওর প্রতি তোমার আকর্ষণ জন্মে গেছে।’ শুনে আমি মৃদু হেসেছিলাম। মেয়েদের এই ঈর্ষা চিরন্তন, এর হাত থেকে মুক্তি নেই। আমি বুঝতে পারিনি যে নীলিমাই ঠিক ছিল; পরীকে হোস্টেলে দেখতে পাওয়া আমিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলাম না।

অভ্যাসবশত: সেদিনও ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দরজা খুলে বাইরে এসে পরীকে দেখলাম না। হেঁটে সিড়ির কাছে আসতেই দেখলাম তাকে। নীরব-নিথর হয়ে পড়ে আছে সে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। গায়ের কাপড় অজস্র যায়গায় ছেঁড়া, লজ্জা ঢাকবার মত অবস্থা নেই; সে চেষ্টাও তার নেই। গায়ে হাজারো ক্ষত রক্তাক্ত হয়ে আছে। হঠাৎ সব বোঝা হয়ে গেল আমার; বুকটা হাহাকারে ভরে গেল, চোখ দু’টো জ্বালা করে উঠল। ওর পাশে বসে পড়লাম; গলার কাছে আটকে থাকা কষ্টগুলো নিয়ে ডাকলাম, ‘পরী..!!’ ঘৃণায় ভরা দৃষ্টি নিয়ে সে ফিরে তাকাল আমার দিকে; ‘থু:!’ শব্দে একদলা থুতু ছুড়েঁ ফেললো মুখে। পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ জাতির মুখে কলঙ্কের কালিমা মেখে তারপর সে ছুঁটে চলে গেল। আমি বসে রইলাম নিশ্চুপ, নির্বাক; বিবেকের কাছে ধর্ষিত...লাঞ্চিত...নির্যাতিত...নিপীড়িত...নিষ্পেষিত হয়ে বসে রইলাম আমি....।।

সাঈদ আজিজ (sayedbinaziz@yahoo.com)


মন্তব্য

বৃহস্পতি [অতিথি] এর ছবি

গল্পের শেষটা এইভাবে হবে পড়ার আগে ভাবি নাই।আপনার মাঝে যে অনুভূতি জন্ম নিয়েছে সেটা যদি সবার মাঝেই নিতো তাহলে আজকে পরীদের এই অবস্থা হতো না

ইশতিয়াক এর ছবি

নাড়া দিলো ভেতরকে। সেই সাথে ধিক্কার পৌরুষ কে!!

তিথীডোর এর ছবি

কিছু বলার নেই...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাদের যারা মতামতের মাধ্যমে আমাকে উৎসাহিত করেছেন।
সাঈদ আজিজ।

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষটা এরকম হবে বুঝি নাই...কিছুই বলার নাই...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।