সাধনের যত স্বপ্ন, ইচ্ছে ইত্যাদি...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৮/০৯/২০১০ - ৯:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাধনের স্বপ্ন বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ছিন্ন নয়। সে-স্বপ্ন ভেসে যায়, ডুবে যায় চন্দ্রবাণ নদীর বুকে। কখনো কখনো বা মুখ তুলে ওঠে, যখন চন্দ্রবাণ নিজে উদ্যোগী হয়ে তার দু হাত দিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিজের বুকের ওপর রোপণ করে। চন্দ্রবাণের যে তীরের ভূমি বন্ধ্যা, বন্ধুর, যে-তীরের আধাঁরে সূর্যের উজ্জ্বল রুদ্র আলো কিংবা কোজাগরি পূর্ণিমার চাঁদের শীতল, শান্ত আলো চির ধরাতে পারেনা, যে-তীরে কারাতের শব্দের থেকে সুচোলো কোনো নৈ:শব্দ বর্তমান, সেই তীরে বৃহত্‍ তিন প্রস্তরখণ্ডের খাঁজে যাপন করে সাধন। সেই যাপন ছন্দে মেলায় বন্ধ্যাত্ব, বন্ধুরতা, আলোকহীনতা, নৈ:শব্দ। পরপারে - যে পার শ্যামল বনানীতে আবৃত, হলুদ সবুজ রক্তিম গাছগাছালি, পাখপাখালির আলোয় আলোকিত থাকে রাজকন্যা। এ রাজকন্যার সারা গা ভর্তি অলংকার নেই, নেই বিশাল রাজবাড়ি, বিশাল সাম্রাজ্য, রাজপুত্র, ঘোড়া, পাইক, হাতি,বরকন্দাজ, পালকি, সৈন্য। এ রাজকন্যার সারা শরীর থেকে নারীত্বরূপী সংস্কার ঝরে পড়েনা। তবুও এ রাজকন্যা - সাধন ও চন্দ্রবাণের কাছে রাজকন্যা।আসলে ওরা মনে করে রাজকন্যা সমস্ত অস্থি, মজ্জা, পেশী, ধমনী, শিরা, হৃদ্‌পিন্ড, অন্তরে নিহিত আছে পৃথিবীর সমস্ত শক্তি, সে-শক্তি অবশ্যই জ্বালানীজাত শক্তির মতো নয়, সে-শক্তির মধ্যে নিহিত আছে বোধ, বন্ধুতা, বিশ্বাস, ভালোলাগা, ভালোবাসা, ইচ্ছেশক্তিগুলো - তাই এ শক্তি এত মৌলিক, সরল, নিষ্কলুষ। আসলে এ শক্তির কাছেই তো পরাজিত হয়েছিল সাধন, এ শক্তির সামনেই তো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়েছিল সাধনের সমস্ত জটিলতা, সংস্কার। সাধন চিরকাল চন্দ্রবাণের এ তীরে বসে ভেবে যায়, স্বপ্ন দেখে যায়, ওই তীরে রাজকন্যার কাছাকাছি যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনদিনই যেয়ে উঠতে পারেনা। সাধন হয়তো ভয় পায় রাজকন্যাকে - রাজকন্যার বিরাট শক্তিকে। কিন্তু রাজকন্যা তো কোনদিনও শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করে না। তবে হয়তো সাধন ভয় পায় রাজকন্যার কাছে গেলে রাজকন্যাকে হারিয়ে ফেলার। তাই সে কখনো চন্দ্রবাণের তীর বরাবর ছুটে যায়, স্বপ্নকে বুকে আগলে ধরে রেখে, আবার কখনো বা কুটীরের জানলা দিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওই পারে রাজকন্যার কুটিরের দিকে। তারপর কখনো জ্ঞানত বা অজ্ঞানত সে-স্বপ্ন ভাসিয়ে দেয় চন্দ্রবাণের বুকে। আসলে সাধন হয়তো ভাবে এই অনন্ত ভেসে যাওয়ার মধ্যে নিহিত আছে স্পর্শিত হওয়ার সম্ভাবনা। দু পারের এই দুই কুটিরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় চন্দ্রবাণ – তার কোন অংশ শান্ত, কোনোটা বা খরস্রোতা, কোন অংশের জল রঙিন, আবার কোন অংশের স্বচ্ছ, কখনো বিস্তৃত, কখনো বা সরু।
চন্দ্রবাণের উত্‍স আর অন্তিমস্থলের সন্ধান জানেনা সাধন। সে শুধু দ্যাখে চন্দ্রবাণের ধারা রজকন্যার কুটিরকে আলিঙ্গন করে আরও দূরে, বহুদূরে চলেছে বয়ে। চন্দ্রবাণের বুকে সাধনের যে-সপ্নগুলো ভেসে বেড়ায়, তার কিছু স্বপ্ন আবার রাজকন্যা নিজেকে চন্দ্রবাণের বুকে উন্মুক্ত করার সময় উদ্যোগী হয়ে সোহাগস্পর্শে স্পর্শিত করে নিয়ে যায় নিজের কটিরে। সাধনের কিছু ভেসে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, চন্দ্রবাণের বুকে মুখ তুলে থাকা স্বপ্ন এ নদীতে বাস করা মাছের পেটস্থ হয়। তারপর চন্দ্রবাণের বুকে যখন বড়ো ট্রলার আসে, সে- ট্রলারের উপর থাকে এক অশ্বরোহী। কালো অশ্বের ওপর তার উন্মু্ক্ত তরবারি এ অঞ্চলের সমস্ত পশু পাখি মাছ গাছপালা ঘাস ফুল ফল, সবার রক্তকে হিম করে দেয়।সে জাল ফেলে চন্দ্রবাণের বুকে, ধরে নিয়ে যায় মাছেদের সাধন চন্দ্রবাণ ও রাজকন্যার স্বপ্নদের। সাধন, চন্দ্রবাণ, রাজকন্যার স্বপ্ন পণ্যায়িত হয়। সাধনের স্বপ্ন মাছের টুকরোর কমড়ের মাধ্যমে মানুষের পেটস্থ হয়। চন্দ্রবাণের চোখ থেকে জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দেয় বুককে। রাজকন্যা ও সাধনের কুটিরও সিক্ত হয়ে ওঠে। সিক্ত হয় আকাশ। সিক্ত হয় মাটি। সিক্ত হয় গাছপালা। পশুপাখি। তারা পরপস্পরকে আলিঙ্গন করে। একে অপরকে সিক্ত করে। তাদের শরীরে জল ছিটোয় চন্দ্রবাণ। তাদের হিম রক্ত ক্রমে তরল হয়। রাজকন্যা চন্দ্রবাণের বুকের জল মুছিয়ে দেয়। চন্দ্রবাণ স্পর্শ করে প্রথমে রাজকন্যার চোখ, তারপর গাল, তারপর বুক। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। সিক্ত করে। অম্নি মাটি কেঁপে ওঠে, আকাশে বজ্র বিদ্যুত্‍ হয়। চরাচর জুড়ে তখন শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। আদিম কোন ছন্দে সমস্ত গাছের শরীর দুলে ওঠে। দুলে ওঠে শরীর পশুপাখিদেরও। তারা ভুলে যায় সংস্কার, নিষেধের অতন্দ্র পাহারা। রাজকন্যার ঠোঁট চন্দ্রবাণের বুকে ছায়া আকেঁ। আর চন্দ্রবাণের ঠোট মায়া আকেঁ রাজকন্যার বুকে। সে ছায়ায়-মায়ায় কখনো চন্দ্রবাণের বুকে কখনো রাজকন্যার স্তনে লুকোচুরি খেলে। চন্দ্রবাণের লিঙ্গ সিক্ত হয়, রাজকন্যার যোনি সিক্ত হয়। তারা পরস্পরে প্রবেশ করে। সাধনের স্বপ্ন ডুবে যায়, ভেসে যায়, মুখ তোলে চন্দ্রবাণের বুকে, জমা হয় রাজকন্যার কুটিরে।
চন্দ্রবাণের যে তীরে সাধন যাপন করে সেই যাপনের মাধ্যম থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ক্রোশ খানেক দূরে যেখানে বন ক্রমশ সবুজ হলুদ রঙ ধুয়ে ফেলে নিকষ বাদমি রঙে সেজে ওঠে, যেখানে বন এতই গভীর যে দূরবীক্ষণ যন্ত্র তাক করেও চন্দ্রবাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়না - খুব ক্ষীণ ভাবে শোনা যায় তার অবিরাম বয়ে চলার শব্দ, সেই খানের শিয়রে গাছে গুঁড়ির তলায় পলকহীন নেত্রে শুধুমাত্র চন্দ্রবাণের বয়ে চলার ক্ষীণ শব্দটাকে আশ্রয় করে বসে থাকে দুয়োরানি - হয়তো বা চন্দ্রবাণের ধারা কোনো একদিনও বা এমুখী হবে এই আশায়। আসলে আগে তো চন্দ্রবাণের ধারা এমুখীই ছিল। তারপর যবে থেকে রাজকন্যা পূর্বদিকের তীরে এসে বসবাস শুরু করল, সেই যবে সাধন এসে তার স্বপ্নের কথা চুপিচুপি চন্দ্রবাণের কানে বলেছিলো - সেই তবে থেকে চন্দ্রবাণের ধারা যে পূর্ব দিকে ঘুরে গ্যালো, তারপর দিন গ্যালো, রাত গ্যালো, সপ্তাহ গ্যালো মাস গ্যালো, এমনকি বছরও কেটে গ্যালো, কিন্তু সে-ধারা তো কোনদিন এমুখী হয়ইনি, বরং যত সময় এগলো, তার ধারা তত নিকটস্থ হয়ে রাজকন্যার কুটিরকে আলিঙ্গন করে কোথায় মিলিয়ে গ্যালো। আর ততদিন এই অংশে বালির ওপর ক্রমশ বড় বড় গাছ গজালো - ক্রমে তা ঘন বনের আকার নিলো। এখন এস্থান শুধুমাত্র চন্দ্রবাণের বয়ে চলার শ্রোতা। তবু দুয়োরানি অপেক্ষা করে। চন্দ্রবাণ যবে এ স্হান ছেড়ে পূবদিকে রওনা হয়েছিল, সেই তবে দুয়োরানি পাতার এক ডিঙা চন্দ্রবাণের বুকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। চন্দ্রবাণের স্রোত এ তাবত্‍ কাল তকে ডুবিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সবই ব্যর্থ। চন্দ্রবাণের ধারা যত রাজকন্যার কুটিরকে আলিঙ্গন করে, সেই পাতার ডিঙা তত গাছের গুঁড়িতে সে থাকা দুয়োরানির চোখের জলে পূর্ণ হয়, কিন্তু ডোবে না - ভেসেই থাকে।
জোয়ারের সময় যখন চন্দ্রবাণের বুকে জল বাড়ে তখন তার ধারা রাজকন্যার কুটিরকে প্লাবিত করে। তার ধারা খেলা করে রাজকন্যার বুকে। আর সেই জোয়ারের ধারায় রাজকন্যার শরীর থেকে আলগা হয়ে যাওয়া কাপড় চন্দ্রবাণের ধারায় ভেসে যায়।তাদর শ্বাসে ঠোকাঠুকি লাগে। একটা শ্বাস অপর শ্বাসকে এই জোয়ারের মুহূর্তটাকে চিরন্তন করে তুলতে বলে। পরপারে প্রস্তরখণ্ডের খাঁজ থেকে এ সব কিছুই দ্যাখে সাধন। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে শক্ত পাথরকে মুহূর্তের জন্য হলেও নরম করে। তারপর সেই চোখের জল ভেসে যায়, ডুবে যায় চন্দ্রবাণের বুকে। দুয়োরানি যে-গাছের গুঁড়ির তলায় বসে থাকে তার পূর্বদিকে ক্রোশ খানেক দূরে বয়ে চলে চান্দ্রেয়ী নদী। নিকষ বাদামী বনের ভিতরে সে কখনো কখনো তার বুক তুলে ধরে বলি চিরে, বয়ে নিয়ে চলে নীলে সবুজ জল, কখনো বালির উপর দিয়ে, কখনো বা নিচ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে, নিস্তব্ধে। এ অঞ্চলের প্রতিটা গছ মাছ পাখি জানে, হয়তো বা পূর্বজদের থেকে শুনেছে, বা ভাবে চন্দ্রবাণ ও চান্দ্রেয়ী একই সত্তার ভিন্ন দুই বিপরীতমুখী রূপ। যদিও তারা কেউ কোন দিনই চন্দ্রবাণ ও চান্দ্রেয়ীর উত্‍সস্থল ও অন্তিমস্থলের খোঁজ পায়নি, তবু তারা বিশ্বাস করে এই দুই নদী উত্‍সস্থল ও অন্তিমস্থলে এক, যেখানে তাদের এ স্থানের বিপরীতমুখিত্ব মিলেমিশে একাকার। দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূখন্ডে যাপন করে সাধন দুয়োরানি, গাছগাছালি পাখপাখালির দল, আরও কত কী। চান্দ্রেয়ী নদীর তীর বরাবর ক্রোশ খানেক অঞ্চল জুড়ে বন এতই ঘন যে সেখানে এ পাশের কোন পাখি কোনদিনও প্রবেশ করতে পারে না, পথ হারিয়ে ফ্যালে। বদলে যায়। গাছেরাও। চান্দ্রেয়ীর তীর বরাবর ক্রোশ খানেক বিস্তৃত অংশে। এখানে গাছেরাও কোমলতা, সরলতা, প্রাণময়তা হারিয়ে অনেক বেশি কঠিন, ঋজু, কন্টকময়। সাধন বারবারই চেষ্টা করে এই নিকষ বন পার হয়ে চান্দ্রেয়ীর তীরে উপস্থিত হতে। কিন্তু প্রতিবারই পথ হারিয়ে ফ্যালে। তবু সে বারবার এই চেষ্টা চালিয়ে যায়। কারণ সে শুনেছে পূর্ণিমা অমাবস্যা তিথিতে চান্দ্রেয়ীরর বুকে নিজেকে অর্পণ করে রাজকন্যা। তখন চান্দ্রেয়ীর স্তন রাজকন্যার স্তনে স্পর্শ হয়, চান্দ্রেয়ী ও রাজকন্যার যোনি পরস্পরে ঘর্ষিত হয়। সে-স্পর্শে, ঘর্ষণে কখনো পূর্ণিমা তিথির নীলচে সাদা আলো, কখনো বা অমাবস্যা তিথির কালচে বাদামি আলো ঝাপ্‌টা মারে। প্রতিটা স্পর্শে, ঘর্ষণের ছন্দে এ অঞ্চলের গাছেদের চেহারা আরও বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। তাদের গায়ের কন্টক আরও প্রসারিত হয়। একে অপরে স্পর্শিত, ঘর্ষিত হয়। আর বিফল হয় সাধনের প্রতিবারের চেষ্টা। কিন্তু এই দুই তিথিতে সে বৃহত্‍ তিন প্রস্তর খন্ডের খাঁজে এক মুহূর্তও শান্ত ভাবে বসে থাকতে পারে না। সে থেকে থেকেই ছুটে যেতে চায় চান্দ্রেয়ী নদীর দিকে। গাছেদের কন্টকে রক্তাক্ত হয়, ব্যর্থ হয়। চান্দ্রেয়ী নদীর তীরে না পৌঁছালেও তার চোখের সামনে চান্দ্রেয়ী-রাজকন্যা সঙ্গমদৃশ্য ঝাপটা মারে। সাধনের সপ্ন ডুবে যায়, ভেসে যায়, মুখ তোলে, চন্দ্রবাণের বুকে, জমা হয় রাজকন্যার কুটিরে।
সকালবেলা চন্দ্রবাণ ও চান্দ্রেয়ীর মধ্যবর্তী জ্যা সূর্যের আলোয় হরিদ্রাভ রক্তিম বর্ন ধারণ করে। সূর্যের তির্যক রশ্মিস্রোত স্পর্শ করে গাছগাছালি পাখপাখালিদের। স্পর্শ করে সাধনকে ঘিরে থাকা বৃহত্‍ তিন প্রস্তরখন্ডকে। তারা রশ্মিস্রোত গায়ে মাখে। এ ওর গায়ে মাখিয়ে দেয়। ভেসে যায় রশ্মিস্রোতে। বেলা বাড়ে। ঢলে পড়ে সূর্য। রশ্মিস্রোত চুঁয়ে চুঁয়ে নেমে আসে বালিনির্মত খন্ডিত ভূ-এ। সূর্য অদৃশ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত তাদের গায়ে লেগে থাকা রশ্মি ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে বালির বুকে। তারপর সেই রশ্মিস্রোতের ধারা দু ভাগ হয়ে বয়ে চলে চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর দিকে। প্রস্তরখন্ডের খাঁজ থেকে আঙুল দেখা যায় সাধনের। রাতে দেখা, বুকে জমে থাকা স্বপ্ন ভাসিয়ে দ্যায় সে চন্দ্রবাণের দিকে বয়ে চলা রশ্মিস্রোতে। স্বপ্ন জমা হয় চন্দ্রবাণের বুকে। অদৃশ্য সূর্যের স্থান নেয় নীলচে সাদা বৃত্ত। তার নীলচে সাদা আলোর স্রোতে স্নান করে খণ্ড ভূ। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় নীলচে আলো। নীল পোষাকের সাদা ডানার পরীরা বালির ওপর নেমে আসে। জাদুকাঠি বুলিয়ে দ্যায় সকলের চোখে। বৃহত্‍ তিন প্রস্তরখণ্ডের মাঝে সাধন ঘুমিয়ে পড়ে। অদৃশ্য ঝুলনবিন্দু থেকে নেমে আসে দোলনা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সাধন দোলনায় উঠে পড়ে। দুলতে দুলতে কখনও চন্দ্রেয়ীর বুকে পৌঁছে যায়, আবার কখনও বা রাজকন্যার কুটির স্পর্শ করে। চান্দ্রেয়ীর বুকে পৌঁছে দোলনা থেকে নেমে পড়ে সাধন। ডুবে যায় চান্দ্রেয়ীর বুকে। ডুবতেই থাকে। চন্দ্রবাণ পার হয়ে দোলনা রাজকন্যার কুটির স্পর্শ করলে সাধন হাত বাড়িয়ে দ্যায় রাজকন্যার কুটিরের দিকে। বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে দোলনায় উঠে আসে রাজকন্যা। দুলতে থাকে দোলনা। সাধন রাজকন্যার শরীর পরস্পরে পেঁচিয়ে যেতে থাকে। নীল পোশাকের পরীরা তাদের সাদা ডানা প্রসারিত করে ঘিরে ধরে দোলনাকে। দোলনার ছন্দে দুলতে দুলতে তারাও ভাসতে থাকে। দুলতে থাকে দোলনা - চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর মধ্যবর্তী বায়ুস্তরে, স্পর্শ করে দুই প্রান্তবিন্দু - চান্দ্রেয়ীর বুক, রাজকন্যার কুটির। ট্রলারের বিকট শব্দ শুষে নেয় রাতের শেষ বিন্দুকে। অদৃশ্য হয় দোলনা। জেগে ওঠে সাধন। জেগে ওঠে গাছগাছালি, পাখপাখালির দল। সারা রাতের স্বপ্নিল মায়া তাদের মুখ থেকে মুছে যেতে থাকে। হলদেটে রঙ গ্রাস করে তাদের মুখ। অশ্বারোহী জাল ফেলে চন্দ্রবাণের বুকে। ধরে নিয়ে যায় মাছেদের। সাধন, চন্দ্রবাণ ও রাজকন্যার স্বপ্নদের।..........। সাধনের স্বপ্ন......... পেটস্থ হয়। ......... সিক্ত হয় গাছপালা, পশুপাখি। .........। চন্দ্রবাণ স্পর্শ করে.........। .........। তারা পরস্পরে.........। সাধনের স্বপ্ন ডুবে যায়, ভেসে যায়, মুখ তোলে চন্দ্রবাণের বুকে, জমা হয় রাজকন্যার কুটিরে।
দুয়োরানি অপেক্ষা করে চন্দ্রবাণের জন্য। তার চোখের জল জমা হতে থাকে চন্দ্রবাণের বুকে ভেসে চলা পাতার ডিঙায়। সেই জল তারপর চুঁয়ে পড়ে চন্দ্রবাণের বুকে, আর মুহূর্তের জন্য হলেও চন্দ্রবাণের মিষ্টি জলকে নোনতা করে। অশ্বারোহীর জালে পাতার ডিঙা বন্দি হয়। অশ্বারোহী হাতছানি দেয় দুয়োরানি, সাধনকে, ট্রলারে উঠে পড়ার। দুয়োরানি প্রাণপণে সে-হাতছানি প্রত্যাখ্যান করতে চায়, কিন্তু তার শরীরে গতি সঞ্চারিত হয়। দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূ-এ ঋজু দাড়িঁয়ে সে-হাতছানি প্রত্যাখ্যান করে সাধন।

এ ভাবে কত দিন কেটে যায় তার খবর কেউ রাখেনা। সাধন চন্দ্রবাণ পেরিয়ে রাজকন্যার কুটিরে পৌঁছার চেষ্টা, চান্দ্রেয়ীর তীরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে য়ায় – পথ খুঁজতে থাকে। সাধন জানেনা ওপারে রাজকন্যার কুটিরের পরে , চান্দ্রেয়ীর ওপারে কী আছে - এ অঞ্চলের কেউই জানেনা। তারা শুধু সাক্ষী হয়ে থাকে কিছু প্রেমের, প্রতীক্ষার, অপেক্ষার, সংগমের, ট্রলারের বিকট শব্দের, আর সাধনের চোখের জলের।
চন্দ্রবাণের বুকে যে ট্রলার আসে, যার উপর দাঁড়িয়ে থাকা কালো অশ্বের উপর বসে থাকে এক অশ্বারোহী, তার গতিপথও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। এখন সে শুধু চন্দ্রবাণের বুকে ভেসে চলা মাছেদের, সাধন, চন্দ্রবাণ, রাজকন্যার স্বপ্নদের জালবন্দী করেই ক্ষান্ত হয়না - তীরে নেমে আসে, কেটে ফেলে গাছ, হত্যা করে পাখিদের, বন্দি করে দুয়োরানিকে, সাধনকে। দুয়োরানির অপেক্ষা তার শক্তির সামনে পরাস্ত হয়। সে দুয়োরানিকে শুয়ে দেয় ট্রলারের বুকে। নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে দ্যায়। রক্তাক্ত হয় দুয়োরানির সারা দেহ। সে-রক্তে খেলা করে চলে অশ্বারোহী। দুয়োরানির নির্বাক চিত্‍কার, কালো অশ্বের একটানা হ্রেষাধ্বনি সমস্ত আলো, চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর বহমানতার শব্দ শুষে নেয়। দুয়োরানির চোখের জল রাতকে ভিজিয়ে দ্যায়। অশ্বারোহীর তীব্র হাসির শব্দ নীল রঙ গ্রাস করে খয়েরি রঙ ঢেলে দ্যায় অন্ধকারের বুকে। সাধন এখন চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর তীর বরাবর খালি ছুটে যায়। দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূ-খণ্ড অশ্বারোহী অধিকার করে। বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় দুই নদীতে। দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে নদীর ওপারে রাজকন্যার কুটিরের দিকে সেতু নির্মাণ শুরু হয়।

ঘটনা রটনা আর দুর্ঘটনার প্রবহমান স্রোতে সে-ছেলের দেহখণ্ড বা বা জীবিত লাশ অথবা যথার্থই লাশ ভেসে চলে নদী থেকে নদীতে, নদী পার হয়ে সাগরে, অথবা প্রস্তরীভূত হয় পাহাড়ের শিলায় কিংবা আটকে থাকে পাহাড় ও নদীর অন্তর্বর্তী খাঁজে। বয়ে চলে চন্দ্রবাণ থেকে চান্দ্রেয়ীতে। চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ী পার হয়ে ছুঁতে চায় রাজকন্যাকে।

সাধন তার সাধ পূরণের লক্ষে করে চলে সাধনা।

ঋণ:
অদ্বৈত মল্লবর্মন রচিত তিতাস একটি নদীর নাম।
বিস্মৃতপ্রায় একটি নাট্য প্রযোজনা, সম্ভবত যার নাম ও গল্পের শীর্ষক এক।
পার্থপ্রতিম মৈত্র।

বন্ধুরা, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মেরা।


মন্তব্য

ইশতিয়াক এর ছবি

গল্পটি যে ষ্টাইলে লেখা তার সাথে

তারপর চন্দ্রবাণের বুকে যখন বড়ো ট্রলার আসে, সে- ট্রলারের উপর থাকে এক অশ্বরোহী

ট্রলার শব্দটা যাচ্ছেনা।

অতিথি লেখক এর ছবি

রূপকথাতেও তো ছেদ পড়ে, হুড়মুড় করে ঢুকে যায় বাস্তব। ওই শব্দটা ব্যবহার করেছি সেই কারণেই। মুহূর্তের মধ্যে রূপকথাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।