নিগ্রো নদীর কথা বলে

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৯/০৯/২০১০ - ১২:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পুর্বলেখঃ
হার্লেম রেনেসাঁর মধ্যমণি আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ কবি Langston Hughes (১৯০২-১৯৬৭)। বিশ শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকার বর্ণবাদ তাঁকে ভুগিয়েছিলো, কিন্তু তিনি আপন সততায়, বোধে ও বিশ্বাসে স্থিরচিত্ত থেকে বর্ণবৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে বিশ্বমানবতার জয়গানে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিতে পেরেছিলেন। "The Negro Speaks of River" তাঁর সেই 'কসমিক' ভালোবাসার গগণবিহারী রূপটিকেই ফুটিয়ে তোলে। এই কবিতাটির মূলসুরটি যেন নজরুলে খুঁজে পাই,

"সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশি।"

কবিতার শুরু থেকে শেষাবধি তিনি বলে যান নদীর কথা, মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারাটিকে নদীর স্ত্রোতধারার সাথে সন্নিবেশিত করেন, ধমনী-শিরায় প্রবহমান রক্তধারার অনিবার্য রূপকে নদীকে মহিমান্বিত করেন। আবহমান কাল থেকে দেশ-কাল-বর্ণভেদে মানবজাতির যে ধারাটি আজ অবধি বয়ে এসেছে সেই আদিম সময় থেকে, সেটি যেন নদীর মতোই শাখায় শাখায় পল্লবিত। ইউফ্রেতিস থেকে মিসিসিপি পর্যন্ত মানবতার ইতিহাস যেন বেবিলন সভ্যতার যুগ থেকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ক্রান্তিকাল পর্যন্ত সময়েরই যথার্থ ব্যঞ্জনা। ইউফ্রেতিস যেন পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্মেষকাল, দোলনা দোলার সময়। ঊষার প্রারম্ভে তাই ইউফ্রেতিসের জলে পুতস্নান সভ্যতার সূচনালগ্নের সুবার্তাই ঘোষণা করে।

এরপর নিগ্রো কবি উদাত্ত গলায় আদিম নগ্ন নির্জন আফ্রিকার কথা বলেন। কঙ্গো নদীর তীরে ঘর বাঁধেন, আর বিভোর হন ঘুম পাড়ানিয়া গানে! নীল নদের সাথে মিশরীয় সভ্যতার সম্পৃক্ততা উচ্চারিত হবার সাথে সাথে আমরা উপলব্ধি করি তাঁর আফ্রিকান অভিজ্ঞতা শুধু কালো মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যেন বিস্তৃত সেইসব সাদা ও পীতবর্ণের মানবকুলের মাঝেও, যারা কঙ্গো নদীর অববাহিকায় ঘর বেঁধেছিল আর যারা গড়ে তুলেছিলো মিশরে পিরামিড।

এবার কবি আমেরিকার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকান। বলেন, দাস প্রথা উচ্ছেদে আবে লিংকনের মহান অবদানের কথা। নদীস্রোত যেমন পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমন্বায়ক, তেমনি রক্তের স্রোতধারায় নিখিল মানবতা যেন একই পৃথিবীর স্তনে লালিত। তাই যেন মানবশিশুর পরিচয় শুধু তার মাতৃ-পিতৃপরিচয়ে সীমিত নয়, বরং আমরা সবাই যেন অনন্ত মহাজগতের সন্তান হয়ে বিচরণ করি নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে।
[রোমেল চৌধুরী]

THE NEGRO SPEAKS OF RIVERS

I've known rivers:
I've known rivers ancient as the world and older than the
flow of human blood in human veins.

My soul has grown deep like the rivers.

I bathed in the Euphrates when dawns were young.
I built my hut near the Congo and it lulled me to sleep.
I looked upon the Nile and raised the pyramids above it.
I heard the singing of the Mississippi when Abe Lincoln
went down to New Orleans, and I've seen its muddy
bosom turn all golden in the sunset.

I've known rivers: Ancient, dusky rivers.

My soul has grown deep like the rivers.

[The Weary Blues, 1926]

নদীকে চিনেছি আমিঃ
জেনেছি, নদী এই পৃথিবীর সমান বয়সী এবং প্রাচীন
ধমনী শিরায় প্রবহমান রক্তের স্রোতধারা থেকেও পুরোনো।

নদীর মতোই গভীর হয়েছে আমার আত্মার তলদেশ।

প্রভাতের পুরোভাগে আমি স্নান করলাম ইউফ্রেতিসের জলে।
ঘর বাঁধলাম কংগো নদীর তীরে, বিভোর ঘুম পাড়ানিয়া গানে।
চোখ মেলে দেখি নীলনদ, সেখানে গড়লাম আকাশছোঁয়া পিরামিড।
মানবতার মহান পথে আবে লিঙ্কন নিউ অরলিন্স অবধি হেঁটে গেলেন।
আমি কান পেতে শুনলাম মিসিসিপির উদাত্ত সংগীত
আর বিস্ময়ে দেখলাম,
গোধুলীর আলোকচ্ছটায় কর্দমাক্ত লহরীর ভাঁজে ভাঁজে
কিভাবে একটি সোনালী স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হতে চলেছে

নদীকে চিনেছি আমিঃ
চিনেছি আবহমান, কাজল নদীকে।

নদীর মতোই গভীর হয়েছে আমার আত্মার তলদেশ।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

লেখা ভালো হয়েছে। তবে এটা আমি লিখলে,

  • মহাজগত, কসমিক ইত্যাদি শব্দ আমদানি না করতাম না।
  • নজরুলের কবিতাটার প্রসঙ্গ টানতাম না। মূল কবিতাটা পড়ে "এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশি।"-জাতীয় কোন ভাবে আসছে না কেন যেন।

এছাড়া অনুবাদ করতে গিয়ে "muddy bosom turn all golden in the sunset." কে "সোনালী স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হতে চলেছে" অনুবাদ করাটা অনেকটা আরোপিত ভাব মনে হয়েছে।

আরো একটা বিষয়, কাউকে পরিচিত করার ব্যাপারে তার অঙ্গ কালো, সাদা, বাদামি বা হলুদ এটা বলার ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। কথাপ্রসঙ্গে কবিতার শিরোনাম আলোচনায় হয়তো আসতে পারে ল্যাংসটন হিউজ আফ্রো এ্যামেরিকান। ওটুকু বললেই যথেষ্ট হতো বলে মনে করি।

লিখতে থাকুন। নতুন নতুন কবিতার সাথে পরিচিত হই।
________________________________________________
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই,
আপনার প্রজ্ঞাদীপ্ত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ! আমি নিশ্চিত, এমন আলোচনা পাঠকমনের আগ্রহী জানালায় আরো আলো দেবে!
রোমেল চৌধুরী

শিশিরকণা এর ছবি

আমি কবিতার পাঠক নই, কিন্তু বাংলা অনুবাদটা ইংরেজিটার মত হৃদয় ছুঁয়ে গেলো না। নতুন একজন কবির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অতিথি লেখক এর ছবি

"যে আমারে দেখিবারে পায় অনন্ত ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি"
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!
রোমেল চৌধুরী

শিশিরকণা এর ছবি

আমি জেনেছি নদীকে,
মানবের রক্তধারার চেয়েও প্রাচীন স্রোতধারা বুকে নিয়ে ছুটে চলা
সেসব নদীকে আমি জেনেছি।
আমার হৃদয় গভীর থেকে গভীরতর হয়ে গিয়ে মিশেছে সেইসব নদীর তলদেশে।
ইউফ্রেতিসের জলে আমি নেয়ে উঠেছি ভোরের আধফোটা আলোয়,
কঙ্গো নদীর তীরে বেধেছি আমার ঘর, ঘুম পাড়ানিয়া গানে।
আর নীল নদের বিস্তীর্ণ জলরাশির পানে চোখ মেলে গড়েছি আকাশছোঁয়া পিরামিড।
আমি শুনেছি এব লিঙ্কনের আগমনে মিসিসিপির গান,
আমি দেখেছি নিউ অরলিন্সে তার কর্দমাক্ত তীর,
সূর্যাস্তের আলোয় তার সোনামাখা রঙ।

আমি চিনেছি কত নদী, ধুলো-কাদা মাখা, প্রাচীন,
আমার হৃদয় সেসব নদীর গভীরেই অন্তর্লীন।

আপনার অনুবাদকে খাটো করার আমার উদ্দেশ্য নয়। ইংরেজিটা পড়ার সময় মনে মনে যেভাবে বাংলা করছিলাম, সেটাই লিখে দিলাম। নাহলে মাথার মাঝে কুটকুট করছিল। কেমন হয়েছে সেটা আপনাদের মতো অভিজ্ঞ কবিদের হাতে ছেড়ে দিলাম। (আমার নিজের কবিতা পড়ার দৌড় ইন্টারমিডিয়েটের বাংলা ইংরেজি সিলেবাস পর্যন্ত) ।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ, মনোমুগ্ধকর একটি কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হলো ! এমন আরো অনেক কবিতা পড়তে চাই মুগ্ধতায় দুলতে দুলতে !
রোমেল চৌধুরী

শিমুল এর ছবি

আফ্রো-আমেরিকান শব্দটি নিগ্রো কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ শব্দটির প্রতিশব্দ।কোন বাক্যে আফ্রো-আমেরিকান শব্দটি ব্যবহার করলে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবহারের দরকারে পড়েনা; শব্দের দিত্ব হয়ে যায়।

শিরোণামে নিগ্রো শব্দটি যদি "এম্ফাসাইজ" করার জন্য ব্যবহার করলে ঠিক আছে।অন্যকোন শব্দদিয়ে প্রতিস্থাপ্ন করা যায় কিনা, সে প্রস্তবনাও রাখি।

অনুবাদ চলনসই। অনুবাদ করা কবিতায় কেন জানি যুত পাইনা।তবে অনুবাদের চেষ্টা প্রশংসনীয়।

www.poets.org -এ Langston Hughes বেশ কয়েকটি কবিতা আছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই,
ধৈর্য নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ! আমার প্রচেষ্টার বিনম্র উদ্দেশ্য সচলায়তনের নবীন পাঠকদের নানান দেশের মহৎ কবিতাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া মাত্র! সে কর্মযজ্ঞে আপনাদের সবার স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ আমাকে যুগপৎ প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত ও আনন্দিত করছে! আমি চাই, পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকেরা মুল থেকেই রসাস্বাদন করুন! মনে করুন, আমার এই কাজগুলি 'এপিটাইজার' যা ক্ষুধাকে বাড়িয়ে দিয়ে 'মেইনকোর্স' এর সুশীল পঠনে সহায়তা করবে! আর তাই যদি হয়, তবে তো ভিন্নমত ও মন্তব্য আরো বেশী কাম্য! নানা দিক থেকে আলো ফেলে দেখি না, কবিতা কিন্নরীর মোহিনী রূপটি কেমন ফোটে!
রোমেল চৌধুরী

তানভীর এর ছবি

বাহ দারুণ তো! (গুড়)

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে !
রোমেল চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু স্থানে অনুবাদ আরোপিত মনে হয়েছে। আসলে "অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তাই কবিতা।" তবে আপনার এই চেষ্টায় সাধুবাদ জানাই। আশা করছি ভবিষ্যতে আরো এই রকম কবিতা পাব।

অনন্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই,
ফ্রষ্ট সাহেব একটি মোক্ষম কথা বলেছিলেন! আশা করছি ভবিষ্যতে আপনার আরো এমন খাপখোলা মন্তব্য পাব।
রোমেল চৌধুরী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।