তোমার জন্য লেখা এলোমেলো শব্দের ঝাঁক-৪(১)

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২১/০৪/২০১৭ - ২:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তোমার জন্য লেখা এলোমেলো শব্দের ঝাঁক-৩
তোমার জন্য লেখা এলোমেলো শব্দের ঝাঁক-২
তোমার জন্য লেখা এলোমেলো শব্দের ঝাঁক-১

আবার কিছু শব্দ জমা পড়েছে কল্পনার ঝাঁপিতে, মা’মণি তোমার জন্যে। তুমি এতদিনে বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে উঠে গেছ আরো খানিকটা ওপরে। ঠিক ‘প্রাপ্ত বয়স্ক’ নও, তবে নিঃসন্দেহে ‘প্রাপ্য বয়স্ক’, কারণ লক্ষ্য করেছি, তুমি আগের চাইতে আরো অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছ। এই যে তুমি দিনে দিনে আরো বেশি ধৈর্যশীল ও স্থিতধী হচ্ছ, কানে কানে বলি, এ বিষয়টি আমাকে খুব প্রশান্তি দেয়, নিশ্চিন্ত করে। তুমি তো জানোই জীবনানন্দ আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। বড় বেশি নিভৃতচারী ছিলেন তিনি। রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার মোটরকারের হু-হু করে ছুটে চলার পথকে তাঁর সবসময়ই একটা খটকার মত মনে হয়েছে। এই পথ চলায় শুধু হু-হু করে ছোটাই আছে, মাঝে-মধ্যে দু’দণ্ড কোথাও থেমে কোন কিছু দেখবার নেই, অনুভবের কিছু নেই, উপলব্ধির নেই। কিন্তু জীবন তো আর মোটরকারের মত নয়। উল্কার মত দ্রুত ছুটে জ্বলেই নিভে যাওয়াও নয়। জীবনের পথ-পরিক্রমা অনুভবের, উপভোগের, আনন্দ লাভের--সেই সাথে উপলব্ধির, অভিজ্ঞতা অর্জনের, মূল্যায়নের, পাথেয় সংগ্রহের ও কিছু রেখে যাবার। এসবের জন্য অবসর চাই। তিনি লিখেছিলেন,

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।

সামনে তোমার এস এস সি পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলে তোমাকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ব মা’মণি। আচ্ছা, বলো তো, কোথায় যাওয়া যায়? গতবছর তোমার ড্রপ-বক্সে টুপ করে ফেলে রেখেছিলাম ফিওদর করোভকিনের লেখা ‘পৃথিবীর ইতিহাস’। আদিম মানুষের জীবনযাত্রার কথা—সে’তো তুমি নেহেরুর লেখা ‘মা’মণিকে বাবা’-তেই পড়েছিলে। অল্প ক’দিনেই ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ থেকে তুমি চুপি চুপি পড়ে ফেলেছিলে সুপ্রাচীন প্রাচ্যভূমি, প্রাচীন মিশর, গ্রীস, ও রোমের ইতিকথা। সভ্য হতে হলে সভ্যতাকে জানতে হয়, বুঝতে হয়। অতীতের স্পন্দন বর্তমানের ধমনীতে অনুভব করতে হয়। তাই চল, এইসব সভ্যতার কোন একটিকে নেড়ে চেড়ে দেখি। কোনটা দিয়ে শুরু করি, বল তো? ধর যদি তুমি কল্পনার পাখায় ভর করে বাংলাদেশ থেকে উড়ে চলে আসলে আমার কাছে, ভূমধ্যসাগরের বুকে একাকী ভেলার মত ভাসতে থাকা সাইপ্রাস নামের এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে, তাহলে আমি নিশ্চিত, গুগলে পৃথিবীর মানচিত্রের উপর একটি পলক ফেলেই তুমি বলে উঠতে, “বাবা, চল আমরা গ্রীসেই যাই!”

আমি উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠতাম, “আমিও তো তাই ভাবছিলাম, মা’মণি! চল তবে মানচিত্রটিকে একটু প্রবর্ধিত করে দেখি?”

“না, না! দাঁড়াও, তার আগে এস ভয়েসকে উইকিপিডিয়ায় যেতে বলি”, স্মার্টফোন হাতে নিয়ে তুমি বলতে। তারপর পড়ে শোনাতে আমাকে, “জানো বাবা, গ্রীসের অপর নাম হেলেনিক রিপাবলিক, অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়েছে ২৫ মার্চ ১৮৬১ সালে...”।

“আচ্ছা, এবার ‘লোনলি প্ল্যানেট’-এ যাওতো দেখি মা”!

তুমি সেখান থেকে আমাকে একে একে পড়ে শোনাতে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের কথা, এক্রোপলিসের কথা, পার্থেনন মন্দিরের কথা, থিয়েটার অব ডাইনোসসের কথা, কেরামিকস সিমেট্রির কথা, টেম্পল অব পসাইডনের কথা, প্যানএথেনিক স্টেডিয়ামের কথা, প্রাচীন আগোরারা কথা, টেম্পল অব অলিম্পিয়ান জিউসের কথা, ডেলপির কথা, মিতেওরার ২৪ টি মনেস্তরীর কথা।

আমি বলতাম, “শুনেছি ঈজিয়ান সমুদ্রের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর দ্বীপ। অমন একটা দ্বীপে গিয়ে দু’টো দিন কাটিয়ে আসলে কেমন হয়?”

“ওয়াও, গুড আইডিয়া!”, আনন্দে লাফিয়ে উঠতে তুমি, “ওগুলোর নাম সাইক্লেডস। সান্তরিনি, মিকোনাস, নাক্সস, এজিনা, হাইড্রা, পোরস..., এই যে দেখ, বাঁকা চাঁদের মত এই দ্বীপটা, এটাই সান্তরিনি...”, এরই মধ্যে গুগল ম্যাপে বের করে ফেলেছ তুমি, “...পৃথিবীর সেরা দশ দ্বীপের একটি”।

আমাদের হাতে এক সপ্তাহের ইস্টারের ছুটি। বাপ-বেটিতে মিলে সিদ্ধান্ত হতো, দিন তিনেক গ্রীসের মূলভূমি দেখব আমরা, তারপর ফেরি চড়ে চলে যাব সান্তরিনিতে, দু’টো দিন কাটিয়ে আসব অপার অবসরে, নির্জনতায়। আনন্দ বিহ্বল হৃদয়ে আমি আবৃত্তি করে উঠতাম,

সুচেতনা, তুমি এক দূরতম দ্বীপ,
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে|

কী ভীষণ হিংসায় উম্মত্ত আজকের এই পৃথিবী! ‘সুচেতনা’ সেখানে আদতেই এক দূরতম দ্বীপ। তবু আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখবার জন্য ‘সুচেতনা’ই যে একান্ত কাম্য, মা!

(চলবে)


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

ভালো লাগলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, সোহেল ইমাম।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আয়নামতি এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম ভাইয়া। রোদেলা(নামটা ঠিক বললেম কী?) ফুপির জন্যে অনেক অনেক শুভকামনা। পরীক্ষা শেষ করে বাবা মেয়েতে দারুণ একখানা ভ্রমণ হোক। ভ্রমণ শেষে একখানা উপাদেয় পোস্ট পাবার আশা থাকলো। শুভেচ্ছা জানবেন হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, বোন। নামটি তুমি ঠিক মনে রেখেছ। ভ্রমের ভ্রমণ সত্যিও তো হতে পারে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

কী অসাধারণ!

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, জনাব।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথম লাইনটা পড়েই নেহেরুর চিঠির কথা মনে হয়েছিলো। 'প্রাপ্য বয়স্ক' কথাটি নোট করে নিলাম, দারুণ লেগেছে। দারুণ লেগেছে লেখাটিও।

---মোখলেস হোসেন

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।