বানানায়তন- ৮ | পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর বানানরীতি মেনে চলতে হবে |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২১/১১/২০১০ - ৪:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'পাঠ্যবইয়ের বানান’ শিরোনামে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একটি বই রয়েছে। অথচ নিজের তৈরি ওই বানানরীতি এনসিটিবি নিজেই মানে না বলে শিক্ষকরা অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা আর কত দিন 'খিচুড়ি' ভাষা শিখে বড় হবে এই প্রশ্নটি যখন ক্রমেই উচ্চকিত হয়ে উঠছিল ঠিক তখনই মাধ্যমিকের সব পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি এল। এ মাসের ৩ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা কার্যকর হবে ২০১২ সাল থেকে। এর ফলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নিজস্ব বানানরীতি আর থাকছে না। [১]

অথচ এই এনসিটিবিই সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সালে কর্মশালা করে ও বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছিল। বোর্ড এই নিয়মটি করেছিল প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য। সেই নিয়মের খসড়া থেকে সাহায্য নিয়ে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী 'প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম' সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন করে, যা বছর দুয়েকের মধ্যেই সংশোধিত আকারে প্রকাশ করা হয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন প্রধান (ডিজি পদমর্যাদা বিশিষ্ট) বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত বানানরীতির বিরোধী ছিলেন। [২] ফলে বানানরীতিটি 'মোটামুটিভাবে' গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সর্বস্তরে সেভাবে সমাদৃত হতে পারেনি। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে এনসিটিবি বাংলা বানানরীতি সমতাবিধান কমিটি গঠন করে। অবশ্য তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পাঠ্যবইয়ের বানান। কিন্তু তা করতে গিয়ে, তারা বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত বানান সুপারিশের প্রতি লক্ষ রাখেনি। এ সময় তারা এমন কিছু নিয়ম প্রবর্তন করে যা-নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের বিদগ্ধ ব্যক্তিরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এনসিটিবির বোধোদয় হয়নি। অবশেষে সরকার বাহাদুর নিজেই উদ্যোগী হয়ে পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি নিলেন। অনেক দেরিতে হলেও এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করতে পারায় সংশ্লিষ্ট সকলকে আমরা অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাই।

আসলে আমরা কেন জানি সব সময়ই ভুলে যাই বাংলা বানানের নিয়ম আছে, যা অন্য অনেক ভাষাতেই নেই। বাংলা একাডেমী কেবল বাংলা বানানের সেসব নিয়মকে সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দিয়েছে, বরং বলা যায়, বানানের নিয়মগুলিকে ব্যবহারকারীর সামনে তুলে ধরেছে। এবং এটি করতে গিয়ে, ব্যাকরণকে কিছুমাত্র লঙ্ঘন করা হয়নি। এই সুখ ও আনন্দের কথা আমরা অনেকেই জানি না, যারা জানি তারা এ-নিয়ে গর্ব করতে ভয় পাই! যা হোক, অনেক দেরিতে হলেও বাংলা একাডেমীর এই প্রমিত নিয়ম (বাংলা একাডেমীর 'ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে'র পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য) আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই পেতে চলেছে। তবে একটি কথা স্বীকার করতেই হবে, এখনও এই নিয়মটির কিছু কিছু ব্যাপারে বিভক্তি রয়ে গেছে। তদুপরি বানানের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় এই নিয়মে উল্লেখ করা হয়নি। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতদ্বৈধতার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।

বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমি এখানে বাংলা একাডেমীর বানানরীতির কিছু দৃশ্যমান অসঙ্গতি তুলে ধরছি। পাঠকদের কাছ থেকেও মতামত আশা করছি। যাঁদের কাছে বাংলা একাডেমীর 'ব্যবহারিক বাংলা অভিধান' নেই তাঁদের সুবিধার্থে সম্পূর্ণ নিয়মটি এই লেখার সাথে (আপত্তিকর অংশে লাল রঙ-চিহ্নিত করে) সংযুক্ত করে দিলাম (মুখবন্ধসহ)। আশা করি এই লেখা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না এবং এই নিয়মটিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটুকু তাঁরা গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।

প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে দৃশ্যমান অনিয়মসমূহ :

১. নিয়ম ২.০১-এ বলা হয়েছে, সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের-কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী।

অনেকেই সম্ভবত গাভী শব্দটিকে তৎসম ভাবেন। এ কারণেই হয়তো এ শব্দে ঈ-কার প্রচলিত হয়নি (অভিধানেও নেই)। কিন্তু রানি, পরি এসব শব্দ অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণটি বোধ হয় সবারই জানা। বাংলায় পরি শব্দটি এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে আর রানি একটি তদ্ভব শব্দ, যার উৎপত্তি সংস্কৃত 'রাজ্ঞী' শব্দ থেকে। এখন কথা হচ্ছে, সকল অ-তৎসম শব্দে ই-কার ব্যবহৃত হবে এ-কথা বলার পরেও কোথাও কোথাও আবার পিছু ফিরে তাকানো কেন? অহেতুক এই বিকল্প বিধান আখেরে কতটুকু ফলদায়ক বলে বিবেচিত হবে?

২. নিয়ম ২.০৭-এ বলা হয়েছে, ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে 'যে', 'যাল', 'যোয়াদ', 'যোই' রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি z-এর মতো, সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলির জন্য য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত। যেমন : আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়ায্ যিন, যোহর, রমযান। তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন।

কেউ 'ইচ্ছা করলে' ব্যবহার করতে পারেন এ কেমন ধারা নিয়ম? যদি কেউ এই 'ইচ্ছা পোষণ' না করেন তাহলে কী হবে? ইতিমধ্যে অবশ্য সমস্ত বিদেশি (আরবি-ফারসিসহ) শব্দে জ ব্যবহারের নিয়ম প্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু এনসিটিবি কি এতটা প্রগতিশীল হতে পারবে?

৩. নিয়ম ২.১০-এ বলা হয়েছে, তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেমন ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেইভাবে ব্যবহার করতে হবে। তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে। যেমন : রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে।

অথচ নিয়ম ২.০৮-এ তদ্ভব এবং দেশি শব্দের উদাহরণ দিতে গিয়ে ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে ঙ ব্যবহারের যৌক্তিক কোনো কারণ উল্লেখ না করেই।

৪. নিয়ম ৩.০৪-এ বলা হয়েছে, নাই, নেই, না, নি এই নঞর্থক অব্যয় পদগুলি শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন : বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই।

বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে 'নি' শব্দটির দুটি মাত্র ভুক্তি পাওয়া যায় :

নি১ : অব্য সামীপ্য, আতিশয্য, অভাব, সাদৃশ্য ইত্যাদি ভাবপ্রকাশক উপসর্গ।

নি২ : সঙ্গীতের সপ্তসুরের শেষ সুর, সপ্তম সুর, নিষাদ।

প্রথম ভুক্তিটিতে 'নি'কে পূর্ণাঙ্গ শব্দ বলা যায় না, কারণ এটি উপসর্গ (prefix)। উপসর্গ কোনো শব্দ নয়। তাহলে 'নি' তখনই শব্দের মর্যাদা পাবে যখন এটি সঙ্গীতের সপ্তসুরের শেষ সুর বা নিষাদ ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করবে। আর কে না জানে, কোনো শব্দ আলাদা বসে তখনই যখন সেটি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে একটি অর্থ প্রকাশ করে।

কিন্তু যখন আমরা 'যায় নি' বলছি তখন 'নি' নিঃসন্দেহে 'নাই' এর সংকুচিতরূপ, তাই স্বাভাবিক নিয়মে 'নি' স্বতন্ত্রভাবেই বসার কথা। অথচ 'নাই' অর্থে আলাদা শব্দ হিসেবে অভিধানে এর উল্লেখ নেই। এটা কি তাহলে স্ববিরোধিতা হয়ে গেল না? তা ছাড়া 'হয়নি' শব্দটি আমরা সাধারণত দ্রুত উচ্চারণ করি, সেক্ষেত্রে এক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তা সত্ত্বেও 'নি'কে যদি আলাদা রাখতেই হয় তাহলে আভিধানে 'নাই' অর্থে 'নি'কে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তার আগ পর্যন্ত খায় নি, করি নি, যায় নি এসব বানান লিখতে বলাটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি কিছুটা অবিচারই হয়ে যায় না কি?

৫. নিয়ম ৪.০১-এ বলা হয়েছে, অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।

মজার বিষয় এই যে, বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে কিছু তদ্ভব শব্দেও শক্তভাবে ণত্ব-বিধি মেনে চলা হয়েছে। যেমন ঘন্টা, গুন্ডা এসব ভুক্তি নেই। আবার লন্ঠন শব্দের ভুক্তি লণ্ঠনের আগে, অর্থাৎ অভিধানটির নিয়ম অনুযায়ী লন্ঠন (যেহেতু এর উৎপত্তি ইংরেজি শব্দ lantern থেকে) শব্দটিই প্রমিত। বিপরীত দিক থেকে ভাবলে, কেউ কিন্তু প্রেসিডেণ্ট, আণ্টি, ব্যাণ্ড প্রভৃতি লিখতে বলছেন না। প্রেসিডেন্ট, আন্টি, ব্যান্ড এসব শব্দ বিদেশি (অর্থাৎ সংস্কৃত-ঘেঁষা নয়) বলেই কি? যদি এটাই কারণ হয়ে থাকে তাহলে সেটা স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায়?

---------------------------------------------------------------------------------

বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম

মুখবন্ধ

উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হলো, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্মেষ হলো, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন-অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় বহু তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ গৃহীত হলেও অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশী, বিদেশী শব্দের পরিমাণ কম নয়। এ ছাড়া রয়েছে তৎসম-অর্ধসৎসম শব্দ, প্রত্যয়, বিভক্তি, উপসর্গ ইত্যাদি সহযোগে গঠিত নানারকমের মিশ্র শব্দ। তার ফলে বানান নির্ধারিত হলেও বাংলা বানানের সমতাবিধান সম্ভবপর হয় নি। তা ছাড়া, বাংলা ভাষা ক্রমাগত সাধু রীতির নির্মোক ত্যাগ করে চলিত রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তার উপর, অন্য অনেক ভাষার মতো বাংলারও লেখ্য রূপ সম্পূর্ণ ধ্বনিভিত্তিক নয়। তাই বাংলা বানানের অসুবিধাগুলি চলতেই থাকে। এই অসুবিধা ও অসঙ্গতি দূর করার জন্য প্রথমে বিশ শতকের বিশের দশকে বিশ্বভারতী এবং পরে ত্রিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র সহ অধিকাংশ পণ্ডিত লেখক সমর্থন করেন। এখন পর্যন্ত এই নিয়মই আদর্শ নিয়মরূপে মোটামুটি অনুসৃত হচ্ছে।

তবু বাংলা বানানের সম্পূর্ণ সমতা বা অভিন্নতা যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়। বরং কালে কালে বানানের বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাচ্ছে। কতকগুলি শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানাজনে নানারকম বানান লিখছেন। এটি গৌরবের কথা নয়। বানানের এইসব বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলার কী কী কারণ থাকতে পারে এখানে সে-আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। তবে অনেক চলমান ও বর্ধিষ্ণু ভাষাতেই দীর্ঘকাল জুড়ে ধীরে ধীরে বানানের কিছু কিছু পরিবর্তন হতে দেখা যায়। তখন এক সময়ে বানানের নিয়ম নতুন করে বেঁধে দেওয়ার বা সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। এ-যাবৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়ম আমরা অনুসরণ করে চলেছি। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি-অনুযায়ী, নানা বানানের যে-সব বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি আমরা দেখছি সেই পরিপ্রেক্ষিতে বানানের নিয়মগুলিকে আর একবার সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়মে বিকল্প ছিল কিছু বেশি। বিকল্প হয়তো একেবারে পরিহার করা যাবে না, কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার। এইসব কারণে বাংলা একাডেমী বাংলা বানানের বর্তমান নিয়ম নির্ধারণ করছে।

বাংলাদেশে এ-কাজ হয়তো আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। ১৯৪৭-এর পর সরকার, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কোনো কোনো ব্যক্তি বাংলা বানান ও লিপির সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে-চেষ্টা কখনো সফল হয় নি। আমরা এই নিয়মে বানান বা লিপির সংস্কারের প্রয়াস না করে বানানকে নিয়মিত, অভিন্ন ও প্রমিত করার ব্যবস্থা করেছি। এ-কাজ করার দাবি অনেক দিনের। এবং তা যে বাংলাদেশে একেবারে হয় নি সে-কথাও ঠিক বলা চলে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কর্মশালা করে ও বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছেন। বোর্ড এই নিয়ম করেছেন প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য। সেই নিয়মের খসড়া থেকে আমরা সাহায্য নিয়েছি এবং সেজন্য আমরা বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ। বলা বাহুল্য, বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষেত্রে যে পথিকৃতের কাজ করেছিলেন তার জন্য সকল বাঙালিই তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।

এখন থেকে বাংলা একাডেমী তার সকল কাজে, তার বই ও পত্রপত্রিকায় এই বানান ব্যবহার করবে। ভাষা ও সাহিত্যের জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে বাংলা একাডেমী সংশ্লিষ্ট সকলকে—লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষভাবে সংবাদপত্রগুলিকে—সরকারি ও বে-সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে এই বানান ব্যবহারের সুপারিশ ও অনুরোধ করছে।

বাংলা বানান সংস্কার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কেবল বানানের নিয়ম বেঁধে দিয়েছি, বরং বলা যায়, বানানের নিয়মগুলিকে ব্যবহারকারীর সামনে তুলে ধরেছি। এইসব নিয়ম বা এইসব বানানে ব্যাকরণের বিধান লঙ্ঘন করা হয় নি। [ঈষৎ সংক্ষেপিত]

তৎসম শব্দ

১.০১. তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও অপরিবর্তিত থাকবে। কারণ এইসব শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে।

১.০২. তবে যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয় শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তার-কার চিহ্ন ই-কার উ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, ধমনি, পঞ্জি, ধূলি, পদবি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, লহরি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা।

১.০৩. রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন : অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য।

১.০৪. সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) লেখা যাবে। যেমন : অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। তবে অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, গঙ্গা, বঙ্গ, লঙ্ঘন, সঙ্গ, সঙ্গী প্রভৃতি সন্ধিবদ্ধ নয় বলে ঙ স্থানে ং হবে না।

অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দ

২.০১. ই ঈ উ ঊ

সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের-কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেমন গাড়ি, চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি (অত্যন্ত অর্থে), শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, সরকারি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মামি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচ, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুখা, মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ।

অনুরূপভাবে—আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন : খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি।

তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী।

সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি! তোমার কী। এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে। কী আনন্দ! কী দুরাশা!

অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি শব্দটি লেখা হবে। যেমন : তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী।

পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন : ছেলেটি, লোকটি, বইটি।

২.০২. ক্ষ

ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত শব্দ খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা হবে। তবে অ-তৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে, ইত্যাদি লেখা হবে।

২.০৩. মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন

তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-য়ের নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণত্ব-বিধি মানা হবে না অর্থাৎ ণ ব্যবহার হবে না। যেমন : অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, সোনা, হর্ন।

তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে যুক্ত নাসিক্য বর্ণ ণ হয়, যেমন : কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচণ্ড। কিন্তু তৎসম ছাড়া অন্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগেও কেবল ন হবে। ৪.০১ দ্রষ্টব্য।

২.০৪. শ, ষ, স

তৎসম শব্দে শ, ষ, স-য়ের নিয়ম মানতে হবে। এ-ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না।

বিদেশী মূল শব্দে শ, স-য়ের যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যবহার করতে হবে। যেমন : সাল (=বৎসর), সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলো, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক, বেহেশ্ ত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট। তবে পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূমে শ দিয়ে লেখা হবে। তৎসম শব্দে ট, ঠ বর্ণের পূর্বে ষ হয়। যেমন : বৃষ্টি, দুষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশী শব্দে এই ক্ষেত্রে স হবে। যেমন : স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট।

কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে।

২.০৫. আরবি-ফারসি শব্দে 'সে', 'সিন', 'সোয়াদ' বর্ণগুলির প্রতিবর্ণরূপে স, এবং 'শিন'-এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যবহৃত হবে। যেমন ; সালাম, তসলিম, ইসলাম, মুসলিম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শাওয়াল (হিজরি মাস), বেহেশ্ ত। এই ক্ষেত্রে স-এর পরিবর্তে ছ লেখার কিছু প্রবণতা দেখা যায়, তা ঠিক নয়। তবে যেখানে বাংলায় বিদেশী শব্দের বানান সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে স ছ-য়ের রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ ব্যবহার করতে হবে। যেমন : পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ।

২.০৬. ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশী s বর্ণ বা ধ্বনির জন্য স এবং sh, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে।

২.০৭. জ, য

বাংলায় প্রচলিত বিদেশী শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি-অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন : কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি, হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা।

[=red]কিন্তু ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে 'যে', 'যাল', 'যোয়াদ', 'যোই' রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি z-এর মতো, সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলির জন্য য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত। যেমন : আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়ায্ যিন, যোহর, রমযান। তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন। [=red]জাদু, জোয়াল, জো, ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লেখা বাঞ্ছনীয়।

২.০৮. এ, অ্যা

বাংলায় এ বা এ-কার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা বাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম রয়েছে। অনুরূপ তৎসম এবং বিদেশী শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা এ-কার হবে। যেমন : দেখে, দেখি, যেন, জেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো), গেল, গেলে, গেছে।

বিদেশী শব্দ অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা এ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : এন্ড (end), নেট, বেড, শেড।

বিদেশী শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা অ্যা-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : অ্যান্ড (and), অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট।

তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশী শব্দ রয়েছে যার অ্যা-কারযুক্ত রূপ বহুল-পরিচিত। যেমন : ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে অ্যা অপরিবর্তিত থাকবে।

২.০৯.

বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়। এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ও-কার ব্যবহার করছেন। যেমন : ছিলো, করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য), ইত্যাদি ও-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ও-কার ব্যবহার করা হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে। যেমন : ধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, ভালো, আলো, কালো, হলো।

২.১০. ং, ঙ

তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেমন ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেইভাবে ব্যবহার করতে হবে। এ-সম্পর্কে পূর্বে ১.০৪ অনুচ্ছেদে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে। তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে। যেমন : রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে। যেমন : বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের। বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ-দু’টি ং দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।

২.১১. রেফ ও দ্বিত্ব

তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, অ-তৎসম সকল শব্দেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন : কর্জ, কোর্তা, মর্দ, সর্দার।

২.১২. বিসর্গ

শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না। যেমন : কার্যত, মূলত, প্রধানত, প্রয়াত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ।

পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে। তবে অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়। যেমন : দুস্থ, নিস্পৃহ।

২.১৩. আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ

আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ও-কার যুক্ত করা হবে। যেমন : করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো।

২.১৪. বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণ

বাংলায় বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে। তাই ব্যাপকভাবে বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাৎ ভেঙে দেওয়া উচিত নয়। শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষ সম্ভবই নয়। যেমন : স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিন্ট, স্প্রিং। তবে কিছু কিছু বিশ্লেষ করা যায়। যেমন : সেপটেম্বর, অকটোবর, মার্কস (ক-এর নিচে হসন্ত), শেকসপিয়র (ক-এর নিচে হসন্ত), ইসরাফিল (স-এর নিচে হসন্ত)।

২.১৫. হস্-চিহ্ন

হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন : কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক, টক।

তবে যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : উহ্, যাহ্।

যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলেও তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : কর্, ধর্, মর্, বল্।

২.১৬. ঊর্ধ্ব-কমা

ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন : করল (=করিল), ধরত, বলে (=বলিয়া), হয়ে, দু জন, চার শ, চাল (চাউল), আল (=আইল)।

বিবিধ

৩.০১. যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণগুলি যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলির স্পষ্ট রূপ দিতে হবে। তার জন্য কতকগুলি স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে। যেমন গু, রু, শু, দ্রু, শ্রু, রূ, ভ্রূ, হৃ, ত্র, ভ্র। [অভ্র কি-বোর্ডে এসব যুক্তবর্ণ ভেঙে দেখানো সম্ভব হলো না বলে দুঃখিত]

তবে ক্ষ, জ্ঞ, ঞ্জ, ষ্ণ, হ্ম, ভ্র, হ্ন—এইসব ক্ষেত্রে পরিচিত যুক্ত-রূপ অপরিবর্তিত থাকবে। কেননা তা বিশ্লিষ্ট করলে উচ্চারণবিকৃতির সম্ভাবনা থাকে।

৩.০২. সমাসবদ্ধ পদগুলো একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা চলবে না। যেমন : সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার, মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদমণ্ডিত, সমস্যাপূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব, দৃঢ়সঙ্কল্প, সংযতবাক, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র।

বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ পদটিকে একটি, কখনো একটির বেশি হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন মা-মেয়ে, মা-ছেলে, বেটা-বেটি, বাপ-বেটা, ভবিষ্য-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, বে-সামরিক, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, কিছু-না-কিছু।

৩.০৩. বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। যেমন : সুনীল আকাশ, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন, সুগন্ধ ফুল, লাল গোলাপ, ভালো দিন, সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু যদি সমাসবদ্ধ পদ অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের গুণ বর্ণনা করে তাহলে স্বভাবতই সেই যুক্তপদ একসঙ্গে লিখতে হবে। যেমন : কতদূর যাবে, একজন অতিথি, তিনহাজার টাকা, বেশির-ভাগ ছেলে, শ্যামলা-বরন মেয়ে। তবে কোথাও কোথাও সংখ্যাবাচক শব্দ একসঙ্গে লেখা যাবে। যেমন : দুজনা।

৩.০৪. নাই, নেই, না, নি এই নঞর্থক অব্যয় পদগুলি শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন : বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই।

তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে না উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন : নারাজ, নাবালক, নাহক।

অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে না-এর পর হাইফেন ব্যবহার করা যায়। যেমন : না-বলা বাণী, না-শোনা কথা, না-গোনা পাখি।

৩.০৫. উদ্ধৃতি মূলে যেমন আছে ঠিক তেমনি লিখতে হবে। ‘কোন’ [কোনো] পুরাতন রচনায় যদি বানান বর্তমান নিয়মের অনুরূপ না হয়, উক্ত রচনার বানানই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে হবে। যদি উদ্ধৃত রচনায় বানানের ভুল বা মুদ্রণের ত্রুটি থাকে, ভুলই উদ্ধৃত করে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে শুদ্ধ বানানটির উল্লেখ করতে হবে। এক বা দুই ঊর্ধ্ব-কমার দ্বারা উদ্ধৃত অংশকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে উদ্ধৃত অংশকে যদি ইনসেট করা হয় তাহলে ঊর্ধ্ব-কমার চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে না। তাছাড়া কবিতা যদি মূল চরণ-বিন্যাস অনুযায়ী উদ্ধৃত হয় এবং কবির নামের উল্লেখ থাকে সেক্ষেত্রেও উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়ার দরকার নেই। ইনসেট না হলে গদ্যের উদ্ধৃতিতে প্রথমে ও শেষে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়া ছাড়াও প্রত্যেক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দিতে হবে। প্রথমে, মধ্যে বা শেষে উদ্ধৃত রচনার কোনো অংশ যদি বাদ দেওয়া হয় অর্থাৎ উদ্ধৃত করা না হয়, বাদ দেওয়ার স্থানগুলিকে তিনটি বিন্দু বা ডট্ (অবলোপ চিহ্ন) দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। গোটা অনুচ্ছেদ, স্তবক বা একাধিক ছত্রের কোনো বৃহৎ অংশ বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি তারকার দ্বারা একটি ছত্র রচনা করে ফাঁকগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে।

কোনো পুরাতন অভিযোজিত বা সংক্ষেপিত পাঠে অবশ্য পুরাতন বানানকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তিত করা যেতে পারে।

৪.০১ ণত্ব-বিধি সম্পর্কে দুই মত

অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।

চলতি ভাষায় ক্রিয়াপদের কতকগুলি রূপ

হ-ধাতু : হয়, হন, হও, হস, হই। হচ্ছে। হয়েছে। হোক, হোন, হও, হ। হলো, হলে, হলাম। হতো। হচ্ছিল। হয়েছিল। হবো, হবে। হয়ো, হস। হতে, হয়ে, হলে, হবার (হওয়ার), হওয়া।

খা-ধাতু : খায়, খাও, খান, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, খাও, খা। খেল, খেলে, খেলাম। খেত, খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব, খাবে। খেয়ো, খাস। খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার (খাওয়ার), খাওয়া।

দি-ধাতু : দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিল, দিলে, দিলাম। দিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেবো, দেবে। দিও (দিয়ো), দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার (দেওয়ার), দেওয়া।

নি-ধাতু : নেয়, নেন, নাও, নিস, নিই। নিচ্ছে। নিয়েছে। নিক, নিন, নাও, নে। নিল, নিলে, নিলাম। নিত। নিচ্ছিল। নিয়েছিল। ণেব, নেবে। নিও (নিয়ো), নিস। নিতে, নিয়ে, নিলে, নেবার (নেওয়ার), নেওয়া।

শু-ধাতু : শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই। শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শোন, শোও, শো। শুল, শুলে, শুলাম। শুত। শুচ্ছিল। শুয়েছিল। শোব, শুয়ো, শুস। শুতে, শুয়ে, শুলে, শোবার (শোওয়ার), শোয়া।

কর্-ধাতু : করে, করেন, করো, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, করো, কর। করল, করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল। করব, করবে। কোরো, করিস। করতে, করে, করলে, করবার (করার), করা।

কাট্-ধাতু : কাটে, কাটেন, কাটো, কাটিস, কাটি। কাটছে। কেটেছে। কাটুক, কাটুন, কাটো, কাট। কাটল, কাটলে, কাটলাম। কাটত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব, কাটবে। কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার (কাটার), কাটা।

লিখ্-ধাতু : লেখে, লেখেন, লেখো, লিখিস, লিখি। লিখছে। লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখো, লেখ। লিখল, লিখলে, লিখলাম। লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব, লিখবে। লিখো, লিখিস। লিখতে, লিখে, লিখলে, লেখবার (লেখার), লেখা।

শিখ্-ধাতু : শেখে, শেখেন, শেখো, শিখিস, শিখি। শিখছে। শিখেছে। শিখুক, শিখুন, শেখো, শেখ। শিখল, শিখলে, শিখলাম। শিখতো। শিখছিল। শিখেছিল। শিখব, শিখবে। শিখো, শিখিস। শিখতে, শিখে, শিখলে, শেখবার (শেখার), শেখা।

উঠ্-ধাতু : ওঠে, ওঠেন, ওঠো, উঠিস, উঠি। উঠছে। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠো, ওঠ। উঠল, উঠলে, উঠলাম। উঠত। উঠছিল। উঠব, উঠবে। ওঠো, উঠিস। উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার (ওঠার), ওঠা। [৩]

---------------------------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র : ১. দৈনিক প্রথম আলো (০৪-১১-২০১০)
২. বাংলা বানান_বিতর্ক এবং পদক্ষেপ (ড. সৌমিত্র শেখর, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
৩. বাংলা একাডেমীর 'ব্যবহারিক বাংলা অভিধান' (পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ : সেপ্টেম্বর ২০০৩)

---------------------------------------------------------------------------------

---------------------------------------------------------------------------------
পূর্ববর্তী পর্ব :
বানানায়তন- ৭ | বাংলা হরফ বনাম রোমান হরফ—জ বনাম J, Z, G |
বানানায়তন- ৬ | বাংলার তিন 'শ'—দন্ত্য-স, মূর্ধন্য-ষ আর তালব্য-শ| বানানায়তন- ৫ | দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ |
বানানায়তন- ৪ | 'অনুস্বার' বনাম 'ঙ', সাথে 'এ' বনাম 'অ্যা' |
বানানায়তন-৩ | হ্রস্ব স্বর না দীর্ঘ স্বর |
বানানায়তন- ২ | ও কি এল, ও কি এল না |

বানানায়তন ১ | ই-কার বনাম ঈ-কার |
---------------------------------------------------------------------------------

-----------------------------
কুটুমবাড়ি

-----------------------------


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

উল্লিখিত অনিয়মগুলো সম্পর্কে অল্পবিস্তর অবগত আছি। ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হবার চেষ্টা আছে বলতে পারেন। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে, মূল্যবান পোস্টটির জন্য।

"আশা করি এই লেখা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না এবং এই নিয়মটিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটুকু তাঁরা গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।"

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয় অতিথি লেখক,
ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লেগেছে, তবে নামটি জানতে পারলে আরও ভালো লাগত। হাসি

এনসিটিবি অনেক দিন ধরেই একটি খিচুড়ি বানানরীতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে আসছিল। আমি রীতিমতো জেহাদি মনোভাব নিয়ে এ সম্পর্কে লেখার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু সরকার এনসিটিবিকে বাংলা একাডেমীর বানানরীতি অনুসরণের নির্দেশ দেওয়ায় সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন যেহেতু বাংলা একাডেমীর প্রমিত নিয়ম পাঠ্যবইয়ে স্থান পেতে চলেছে তাই এই নিয়মের ছোটখাটো অসঙ্গতিগুলিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো। সেজন্যই এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

সংশোধনী : 'চলতি ভাষায় ক্রিয়াপদের কতকগুলি রূপ' এই অংশে
দুটি বানান ভুল চোখে পড়ল। ণেব> নেব, শিখতো> শিখত। ইয়ে, মানে...

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

ডুপ্লি ঘ্যাচাং

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

কাজের লেখা, মনে হলো আমি এতদিন কী লিখে এসেছি? বেটার লেট দ্যান নেবার, এবার "শুধরে নেব জীবনের ভুলগুলি"
-----------------------------------
যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, রোমেল চৌধুরী ভাই। শুভেচ্ছা রইল। হাসি

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

অতি মূল্যবান পোস্ট. বাংলা একাডেমীর বাংলা অভিধান সকলের মেনে চলা উচিত।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

মূল্যবান পোস্ট

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখকরা দেখছি সবাই নাম লিখতে ভুলে যাচ্ছেন। হাসি ক্যাম্নে কী? চিন্তিত

কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।