ড্রিম জব!!!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৫/২০১১ - ৪:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই এলাকায় নুতন বাড়ী কিনে গৃহ প্রবেশের পরের সপ্তাহেই দশ বছরের পুত্র এসে জানালো আগামী কাল তার ‘জব ইন্টারভিউ’। পরের দিন সকালে ঢ্যাংগা মতন একজন রাশান ভদ্রলোক এলেন আমাদের বাসায়। ফ্লায়ার ফোর্সের এরিয়া ম্যানেজার। এখানকার প্রায় প্রতিটি দোকানেই প্রতি সপ্তাহেই কিছু কিছু জিনিসের দাম কমিয়ে ব্যাবসা করার এদেশি নিয়ম। যে যে জিনিসের দাম কমলো, তার ছবিসহ নুতন দামের লিস্ট চমৎকার রঙ্গীন পেপারে ছাপিয়ে মানুষের বাড়ীতে বাড়ীতে পৌছে যায় শুক্রবার রাতেই, এই ছাপানো পেপারের নাম হচ্ছে ফ্লায়ার, আর বাড়ীতে বাড়ীতে পৌছানোর কাজটি দশ বছর বয়সে আমার এক্ মাত্র পুত্রের ড্রিম জব! আমাদের অনুমতি সাপেক্ষে ম্যানেজার সাহেব ইন্টারভিউ নিলেন, কোন হ্যাংকি প্যাংকি না, সিরিয়াস ব্যাপার স্যাপার, প্রশ্নের যথাযথ উত্তরে খুশি হয়ে সাথে সাথে কন্ট্রাক্ট সাইন করতে বললেন, কো-সাইনার মা অথবা বাবা। ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলতে হবে, যেখানে প্রতি সপ্তাহে তার বেতনটা জমা হবে।

ব্যাংকে গিয়ে একাউন্ট খোলার জন্য ফর্ম ফিল আপ করার পর, ব্যাংকের ভদ্র মহিলা ছেলেকে অভিনন্দন জানিয়ে যা বললেন তার সারমর্ম, ‘তুমি যেহেতু এখনো ছোট, সেইহেতু তোমার মায়ের সাথে সাব একাউন্ট খুলতে হবে। তুমি একটা পাস বই পাবে, মাসের শেষে ব্যাংকে এলে যেকোন ব্যাংক কর্মী ইনফর্মেশন হাতে লিখে আপডেট করে দেবে ঐ পাসবইএ’। রুটিন চেকের মত আলগোছে মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডু ইউ হ্যাভ এনি কোশ্চেন?’ অত্যন্ত বিনয় কিন্ত পরিস্কার স্বরে পুত্র বললো ‘আই হ্যাভ থ্রি কোশ্চেন, নাম্বার ওয়ান, ক্যান আই হ্যাভ এ ডেবিড কার্ড, সো আই ক্যান উইথড্র মানি ফ্রম দি এটিএম মেশিন?’ মহিলা বললেন ‘ও কে, হোয়াট ইজ দি সেকেন্ড ওয়ান?’ পুত্রের প্রশ্ন, ‘ইনস্টিড অফ ড্যাট হ্যান্ড রিটেন বুক, ক্যান আই হ্যাভ ব্যাঙ্ক স্টেটম্যেন্ট, পোস্টেড টু মাই হোম?’ অত্যান্ত অবাক হলেও তিনি বললেন, ‘এন্ড হোয়াট ইজ দা থার্ড ওয়ান?’ একটু থেমে সে প্রশ্ন করলো ‘হাউ মেনি ট্রাঞ্জাকশান ইজ ফ্রি?’ অবাক হোলেও ভদ্র মহিলা খুব খুশি হয়েই প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যা’ বললেন, তৃতীয়টার উত্তরে বললেন ‘ইউ আর টেন ইয়ারস ওল্ড, ইউ ক্যান হ্যাভ ফার্স্ট টেন ট্রাঞ্জেকশান ফ্রি’। আরেক বন্ধুর সাথে মিলিয়ে মোট একশত ছেশট্টিটা বাসায় তিন বছর ঠিক নিয়মমত ফ্লায়ার ডেলিভারি করেছে, গাদা গাদা ফ্লায়ারস গাড়ীর বুটে নিয়ে তাদের সাথে সাথে পাহারায় গাড়িতে বসে থেকেছি। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার আগেই সাবওয়ে, হকি কোচ, কল সেন্টার, একটি প্রাইভেট অফিসের ফাইন্যান্স ডিপার্ট্মেন্ট কাজ করে সে মনে করলো আসলে কাজ কাজই, ড্রিম ট্রিম গুলো নিয়ে না ভাবাই ভালো। যদিও চার পাঁচ বছর বয়সে তার প্রবল ইচ্ছে ছিলো ট্রাক ড্রাইভার হবার!!!

সেকেন্ড ইয়ারে সামার জবের জন্য বন্ধু বান্ধব সহ অনলাইনে গভর্মেন্টে এপ্লাই করে, ছয় বন্ধুই একসাথে ইন্ডাস্ট্রি কানাডাতে সামার জব পেয়ে গেল। কাজে যোগ দেবার এক সপ্তাহ পরে সে আর একটি অফার পেলো রেভিনিউ কানাডাতে, বেতন আগেরটার থেকে ঘন্টায় পাচ ডলার বেশি। তার মানে, দিনে চল্লিশ, সপ্তাহে দুইশ, মাসে আট, নয়শ ডলার বেশি। দুই পা আগিয়ে এক পা পিছিয়ে অবশেষে সে নুতন চাকরিতে যোগ দিল। দিন তিনেক পরেই দেখি অফিস থেকে এসে এতিমের মত দুঃখি দুঃখি চেহারা নিয়ে আমার সামনে অকারনেই ঘোরা ঘুরি করছে। সব বুঝেও না বোঝার মত করেই জিজ্ঞেস করি, ‘কি হোল বাবা, মন খারাপ কেনো?’ উত্তরে একদম হতাশ স্বরে বললো ‘বুড়োদের সাথে কাজ করতে একদম ভালো লাগছে না, ঐখানে বন্ধুরা সবাই একসাথে ব্রেক নিচ্ছে, লাঞ্চে যাচ্ছে, কত ফান!’ বুঝছেন তো আসল ব্যাপার হচ্ছে ঐ বন্ধু এবং ফান!! আমি বলি, ‘বাবা বুড়োদের সাথে কাজ করে মজা আছে, তোমাকে অনেক আদর করবে উনারা’। গরম তেলে ফোড়ন দেবার মতন চিড়বিড়িয়ে
উঠলো, ‘বুড়োরা আদর করে না, খালি খালি কাজ দ্যায়, ওদের কাজ ও আমার টেবিলে দিয়ে দ্যায়’!

দুই হাজার আটে ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগেই সে রেভিনিউ কানাডাতে ফুল টাইম চাকরীর অফারটা নিয়ে নিল। তারপর আমার অবাক হবার পালা। হাইস্কুল থেকেই মাথার চুল গুলিকে জেল দিয়ে মোরগের ঝুটির মত কপালের কাছে খাড়া করে চুলের ফ্যাসন করতো। অন্যান্যদের মত জিন্সের প্যান্টে ফুটো ফাটা, চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স। সেগুলিকে ঝেটিয়ে বিদায় দিল, চুল বায়ে সিথি করে আচড়ানো, চোখে চশমা, গায়ে উঠলো অতি ভদ্রলোকের কাপর চোপর। দিন কতক পরে হটাৎ আমাদের জিজ্ঞেস করলো মুখে দাড়ি বা মোচ রাখলে কেমন হবে। বোনেরা নির্বিকার ভাবেই জানান দিল তার মুখে মনকে মন মিরাকেল গ্রো সার দিলেও ছাগলা দাড়িই গজাবে, আর মোচ মোটেই সুবেধের লাগবেনা তার চেহারায়। একটু সদয় বড় বোন জিজ্ঞেস করলো ‘কেন ভাইয়া মোচ দাড়ির কথা বলছো কেন?’ উত্তরে সে তার অস্বস্তির কথা বললো, তার কলিগরা সব তার থেকে দুই গুন বড় বয়সে, তো তার চেহারায় কি করে একটু ভারিক্কি করা যায়। ও এই ব্যাপার!!! ‘চেহারা ভারিক্কি করা লাগবে না’। বোনেরা বুদ্ধি দেয় ‘কাজটা ভালো ভাবে করো, সবার সাথ ফ্রেন্ডলি কথাবার্তা বলো’।

ইউনিভার্সিটিতেই কেরিয়ার সেন্টার আছে, কাউন্সিলার আছেন। প্রতিবছর জবফেয়ার হয় খোদ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই। নামী দামী কোম্পানির এইচ আর এর ঝানু ম্যানেজারেরা চিলের মত শ্যান দৃস্টিতে খুজতে থাকে যোগ্য, সেরা ক্যান্ডিডেটকে। সেরা ছাত্রই যে সেরা চাকরিটা বগলদাবা করবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই! আবার প্রাইভেট সেক্টরে একই চাকরির একই পজিশনে একই বেতন না হবার সম্ভাবনাই বেশি!! উপযুক্ত মনে হোলে আটলান্টিক উপকুল থেকে যাওয়া আসার প্লেন ভাড়া দিয়ে প্রশান্ত উপকুলে নিয়ে পাচ তারা হোটেলে রেখে ইন্টারভিউ নিয়ে সাথে সাথে চাকরির কন্ট্রাক্ট সাইন করিয়ে নেয়। দুই হাজার পাঁচ সালে ছোট মেয়ে (সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার)যখন গো ধরে ব্যাচের সেরা চাকরিটা করার জন্য ভ্যাংকুভারে যাবে, তখন অলরেডি মেজ মেয়ে (সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার) প্রতি সোমবার অটোয়ার বাসা থেকে সকাল ছয়টার প্লেনে করে নিউ ইয়র্ক এর ম্যনহাটনে অফিস করছে, উইক ডে পাচতারা হোটেলে থেকে শুক্রবারে অফিস শেষে প্লেনেই ফের অটোয়াতে ফিরে আসছে। দুই হাজার এক সালের কার্ল্টন ইউনিভারসিটির কম্পিউটার সায়েন্সের সেরা বেতনের চাকরিটা বড় মেয়ে নিয়ে নেয় সফটওয়ার ডিজাইনার হিসেবে।

এ বছর ইস্টারের লং উইক এন্ডে ছোট মেয়েকে দেখতে ভ্যাংকুভারে গেলাম। শনি বারে মেয়ের অফিসে একটু সময়ের জন্য যেতে হোল, সংগে আমাদেরকেও নিয়ে গেল। বেন্টাল্ল টাওয়ারের ছাব্বিশ তালায় ডেলওয়েট অফিস। মেয়ে যখন কাজে ব্যাস্ত, কানাডিয়ান জামাই আমাকে উইকেন্ডের ফাকা কর্পোরেট অফিসটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো। বড় কাচের জানালার বাহিরে আদিগন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট ছোট রুপালি ঢেউ, ঠিক পাহারের পদদেশে সমুদ্রের সৈকতে ছবির মত সাজানো ভাংকুভার শহর, ছাব্বিশ তালার বড় কাচের জানালা দিয়ে আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, জামাই আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘আম্মু ডিড ইউ এভার থট, ইয়োর ইয়োংগেস্ট ডটার উইল ওয়ার্ক হিয়ার?’ তার চোখের দিকে তাকিয়ে অকপটেই বললাম; ‘নো বাট আই অলওয়েস হ্যাভ ড্রিম’।

আমার স্বপ্নটাকে ছুয়ে এলাম!!!

আসমা খান, অটোয়া।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।