ঘুষখবর!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৭/০৬/২০১১ - ৭:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


ইয়ে, মানে একটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করি, শেষ কবে ঘুষ দিয়েছিলেন? মানে ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় কিঞ্চিত তেলপানি দেয়া লেগেছিল? পাসপোর্ট করার সময়? বিদ্যুতের ভূতুড়ে বিল সামলানোর জন্য? কলেজের সার্টিফিকেট ইংরেজী করার সময়? বাড়ি সংক্রান্ত কোন কাজে রাজউকে? নাকি বছরশেষে ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা ভদ্রলোকের মত মেটানোর জন্য আপনার ট্যাক্স লইয়ার আপনাকে বলেছিল আপনার ট্যাক্স এত টাকা, আমার ফী এত টাকা আর এই টাকার ভেতরে জান ছুটানোর জন্য ট্যাক্স অফিসের খরচ এত টাকা?

ভালো লাগুক আর না লাগুক প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আমরা নানাপদে ঘুষের পাল্লায় পড়ে থাকি। আমি সহজভাবে এই প্র্যাক্টিসকে এইভাবে দেখি, মোটামুটি এমন কোন সরকারী বিভাগ নেই, যেখানে যা আইন অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে হবার কথা সেটি কিঞ্চিত পয়সা খরচ ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে হয়ে যাবে, আর উলটো করে বললে এমন কোন বিভাগ নেই, যেখানে কিঞ্চিত পয়সা খরচ করলে, যা আইনে নাই, তা করে ফেলা যায়না। আর আমাদের সচ্চরিত্র জাতির বেসরকারী পর্যায়েও যে বিশাল আকারের টেবিলের তলায় টাকার লেনদেন হয় সেটিও বেশ ভীতিকর। ফলে সত্যি কথা হল, যারা সেবা দানকারী হিসেবে বিশেষ কোন সুবিধা দিতে চান না, অথবা গ্রাহক হিসেবে বিশেষ কোন সুবিধা নিতে চান না, তাদের জন্য দেশের মাটিতে অনেক সময়েই নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়ে যায়।

আমরা জনগণ যেখানে নিয়মিত কিছু লোভী, স্বার্থপর, ধান্দাবাজ লোকের সমন্ময়ে গঠিত দুটি রাজনৈতিক দলকে উলটে পালটে আমাদের ত্রাতা হিসেবে নির্বাচিত করি, সেখানে সরকার বা রাজনৈতিকভাবে এই পরিস্থিতির থেকে উত্তরণের সুযোগ কম। আর দূর্নীতির শিকার যারা তাদের ভিন্ন ভিন্ন হয়রানীগুলোর কোন একত্রিত প্ল্যাটফর্ম বা একত্রিত কন্ঠ নেই। ফলে অবস্থা যা ছিল তাই থাকছে বছরের পর বছর। মাঝখানে কিছুদিন বিজ্ঞাপন দেখতাম র‍্যাবের, যে দূর্নীতির শিকার হলে

ধরণের ঠিকানায় ইমেইল করে জানাতে, আদৌ কেউ ইমেইল করত কিনা, বা ইমেইল করে ফল পেয়েছে কিনা সেটি সম্পর্কে তেমন জানা যায়না। আর দুদকের নখ-দাঁত ইত্যাদি আছে নাকি নাই, ইত্যাদি নিয়ে আমরা মাঝে মধ্যেই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনতে পাই। যদিও ক্ষমতাশীল দলের কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হাই কমান্ডকে চটানো ছাড়া আইন কখনো গিয়েছে বলে তেমন দৃষ্টান্ত বিশেষ একটা নেই।

আমি নিজে প্রায়ই ভাবতাম, যে ঘুষের গল্প/বিভীষিকাগুলো যদি কোন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা যেত তাহলে সেটি কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য কার্যকরী টিপ হতে পারত। একই সাথে সেখানে “কি ছহি পদ্ধতি ব্যাবহার করলে” অমুক অফিসে ঘুষ দেয়া থেকে বাঁচা যাবে এই রকম বিশেষ তরিকাও দেয়া থাকবে যদি সম্ভব হয়। আর ঠিক সেই রকমেরই একটি উদ্যোগের খবর চোখে পড়ায় সেটি নিয়ে আজকে লিখছি।

দূর্নীতি আর ঘুষ বাংলাদেশের একক সমস্যা না। আমরা একসময় চ্যাম্পিয়ন থাকলেও আমাদের ভাই বেরাদেন আরো দেশও তো আছে। আমাদের প্রাক্তন জ্ঞাতি পাকিস্তান নিয়মিতই দেশে-বিদেশে ঘুষ সংস্কৃতির পথিকৃত হিসেবে নাম কুড়ানো। নিকট প্রতিবেশী ভারতের অবস্থাও সত্যি কথা বলতে খুব দূরে না। সেই ভারতেরই দুজন বিলেত ফেরত উদ্যোক্তা নিজ দেশে ফিরে ঘুষোঘুষি করতে করতে ক্লান্ত, ত্যাক্ত, বিরক্ত হয়ে খুলে ফেললেন ওয়েবসাইট “আই পেইড এ ব্রাইব ডট কম/ iPaidaBribe.Com”। মতলব আমি ঘুষ দিয়েছি ডট কম।

ওয়েবসাইটির মুল কাজ হল, হাস্যকর হলেও সত্যি – ঘুষের বাজারদর জনসমাক্ষে প্রকাশ করা। আপনি গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট আনার জন্য গেছেন? ইন্সপেক্টর আপনাকে বলে দিল গাড়ির যা অবস্থা তাতে ফী ছাড়াও আরো হাজারদুয়েক টাকা অতিরিক্ত “তেলপানি” খরচ করা লাগবে। ওয়েবসাইটে যদি দেখেন যে এই কেইসের স্বাভাবিক বাজারদর পাঁচশো টাকা, তাহলে কমপক্ষে দরাদরি করার মত সুযোগ আপনার থাকে। আর একই বিভাগের একই কর্মচারীর বিরুদ্ধে দিনের পর দিন, নিয়মিত অভিযোগ থাকলে, সেটিকে প্রমাণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছেও উপস্থাপন করা যায়।

এই ওয়েবসাইটের বারংবার অভিযগের প্রেক্ষিতে ব্যাঙ্গালোরের ট্রান্সপোর্ট কমিশন তাদের বেশকিছু অফিসারদের বকুনি, শাসানী, তিরস্কার, বহিস্কার ইত্যাদি করেছে। একই সাথে এই চিন্তাধারা কিছু কর্মকর্তার মাথায় হলেও ঢুকেছে যে, আজকে আমি একটু বামহাত খরচ করলে সেই খবর শুধু গ্রাহক আর আমার মাঝেই থাকছে না, সেটি অফিস পেরিয়ে জনসমাক্ষে এমনকি অনলাইনের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর কাছে খবর হয়ে যেতে পারে। ফলে অনেকেই একটু বুঝেশুনে চলার চেষ্টা করছেন। আর মোটরবাইক চালকদের নিয়মিত অভিযোগের ভিত্তিতে পৃথিবীর প্রথম সেন্সরভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় মোটরবাইক ড্রাইভিং টেস্ট সেন্টার চালু হয়েছে ব্যাঙ্গালোরে যেখানে প্রতিদিন আটশোর বেশি পরীক্ষার্থী নিয়মিত পরীক্ষা দিচ্ছেন।

আমার কাছে আইডিয়া এবং তার এক্সিকিউশন দুটোই বেশ মানসম্মত মনে হয়েছে, যা উইকিলিকসের চেয়ে সাধারণ সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও কেউ যদি এরকম একটি ওয়েবসাইট খোলার উদ্যোগ নেন, তবে সেটিও ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে একটি কার্যকরী সাহায্যকারী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

http://ipaidabribe.com/

এই সংক্রান্ত অন্যান্য খবর সংবাদমাধ্যমে
http://www.bbc.co.uk/news/world-south-asia-13616123
http://www.foreignpolicy.com/articles/2011/05/03/fatal_corruption?page=0,0
http://www.businessday.co.za/articles/Content.aspx?id=142346
http://www.economist.com/node/18652037?story_id=18652037

ফরিদ
বইমেলা


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বাহ্ মজা তো...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বাবলু কিশোর এর ছবি

আইডিয়াটা দারুন লেগেছে। খুলে ফেলুননা এরকম একটা ওয়েবসাইট যেখানে আমরা শেয়ার করতে পারি আমাদের সত্যিকারের ঘুষের গল্প। হাসি

ফালতু পাঠক এর ছবি

জানিনা আমার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা, কিন্তু ঠিক এমনি একটি আইডিয়া আমার মাথায় এসেছিল আজ থেকে দেড়-দু বছর আগে । ব্যাপারটা নিয়ে আমার এক সহকর্মীর সাথে আলোচনাও করেছিলাম এবং চেয়ে ছিলাম এইধরনের কিছু একটা করতে যেখানে পুরো বেপারটাই হবে এনোনিমাস । মাত্র পাঁচ হাজার টাকা হলেই ডোমেন-হোস্টিং কিনে ফেলা যায় আর আমরা নিজেরাই ডেভেলপ করতে চেয়েছিলাম । কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির যে সমস্যা, অতি উৎসাহ নিয়ে কিছু শুরু করে পড়ে ঝিমিয়ে পড়া, আমাদেরও তাই হয়েছিল । আর ছাপোষা মানুষ আমরা, র্যাব এর দৌড়ানি আর সামসুর কোপানির কথা ভেবেও থেমে যেতে হয়েছিল, ঝামেলা এড়িয়ে চলতেই আমরা বেশি পছন্দ করি কিনা...

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

ঘুষ খাই না, তবে মাঝেমাঝে দিতেই হয়। নোংরা লাগে খুবই, কিন্তু নইলে পরবর্তী ঝামেলা যা আসবে, সেটা এড়ানোর কথা ভাবলে অগত্যা...

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

শামীম এর ছবি

আমাদের এখানেও এমন কিছু করা গেলে খেলা জমবে ভাল গুল্লি

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

শামীম এর ছবি

আমাদের এখানেও এমন কিছু করা গেলে খেলা জমবে ভাল গুল্লি

তবে সাধু সাবধান -- ভাল মানুষকেও ফাঁসানো হতে পারে। চিন্তিত

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

ফরিদ এর ছবি

অপপ্রয়োগের বিষয়ে দুটি দিক লক্ষ্যনীয়ঃ

প্রথমতঃ অনলাইন ছাড়াও বাস্তবক্ষেত্রেও পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে কোন ব্যাক্তি বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ দাঁড় করানো যায়। তাই একই ভবিতব্য এই অনলাইন অবতারেরও। তবে গড়পড়তা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হবে দেখা যাবে তাদের ৭০-৮০% আসলেই ডানের সাথে বামকেও মেশান।

দ্বিতীয়তঃ এই ওয়েবসাইটটি কোন সরকারী দফতর বা অভিযোগ কেন্দ্র নয়। বরং এটি জনসাধারণের পরস্পরের অভিজ্ঞতার মিথস্ক্রিয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম, যা ভূক্তভোগীদের পরস্পরকে সচেতন করতে সহায়তা করবে। আর অনলাইনের সংকলিত অভিজ্ঞতা বা অভিযোগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অথবা সংস্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে মগডাল পচা হলে শিকড়ের রোগ সারানো মুশকিল মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।