গল্পঃ মৃত্যুচ্ছা পর্ব-২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২১/০৬/২০১১ - ২:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গল্পঃ মৃত্যুচ্ছা পর্ব-১

কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার এ ইচ্ছাটার কথা আমি রাতুলকে বলেছিলাম। যদিও বলার কোন মানে নেই—এসব ভারী কথা কখনই ওর কান ভেদ করে মস্তিষ্কে ঢুকত না। আমার সবচেয়ে সিরিয়াস টাইপের কথাগুলোও ও হেসে উড়িয়ে দিত বা তা নিয়ে খুব বাজে ধরণের কোন কৌতুক করত। অন্য কেউ এমন করলে আমি নির্ঘাত রেগে যাতাম, কিন্তু কেন যেন রাতুলের ওপর কোন রাগ উঠত না। আমি প্রচুর ধৈর্য নিয়ে আমার গভীর মনের ভাবনাগুলো ওকে বলতাম—যদিও জানতাম ওকে বলা আর তালগাছকে বলা একই কথা।

এখনো মাঝে মাঝে ভাবি, যে ভাবনা একন্তই আমার তা কেন বলতাম রাতুলকে? ওকে আমি সবচেয়ে আপন ভাবতাম, তাই? মনে তো হয় না আমি রাতুলকে সবচেয়ে আপন ভাবতাম। হয়তো ও আমার ভাবনা-চিন্তাগুলো নিয়ে মাতামাতি করত না বলেই ওকে বলতাম। হয়তোবা লেখালেখি করার অভ্যাস থাকলে সেগুলো প্রকাশ করার জন্য ওকে না বলে ডাইরীতে লেখতাম। কিন্তু আমার লেখালেখি করতে অসহ্য লাগে-- যে মিশরীয় ব্যাক্তি প্রথম প্যাপিরাসে লেখা আবিষ্কার করেছিল, তাকে পেলে আমি নিশ্চিত উত্তম-মধ্যম করতাম। কাজেই রাতুলকে বলাই ছিল আমার ভাবনা-চিন্তা প্রকাশের অন্তিম পরিণতি।

রাতুলের সাথে আমি যখন কথা বলতাম, বেশির ভাগ সময় আমি একাই কথা বলতাম। এর কারণ রাতুল চুপচাপ ধরণের মানুষ তা না, আমি ওকে কথা বলতে দিতাম না। এরকম কথা বলতে বলতে একসময় আমার মনে হল আমি রাতুলের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। যে মানুষকে মনের সবচেয়ে গভীর ভাবনাগুলো বলা যায়, সে-ই তো সবচেয়ে আপন। আর যে সবচেয়ে আপন, তারই তো প্রেমে পড়া যায়। এ-ই ছিল আমার তখনকার যুক্তি!
তবে তখন প্রেম সম্পর্কে যা জানতাম সবই সিনেমা-উপন্যাস থেকে। উপন্যাসে পড়েছি প্রেমে পড়ার মূহুর্তে ঝনঝন করে সর্বনাশের ঘন্টা বেজে উঠে, সাড়া পৃথিবী দুলতে থাকে। সিনেমায় দেখেছি যার প্রেমে পড়া হয়, তার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমিক ব্যাক্তিটি হারিয়ে যায়, প্রেমিকের অবয়ব দেখতে থাকে সকল জায়গায়( আরেকটু ছোট থাকতে ভাবতাম, প্রেমে পড়লে প্রেমিক-প্রেমিকারা হাত ধরে ফাঁকা মাঠে দৌড়ায়, তখন অবশ্য সেটা যে শুধু সিনেমার দৃশ্য তা অনুধাবন করার মতন বড় হয়ে গিয়েছি)।

প্রেম সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল, তার সাথে রাতুলের প্রতি আমার অনুভূতির কোন মিল খুঁজে পেতাম না। আমি অনেক ভাবতাম, আচ্ছা কাহিনী কি? আমি কি রাতুলের প্রেমে পড়েছি নাকি পড়িনি? ছেলেটার সাথে কথা বলতে আমার নিঃসন্দেহে ভাল লাগে। প্রতিদিন আমি ওর সাথে দেখা হবার জন্য অপেক্ষা করি, দেখা না হলে মন খারাপ হয়ে যায়। আমরা কথা বলার সময় অন্য কেউ এসে হাজির হলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এসব লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আমার নিজেরই মনে হল যে আমি ওর প্রেমে পড়েছি।

কিন্তু তারপরই মনে হত, যে ছেলে এত সিগারেট খায়, তাকে আমার জীবনসঙ্গী করা সম্ভব না। যখন রাতুল বাজে বাজে স্ল্যাং ব্যাবহার করত ওর কথোপকথনে, তখন মনে হত , যে এমন করে কথা বলে তাকে আমার পছন্দের মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে আমার বাধবে। রাতুল আর আমার কোন প্রতিচ্ছবি দেখলে মনে হত আমাদের দুজনকে একদমই মানায় না—দুজনেরই কেমন কাছাকাছি উচ্চতা; আমি হিল পড়লে রাতুলকে খাটো দেখাবে! আর এসব ভাবনা-চিন্তা আসলেই আমার মনে হত আমি রাতুলের প্রেমে পড়িনি। কারণ গল্প-সিনেমায় যেমনটি দেখেছি, প্রেম এত ভাবনা-চিন্তা করে হয় না। যেহেতু আমি এত ভাবনার অবকাশ পাচ্ছি, অতএব এটা প্রেম নয়।

আমার এমন আধাআধি প্রেম আছে-প্রেম নেই অবস্থাটা কিছুদিনের মধ্যেই কেটে গেল। যাওয়াটাই স্বাভাবিক—কোন কিছু নিয়ে বেশিদিন পড়ে থাকাটা ঠিক আমার স্বভাব নয়, তাছাড়া আমার বিভ্রান্তির সময় রাতুলের মধ্যে আমার প্রতি কোন দূর্বলতা উপলব্ধি করিনি—আমার দোটানা কেটে যাওয়ার সম্ভবত এটাও একটা কারণ। একপেশে প্রেম ব্যাপারটা আমার কাছে ভারি গোলমেলে লাগত।

যখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে রাতুলের প্রতি আমার কোন প্রেমের অনুভূতি নেই, তখনই হঠাৎ আমার মনে হতে লাগল যে ও আমার প্রতি কেমন যেন অদ্ভূত আচরণ করছে। তবে এমন কোন নির্দিষ্ট ব্যবহারও না যা নিশ্চিত করে যে ও আমার প্রেমে পড়েছে। আমার দু-একবার এমনও মনে হয়েছে হয়তো সবই আমার কল্পনা। আমার প্রেম-বিভ্রান্তির সময় ও এমন ব্যবহার করলে সম্ভবত সব বিভ্রান্তি ভুলে আমি টুপ করে ওর প্রেমে পড়ে যেতাম। কিন্তু যেহেতু তখন প্রেম নয় এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, প্রেম আর হল না।

কিছুদিন পর রাতুলও আবার আগের মতন স্বাভাবিক ব্যাবহার করা শুরু করল। আমি এ ধারণায় উপনিত হলাম যে সে-ও মনে হয় আমার মতন বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, সময়ের সাথে যা কেটে গিয়েছে। আমি মনে মনে হাঁফ ছাড়লাম, ভাগ্যিস আমাদের দুজনের বিভ্রান্তি এক সময়ে হয়নি! তাহলে নির্ঘাত প্রেম হয়ে যেত। আর রাতুলের মতন সিগারেটখোরের প্রেমে না পড়ে যে আমি খুব ভাল কাজ করেছি, ততদিনে সে সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম।

এরপর একসময় রাতুলের সাথে আমার বন্ধুত্বেরও ছেদ পড়ে গেল। নাহ! রাতুল সিগারেটখোর, স্ল্যাং বলে বা সংবেদনহীন—সে জন্য না! সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিকগুলো, খুব কাছের বন্ধুর মধ্যেও সহ্য করা যায় সহজেই। আমাদের বন্ধুত্বটা আস্তে আস্তে যেভাবে দড়ির বাধন কালের টানে ঢিলা হয়ে আসে, সেভাবে ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল। আমি পার্ট-টাইম চাকরীতে যোগ দিলাম, আর রাতুল হঠাৎ করে অনেকগুলো মেয়ের সাথে প্রেম-প্রেম ভাব করা শুরু করল। আমাদের কথোপকথনেরও পটপরিবর্তন হল। রাতুল দিন-রাত কোন মেয়ে কিভাবে ওর প্রেমে হুটোপুটি খাচ্ছে তার বর্ণনা দিত। আমার যে জেলাস লাগত তা না, আমি দিব্যি নীরব শ্রোতা হয়ে ওর গল্প শুনতাম। এর কিছুদিন পরই তপুর সাথে আমার পরিচয়, ভালোলাগা, ভালবাসা, প্রেম—সব হইয়ে গেল।

তখন যেন পৃথিবীর আর সবকিছুকে আমি ভুলে গেলাম। (চলবে...আগামি পর্বতেই শেষ হাসি )

-শান্তিপ্রিয়

priyoshanti@gmail.com


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

পড়ছি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

আহম, শুধু পড়েছেন; ভাল লাগেনি এ পর্বটা? চিন্তিত পড়ার জন্য ধন্যবাদ হাসি

আশালতা এর ছবি

এই পর্বটা আগের টার থেকে ভালো লাগলো । পরেরটা দ্রুত দিন, আমার ধৈর্য বড্ড কম । হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি প্রথম পাতা থেকে এ পর্ব বিদায় হলেই পোস্ট করব পরেরটা।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভালো লেগেছে! শান্তিপ্রিয় মানুষ সাধারণত সন্ধিপ্রিয় হয়। ব্যাকরণের নিয়মে 'মৃত্যু+ইচ্ছা' সন্ধিযোগ্য কি?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

$)ভুলের জন্য লজ্জিত। কিছু না ভেবেই নাম দিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ধি-ব্যাকরণ মাথায় ছিল না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। যদি কখনো অন্য কোথাও পুনঃপ্রকাশ করি, তাহলে নাম বদলানোর কথা মাথায় রাখব।

পুনশ্চ- চিন্তিত আমি মানি হয় ঠিক শান্তি প্রিয় নই; আমার নামের মানের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় প্রিয় শান্তি-- সেখান থেকেই এ ছদ্মনাম নেয়া

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আপনার কথাগুলো কিন্তু খুব আপন ও অকপট মনে হলো। ভালো থাকুন। আর হ্যাঁ, অনেক অনেক লিখুন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কবি-মৃত্যুময় এর ছবি

ব্যাকরণ তো সম্পূর্ণ মনে নেই, আচ্ছা রোমেল ভাই 'মৃত্বিচ্ছা' কি গ্রহণযোগ্য? না উ/ঊ+ই/ঈ একদমি অসংজ্ঞায়িত?

কবি-মৃত্যুময় এর ছবি

তবে সন্ধির যে মূল উদ্দেশ্য তা ব্যহত হচ্ছে স্পষ্টত:, 'মৃত্বিচ্ছা' তে শ্রুতিমাধুর্য নেই!!

অতিথি লেখক(শান্তিপ্রিয়) এর ছবি

@রোমেল চৌধুরীঃ আপনিও ভাল থাকুন হাসি
@রোমেল চৌধুরীঃ 'মৃত্বিচ্ছা' শুনতে তো বেশ লাগছে...এটা গ্রহণযোগ্য হলে এটা দিয়ে দেব গল্পের নাম হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

সবগুলি পর্ব শেষ করে নিন, তারপর একটা চমৎকার শিরোনাম খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।