বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর জ্বালানী সাম্রাজ্যবাদের আছর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০২/০৭/২০১১ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যিশু মহমমদ

পুঁজিপতিদের অসুখের(মুনাফা লাভের) সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ -লেনিন বলেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পুঁজিপতিদের একরূপ চরিত্র দেখেছে ‘ঔপনিবেশিক’ আমলে, আর এখন সর্বোচ্চ রূপ দেখা যাচ্ছে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ আকারে। ঔপনিবেশিক সময়ে পুঁজিপতিরা যেমন বৃটিশ পরাশক্তি দাঁড়িয়েছিল সুতার উপর একচ্ছত্র দখলদারিত্ব কায়েম করে। আর আজকের সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিপতিরা যেমন মার্কিন পরাশক্তি দাঁড়িয়ে আছে জীবাশ্ম জ্বালানী সম্পদের উপর একচ্ছত্র দখলদারিত্ব কায়েম করে। আজ তেল যেমন শিল্পোন্নত দেশগুলোর জ্বালানী হিসেবে কাজ করছে, তুলাও সেকালে শিল্প বিপ্লবের জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছে। কাজেই পুঁজিপতিদের কাছে দরকার অনুযায়ী/সময়ানুযায়ী সম্পদের রূপও ভিন্ন ভিন্ন। আধিপত্যের দরকারে কখনো সুতা, কখনো তেল-গ্যাস-কয়লা। ভবিষ্যতে পানি। আরো পরে হয়ত অক্সিজেন। সম্পদ লুন্ঠনের জন্যই তাকে সাজাতে হয় ভূ-রাজনৈতিক কৌশল। ‘ভূমি’ও তাই তার কাছে দরকারী সম্পদ। পরদেশ দখলের তোড়জোড় নিশ্চয় সেই শিক্ষাই দেয়। ঔপনিবেশিক আমলে পররাজ্য দখলের স্ব-শরীরী উপস্থিতি যেমন, আজকের সাম্রাজ্যবাদের যুগে সে দখলের চালবাজি আরো বেড়েছে বৈ কি। চালবাজি বলছি এই কারণেই যে ঐসব দেশ দখল করার পরও তা নামকাওয়াস্তে স্বাধীন থাকবে, কিন্তু তার সরকার হবে ডোরাকাটা বিড়াল, যা অনেকটা দেখতে বাঘের মতো। ডোরাকাটা বিড়ালকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়, সে ক্রিড়ানক মাত্র, সে সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন দালালি করে দেশের মানুষের উপর খবরদারি ফলাবে। আর সাম্রাজ্যবাদ সেই নামকাওয়াস্তে স্বাধীন দেশের ঘাঁড়ে-গর্দানে বন্দুক রেখে শাসাবে সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য হুমকি(!) অপরাপর রাষ্ট্র গুলোকে। একারণেই ‘ভূমি’ও তার কাছে দরকারী সম্পদ। সাম্রাজ্যবাদী হোতারা এসব অভিজ্ঞতা(চালবাজি) ঔপনিবেশিক পৃষ্ঠা থেকে ক্রমান্নয়ে অর্জন করেছে। কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদকে তাই ‘পুনঃঔপনিবেশিকরণ’ নামেও চিহ্নিত করে থাকে মাঝেমধ্যি। শব্দটি শুনতে পুলক জাগে বটে তবে দোহাই লাগে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বর্গটিকে প্রচ্ছন্ন করার অর্থে যেন (অপ)ব্যবহার না-হয়।
যাই হোক, কথা বলছিলাম ঔপনিবেশ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের চেষ্টা-চরিত্র নিয়ে। যাদের আজ জ্বালানী সম্পদের উপর সমূহ কর্তৃত্ব আরোপ না ঘটাতে পারলে জানে-প্রাণে মরতে হবে। জ্বালানী সম্পদ যা সাম্রাজ্যবাদের জীবনী শক্তি, আজকের দিনে এই সম্পদের একচেটিয়া দখলদারিত্বের উপরই তার আয়ুর সীমা নির্ধারিত হয়। অতএব আজকের দিনে এই সম্পদের উপর যে যত বেশী দখলদারিত্বে কামিয়াব হবে ততবেশী সে মানে(বিলাস) বাঁচবে। আর তাতে করে অন্যদের মান(স্বার্বভৌমত্ব) হরণে সাম্রাজ্যবাদকে আগ্রাসী হতেই হবে। ঔপনিবেশ যেমন স্ব-শরীরে দখল করতো অন্যের ভূমি, তেমন করেই সাম্রাজ্যবাদও দেশ-দুনিয়া আস্ত গিলে খেতে ততপর। আজকের দিনে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ‘মূল নজর’ নিঃসন্দেহে বিশ্বের তেল ভাণ্ডার গুলো উপরই। এ বয়ান নিয়ে নিঃসন্দেহ থাকা যায় কেননা পৃথিবীর সহজ মানুষ গুলোও ইতিমধ্যেই ইরাক অধ্যায়ের জটিল হেতু সম্পর্কে জানে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ভাণ্ডার হচ্ছে ইরাক। এখন ইরাককে যদি কব্জা করা যায় তবে জ্বালানী তেলের উৎপাদন ও দাম নির্ধারণে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারবে এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে চোখ রাঙাতে পারবে চোখ আরো লাল করে। ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্ব, পুতুল সরকার বসানো ও সেই পুতুলকে দিয়ে আস্ত দেশটাকে মার্কিনী প্রশাসনের আওতায় লুন্ঠন করবার প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নিলে সেই প্রাসঙ্গিকতা পষ্ট হয়। আফগানিস্থান পরিণতিও সে কথাই বলে। এখন ইরাক পাঠ সাঙ্গ করে সাম্রাজ্যবাদের নেক-নজর বড় আকারে ইরানের দিকে তাক করা আছে; তাদেরও তেল ভাণ্ডার কম নয়। এভাবে পুরো তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকেই হাতের তালুতে বন্দী করার লাগাতারা অভিসন্ধি চালু আছে। অন্যান্য প্রান্তের আপেক্ষাকৃত দূর্বল, মধ্যম রাষ্ট্র গুলোতো আগ্রাসনের তালিকায় আছেই; বাদ যাবে না কেউই।
দুনিয়াদারিতে এইসব অভিসন্ধি বাস্তবায়নে আগোছালো ‘প্রাক-সাম্রাজ্যবাদ’কে শক্তিসামর্থ্যে ও গোছানো গোছের(প্রাতিষ্ঠানিক) আবির্ভাব ঘটাবার বেলায় বলা যায় মার্কিন শক্তি যথেষ্ট সফল। তাই পুঁজির নিয়ম-নীতি অনুসারে যারা তার সাথে পরষ্পর সম্পর্কিত সে দেশ গুলোর কাছ থেকে বাহবা, হাততালি, বখরা তার ন্যায্য পাওনা বটে। কেননা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রকরণ-পদ্ধতিতে সাম্রাজ্যবাদ আজ দুনিয়াজোড়া দীর্ঘমেয়াদি আগ্রাসনের পরিকল্পনা এঁটে বসেছে; আর সেই আগ্রাসনের পতাকা মার্কিনীদেরই, অন্যরা সহযোগী মাত্র। সাম্রাজ্যবাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বহুরূপী, তার চেহারা একটি নয়, একাধিক। অথবা বলা ভালো সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশভূষে বিভিন্নভাবেই হাজির নাজির হবার কৌশল রপ্ত করেছে। সে এক মূর্তিমান(প্রকাশ্য) ত্রাস, আবার কখন-সখন পর্দার আড়ালে থেকে ভূতের মতো ঘাঁড় মটকে দেয়। দুই দিকেই সে নাটের গুরু। আর গুরুর গুরুগিরি ফলাতে দুনিয়াদরির মানুষজনকে ঠকাতে উন্নয়নের মোহ, বিশ্বায়নের চক্কর, মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্যাঁড়াকলে ফেলতে হয়। আর নিরীহ-নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে ধরতে হয় গণতন্ত্রের ভেক। এসব চক্কর ও ভেকবাজিকে প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবায়নে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এনজিও, সিভিল সোসাইটি(ভদ্রলোকি সমাজ), রাষ্ট্র, সরকার-ব্যবস্থা, মিডিয়া ও বিদ্যায়তনিক-প্রতিষ্ঠানের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। নিয়োজিত এসব প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক কোম্পানি গুলোর স্বার্থকেই মসৃণ করে, প্রক্রিয়াধীন করে। যেমন ঔপনিবেশিক আমলে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থে দস্যু লর্ড ক্লাইভদের প্রকল্প ভারতবর্ষে যা যা করতো। আজকের কলিযুগে মানুষের মন-মানসিকতা থেকে শুরু করে যদি ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখি তো অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজের প্রায় সব কিছুর(যা সামগ্রিক অর্থে মানুষের স্বার্থের বাইরে নয়) উপরই একচেটিয়া পুঁজির আছর ভর করে আছে, অঙ্গীভূত হয়ে আছে। যার সর্বচ্ছ পর্ব/পর্যায় সাম্রাজ্যবাদ। বিভিন্ন স্তরে ও উপস্তরে বিভিন্ন কায়দা ও কানুনে বিভিন্ন ধরনের অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরী করে বিভিন্ন পরিসরে বিস্তৃত হয়ে আছে আজকের সাম্রাজ্যবাদ। মোড়কের তার অভাব নেই।
অতঅব, সাম্রাজ্যবাদের করতলে দুনিয়াদারির অবস্থা জ্বলন্ত উনুনে চাপানো কড়াইয়ে ফুটন্ত তেল। কেননা, যুদ্ধবাজ নীতিই তার ধর্ম। পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলোর নিজেদের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য এই নীতি অনিবার্য ভাবেই তাদের ফলাতে হয়। এই ‘অনিবার্যতা’ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ধর্ম। সোজা কথায় সেটাই সাম্রাজ্যবাদ। আবার স্মরণ করিয়ে দেই: পুজিতান্ত্রিক দেশগুলোর নিজেদের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য যে যুদ্ধংদেহী আচরণ করে, যুদ্ধ বাঁধায় ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ভেতর দিয়ে প্রকল্প সাজায় তা নির্বিঘ্নে মুনাফা কামানোর জন্য(মন্দা কাটাবার জন্যও) ও সেই মুনাফা কামানোর পেছনে ‘আজকের দিনে’ বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক সম্পদেরে মধ্যে নির্দিষ্ট করে ‘জ্বালানী সম্পদে’র উপর কর্তৃত্ব কায়েম তার অস্তিত্বের জন্য অবশ্যম্ভাবী। জ্বালানী সম্পদ বর্তমানে তার প্রধান খাদ্য; এবং অতিঅবশ্যই ভবিষ্যতের জন্যও। বিজ্ঞানের কৃত-কৌশলের কারণেই জ্বালানী আজ এতটা গুরুত্বপূর্ণ, যেই বিজ্ঞানকে দখল করে, একচেটিয়া ব্যবহার করে চকমকে ঝকমকে হয়ে উঠছে ‘উন্নত বিশ্ব’। সাম্রাজ্যবাদ জানে এই জ্বালানীর উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে সে যান্ত্রিক ভাবে বিকল হয়ে পড়বে। তার সাদা চামড়া উজ্বলতা হারাতে বসবে। যন্ত্রসভ্যতার(‘সভ্যতা’ একপ্রকারের আধিপত্যবাদী শব্দ) নাড়ি-ভূড়ি, লোহা-লক্কড়ে, যন্ত্রে যন্ত্রে ঘর্ষণ, চাকা ঘুরবে-না যদি-না যন্ত্রের খাদ্য জ্বালানী না-থাকে। মুনাফা কামানোর ছলচাতুরিতে বিশ্ব-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ তখন সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে ফসকে যাবে, তীব্র ধাক্কা খাবে, ধসে পড়বে। উন্নয়ন, বিশ্বায়ন, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র রক্ষার দোহাই পেড়েও তখন আর জানে বাঁচতে চাওয়ায় কোন লাভ হবে না। এ অবস্থান জেনেই সে বেঁহুশ দশায়(যুদ্ধংদেহী) আছে। কিন্তু চাতুরিতে তবুও কম যায় না। কূটনৈতিক কূটচাল, পরদেশ লুণ্ঠন, বোমা হামলা, যুদ্ধের আসল চেহারা-সুরুত লুকাবার তালে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ নামক তত্ত্বীয় ধারণাটিকে(যা তার গায়ে কালিমা লেপে দেয়) বেমালুম হাওয়া করার উদ্দেশ্যে ‘গ্লোবালাইজেশন’ বা বাংলা অনুবাদে ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটিকে যত্রতত্র ব্যবহার করছে। আহা ‘বিশ্বায়ন’ বললেই দুনিয়াদারি যেনবা হাতের মুঠোয় চলে এলো বটে। এই যত্রতত্রের স্রোতে গা ঘেঁষতে উঠে পড়ে লেগেছে (আত্ম-অসচেতন)মানুষজন, যে মানুষজন এখনো পুরোপুরি ‘জনগণ’ হয়ে উঠে নাই। সাম্রাজ্যবাদের মুখে শব্দের প্রয়োগিক আচরণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘোলাটে করে তুলছে। যেমন: ‘উন্নয়ন’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই ঝকমকে চকমকে লোভনীয় দৃশ্য ভেসে উঠে। তেল-খেকো সাম্রাজ্যবাদ এমনই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছে যে- অতশত না জানা মানুষজনের মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো/বাক্যগুলো/কথামালাও যেন একই ছাঁচে, দাফতরিক আদলে পরিণত হচ্ছে। এই শব্দ গুলোই আমাদের কামনা, বাসনা ঠিক করে দিচ্ছে; নিজেরা নয়। পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে বাজারের ফর্দ ও প্রেমিকার কাছে লেখা পত্রেও একই ছাঁচ, বাদ যাচ্ছে না কবিতার শরীর। বিজ্ঞাপনী সংস্থা সে তো চরিত্রগত ভাবেই পণ্যায়িত করবে সমস্তকেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েরও কি একই কাজ?
তেল-খেকো পুঁজিপতিদের একচেটিয়া স্তর সাম্রাজ্যবাদ প্রথমত এই ধরণের বিদ্যায়তনিক ধারার ক্ষমতাযন্ত্র(প্রাথমিক ধাপের অস্ত্র) দিয়ে জনগণের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন: মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়, আইন-আদালত। এইসবের ভেতর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ খুবই সূক্ষ্ম চালে হয়। জনগণের স্বাধীন মনোজগতে দখলিস্বত্ত্ব কায়েম করার ছলচাতুরি। সোজা কথায় ‘মগজ’ কিনে নেয়া। যদি তাতে না কুলালো ততপরবর্তী পদক্ষেপ হলো সরাসরি চোখ রাঙানি অর্থাত বলপ্রয়োগ করার প্রস্তুতি নেয়া। আবার ভিন্ন দিক(বৈপরীত্য) হলো, যদি বলপ্রয়োগ করে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ভাও না থাকে তাহলে জনতার আচরণ ও মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। যেনবা ক্ষোভ জন্মাতে না পারে। আর সেই জন্যই দীর্ঘ মেয়াদি সময় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চলন-বলনে, শব্দ প্রয়োগের ভেতর দিয়ে, বাক্য গঠনের ভেতর দিয়ে প্রভু তার কারসাজিটা চালিয়ে দেয়। চেতনার উপর বলপ্রয়োগ ও শরীরের উপর বলপ্রয়োগ দু’য়ই সময় বুঝে কর্ম করে থাকে। এর অঙ্গাঅঙ্গি ভাব আবার ভুলে গেলে চলছে না। প্রভুর এহেন জনগণের ‘চেতনায় বলপ্রয়োগ’(চেতানায় উপনিবেশ স্থাপন করা বা চেতনার উপর আধিপত্য স্থাপন করা) করার কারণ হলো জনগণের ঐক্যবদ্ধ হবার প্রক্রিয়াকে কোনভাবেই দানা বাধতে দেয়া যাবে না। ক্ষোভ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে ফুসলায়, আর ঐক্যবদ্ধ ক্ষোভ বিপ্লবের দানা বাঁধায়। প্রোপাগাণ্ডায় তাই তাকে বেশি ঘুরপথ ব্যবহার করে হলেও সম্মতি উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। জনগণের দিব্যচক্ষুকে উপড়ে ফেলে অন্ধ-বিশ্বাস অর্জন করা অব্দি ঐসব শব্দকে(আজকাল যেমন ‘দেশপ্রেম’ শব্দের ব্যবহার আমরা দেখতে পাচ্ছি) নানা ভাবে গুলিয়ে গেলানো হবে; মুক্তবাজার অর্থনীতির চিনি-গুড় মিশিয়ে। বিশ্বায়নের চক্করে মানুষকে চিন্তাশক্তিহীন ভোক্তা বানানোই এসবের লক্ষ্য। উন্নয়ন দর্শনের ঠুলি পরিয়ে পুনঃঔপনিবেশিক প্রকল্পকে আড়াল করাই মূল মওকা। আর যদি শেষ পর্যন্ত ‘জনগণমন’ পোষ না-মানে তবে সমস্ত লোক দেখানো ভালো-মানুষিগিরির মুখোশ ফেলে প্রভু চিকায় তুলে রাখা(মজুদ রাথা) বাকীসব ক্ষমতাযন্ত্র(দ্বিতীয় ধাপের অস্ত্র) যা দিয়ে শারিরীক ভাবে দমন করা হবে সেই সব দমনযন্ত্র তাক করতে নির্দেশ দিবেন। যেমন: স্বসস্ত্র সব ধরণের বাহিনী গুলো। প্রভুর স্বার্থের পক্ষের ক্ষমতাধর শব্দরা এভাবেই হয় দ্বীন-দুনিয়ার জনগণকে চেতনাগত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, তা না-পারলে শরীরের উপর বন্দুক নিয়ে খুন-খারপিতে হামলে পড়বে। সাম্রাজ্যবাদের যুগে ‘শব্দ’কে(ব্যাপক অর্থে বিদ্যায়তনিক প্রকল্প গুলোকে) তাই আমাদের নেড়েচেড়ে দেখাটাও কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।(শব্দের সাম্রাজ্যিক বাসনা ধরার কাজ আজ নয়; সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার অন্যত্র। তবে এই হাল্কা আঁছ দেয়াটা বিষয়বস্তুকে বিস্তৃত ভাবে বুঝে নেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ)
যাই হোক, এইরকম বিদ্যায়তনিক ধাঁচের ক্ষমতাযন্ত্রের কাছে আটকা পড়ে আছে(নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে) স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে শহুরে মধ্য ও নিম্ম আয়ের(মধ্যবিত্ত) মানুষজন- যারা এখনো রাজনৈতিক ভাবে ‘জনগণ’ হয়ে উঠতে শেখেনি। ঔপনিবেশিক আমলে বৃটিশ বেনিয়ারাও এমনই বিদ্যায়তনিক ধাঁচের ক্ষমতাযন্ত্রের সদ্ব্যবহার করেছিল। নির্বিঘ্ন লুণ্ঠন অব্যহত রাখতে এ-বড়ই কার্যকর পদ্ধতি, যদি যথাযথ কাজে লাগানো যায়। এর কব্জায় পড়লে আত্ম-সচেতনতা হারাতে বসে মানুষ। হাস্যমুখে দাস্যসুখ বরণ করে নেয়। যেমন: একশ্রেণীর লোকে আক্ষরিক অর্থেই রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে পূজা দিতে বসেছে ঔপরিবেশিক আমলে, আর আজকের দিনে পক্ষান্তরে ইনিয়েবিনিয়ে বুশ-ওবামার নামেও স্তুতি গাওয়া হচ্ছে। এমন আত্ম-অসচেতনতা উতপাদ-পুনরুৎপাদনের মধ্যদিয়ে নিজেদের জীবন-যাপন, প্রতিষ্ঠান ও সম্পদের উপর এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্তৃত্বের ধারা নস্যাৎ হচ্ছে, করা হচ্ছে। ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চলছে জনগণের উত্থানের শক্তিকে। রূঢ় হলেও সত্য: প্রাথমিক ধাপের অস্ত্র(বিদ্যায়তনিক ক্ষমতাযন্ত্র) গুলো নানান কায়দা-কানুনে আজঅব্দি(ঔপনিবেশ তার তাবু গুটিয়ে নেবার পরও) বাংলাদেশের জনগণের মগজে-মননে বিন্ধে আছে।(ঔপনিবেশের ফলে যেসব জ্ঞানপাপ সচেতন ভাবে পুতে দেয়া হয়েছে তা আজ মহীরূহ হয়ে উঠেছে। এর শেকড় উপড়াতে হবে)। সাম্রাজ্যবাদের প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের ভেতর দিয়ে তাই উন্নয়ন, বিশ্বায়ন, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র, দেশপ্রেম ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষমতাধর শব্দ গুলো পুতঃপবিত্র সুবাস নিয়ে জনগণের সরল মন-মনসিকতা দখল করে আছে। ক্ষমতাধর এসব শব্দ গুলোর সঙ্গ-সমন্ধে বাক্য যেভাবে উপস্থিত হয়: ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’, ‘দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানো হবে’, ঋণগ্রস্থ হওয়া মানবিক অধিকার’, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে’, ‘বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে’, মুক্ত বাজার অর্থনীতিই দেশ-দশের সফলতা এনে দেবে’, ‘আমার চেয়ে কে আর বেশী দেশপ্রেমিক?’ ইত্যাদি ইত্যাদি বহু-রকমের ভালো ভালো কথা। যার অনেক গুলোই আমরা হামেশাই শুনে থাকি। জ্বালানী সম্পদ লুণ্ঠনজীবী গোষ্ঠির(সাম্রাজ্যবাদীদের) এসব শব্দ, বাক্য, কথামালা(যা বিদ্যায়তনিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে জারিত হয়) ব্যবহারের ফলে আসলেই কি-বা এমন বিশেষ ক্ষয়-ক্ষতি হয়? উপরে যদিও এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে তবু আবার বলবার চেষ্টা করছি: বিদ্যায়তনিক ক্ষমতাযন্ত্র দিয়ে যদি জনগণমনের চেতনায় উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য স্থাপন করা যায় অর্থাত আত্ম-সচেতনতার পথে দোদুল্যমান করা যায়, মগজ-মনন ভোঁতা করে দেয়া যায় তবেই যে কোন রূপ সম্পদ(প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্বল্প দারে ‘শ্রম-সম্পদ’ শোষণ) লুণ্ঠন করার রাস্তা-ঘাট সহজ হয়ে পড়ে। জনগণের পক্ষ থেকে কোন রূপ বিশেষ বাঁধা আসে না। বন্দুক হাতে তুলবার বিশেষ দরকার পড়ে না(তবে কোমরে গুঁজে রাখতে হয়)। এখন প্রশ্ন হলো: বাংলাদেশের জনগণমনের অবস্থান কী আজ সেই পরিস্থিতিতে ঠেকেছে কি- যে পরিস্থিতে সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের পথ আগলে দাঁড়াবার কারো বুকের পাটা নেই?
০২.
দুনিয়াদারিতে এক রকমের দেশ রয়েছে যারা নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ মজুদ রেখে অন্যের সম্পদ দখল, লুঠ, নিয়ন্ত্রণ কিংবা কুক্ষিগত করার দিকে মনোযোগী। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আরেক রকমের দেশ আছে যারা নিজেদের সম্পদ লুণ্ঠনজীবীদের(সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর) ছোবল থেকে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মধ্যদিয়ে রক্ষা করে, জনগণের মালিকানার নিশ্চতায় বিধান করে নিজেদের কব্জায় রেখে তা ব্যবহার করে থাকে। যেমন: ভেনিজুয়েলা। আরেক দিকে আছে এমন কিছু দেশ যারা নিজেদের সম্পদ সাম্রাজ্যবাদি শক্তির কাছে খুইয়ে আঁখ ছিবড়ে রস বের করা ছোবড়ার মতো এখন হাড্ডিসার, হতদরিদ্র। যেমন: নাইজেরিয়া। আর আছে এতসব উদাহরণ দেখার পরও মেরুদণ্ডহীন এমন কিছু দেশের সরকারি বা রাষ্ট্র ক্ষমতা(দালাল চক্র) যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে স্বেচ্ছায় নতি-স্বীকার করে মেহেমানদারির মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিয়ে বখশিশ পেতে ইচ্ছুক। যেমন: বাংলাদেশ। ‘বলা খুব অতুক্তি নয় যে, সামরিক অভিযান চালিয়ে দখল করে সামরিক ঘাঁটি বসিয়ে গণহত্যা আর নিপীড়নের যথেচ্ছার করে মার্কিনী প্রশাসন ইরাকে যা যা অর্জন করেছে, বাংলাদেশে ‘সার্বভৌম’ সরকার, মার্কিন প্রশাসন, আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাসমূহ তা নিশ্চিত করেছে ‘শান্তিপূর্ণভাবেই’ এবং আইনি প্রক্রিয়াতেই।’ বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী খুব একটা দেন-দরবার(বংলাদেশের স্বার্থ) ছড়াই তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দিতে মরিয়া। আজকের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিন্ন দুই ধারার রাজনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং দু’য়ের আপাত বিরোধে থাকলেও আসল সত্য হলো জনগণের জীবন-যাপন, সম্পদ লুন্ঠন, জাতীয় স্বার্থ নিয়ে জালিয়াতি, বৈষম্য, শ্রেণী নিপীড়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার রক্ষা ও বিকাশে তাদের দু’য়ের ঐক্যটা বেশ মৌলিক। কাজে কাজেই আর্ন্তজাতিক সংস্থাসমূহ (তাদের স্বার্থ রক্ষিত হলে) এবং সরকার(যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে) বলবে এবং বলে থাকে- আমরা প্রতিনিয়ত উন্নয়ন ঘটাচ্ছি, আইন-শৃঙ্খলা সুষ্ঠ আছে, দেশকে অমুক-তমুকের(জঙ্গি, চরমপন্থি, সন্ত্রাসী) হাত থেকে উদ্ধার করে ছাড়ব, দেশে বিনিয়োগের হার বাড়ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। খেয়াল করলে দেখা যাবে এসব বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে লেজুড় সমর্থক সেই সব সুবিধাবাদীরা যারা বিভিন্ন ফাঁক-ফোঁকড়ের সুযোগ নিয়ে, দলবাজী করে, কু-উপায়ে, কালো পথে টাকা কামাইকারী ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, আমলা, এনজিও, মিডিয়াসহ বিভিন্ন উচ্চ-মধ্য পেশাজীবি শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ, বুদ্ধিজীবি। এদের শ্রেণীচরিত্র, শ্রেণীগত ভোগ-বিলাস তাই পুরো বাংলাদেশ বেচে দিয়ে হলেও অক্ষুন্ন রাখতে চায়।
সত্য সত্যই দেশ বেচার সেই প্রকল্প আক্ষরিক অর্থেই জারি আছে। তা আমরা বিভিন্ন পরাশক্তির সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হতে দেখি। কারণ জ্বালানী সম্পদ লোভী সাম্রাজ্যবাদের এও জানা আছে যে লুঠ করার সঙ্গি-সাথী দালাল-দোসররাই শুধু দেশ-দুনিয়ায় বাস করে না, লুণ্ঠন চালাতে গেলে ‘জনগণের শক্তি’ বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়াবে। জনগণের রাগ-ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে বিপ্লবের সড়ক ধরে জঙ্গি মিছিল শুরু করবে। আজকের হাতের ঢিল কালকে গ্রেনেড হবে, আজকের লাঠি-সোটা পরশু বন্দুকে রুপান্তরিত হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবুতে আঘাত হানবে। কাজে কাজেই সামরিক ঘাঁটি অঞ্চল স্থাপন করে বা স্থাপন করার আইনি-চুক্তি করে দখলদারিত্বকে নিরাপদ রাখার একটা প্রাক-প্রস্তুতি সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসররা সেরে রেখেছে। নজর একটু ডানে বায়ে ঘুরালে সে আলামত টের পাওয়া যায়। যেমন: বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের দোসর। সে অনুযায়ী জঙ্গি, চরমপন্থী, সন্ত্রাসী, মৌলবাদী শক্তি যত-না আছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার-প্রপাগাণ্ডা(গুজব) চালানো হচ্ছে। ‘শান্তি রক্ষার’ বা ‘সন্ত্রাসবাদের বিরোদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’র নামে বাংলাদেশের সরকারেরা এসব প্রক্রিয়াধীন করে তুলছে। কিন্তু নেপথ্যের গল্পটা ঠিক উল্টো। যদি আমরা নজর দেই তবে দেখবো বাংলাদেশ দুনিয়াদারির রাজনীতিতে গভীর গুরুত্বপূর্ণ এক ভূ-খণ্ড। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এটিকে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশকে জিম্মি করে বাংলাদেশের ঘাড়ে-গর্দানে বন্দুক রেখে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষমতাধরদের শাসানোই মূল লক্ষ্য। বঙ্গোপসাগর ভারত-মার্কিন যৌথ সামরিক মহড়া, নৌ-ঘাঁটি স্থাপন করে সাগরের নিয়ন্ত্রণ-বৃদ্ধি গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে তা আরো পষ্ট হয়। তাদের দীর্ঘ দিনের প্রকাশ্য ও গোপন সামরিক পরিকল্পনা, বাণিজ্যিক চুক্তি, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পরমানু সমঝোতা ইত্যাদি খেয়াল করলে বোঝা যায় এই অঞ্চলে যুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টা জারি আছে। চেষ্টার অন্যতম কারণ চীনের আধিপত্য বিস্তারের পথ আগলে ধরা। ক্ষমতাধর চীনকে আগলে ধরার পথে মার্কিন ও দুনিয়াজোড়া অন্যমত সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠবার খায়েশে থাকা ভারত এক জোট হয়েছে। ইসরায়েল যেমন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের হয়ে কাজ করে, তেমনি ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনীদের হয়ে কাজ করে। ‘মার্কিনীদের হয়ে কাজ করে’ বললে বেশ সরলীকরণ হয়ে যায়, বলা ভালো দুয়েরই স্বার্থ-নীতি এক(দ্বন্দ্বও আছে বটে!)।
আধিপত্যকামী ভারত ও সামরিক সরকার দ্বারা শাসিত মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে একটি বড় অংশ নিজেদের সমুদ্র অঞ্চল বলে দাবী করে আসছে [বিস্তারিত দেখুন: আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন-১৯৮২ ও বাংলাদেশের সাথে ভারত-মায়ানমারের বিরোধ। ২০১০। নূর মোহাম্মদ]। এ দাবীর পেছনের কারণ বঙ্গোপসাগরের তলায় থাকা জ্বালানী সম্পদ দখলের পাঁয়তারা। ভূ-রাজনৈতিক কৌশল সেই অনুযায়ী সাজানো হচ্ছে। এশিয়ায় ভারত বনাম চীন দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন তার দাবার গুটি সাজায়, তেমনি আবার অন্যদিকে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে ভারতকে সামাল দেয়ার জন্য বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ওপর নানাভাবে আছর করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র৷ কেননা, জ্বালানীর- রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে ভারতের সঙ্গে মার্কিনীদের সম্পর্ক ভবিষ্যতে একবার সাপে-নেউলে দ্বন্দ্ব পর্যায় ভূক্ত হবে, আরেকবার গলায় গলায় দোস্তি ভাব রক্ষা করে স্বার্থ উদ্ধারের কাজ চলবে। বঙ্গপোসাগরকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্ব ও দোস্তি তলে তলে এখন থেকেই বিরাজমান আছে। এই কৌশলগত দিকে থেকেই মার্কিন কৌশলের কাছে যেমন দিনে দিনে বলি হয়েছে পাকিস্থান, তেমনি বাংলাদেশও ভবিষ্যতে কোরবান হতে যাচ্ছে। এই কোরবানীর আরো কিছু আদর্শিক, মতার্দশিক কারাকারণ রয়েছে; সেসব নিয়ে কথা সয়লাব করবার এই মূহুর্তে জায়গা নেই। তো বর্তমানে ভারত-মার্কিনীদের আপত সুসম্পর্কের ফলে দুই গ্রুপই বাংলাদেশের সাথে(আওয়ামী ও বিএনপি দুই সরকারের আমলেই) নানান চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে। যেমন: বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘টিফা’ চুক্তি(Trade & Investment Framework), ‘সোফা’ চুক্তি(Status of Forces Agreement), পোর্ট কন্টেইনার স্থাপন, ২০০৩ সালে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়তা’ নামে, ২০০৪ সালে ‘পারসোনাল আইডিন্টেফিকেশন সিকিউর কমপারিজন এন্ড ইভাল্যুয়েশন সিসটেম’ নামের চুক্তি, সেনাবাহিনীর সাথে IMET কর্মসূচি, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি, সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহায়তা(ATA) কার্যক্রম ইত্যাদি গোপন-অগোপন চুক্তি দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধবাজনীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই দিনে দিনে এগিয়ে চলছে। এবং গেল ১৬ই জুন ২০১১তে সাগরের দুইটি গ্যাস ব্লক ‘মডেল পিএসসি’ অনুযায়ী মার্কিন কোম্পানি কনাকো ফিলিপসের কাছে লুঠ করার জন্য ইজারা দেয়ার চুক্তির ফাঁক-ফোঁকড়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের জন্য বিশাল ফাঁড়া তৈরী করে রেখেছে(বর্তমান লেখার উদ্দেশ্য এই চুক্তিকেই প্রতিহত করার তাগিদে ও এই চুক্তির লেজুড় হয়ে যে যে বিপদ সীমায় বাংলাদেশ পড়তে যাচ্ছে তা খানিকটা আমার বুঝ মতো বলে-কয়ে দেওয়া)। যা সামরিক চুক্তি গুলোকে বাস্তবায়নের ছুতো হিসেবে কাজ করবে। মার্কিনীরা স্বভাব-চরিত্র দুনিয়াজোড়া যেভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই অনুযায়ী একদিন বলে বসতেই পারে: বঙ্গোপসাগরে আমার দেশের কোম্পানির স্বার্থ রয়েছে, অতএব আমাদের পাহারা বসাতে হবে। যুদ্ধ-জাহাজ ভিড়াতে হবে। ফলে এইসব আইনি-চুক্তি বলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শান্তিপূর্ণ ভাবেই কোন বাধা বিঘ্নতা ছাড়াই ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ছুঁতো ধরে মরণাস্ত্র নিয়েও এই ভূ-খণ্ডে অবস্থান নিতে পারবে। এবং ইতিমধ্যেই এসব আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা, ট্রেনিং ও নানান রকমের মহড়া তারা অব্যহত রেখেছে। যৌথ সামরিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। তারপর দেখা যাচ্ছে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, বিনিয়োগ করা ও সেসবের আওয়তায় ট্রানজিট চুক্তি, করিডোর দাবী করা, চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারিকরণ কিংবা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রক্রিয়া গুলো বাস্তবানের পথে আছে। এসবকে নিছক বিনিয়োগের আগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করলে চলছে না। চলছে না কারণ তাদের লোভাতুর চরিত্রই আমাদের ভয়াবহ সংঘাত গুলো সম্পর্কে সচেতন/সাবধান হতে তাগিদ দেয়।
অতএব, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বিশেষত প্রাকৃতিক সম্পদ দখল কর্মসূচিতে মার্কিন-ভারত-ইউরোপ জোটবদ্ধতা খুব স্পষ্ট৷ আবার বিনিয়োগের নানান উদ্দেশ্যের মধ্যে পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা আদায়ের এবং আদায়ের পথে যে কোন ‘বিশেষ ধরণের’ বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা নিশ্চিত করার জন্যও আগাম অঢেল টাকা ঢালা হয়। এসব উদ্দেশ্যকে টেকসই করার জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী ও বিএনপির স্থান-অবস্থান নিয়ে ‘রাজনীতি রাজনীতি খেলা’ বা সোজা কথায় দালালি দালালি খেলা হয়। যেহেতু দিনকে দিন ভারতের নিজের অর্থনীতিতে জ্বালানী সম্পদের চাহিদা বাড়ছে সেহেতু বাংলাদেশের অংশের মধ্যে নিজের ভাগ(সম্ভব হলে পুরোটাই) দাবী করা নিয়ে সামনে দিন গুলোতে আরো আগ্রাসী রূপ দেখা বাকী আছে। ভারতকে তাই আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের শক্তি থেকে বৈশ্বিক শক্তি হয়ে উঠার রাস্তায় এসবের এক ফোঁটাও ছাড় দেয়ার কথা ভাবা আহাম্মকি মাত্র। আবার বাংলাদেশের গ্যাস ও কয়লা সম্পদের উপর দখল স্থাপন মার্কিন বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর জন্যও মহা লাভজনক প্রকল্প৷ অতঅব বর্তমানে ভারত-মার্কিন ঐক্য থাকলেও সামনের দিন গুলোতে ঐক্য ভেঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা অধিক এমনটা আমাদের কারো কারো মনে হলেও বরং ঘটনা (হয়ত) ঘটবে উল্টো: তাদের নিজেদের মধ্যে সমঝোতা স্বপক্ষে সাগরবক্ষ থেকে শুরু করে স্থলভাগ সবই ছিড়ে ছিবড়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত হবে, হয়ে আছে। কাজেই দুয়ই ‘দ্বন্দ্ব ও দোস্তি’ বৈপরিত্যের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে গুটি হিসেবে নাড়াচাড়া করছে। আর বাংলাদেশের কথিত দেশপ্রেমিক সরকার গুলো গুটি হতে আপত্তি দেখাচ্ছে না, দেখাবার কথাও না। সেইহেতু এই দ্বি-দলীয় রাজনৈতির স্বার্থের খায়েশে যে যে সংঘাত, বিপক্ষতা বিরাজমান তার সবই ক্ষমতার গদিতে বসার আয়েশে। তাদের শ্রেণীগত ভোগ-বিলাস অক্ষুন্ন রাখার দৌড়াঝাপ মাত্র। এই দৌড়ঝাপের ভেতর দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে তৈরী হয় অস্থিতিশীলতা খুন-খারাবি, আর সেটাকেই কাজে লাগায় বহিঃস্থ শক্তি। সাম্রাজ্যবাদ এই দুই দলের সাথে দু’মখো সাপ হয়ে কাজ করে থাকে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্বোয়ামী সেই সাম্রাজ্যবাদি শক্তি গুলোই, শুধু মাঝে মাঝে তাদের নিজেদের মধ্যে সতিতে সতিনে ঝগড়া হয় মাত্র। মাঝখান দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য সেই দু’মুখো সাম্রাজ্যবাদ নিজেকে আড়ালে রেখে জনগণের সামনে হাজির করে ‘সুশীল সমাজ’কে, যা সাদা বাংলায় বললে ভাবানুবাদ দাঁড়ায় ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’। এক্ষণে এই ভদ্রলোকদের কাজে লাগিয়ে সে ত্রিমুখী সাপে পরিণত হয়। আগেই বলেছি সাম্রাজ্যবাদ বহুরূপী, তার চেহারা একটি নয়, একাধিক। এই সাম্রাজ্যবাদ একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক এবং পরিবেশগতও। কোথায় সে নেই?
০৩.
বাংলাদেশের শরীরের ভেতরে ও উপরে অর্থাত সাগর নিচে, স্থলভাগের নিচে একই সাথে উপরের সব রকমের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, দখল কি লুট করার দীর্ঘ মেয়াদি অভিসন্ধি ফেঁদে রেখেছে মার্কিন-ইউরোপ-ভারত জোটবদ্ধতা। ভালোই ভালোই যদি শান্তিপূর্ণ ভাবে এসব সম্পদ লুটে নেয়া যেত তবে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের এত কৌশলী হয়ে আগাম এতসব চুক্তি চক্করের(বিশেষ করে সামরিক) ফাঁদ পাতার কথা নয়। কিন্তু সাবধানী তাদের হতেই হয়, কেননা রাজনৈতিক ভাবে বৃহত জনগোষ্ঠী যদি সচেতন হয়ে উঠে, তথাকথিত শান্তিপূর্ণ অর্থাৎ অচেতন অবস্থা কাটিয়ে উঠে তবে তাদের জন্য তা মুষ্কিল বৈকি। এই কারণেই বিদ্যায়তনিক পদ্ধতিতে ‘মগজ ধোলাই’, দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যদিয়ে ‘আই ওয়াশ’ অর্থাত জনগণের ভেতর বিভ্রান্তি, জনগণকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগাতে তারা যেমন প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কাজ করে থাকে, তেমনি জনগণ যদি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে উঠে এবং কাজে কাজেই সেই সচেতনতা যদি তাদের স্বার্থে/উদ্দেশ্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে বর্বর পথেই তারা আগাবে। সেই জন্যই সামরিক চুক্তি আগে আগেই সরকার গুলোর সাথে করে রাখা হয়। তারও আগে তারা ধৈর্য্য সহকারে আরো কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা চালনা করে। যেমন: স্পষ্টতই আওয়ামী-বিএনপি বলয়ের বাইরে গিয়ে জনগণ যদি সত্যিকারের রাজনৈতিক অধিকারের কথা ভাবে ও সেই অনুযায়ী কর্মতৎপরতা শুরু করে দেয় তবে তাতে সাম্রাজ্যবাদীদের মাথা ব্যাথার কারণ আছে বটে। তাই এই ধরণের ঝোঁককে তাড়িগাড়ি সামাল দিতেই ২০০৭এর দিকে সেনা পাহারায় ও সুশীল সমাজের সমর্থন নিয়ে ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্ববধায়ক সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী করা হয়। এবং জনগণের মনোযোগ, সমর্থন আদায়ের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের মিছে মিছি হয়রানির নাটক পরিচালনা করা হয়। আর এই আই ওয়াশ বা ব্রেইন ওয়াশের ভেতর দিয়ে তারা তাদের কূটচাল গুলোকে আরো পাকাপোক্ত করে নেয়। তেমনি একটি পাকাপোক্ত চুক্তি হলো তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ লুটপাটের উদ্দেশ্যে করা অংশীদারিত্ত্ব মূলক বা উতপাদন-বন্টন চুক্তি(মডেল পিএসসি)। যে চুক্তির আগাগোড়াই বাংলাদেশকে তার নিজস্ব সম্পদ হতে ঠকানোর উদ্দেশ্যে তৈরী। তেল-খেকো সাম্রাজ্যবাদের সেই চুক্তি অনুযায়ী দাসখত দিয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। এটা এখন জনগণের কাছে স্পষ্ট। এর জন্য দিনের আলোরও দরকার পড়ে নাই। এই নাকে খত দিয়ে ক্ষমতায় আসার কথা ভুল বশতঃ মুখ দিয়ে বের করে ফেলেছিলেন বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে জানিয়েছেন যে তিনি ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি ক্ষমতায় আসতে পারেন নাই। আর সে কথা জনগণ নিজ কানে শুনে ফেলেছে। এবং জনগণ বুঝে ফেলেছে এবারের ক্ষমতায় আসার কারণ গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিতে তিনি রাজী হয়েছেন। ভ্রান্তির ছলে পড়ে বলা এই কথা এখন রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে। এ কথাগুলো শুনে ফেলার ফলে উপকার হলো এই যে: জনগণ এখন অনেক আগেই করা ‘অনুমান’ গুলোর বাস্তবায়নের সত্যতা টের পায়। জনগণের আর উইকিলিকসের দরকার হয়নি, শেখ হাসিনা নিজেই উইকিলিকসের কাজ করে দিয়েছেন।
সাম্রাজ্যবাদ এইসব তড়িগড়ি বিপদ সামলাবার পাশাপাশি আরো কিছু ধীরে সুস্থের রাজনৈতিক কৌশল ঢুকিয়ে দিয়েই বাংলাদেশকে(ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাবার) পরীক্ষা নীরিক্ষা করে চলছে। বহু আগ থেকেই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। যেমন: জঙ্গিবাদের, মৌলবাদের উত্থান ঘটানো ও সেসব দমনের জন্য মুখিয়ে থাকা এবং সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থী দমনের নামে রাজনৈতিক কর্মীদের(বিশেষত গোপন কমিউনিষ্ট দল গুলো হলো এর লক্ষ্য, সাম্রাজ্যবাদ মনে করে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থে বিপ্লব সংগঠিত হলে এইসব গোপন স্বসস্ত্র অংশগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে) খুন করা। এসব ঘটাবার বেলায় সহযোগী থাকা পুঁজিপতি শাসক গোষ্ঠীর অংশ যেমন স্বস্থি পায় তেমনি উপরে উঠবার সিঁড়ি নাগালে থাকা মধ্যবিত্ত খুশি হয়। খুশি রাখার জন্যই মার্কিনীদের হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিশেষ খুনিদের নিয়ে র্যা ব গঠিত হয়। এছাড়া আরো গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যৌথ কার্যক্রমের ভিত্তিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ কাজ পরিচালনা, মাদক-চোরাচালন নিমূর্লে সাহায্য প্রদান, চীনকে ঠেঙ্গানোর জন্য বঙ্গোপসাগরে স্থায়ী নৌ উপস্থিতি বজায় রাখার নীতিসহ যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগে এ অঞ্চলে যুদ্ধ জাহাজ পাঠানোর ছুতো। সেই অনুযায়ী যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা ও মার্কিন কমাণ্ডে কাজ করতে এ সকল বাহিনীকে শেখানো পড়ানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া দিনে দিনে আরো দ্বিগুণ হচ্ছে জনগণের বেশ কয়েকটি স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রামকে নমুনা ধরে। যেমন: ২০০৬-এ বিদ্যুতের দাবীতে কানসাটে ও ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লাখানির বিরুদ্ধে কৃষিজীবী জনতার গণঅভ্যুত্থান। এছাড়া পানির দাবীতে শনির আখড়া, এবং কিছু দিন আগের বিমানবন্দর নির্মাণের বিরোদ্ধে আড়িয়ল বিলের জনগণের তীব্র বাধা ও রূপগঞ্জে জমি দখলের বিরোদ্ধ জনগণের সেনা-বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও প্রায়শ গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন গণবিস্ফোরণে রূপান্তরিত হচ্ছে। এইসব আলামত থেকে স্পষ্ট হয় যে: বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, তথাকথিত দারিদ্র্য নির্মূলের নামে গরীব মারার ‘উন্নয়নের দর্শন’ কাঠামোকে জনগণ অস্বীকার করছে এবং কৃষিভিত্তিক গ্রামাঞ্চল বড় ধরণের একটা পরিবর্তণের জন্য মুখিয়ে আছে। ফলে সংগঠিত যে কোন সত্যিকারের জনগণের স্বার্থের আন্দোলন হালে পানি পেতে পারে। (তা পাঠক আওয়ামী বিএনপি যে ‘জনগণের’ নাম নেয় তা ভূতে যোগায়, বিশ্বাস না হলে প্রয়োজনে তদন্ত করে দেখুন সত্যিকার অর্থে তাদের সাথে কোন ‘জনগণ’ নেই।) এসব জেনে বুঝে সাম্রাজ্যবাদিরা খুব দ্রুতই ঝোপ বুঝে কোপ মেরে লুটে নেবার তাড়ায় আছে, সাথে সাথে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত জায়গা থেকে বাংলাদেশকে ব্যবহার করার মতলবে আছে। জনগণ দিনে দিনে এসব মতলব টের পাচ্ছে তাই সাম্রজ্যবাদের দোসরেরা জনগণের উত্থানের ভয়ে বারবার নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে প্রমাণ করবার জন্য হাঁসফাঁস করছে।

এই হচ্ছে সপ্ত-কাণ্ড। এখন এতক্ষণের পরিস্থিতিতে বলা-কওয়া কথা গুলো শোনার পর যদি লেনিনের মতো স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে প্রশ্নে আসে: এখন আমাদের ‘কী করিতে হইবে?’ তবে সহজ করেই বলতে হয়: স্পষ্টতই বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব নিয়ে আতংকিত, জনগণ একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন চায়। অতএব, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, তাদের এদেশেীয় ‘নব্য রাজাকার-আলবদর’, মির্জাফর, ঘষেটি বেগমদের বিরুদ্ধে জনগণের একটা লংকা-কাণ্ড ঘটে যাওয়া সমূহ দরকার। ক্ষিপ্ত-বিক্ষিপ্ত জনগণের আন্দোলন গুলো সংগঠিত হয়ে বিপ্লবের সড়কে পৌঁছে যাওয়াটা কর্তব্য। সেই ধারাবাহিকতায় আসছে ৩ জুলাই মার্কিন কোম্পানী কনাকো ফিলিপসের কাছে বঙ্গোপসাগরের দুটি গ্যাস ব্লক ইজারা দেবার প্রতিবাদে, চুক্তি বাতিলের দাবীতে ‘তেল-গ্যাস-বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র আহ্বানে রাজধানী ঢাকায় অর্ধবেলা হরতাল পালন করুন। এবং চুক্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে লাগাতার কর্মসূচি চলুক ‘জাতীয় কমিটি’র কাছে এই আব্দার জানাই। আমাদের এখন ক্ষুদিরাম হবার সময়।

যিশু মহমমদ
২৯ জুন ২০১১


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।