বাঁচতে চাই; বাঁচাতে চাই

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৬/০৭/২০১১ - ১:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খবরের কাগজে আজকাল অকাল মৃত্যুর খবর দেখলে আগের মতন আর গা শিরশির করে না। স্নায়ুতন্ত্রও বোধহয় বিরক্ত; কত আর প্রতিক্রিয়া দেবে? যখন খবরের কাগজে পড়ি যে চার বছরের শিশু জিহাদকে অপহরণকারীরা পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেছে, তখন হয়তো মূহর্তের জন্য থমকে যাই, অস্ফূট স্বরে ‘ইশ’ বলি, কিন্তু পরের মিনিটেই অন্য খবরে চোখ রাখি। যখন পড়ি শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার সময় মায়ের কোল থেকে ছয়-মাসের শিশুকন্যাকে নিয়ে আছড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে, তখন শিউরে উঠি, কিন্তু পরক্ষনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি এই মনে করে যে গ্রামে এমন কত আরো ঘটনা ঘটছে যা হয়তো খবরের কাগজে জায়গাও পায় না। এটাই বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেই। যারা পত্রিকা পড়ি তাদের কাছে এসব সচারচর ঘটনা, এতটাই যে খবরের প্রথমটুকু পড়তে পড়তে শেষটা অনুমান করে ফেলতে পারি। বারবার একই ধরণের নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো পড়তে পড়তে আজকাল খুব অবাকও হই না, মেনে নেই, মেনে নিতে হয়। অভিযোজন বা পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া তো শুধু মানব ধর্ম না, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জীবজগতের নিয়ম। রাতে শান্তিতে ঘুমানোর জন্যই আমাদের স্নায়ু সুচতুরভাবে অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করে দেয়।

কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ঘটনাগুলো খবরের কাগজের পাতা থেকে লাফিয়ে বের হয়ে এসে খুব কাছে ঘটে যায়; তখন মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। মনে হয় ভোঁতা ছুরি দিয়ে কে যেন বুকের ভেতর বারবার আঘাত করছে, এ ব্যাথা মৃত্যু ব্যাথার চাইতেও তীব্র-- এ ব্যাথা অসহয়াত্বের ব্যাথা, কিছু না করতে পাওয়ার ব্যাথা,হারানোর ব্যাথা, আশংকার ব্যাথা।


শুক্রবার সাধারণত দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রতিদিন কাজের জন্য সকালের ওঠার অভ্যাসেই বোধহয় তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাও আলসী করে শুয়ে ছিলাম। হাতের বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটা নিয়ে ফেসবুক খুলে বেশি, সকাল-সকালই দেখি সবাই ফেসবুকে খুব সচল, পড়তে থাকি এর-ওর স্ট্যাটাস। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা স্ট্যাটাস—‘লাইফ ইজ নট ফেয়ার!’। একটু মনটা খারাপ হয়, শুক্রবার সকালের আবার কি হল বেচারার! এরপর আরো কয়েকটা মন খারাপ করা স্ট্যাটাস চোখে পড়ে, হঠাৎ খেয়াল হয় এমন স্ট্যাটাসকারীরা সবাই একই সার্কেলের। কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে, সবাই কি একই ঘটনা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করছে, কি হয়েছে? হঠাৎ দরজায় টোকা; বুকটা কেমন ধ্বক করে ওঠে। দরজা খুলে জানতে পারি সে হৃদয়-বিদারক ঘটনা। ছোট্ট নুহা আর এ পৃথিবীতে নেই। পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি আর কখনো সেজেগুজে নাচের স্কুলে যাবে না, কোনদিন স্কুলের বান্ধবির সাথে টিফিন ভাগ করে খাবে না, কোনদিন বাবার ফুটবল খেলা দেখতে বুয়েটের মাঠে আসবে না... কোনদিন বড় হবে না।

কি অপরাধ ছিল নুহার? সে তো বাবার কোলে বসে পুরো পরিবারের সাথে নিশ্চিত মনে যাচ্ছিল কক্সবাজারের সমুদ্র দেখতে। কেন কক্সবাজার পৌছানোর ২০কিমির আগে রাতের আঁধারে পথে গুড়ি পেতে রাখা ডাকাতদলের গুলিতে মৃত্যুবরণ করতে হল ওকে? দ্রুত চালিয়ে পেরিয়ে যাওয়া গাড়িটা ডাকাতি এড়াতে পারলেও, নুহার মৃত্যু এড়নো যায়নি। ওরা একটাই গুলি করেছিল, আর সে একটা গুলিই নুহার মাথায় লেগে ওর প্রাণটা ছিনিয়ে নিয়েছিল। একেই কি ভাগ্য বলে? গাড়ির আর কারো কিছু হলনা; শুধু হারিয়ে গেল বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র কন্যা নুহা?

মৃত্যু সবসময় কষ্টের; কিন্তু কেন যেন শিশুমৃত্যু আরো বেশি কষ্টের। আর তা যদি হয় নির্মম হত্যা, তাহলে তা মেনে নেয়াই যায় না। কিন্তু মেনে নেয়া ছাড়া আছে কি কোন উপায়। নুহা হত্যার তো কোন বিচার হবে না! বাংলাদেশের হাই-ওয়েতে তো ডাকাতি হয়ই; কে খুঁজে বের করবে কোন ডাকাতের গুলি কেড়ে নিয়েছে নুহার প্রাণ?


ছোট্ট আফশিন বেঁচে থাকলে জুনের ত্রিশ তারিখে ওর আটমাস হত। কিন্তু তা বোধহয় অদৃষ্টে লেখা ছিল না। যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন, তারা বলবেন আল্লাহ এ কয়দিনেরই হায়াত দিয়েছিলেন, আফশিন এখন পৃথিবীর চাইতে অনেক সুন্দর জায়গায় সৃষ্টিকর্তার কাছে আছেন। কিন্তু বাবা-মায়ের মন যে তাও হুহু করে; ভাবে, কি হত যদি আফশিন সঠিক চিকিৎসা পেত? কি হতে পারত যদি বাংলাদেশের জল্লাদখ্যাত চিকিৎসকরা তাদের জল্লাদগিরি এ ছোট্ট শিশুর ওপর প্রয়োগ না করত? কি হতে পারত? হয়তো আফশিন আজ বেঁচে থাকত!

আফশিনের তো দেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা পাবারই কথা ছিল। ইউনাইটেড হাসপাতাল তো মহানগরীর প্রথম সারির হাসপাতালেরই একটি! তবু কেন তা পেল না আফশিন? জানতাম যে ভুল চিকিৎসার জন্য মারা গিয়েছে আফশিন। ওর সাংবাদিক বাবার লেখা ফেসবুক নোট পড়ে বিশদে জানতে পারলাম পুরো ঘটনা। রাগ করব না দুঃখ করব বুঝতে পারছিলাম না। নিজের পরিবারে ডাক্তার থাকবার বদৌলতে বহুবার শুনেছি, ‘রোগীর আত্মীয়স্বজন খালি বাংলাদেশের ডাক্তারদের দোষ দেয়, কিন্তু অনেক সময় ডাক্তারেরও কিছু করার থাকে না’। কিন্তু যখন শুনি যে চিকিৎসকরা সিটিস্ক্যানের রুমে এসি কাজ করছে না বলে সংকটপূর্ণ রুগীর সিটিস্ক্যান পিছিয়ে দেয়, তখন কি ডাক্তারের কিছু করার থাকে না? যখন জেনেশুনেও ডাক্তাররা ঠিক ওষুধ দেয় না, তখনও কি কিছু করার থাকে না? ওরা এটাকে দুঃখজনক অকাল মৃত্যু বলতে পারে; কিন্তু আমার যে একে হত্যা বলে মনে হয়!

আফশিনের বাবার মতে, হয়তো ভালই হয়েছে আফশিনকে এমন দেশে থাকতে হবে না যেখানে যেখানে ইউনাইটেড হাসপাতালের মতন প্রতিষ্ঠানরা শত অনিয়ম করেও মন্ত্রী-খবরের কাগজকে ক্ষমতা দিয়ে হাতে রেখে মাথা উঁচু করে ব্যবসা করে।


ওপরের ঘটনা দুটোর কোনটিই আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুব অবাক হওয়ার মতন কিছু না। এমন ঘটনা খবরের কাগজে প্রতিদিন ভরে থাকে, পরিচিতদের মুখে অহরহ শোনা যায়। একটু ‘ইশ’ বলে মেনে নেই আমরা; ভাবি ভাগ্যিস আমার সাথে এমন হয় নি, আশা করি আমার সাথে এমন হবে না। কিন্তু যখন খুব কাছে এমন ঘটনা ঘটে যায় তখন খুব অসহায় লাগে, খুব ভয় হয়। এরপর কি আমার সাথে হবে এমনটা? দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে উঠি, চিন্তার জালের জটটা কিছুতেই খুলতে পারি না। ভাবনা গুলো বদলে যায়, পালটে যায় পরিকল্পনাগুলো, ভেঙ্গে যায় স্বপ্ন।

বাবা-মায়ের সমসাময়িক যারা প্রবাসজীবন বেছে নিয়েছে অনেকের মুখেই শুনেছি যে তাদের দেশে থেকে কিছু করার ইচ্ছা ছিল। শুনেছি সেসব দেশে তাদের জীবন নিয়ে অতৃপ্তির কথা। তা সত্তেও সেখানে থেকে যাবার কারণ হিসেবে অনেকেই সন্তানদের দোহাই দিতে শুনেছি। এমন মন্তব্য শুনলে সবসময়ই আমার তাদের সুবিধাবাদী মনে হত, ভাবতাম ‘আছেন তো নিজের আয়েশের জন্য, এখন ছেলেমেয়ের দোহাই দেয়া হচ্ছে!’

এ ঘটনা দুটোর পর আমার কেন যেন আর তাদের সুবিধাবাদী মনে হচ্ছে না। আমি নিশ্চিত যে নুহা আর আফশিনের মা-বাবার একবার হলেও মনে হয়েছে, এ দেশে না থেকে অন্য কোন উন্নত দেশে থাকলে হয়তো তাদের সন্তানরা আজ তাদের সাথেই থাকত। ভাবি, যখন আমার নিজের এমন একটা বাবু হবে, আমি কি পারব তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে? ক্ষীণ সন্দেহ হয়, বন্ধুদের মতন কোমর বেঁধে ইমিগ্রেশনের প্রচেষ্টা না চালিয়ে কি ভুল করছি?

খুব কি অন্যায় করছি এ দেশে নিজে বাঁচতে চেয়ে? ফুলের মতন শিশুগুলির বড় হবার সুযোগ প্রার্থনা করা কি খুব অপরাধ?

-শান্তিপ্রিয়


মন্তব্য

ছাইপাঁশ এর ছবি

এমন করে লিখেছেন যে শুধু 'ইশ' বলে লেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য যায়গায় আর মনোযোগ দেয়ার উপায় রইলো না।
বিদেশের জীবন যে মানুষ কত কারণে বেছে নেয়! এই আমি যেমন ফিরতে পারছি না...। কে জানে কেউ হয়ত আমাকেও ভাবছে সুবিধাবাদী কিংবা হয়তো কেউ ভাববে...।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

....................

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বইখাতা এর ছবি

পত্রিকার পাতার খবরের মতো কিছু যে আমাদের নিজেদের সাথেও ঘটতে পারে, একথা আমরা অনেকেই ভাবতে পারিনা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।