ভোট

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৭/১২/২০১১ - ১:৫২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোরগ মার্কার উপর সিলটি বসানোর ঠিক আগ মুহূর্তে পরিমন বেওয়া মারাত্মক ধান্ধায় পড়ে গেল। গোলাপি রঙের কাগজে ছাপানো মেম্বারদের জন্য নির্ধারিত ব্যালট পেপার। ব্যালট পেপারের একেবারে নিচে বাম দিকে মোরগ মার্কা ছাপানো থাকবে, ভোট কেন্দ্রে ঢোকার আগে পূব পাড়ার সাবেক মেম্বার জমির শেখ খুব ভালো মতো শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে। ছাপ মারার কালি মাখানো সিলটি যেন অন্য কাগজ বাদ দিয়ে মোরগ মার্কাতেই প্রথম ছোঁয়ায়, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বারবার। কেন্দ্রে প্রবেশের আগে অবশ্য দীর্ঘ সময় ধরে বিরাট লাইন পেরুতে হয়েছে তাঁকে খাড়া সূর্যের প্রখর ছটা আঁচলে আড়াল তুলে। সূর্য ততক্ষণে তিন ঘড়ি হেলে গিয়েছে পশ্চিমে। এতে কিন্তু পরিমন বেওয়া নাখোশ নয় মোটেও। ভোট তো আর বছর বছর আসে না! এক দিন না হয় একটু কষ্ট হলই। জমির শেখ তেমনটাই বলেছে।

ভোট নেয়ার লোকটা তাঁকে বেশ যত্ন করেই ব্যালট আর সিল ধরিয়ে দিয়েছে। ভোটকক্ষের এক কোণায় এক চিলতে হলুদ কাপড় দিয়ে ঘেরা। কাপড়ের আড়ালে বেঞ্চ পেতে তার উপর ভোট দেবার ব্যবস্থা। হাতে পাওয়া তিন ধরণের ব্যালট পরম যত্নে বেঞ্চের উপর বিছিয়েছে সে। না, ব্যালট পেপারে মোরগ মার্কা চিনে নিতে কোন কষ্ট হয়নি তাঁর। জায়গাটা যদিও একটু অন্ধকার, আর তার চোখ দুটোরও বয়স হয়েছে ঢের। তথাপি কালো রঙের ঝুঁটিওয়ালা মোরগটির ছবি একবারে জ্বলজ্বল করে উঠেছে যেন। মার্কা উজ্জ্বল হলে সেই প্রার্থীই নাকি ভোটে জিতে যায় এমন কথা অনেক শুনেছে সে। সিলটা মোরগের পাখনা বরাবর বসিয়ে দেবে, ঠিক তার আগে এই বিপত্তি। মোরগটি যেন ককিয়ে উঠল, স্পষ্ট শুনতে পেল পরিমন বেওয়া। তার মিনসে বেঁচে থাকতে ছোট মেয়ে একবার নাইওর এসেছিল এইরকম আষাঢ় মাসে। সেবারই আস্ত একটা মোরগ জবাই করে মেয়ে জামাইকে রান খাইয়েছিল। জবাই করার আগে পা পাখা আর গলা টান টান করে ধরার সময় ঠিক এই রকম একটা আওয়াজ তুলেছিল মোরগটা। সুবহে সাদিকের ঘোর লাগা আলো মুরগির খোঁয়াড়ের ফাঁকে ঢুকে মোরগগুলোকে জাগিয়ে দিলে ওরা যেই শানদার আওয়াজ তোলে, এটি তেমন নয় মোটেও। খুব ভয় পাওয়া গলায় যেনবা বাঁচার আকুতি জড়ানো সেই আওয়াজ। মোরগের ছবিটার ওপর থেকে সিলটা সরে যায় কোন অদৃশ্য ইঙ্গিতে যেন।

জমির শেখের মুখটা যেন ভেসে উঠে অকস্মাৎ ব্যালট পেপারের গায়ে। লোকটা আজ অনেক করেছে। ভোট দিতে আসার কোন ইচ্ছে ছিল না পরিমনের। এই বয়সে ভোটতো কতবারই দিল সে। ভোট দেবার আগে সবার সেকি তোয়াজ! এবারো তার অন্যথা ছিল না। খাটামারার জব্বর বেপারিতো প্রায় প্রতিদিন লোক পাঠিয়েছে তার বাড়িতে গত একমাস জুড়ে। ফুটবল মার্কার জোয়ান পোলা আঞ্জু যেদিন তার বাড়িতে ক্যানভাস করতে আসে, পরিমনের শ্বাসের টান সেদিন একটু বাড়তির দিকে ছিল। দেখে আঞ্জুর কি রাগ!
‘ও খালা, তুমি কি এম্বা করি মরি যাবার চান নাকি? মুই তা হবার দিবার নও। ঐ জগলু, খাড়া হয়া আছিস ক্যান বাহে? যা, বাদশা ডাকতরক ধরি আন!’’

পরিমন যতই বোঝায় এই অসুখ তার গা সওয়া, আঞ্জু ততই জোর খাটায়। শেষে নিজের টাকায় এক পাতা শ্বাসের বড়ি কিনে দিলে ওগুলো হাত পেতে নিয়ে পরিমন তাঁকে ক্ষান্ত করে। এরকম শ্বাসের টান আবার উঠা মাত্রই তাঁকে খবর পৌঁছাতে হবে, এমন ওয়াদা করিয়ে তবেই সে বাড়ি ছাড়ে। সেদিন পরিমনের ভাঁজ খাওয়া চোখের পাতার কোণদুটো ভিজে উঠেছিল কেন যেন অনেকবার। আহারে, ছেলেটার বয়েস একটু বেশি হলে ভোটটা ওকেই দিত এবার পরিমন। বয়সের একটা বিষয় আছে না? অমন বাচ্চা ছেলে পরিষদে গিয়ে তো কেবল মুরুব্বিদের সামনে কুতর্ক করবে। গাঁয়ের গণ্যমান্যদের উপর ওর নাকি কোন ভক্তি শ্রদ্ধা নাই, জমির শেখ তেমনই বলেছে। পরিষদ হল গিয়ে বুঝদার মানুষদের জায়গা। ওইখানে কত ‘ইলিফের মাল’ আসে। আঞ্জুর মতন ‘ছইল পইল’ তো এইসব মালপত্র সাগরেদদের নিয়ে ভাগ বাটোয়ারা করেই সাবাড় করে ফেলবে। জমির অবশ্য কথা আরেকটি বলেছে।

‘আর একটাবার ভোট হামাক দ্যান হনুফার মাও। মুই তুমার দুইখান হাত ধরি ওয়াদা করং, ইবার বিদবা ভাতার কাড তুমার নামৎ নেখি দিমুই। আগত বার ঐ চ্যাঁরম্যানের ফান্দত পড়ি তুমার নাম কাটি দিছং। ইবার মুই ফির ভুল না করং। মোক ফির একটা বার পরিষদত উটপার দেও বুবু।’

জমির শেখের মিষ্টি কথায় অবশ্য এত টলেনি পরিমন এবার। গতকাল রাত পর্যন্ত সে গোঁ ধরেছিল জমিরকে ভোট দেবে না বলে। ভাব অনুমান করেই বুঝিবা কাল রাতে আবার হাজির হয়েছে লোকটা। এই কথা সেই কথা পেড়ে শেষে যাবার আগে দুইখানা ‘বড় বিরিজের’ ছবি ওয়ালা টাকার নোট তেল চিটচিটে বালিশের নিচে গুঁজে দিয়ে গেছে। ভোটটা যাতে কোনমতেই ফস্কে না যায়, সেদিকে জমির শেখের নজর খুব কড়া। আজ ভোটের দিন ভ্যান গাড়ি সব বন্ধ। ঐ লোকটা কোথা থেকে যেন ভ্যানগাড়ি জোগাড় করেছে পাঁচ সাতটা। তারই একটা বেলাবেলি পরিমন বেওয়ার বাড়িতে পাঠিয়ে কেন্দ্রে নিয়ে গেছে তাঁকে। অনেকদিন পর ভ্যানগাড়ির দুলুনি অবশ্য মন্দ লাগেনি তার। মেয়ে হনুফার ঘরের নাতিটা ভ্যানগাড়িতে তার বাঁ পাশেই হাত ধরে বসেছিল। কেন্দ্রে ঢোকার আগেই পান শেধেছিল শেখের লোকজন। পরিমন খায়নি। পান পরেও খাওয়া যাবে। ভোটটা তাড়াতাড়ি দেবার তাগাদায় সে দ্রুত কেন্দ্রে ঢুকেছিল। এপর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। হঠাৎ ব্যালটের মোরগটা ডেকে উঠেই যত বিপত্তি ঘটাল।

জমির শেখ লোকটা অতো খারাপ না। শুধু একটা ঘটনা মনে পড়ল পরিমনের। তার মেয়ে হনুফাকে হিল্লা বিয়ে করার প্রস্তাব রেখেছিল মেম্বার জমির শেখ। তিন বছরের ছেলেটার হাতের আঙ্গুল ধরে একদিন ভর সন্ধ্যায় হনুফা তার উঠানে উপস্থিত। মুখে তার কথা নেই। তিনদিন জবান বন্ধ থাকার পর জানা গেল সোয়ামী তাঁকে তিন তালাক দিয়ে বিদায় করেছে। একমাস পর মেয়ের জামাই এসে অবশ্য বলল ঘটনা তেমন কিছু না। রাগের মাথায় কি না কি বলেছে। সে এসেছে হনুফাকে নিয়ে যেতে। তখন বাদ শেধেছিল এই জমির শেখ। হনুফা তার বাড়িতে আসার পর জমির অবশ্য তাদের খোঁজ খবর রাখছিল বেশ। মাঝে কয়েকদিন সাঁঝের পড়েও হাওয়াই মিঠাই হাতে উঠোনে ঢুকে নাতির নাম ধরে ডেকেছে। এখন জামাই আবার হনুফাকে নিয়ে যেতে চায় শুনে জমির বলল মেয়ের তালাক হয়ে গেছে। শরিয়ত মতে একবার তালাক উচ্চারণ হলে সেই সোয়ামীর ঘর হারাম। আবার সেই ঘরে ফিরতে চাইলে উপায় আছে। তবে মেয়েকে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে বিশ্বস্ত কারো সাথে। আর এ গাঁয়ে জমির শেখের থেকে পরিমন বেওয়াদের কাছে অধিক বিশ্বস্ত কেই বা আছে? সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। হনুফার সোয়ামীও মেনেই নিয়েছিল প্রায় বিষয়টি। কিন্তু বেঁকে বসলো হনুফা। সে এই বিয়েতে কিছুতেই রাজী নয়। শেষে একদিন ভোরে জেগে পরিমন দেখল হনুফার বিছানায় বালিশ পড়ে আছে। একপাশে ছেলেটা গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে। হনুফা উধাও। মেয়েটা সেই যে গেল!

নাহ। এই নোংরা লোকটাকে কিছুতেই ভোট দেবে না পরিমন বেওয়া। ক্ষোভের আন্দোলনে ঝাপসা হয়ে আসা চোখে আবছা আলোয় সে গোলাপি রঙের ব্যালটের অন্য মার্কাগুলো আঁতিপাঁতি খুঁজতে থাকে। পর্দার বাইরে থেকে তখন একজন পাহারারত আনসার বিরক্ত গলা বাড়িয়ে খেঁকিয়ে ওঠে,

‘অ দাদী!! ভোট করতি ধরি নিদ গেছ নাকি? ইদিকে যে আইত হবার ধরছে। ফস করি বাইর হন।’

--------------
পথিক পরাণ


মন্তব্য

সুমাদ্রি এর ছবি

দূর্দান্ত, দূর্দান্ত! প্রথম লেখাটাও ভাল লেগেছিল। গল্পটা একটু পরাবাস্তবতার দিকে যাচ্ছিল, মোরগটা কথা বলে উঠবে ভেবেছিলাম। যাহোক, এরকম লেখা আরো উপহার দেবেন আশা করছি।

পথিক পরাণ এর ছবি

কষ্ট করে সাথে আছেন জেনে ভালো লাগছে ভীষণ। পরাবাস্তবতায় যাইনি ইচ্ছে করেই।
অনেক ভালো থাকুন। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

জাদুকর এর ছবি

গল্প পড়ে বেশ ভাল লাগল। গ্রাম বাংলার বাস্তবতাগুলো বুঝা যাচ্ছিলো।

পথিক পরাণ এর ছবি

ভালোলাগা রেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ। গ্রাম বাংলার বাস্তবতা আরও অনেক বেশি কলুষিত কোথাও কোথাও। তারই কিছুটা ধরার চেষ্টা করেছি।
অনেক শুভ কামনা রইল। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সাফি এর ছবি

চলুক

পথিক পরাণ এর ছবি

দেঁতো হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তাপস শর্মা  এর ছবি

ভালো লাগল খুব। চলুক

পথিক পরাণ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মেঘা এর ছবি

খুব ভালো লাগলো গল্পটা। সময় নিয়ে পড়েছি। গ্রামের মানুষগুলো বুঝি এমন ভাবেই বিভ্রান্ত হয় ভোটের সময়। আমাদের বাসার বুয়ার কাছে ভোটের সময় শুনেছিলাম তার বাবা বলে গেছে ভোট দিলে লৌকাতেই দিতে হবে খাইছে

পথিক পরাণ এর ছবি

সময় নিয়ে পড়েছেন সে জন্য কৃতজ্ঞতা। গ্রামের মানুষগুলোকে বিভ্রান্ত করা খুব সহজ। এদের ভেতর একবার কোন মন্ত্র ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হল। দুষ্ট লোকগুলো এই সুবিধাটা নিয়ে থাকে।

----------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

মর্ম এর ছবি

গল্প তৈরি আর বলায় আপনার মুন্সীয়ানা প্রশংসা করার মত। খানিকটা অপরিচিত পরিবেশ নিয়ে লিখেছেন, তারপরও টানা পড়ে যেতে হল। গল্পে গল্প এক একটা চরিত্র উঠে এল একটু একটু গল্প নিয়ে, যেখানটায় চাইলেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ঠিকই কিন্তু তাতে গল্প বলা থেমে গেল না।

সচলে আপনি থাকতেই এসেছেন ভাই, প্রাণ ভরে লিখুন, মন ভরে পড়ি।

সুন্দর গোছানো গল্পের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন আপনাকে।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

পথিক পরাণ এর ছবি

এতো সুন্দর করে বললেন আপনি! আমি রীতিমত মুগ্ধ!
অনেক অনেক শুভকামনা রইল আপনার জন্য। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

গ্রামে ভোটের আগে পরে অনেক সময় কাটিয়েছি। মেম্বর, চেয়ারম্যানদেরকেও ভালভাবে বুঝেছি। আর ঐ সব পরিমন বেওয়া! ওদের সাথেইতো মিশতাম। চরিত্রগুলো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্নণও যথাসম্ভব সুন্দর।
ধন্যবাদ, এমন একটি লেখার জন্য। স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হলাম।

পথিক পরাণ এর ছবি

গ্রামগুলো আজ আর ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় নেই মোটেও। কে হবে মেম্বার, কে হবে গ্রামসরকার(পোস্ট না থাকলেও আন্দোলন থামে নাই), এই নিয়ে লেগে থাকে ধুন্দুমার। আমরা কোথায় যে যাচ্ছি?

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

----------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

সিরাজুল লিটন এর ছবি

ভাল লেগেছে। হাসি

পথিক পরাণ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

atmkader এর ছবি

৯৬ এ ভোটের সময় দেশে ছিলাম । ভোট দিতে বুথে ঢুকে দেখি ভিতরে বিশেষ দলের এক ক্যাডার ! আমাকে দেখে, 'ও বদ্দা না' ! বলে জ্বিবে কামড় খেয়ে তাড়াহুড়ো বেরিয়ে যায় । প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা বলে রেহাই পাই । পরিমন বেওয়াদের খবর জানতাম না । এখন কি বদলেছে পরিবেশ ?

লেখাটা খুবই ভাল লাগলো । ধন্যবাদ !

পথিক পরাণ এর ছবি

কেন্দ্রের ভেতরের চেহারা পাল্টেছে নিঃসন্দেহে। তবে বাইরে পরিমন বেওয়ারা আরও অসহায় হয়েছে মনে হয়। লোকজন এইটাকে উৎসাহ নিয়ে 'ভিলেইজ পলিটিক্স' বলে থাকে!! জঘন্য!!

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য।

----------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।