নিয়তির সালিশ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৪/০২/২০১২ - ১১:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সারাটা গ্রামই আজ নীরব, প্রায় সবাই ঘুমে বিভোর। গাঢ় অন্ধকারের চাদরে ঢেকে আছে সব। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছগুলোর অস্তিত্ব পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। ঝিরি ঝিরি বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ হচ্ছে। সেই সাথে কিছুক্ষণ পরপরই থেমে থেমে শেয়াল ডেকে উঠছে ক্রমাগত। গ্রামকে একপাশে রেখে চলে গেছে এবড়ো-থেবড়ো মেঠোপথটি। মাঝে মাঝে শেয়াল ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এই পথের উপর চলে আসে। এই পথ ধরেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নূরু মেম্বার। গঞ্জ থেকে ফিরতে আজ বড় দেরী হয়ে গেছে।

সেই ছোট বেলা থেকেই পরিচিত গাঁয়ের এই পথটির সাথে। কত দাপট, কত বীরত্বের আজন্মের স্মৃতি বিজড়িত এই পথ। অথচ আজকে বড় অদ্ভুত লাগছে, কেমন যেন একটু ভয়ও করছে। এমন অদ্ভুত অনুভূতি এর আগে কখনোই হয়নি। তাছাড়া আজ রাতের অন্ধকারটাও অন্যসব রাতের চেয়ে অনেক বেশী গাঢ় ও তীব্র; হয়ত কবর অন্ধকার এমনই নিশ্চল গাঢ়। চার ব্যাটাটির একটা টর্চ আছে নূরু মেম্বারের। প্রত্যেক দিন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় হাতে ভর করে চলার নায়েবি লাঠিটার সাথে টর্চ-ও সাথে নিয়ে নেন। এর কখনোই ব্যতিক্রম হয়নি। আজ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নায়েবি লাঠিটা সাথে নিলেও ভুলে টর্চটা ফেলে রেখে যান। টর্চটা সাথে থাকলে এমনটি হত না। নিজের ভুলের কারণে নিজের উপরই প্রচণ্ড রাগ লাগছে।

অন্ধকারে ডুবে থাকা নূরু মেম্বারকে সঙ্গ দিচ্ছে কিছু জোনাকি। কিছুক্ষণ পরপরই তারা মুখের সামনে দিয়ে ঢেউয়ের মত জ্বলে-নিভে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। এমনিক্ষণে হঠাৎ করেই বাতাস থেমে গেল। বাতাস থামতেই তিনি ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পেলেন। হয়ত এতক্ষণ গাছের ডালপালা ও পাতার শব্দে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাননি। হঠাৎ-ই খুব কাছে শেয়াল ডেকে উঠতেই তিনি চমকে থেমে গেলেন। এবার পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত হাটতে শুরু করলেন। কিছুদূর এগুতেই দেখতে পেলেন হারিকেন হাতে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি আসতেই সালাম দিয়ে হারিকেন হাতে এগিয়ে এল ধনু মিয়া। সালামের জবাব না দিয়েই নীরবে হাঁটতে থাকলেন তিনি। সন্ধ্যার পর থেকেই হারিকেন হাতে মেম্বারের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল ধনু মিয়া। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ধনু মিয়ার উৎকণ্ঠিত প্রশ্নে মৌনতা ভাঙ্গে। কিছু একটা ছিল ধনু মিয়ার কন্ঠে, প্রশ্ন শুনেই নূরু মেম্বার কিছুটা বিচলিত ও ইতস্তত বোধ করলেন।

:'বিচারডা পামু নি মেম্বর সাব?'

:'এসবের বিচার কি কেউ চায়? এসব কথা না উঠনই ভালো না? তোমার জন্যও ভাল, তোমার মাইয়্যার জন্যও ভাল।'

:'কি কন মেম্বর সাব! যেই জানোয়ারগুলা আমার মাইয়্যার এতবড় সর্বনাশ করল আমি তাদের বিচার চামু না?'

:'না না, হেই কতা কই নাই। বিচার চাইতে তো মানা নাই। তয় সালিশ বসাইলে গ্রামগঞ্জের সবাই তোমার মাইয়্যার ঘটনাডা জানবো তখন তোমার মাইয়্যা মুখ দেখাইবো কেমনে? আর তোমার ইজ্জতই-বা কই যাইব ভাইবা দেখছ। তাছাড়া হুনলাম গঞ্জের বেপারীর পোলা-ও নাকি সাথে ছিল।'

ধনু মিয়ার কন্ঠ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হয়। নূরু মেম্বারের কাছে সেই শব্দ পৌছায় না। নূরু মেম্বার বলতেই থাকেন –

:'সালিশে না হয় তুমি বিচার পাইলা। তয় তোমার মাইয়্যারে তুমি বিয়া দিতানা? তখন তোমার মাইয়্যারে বিয়া করব কেডা? আর ওই পোলাগুলা যে আবারও তোমার কোন ক্ষতি করব না সেইটাই-বা বলি কেমনে।'

চৈত্রের এই ভ্যাপসা রাতে ধনু মিয়ার শীত লাগতে শুরু করে। হাত, পা তার ক্রমশ অনুভূতি হারাতে থাকে। মেম্বার সাব বলতেই থাকেন-

:'ররং আমি বলি কি তুমি সালিশে না যাইয়্যা মিমাংসাতে যাও। আমি এর ব্যবস্থা কইরা দিমু। কেউ জানতে পারবো না। ওদের কাছ থেইক্যা তোমারে জরিমানা আদায় কইরা দেই। তুমি তোমার মাইয়্যারে লইয়া এই গ্রাম ছাইড়া অন্য কোথাও চইল্যা যাও।'

একটু যেন দমে যায় ধনু মিয়া। মেয়ের কথা, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই বুকে হাহাকারের ঢেউ উঠে। নিজের অজান্তেই তাই বলে উঠে-

:'আমার বসত ভিটা, গঞ্জের দোকান। এসবের কি হইব?'

:'কি আর করবা? বেইচ্যা দেওন ছাড়াতো আর কোন গতি দেহি না। তয় নায্য দাম পাইবা বইল্যা মনে হয় না।'

:'মেম্বর সাব, আফনেওতো জমি-জিরাত কিনেন। আমারগুলো কিন্ন্যা লন না।'

:'তা ঠিক আছে। কিন্তু আমার হাতে তো টেহা-পয়সা নাই খুব একটা। তুমি যদি সময় দেও তাইলে দেখতে পারি। তাও কিনতাম না, শুধু তোমার বিপদ বইল্যা আগাইয়্যা আইছি।'

:'আফনে তাইলে ব্যবস্থা করেন মেম্বর সাব। দুই-একদিনের ভিতরেই করেন।'

নূরু মেম্বরের চোখে-মুখে চাপা হাসির আভা ফুটে উঠে। অন্ধকারে হারিকেনের মৃদু আলোয় ঐ হাসি ধনু মিয়ার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। সালাম দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় ধনু মিয়া। এবার বেশ সম্ভ্রমের সাথে শব্দ করে সালামের উত্তর দেন নূরু মেম্বার।

বাড়িতে ঢুকতেই গোঙ্গানির মত অস্ফুট শব্দ ভেসে আসে তার কানে। মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মত সাহস খুঁজে পায় না। তবুও ভীরু ভীরু পায়ে ঘরে ঢোকে সে। হাফিজের বউটা তার মেয়ের মাথা কোলে তুলে বসে আছে। মা-মরা মেয়েটা মুখের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কান্না আসে তার। কাছে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত রাখে সে। বুঝতে পারে তার হাত ক্রমাগত কাঁপছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে- '

:'মা-রে, তুই চিন্তা করিস না। আমরা দুই-একদিনের ভিতরেই এই গ্রাম ছাইড়্যা চইল্যা যামু দূরে কোন খানে। এমন দূরে যামু যেইহানো তরেও কেউ চিনব না আমারেও কেউ চিনব না। নতুন কইর‍্যা আবার আমরা বাঁচতে শুরু করুম।'

মেয়ের গালে-থুতনিতে হাত রাখতেই মেয়ের চোখের জলে ভিজে উঠে তার হাত। মেয়ের এত চোখের জল, এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে উঠে পড়ে। ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগেই মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসে কানে-

:'বাজান, যারা আমারে এত কষ্ট দিছে হেই পশুগুলার বিচার করবা না?'

ঘরের কোণের দিকে উঠোনের একপাশে একটা কাঠের চৌকি পাতা। মাঝে-মধ্যে রাতে প্রচণ্ড গরম লাগলে এই চৌকিতেই রাত কাটায় ধনু মিয়া। হারিকেনের আলো কমিয়ে চৌকির একপাশে রেখে শুয়ে পড়ে সে। কানে তার বাজতে থাকে মেয়ের প্রশ্নটা। কেন সে মেয়ের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনি? কেমন বাবা সে, যে মেয়ের উপর জুলুমের বিচার না করেই পালিয়ে যেতে চায়? সে একবারও কেন মেয়ের মনের ইচ্ছাটা জানতে চাইল না? হাজারও ভাবনায় নিজেকে বড় বেশী হেয়, বিপন্ন ও কাপুরুষ মনে হতে থাকে।

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কিছুটা ঘোরের মত লাগে, হঠাৎ পায়ের শব্দে চৌকিতে উঠে বসে ধনু মিয়া। জলিল মাস্টার এসেছে। ছোট বেলার বন্ধু এই জলিল মাস্টার। সে আর জলিল মাস্টার একসাথে স্কুলে যেত। বেশ কিছুদিন স্কুলে গেলেও পড়াশোনায় কোন মনোযোগ ছিল না ধনু মিয়ার। একটা সময় স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিল। খুব ছোট বেলাতেই বাপ-মা মারা যাওয়ায় ধনু মিয়াকে দেখাশোনা, আদর ও শাসন করার মত কেউ ছিল না। তাই শৈশবের সময়টুকু কেটেছে দুরন্তপনায়।

স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও জলিল মাস্টারের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। স্কুলের বাইরের পুরো সময়টুকু তারা একসঙ্গে খেলাধূলা, ছোটাছুটি, হৈ-হুল্লোড় করে কাটাত। দিন যেতে লাগল, জলিল একেক পর এক এক বড় পাস দিতে লাগল। একসময় একটা বড় পাস দিয়েই জলিল হল জলিল মাস্টার। গঞ্জের পাশেই হাই স্কুলে চাকরি নিল সে। আর এইদিকে ধনু মিয়া স্কুলের পাশেই বাবার গঞ্জের ভিটায় দিল চায়ের স্টল। ধনু মিয়ার বাবার জমি-জিরাত ছিল অনেক। বসত বাড়ি, গঞ্জে কয়েকটা ভিটা, বেশকিছু ধানি জমি ছিল তার বাবার; সবই অবশ্য শোনা কথা। ধনু মিয়া যখন বুঝতে শিখলো তখন অবশ্য বসত ভিটা, গঞ্জের একটা ভিটা ও এক টুকরো বিঘা খানেক ধানি জমি ছাড়া কিছুই মিলল না। জানা গেল তার বাবা বিভিন্ন সময় জমির দলিল দিয়ে টাকা ধার নিয়েছিল, পরে আর শোধ দিতে না পারায় অনেক জমিই হাতছাড়া হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার বলে অন্য কথা। সেই এক টুকরো ধানি জমি বিক্রি করেই গঞ্জে দোকান দিল, ভিটায় নতুন ঘর তুলল। আর ঘরে নিয়ে এল একটা টুকটুকে নতুন বঊ।

দিনগুলো সুখেই কাটছিল, সবকিছুই কত সুন্দর কত আপন আপন ছিল। একসময় জুলির জন্ম হল। আহা! কত সুখ, কত আনন্দের সেইসব দিনরাত্রি। জুলির জন্মের বছর দুয়েক পরে এক বৈশাখী রাতে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে জুলির মা মারা যায়। অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল পুত্র সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। দুইদিন হেসে-কেঁদে সেই পুত্রও মায়ের পথ ধরে পাড়ি জমাল না ফেরার দেশে। সবাই বলেছিল আরেকটা বিয়ে করতে। মা-মরা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ না কাল, দেখা যাক সময় তো যায় নায় বলে কয়ে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেল! দেখতে দেখতে জুলির বয়স সাত-আট বছর হয়ে গেল। নিজের ভেতর থেকে কখনোই আর তাগিদ এল না বিয়ে করার। শুরু হল বাবা-মেয়ের নতুন সংসার।

মেয়ে প্রাইমারী পাস করলে পরে তাকে গঞ্জের হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় ধনু মিয়া। বছর তিনেক ধনু মিয়া নিজের সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেত, আর স্কুল শেষে নিজেই বাড়ি দিয়ে যেত। এইতো কিছুদিন আগেই স্কুল পাসের পরীক্ষা দিল। এভাবেই দেখতে দেখতে তার মেয়ে বড় হতে লাগল। বড় সুন্দর, বড় আদরের তার এই মেয়েটা দেখতে যেন ডানা কাটা পরী। অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ধনু মিয়ার কাছে আসে। ধনু মিয়া এক কথায় ফিরিয়ে দেয় সবাইকে। ধনু মিয়ার স্বপ্ন তার মেয়ে একদিন বড় পাস দিবে, অনেক বড় মাপের মানুষ হবে। তখন কত ভাল শিক্ষিত পরিবার থেকে তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসবে। মেয়েকে একটা ভাল ছেলের হাতে তুলে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্তে মেয়ের সুখী সংসার দেখে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে।

:'মেম্বর সাবের সাথে আলাপ হইছেনিও ধনু মিয়া?'

জলিল মাস্টার যে কখন এসে তার পাশে বসে ছিল ধনু মিয়া তা মনে করতে পারে না।

:'কখন আইলা মাস্টার?'

:'অনেকক্ষণই-তো হইব। মেম্বর সাবের সাথে আলাপ করছ নি?'

:'মেম্বর সাব তো কইল ঘটনা জানা জানি হইলে তোমারও শরম তোমার মাইয়্যারও শরম। সমাজে মুখ দেখাইবা কেমনে? এরচেয়ে ভাল ওদের সাথে মিলমিশ কইরা দেই। ওরা কিছু টাকাও দিব আর তুমি তোমার মাইয়্যারে লইয়া দূরে কোথাও চইল্যা যাও।'

:'ও-ও-উ, মেম্বর তাইলে এই মতলব আঁটছে! আচ্ছা তুমি কি চাওনা যারা তোমার মেয়ের এই সর্বনাশ করল তাদের বিচার হউক, সমাজ তাদের চিনুক? আজকে তারা তোমার মেয়ের ক্ষতি করছে, কালকে হয়ত অন্য কেউ ওদের বিষাক্ত ছোবলের শিকার হইব। তুমি তোমার মেয়ের মুখের দিকে একবার ভাল কইরা তাকাইছো? কি, কিছু দেখতেই পাও নাই? তোমার মেয়ে কি চায় তুমি কিছু বোঝো নাই?'

বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে ধনু মিয়ার। চাপা যন্ত্রনার পাথর ক্রমেই দানা বেধে শীতল ও ভারী হতে থাকে। ধনু মিয়াও চায় ঐ পশুগুলার বিচার হোক। কিন্তু বিচার বসলেই যে তার মেয়ে নায্য বিচার পাবে সেই আশংকা খুব কম। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল তার মেয়েকে তখন কে বিয়ে করতে চাইবে? মিশ্র অনুভূতিতে ধনু মিয়ার সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসতে থাকে।

:'আমিও চাই বিচার হউক। কিন্তু জানা জানি হলে আমার মাইয়্যা মুখ দেখাইবো কেমনে? আমার মাইয়্যারে বিয়া-ই বা করব কেডা?'

:'সমাজ রে জানতে দেও ধনু মিয়া। সমাজই সমাধান দিব। আর আমরা তো আছি-ই। সবাই যখন জানবো গঞ্জের ঐ বেপারীর পোলা এই কাম করছে তখন সবাই বেপারীরে ছি ছি দিব। দেখবা তখন সব ঠিক হইয়া গেছে। যাও তুমি মেম্বরের কাছে গিয়া সালিশের ব্যবস্থা কর।'

রাত অনেক গভীর এখন, সেই সাথে অন্ধকারের তীব্রতাও আগের চেয়ে অনেক বেশী। রাতের অন্ধকারের মত ধনু মিয়ার জীবনেও এখন অনিশ্চিত নিগূঢ় অন্ধকার। রাতের অন্ধকার যত গভীর হবে প্রভাত তত সন্নিকটে আসবে এটাই জগতের নিয়ম। রাতে অন্ধকারের ভয়ে যাদের ঘুম নেই চোখে, তারাও নিশ্চিত ভোরের আশায় ঘুমাতে যাবে। শুধু ধনু মিয়ার জীবন আজ অসীম অন্ধকারে। সেখানে রাত যত গভীর হয় অন্ধকারও তত গভীর হয়, সেই সাথে অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে এবং প্রভাতও ক্রমশ দূরে চলে যায়।

হারিকেনটা হাতে নিয়ে প্রকম্পিত পায়ে নূরু মেম্বারের বাড়ির দিকে পা বাড়ায় ধনু মিয়া। অনেকক্ষণ ঘরের দরজায় শব্দ করে ডাকার পর ঘুম ভেঙ্গে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলে নূরু মেম্বার। দরজা খুলেই মেম্বার বলে উঠেন-
:'এই মাইজ-রাইতে না আইলেও চলত। সকাল বেলা আমিই যাইতাম তোমার বাড়ি।'

ধনু মিয়া কোন কথা বলে না দেখে নূরু মেম্বার জিজ্ঞাসা করে উঠেন-
:'নতুন কিছু ঘটছে নাকি ধনু মিয়া?'

অনেকটা আমতা আমতে করে ধনু মিয়া বলে-
:'আমি বিচার চাই মেম্বর সাব।'

ধনু মিয়াকে ধমক দিয়ে বলেন-
:'তুমি কি কইলা ধনু মিয়া? তোমারে একটা ভাল পরামর্শ দিলাম তাতে তোমার মন ভরল না।'

রাগে জ্বলতে থাকেন নূরু মেম্বার। উত্তরের প্রত্যাশা না করেই নিজের রাগ দমন করে অনেকটা মোলায়েম গলায় বলেন-

:'দেখ মিয়া, আমি তোমার বাপের বয়সী। তোমার বাপ আর আমি এক সাথে ব্যবসা করছি অনেক। আমি তোমার ভালোর লাইগাই কইতাছি তুমি সালিশে যাইও না। আমি বেপারীর লগে কথা কইছি। বেপারী মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি। এমনকি তুমি চাইলে গঞ্জে তোমার দোকান ঘরও ভিটাসহ উঁচু দরে কিনতে চায়। আমিতো দেখি তোমার কপাল খুইল্যা গেছে।'

হাত কচলাতে কচলাতে ধনু মিয়া বিনম্র বলে উঠে-
:'মেম্বর সাব, আমি বিচার চাই।'

এবার আর রাগ প্রশমিত করতে না পেরে তীব্র হুংকার দিয়ে উঠেন নূরু মিয়া। নূরু মেম্বারের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে বড় ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ছেলেকে দেখে নূরু মেম্বার ধনু মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন-

:'যাও মিয়া, ঘরে ফিইরা যাও। তুমি সালিশ ডাকলে তো কিছু করার নেই, সালিশই হবে; কি আর করা।'

এখনও অনেকক্ষণ পরে পরে শিয়াল ডেকে উঠছে, তবে জোনাকির ছিটে ফোটাও নেই, হয়ত ওরাও ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুম নেই ধনু মিয়ার চোখে, তার মেয়ের চোখে। এদিকে ধনু মিয়া যাবার পর নূরু মেম্বারের চোখেও আজ ঘুম নেই, সেই কথা ধনু মিয়া হয়ত কখনোই জানবে না। জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। সারি সারি গাছের ডালপালা একটি আরেকটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এখন আর শেয়াল ডেকে উঠছে না। বাতাসের ঝাঁপটায় হারিকেনের লকলকে সলতে দপদপ করে জ্বলে উঠতেই নিভে গেল।

গ্রাম গঞ্জের যত প্রধান ব্যক্তি, মুরুব্বী, মাতব্বর ও সম্ভ্রান্ত যত লোক আছে সবাই এসেছে আজকের সালিশে। ধনু মিয়ার বাড়ির উঠোনের পুরো জাগয়া জুড়েই গোল হয়ে সালিশ বসেছে, মাঝখানে সন্দিগ্ধ দোষী লোকদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। বৈঠকের এক কোণে কালো শাড়ির ঘের দিয়ে তৈরী পর্দার আড়ালে চৈতন্যহীন জুলিকে নিয়ে বসে আছে হাফিজের বউ, সাথে গ্রামের মহিলা ও বয়স্ক মেয়েরা। উঁকিঝুঁকি দিয়ে সালিশে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। সালিশের প্রধান করা হয়েছে নূরু মেম্বারকে। নূরু মেম্বারের ডান পাশের চেয়ারেই বসা গঞ্জের বেপারী। সালিশের নিয়ম অনুযায়ী জলিল মাস্টার সালিশে উপস্থিত সবার পক্ষ থেকে নূরু মেম্বারকে সালিশ পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেন।

সালিশ শুরু হয়। সালিশে ধনু মিয়া ও তার মেয়ে জুলিকে অতি জঘণ্য ও অশ্লীল ভাবে অপদস্থ ও হেয় করা হয়। দোষীদের স্বীকারোক্তি ও বিচার বিশ্লেষণে সংঘটিত ঐ নিকৃষ্ট ঘটনায় ধনুর মেয়ের সায় ছিল বলে সাব্যস্ত হয়। জলিল মাস্টার মাঝে মাঝে কিছু বলার চেষ্টা করলেও নূরু মেম্বার তাকে থামিয়ে দিয়ে সমস্ত পথ বন্ধ করে দেন। সালিশের গতিবিধি দেখে সারাটা সময় ধনু মিয়া নির্বাক চেয়ে রয়। সম্ভ্রান্ত বেপারীর ছেলেকে পুরোপুরি নির্দোষ দেখিয়ে বেপারীর সন্মানহানীর জন্য ধনু মিয়ার মেয়েকে একশ দোররা মারার নির্দেশ জারি হয় এবং ধনু ও তার মেয়েকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত দিয়ে বৈঠক শেষ হয়। আর অন্যদিকে অচৈতন্য জুলি এই সালিশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড় পদার্থের ন্যায় নিষ্প্রাণ পড়ে থাকে। হাফিজের বউ-এর কোলে মাথা রেখে জুলিও যে কখন তার মায়েরই মতন না ফেরার দেশে হারিয়ে গেছে সেটা বিশ্বভ্রমান্ডের একমাত্র অধিপতি, সমস্ত জাহানের সমস্ত সালিশের প্রধান ও তার অনুগত আদেশ পালনকারী ছাড়া আর কেউ-ই জানতে পারল না।

আজ ভরা পূর্ণিমা। চারিদিকে জ্যোছনার ফোয়ারায় সবকিছুই যেন ভেসে যাচ্ছে। ঝিরি ঝিরি হিমেল বাতাসে সারি সারি গাছের ডালে মিষ্টিমধুর শব্দ হচ্ছে। আজও নূরু মেম্বারের বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেছে। প্রাণবন্ত ঝিরি ঝিরি বাতাসে জ্যোছনায় নিজের ছায়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাড়ির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চাঁদের আশেপাশে বেশ কিছু মেঘের আনাগোনা, মাঝে মধ্যেই চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে ক্ষণিকের জন্য। তবে আজ আর ভয় নেই, আজ নায়েবি লাঠিটার সাথে চার ব্যাটারির টর্চটা সাথে নিতে ভুল হয় নি।

দূরে কেউ একজন হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নূরু মেম্বারের প্রচণ্ড রাগ উঠে, এমন ফকফকা জ্যোছনা রাতে হারিকেন জ্বালানোর কোন মানে হয়। মনেমনে আহাম্মক বলে গালি দেন তিনি আর ভাবেন কাছে গিয়ে একটা ধমক দেবেন। চাঁদ আবারও বড় একটা মেঘের আড়ালে ঢেকে যায়। হারিকেনের আলোটাও নড়েচড়ে আরো কাছাকাছি আসতে থাকে। কাছাকাছি আসতেই সালাম দিয়ে হারিকেন হাতে এগিয়ে এল ধনু মিয়া। নূরু মেম্বারের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সেই সাথে প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেয়ে গেল। আজ অতি আদবের সঙ্গে সালামের জবাব দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন তার কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে, কোন শব্দ বের হচ্ছে না। হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অনেক কষ্টে বলে উঠলেন-

:'আমারে ছাইড়া দেও বাজান। আমি কতা দিতাছি তোমার বাপের যত ধানী জমি, গঞ্জের ভিটা সব তোমারে ফিরায়া দিব।'

ধনু মিয়ার আজ আর কোন তাড়া নেই, নেই কোন পিছুটান। জগৎ সংসারের কোন কিছুর প্রতিই তার আর কোন মোহ নেই। আজ সে লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, লাভ-ক্ষতি, মোহ এই সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে। আজন্ম দুরন্তপনায় ছুটে চলা শৈশবে যেমন কোন পিছুটান ছিল না, রক্তের প্রতিটি কণিকা যেমন খেয়ালীপনায় উষ্ণ রাখতো সারাটি প্রহর, ঠিক তেমনি প্রখর ও উষ্ণ আজ তার প্রতিটি অনুক্ত অনুভুতি।

চার ব্যাটারির টর্চটা জ্বলে পড়ে আছে। টর্চের সমস্ত আলো মাটির এই রাস্তার উপর। কত দাপট, কত বীরত্বেও গাঁয়ের এই মেঠোপথটি একটুও টলেনি। টর্চের আলোয় সেই উঁচু নিচু এবড়ো-থেবড়ো মেঠোপথটি মাথা উঁচু করে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আচমকা একদল জোনাকি এসে ঢেউয়ের মত মাটির উপর টর্চের আলো ঘেঁষে জ্বলে নিভে উড়ে গেল।

...................................
মোখলেছুর রহমান সজল


মন্তব্য

অচল এর ছবি

অসাধারণ

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

পূনিয়া এর ছবি

শুভ শুরুর শুভেচ্ছা।
আরও অনেক পড়ার ইচ্ছা রইল।

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।
লিখব এই প্রত্যাশা রাখি . . .

আমার লেখা প্রথম গল্প রইছুদ্দি । হয়ত ভাল লাগবে।

তানভীর এর ছবি

চ m o t কা r............................

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ ..................................

অরফিয়াস এর ছবি

আপনার গল্প লেখার হাত বেশ ভালো, অন্য থিম নিয়েও লিখুন, লেখায় বেশ গভীর একটা ভাব আছে সেটাই ভালো লাগলো ..

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ অরফিয়াস ভাই।
লিখব. . . . . . . .
আমিও ভোরের প্রতিক্ষায় রইলাম।

ভাল থাকুন। শুভ বোধের জয় হোক।

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

হাসি
ধন্যবাদ উদাস ভাই।

kamal এর ছবি

অনেক কষ্ট করে শেষ করতে হইল।

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

তবুও ধন্যবাদ আপনাকে।
ভাল থাকুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।