ভয়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৫/০৪/২০১২ - ৮:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মশার কামড় খেতে আমার কোনকালেই তেমন আপত্তি ছিল না; সেই আপত্তির কারন যতখানি আমার গন্ডার সদৃশ মোটা চামড়া তার থেকেও বেশি মশারি টানানোর আলসেমি। সমস্যা হয় যখন মশকসমাজ কানের কাছে প্যাঁপোঁ গান বাজায়। আরেবাবা তোমাদের খাওয়া লাগবে খাও না, ৮০+ কেজির শরীরে তোমাদের জন্য একটু রক্ত বরাদ্দ থাকবে না এমন পাষান এখনো হইয়া পারি নাই। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করলাম সেই সুমধুর সঙ্গীত খুব একটা খারাপ লাগতেছে না। ইদানীং সবকিছুতেই এই “খুব একটা খারাপ লাগছে না” হুজ্জত চালু হইছে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে ভাল লাগত সেই ছোটবেলায় যখন কলোনীতে থাকতে; যখন শিউলী ফুটত। ভোর বেলায়া পাল্লা দিতাম কে কত শিউলী কুড়াতে পারে। ওই কুড়ানো পর্যন্তই, মালাগাথার মত বিরাট কর্ম আমার মত অকর্মা বালককে দিয়ে হয়নি। আজ দেখলাম ঘুম ভেঙ্গে গেল ভোর ৪:৩০ এর দিকে। আজান শুনলাম, তারপর সূর্য ওঠা দেখলাম, পাখি ডাকাডাকি করল, বাতাসটাও “খুব একটা খারাপ লাগতেছিল না”! গত কয়েকদিন ধরে দিনের মোটামুটি বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকতে হচ্ছে, আর বাইরে থাকলেতো ৩/৪ সময় যায় ঢাকার “সেইরাম” জ্যামে পড়ে। কিন্তু একজন আলসের কাছে সেইটাও আশীর্বাদের মত। কারন আমি বাসে উঠেই ক্যামনে ক্যামনে ঘুমাইয়া যাই। যায়গামত আসলে ক্যামনে ক্যামনে ঘুম ভেঙ্গেও যায়। কিন্তু ইদানীং কেন যানি বাসে ঘুম হয় না। জ্যামে বসে থেকে আসেপাশের শয়ে শয়ে গাড়ি-মানুষ-দোকান দেখতে “খুব একটা খারাপ লাগে না”! রাস্তার মোড়ের মামার দোকানের চিপায় বসে চা-টা খেতে আমার কোনকালেই অরুচী ছিল না, এখন সেই “মামা দুধ-লিকার বেশী, চিনি কম” চা খেলে মনে হয়, “আহা, এইরকম অসাম জিনিষ তো লুইস জিউস মামাও খাইত না।” মিরপুর রোড বেশ কিছুদিন ধরে কাঁটা, গাড়ি যায় যায় না আর ধূলা শুধুই ওড়ে আর মুখে ঢোকে-চোখে ঢোকে। সেই সময় আমি দেশের রাজনীতি আর তার বিশারদদের বিরাট হারে মুন্ডুপাত করি। আজকে মিরপুর-১০ হয়ে বাসায় আসার সময় দেখলাম ট্রাফিক মামারা তুমুল উৎসাহে রাস্তা ফাঁকা করতেছে। আমি একটু গাঝাড়া দিয়ে কপালের ঘাম ফেললাম, এইবার একটু লেকচার মারব। হঠাৎ দেখলাম আরেহ ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রিক্সালামামা হেব্বি টান দিছে। তখন এই ধর-মার-খা রাজনীতি আর তার বিদদের মুন্ডূপাত ছাড়া থাকতে “খুব একটা খারাপ লাগল না”। আমার বাবা-মা দুইজনে পুরা দুই ক্যাটাগরির মানুষ। আমার মা এক্কেরে জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ের মাস্টারনী মা, নিজে মাস্টার বলে মনে হয় সেই অভ্যাস আরো পাকাপোক্ত হইছে। আমার খালাদের কাছে শুনছি আম্মু যখন রাজশাহী থেকে বাগেরহাটে আসত ভার্সিটির ছুটিতে তখন নাকি পাড়ার বাচ্চাকাচ্চারা বাড়ি ঢুকত না, আম্মুর ভয়ে। সেই আম্মুর অভ্যাস হচ্ছে পুরা মিলিটারী রুলঃ সোজা হ, ঘুম দিয়া উঠ আরো যত ধরনের মৌখিক(শারীরিক টা ভার্সিটিতে ওঠার পরে একটু ব্রেকে আছে) অত্যাচার করা সম্ভব তা করে। আমার বাবা আবার পুরাই ডিফারেন্ট কিসিমের মানুষ। বাবা হল জাফর ইকবাল স্যারের অসাম বাবা আর নাটকের জ্ঞানদানকারী বাবার একটা সংমিশ্রন। মজাটজা ভালই করে, আমার ধারনা আমি আমার কিঞ্চিত টাংকীবাজির অভ্যাস বাবার জিন থেকে আদায় করছি। সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত জ্ঞানপ্রদান। আম্মু ঝাড়ি মেরে করে, আর বাবা ঠান্ডা মাথায় করে। মোদ্দা কথা এই ডুয়েল জ্ঞানপ্রদান শারীরিক আর মানসিক দুই স্বাস্থ্যের জন্যই হানিকর লাগত আমার। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করলাম জ্ঞানের এই তপ্ত নাচনের তেজ একটু কম। ভাবছিলাম এই ব্যাপারটাও “খুব একটা খারাপ লাগছে না” হয়ে যাবে। কিন্তু না, এক্কেরে নিজের পায়ে নিজেই হাতুড়ি মারলাম। জ্ঞান না শোনা ব্যাপারটা খুব ভালোও লাগছে না, কি মুশকিল!!

“ভালো লাগছে” কথাটা যখন নেগেটিভ সেনটেন্সে চলেই আসল তখন আরো একটা ত্যানা প্যাচাই। ইদানীং ভালো লাগার ব্যাপারটা সীমা-পরিসীমা ক্রস করে ফেলতেছে। এলিফ্যান্ট রোডের ভেলপুরি সব সময়েই ভালো। ইদানীং টেস্ট বেশি লাগে। এইখানে আটকাইয়া থাকে নাই ব্যাপার না বিউটির শরবত, নান্নার বিরানী, মোস্তাকিমের কাবাব, সুজন মামার ভাতের হোটেলের ভাত সবকিছুর টেস্টই একটু বাড়তি লাগে।

এই শহরটায় আমি বড় হইনি। এই শহরটার ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে আমার হাসফাস লাগত। কিন্তু এখন এই শহর, শহরের রাস্তা আর রাস্তার নিওন আলোগুলোকে মনে হয় অনেক আপন। মোড়ের দোকানের মামাকে বড্ড আপন লাগে, লোকটা সবসময় সিগারেটের টাকা দিতে গেলে বলত, “পরে দিও, আছ না”। আমার প্রিয় বন্ধু, টাকার অভাবে যখন বেনসন ছেড়ে গোল্ডলিফ খেতে খেতে গল্প করত পাওয়া-না পাওয়া আর হাজারটা ব্যাপারে, সেই বন্ধুর সাথে দেখা করতে ভয় লাগে। কি বলব দেখা হলে? “মামা আরেকটু চল!!!” আমার দুই প্রিয় বান্ধবী, আমি অকর্মা হলেও তারা এখন বিরাট চাকরী করে। অনেক দেখা করতে ইচ্ছা হয় ওদের সাথে। কিন্তু বলি না, ফেরার সময় ভাল্লাগবে না। ফোনের ওপাশে আমার প্রিয় মানুষটা, মানুষটাকে আমি কখনই সময় দিতে পারিনি ঠিকমত। তা নিয়ে তার অনুযোগের শেষ নেই। আজকাল ওকে অনেক সময় দেয়ার চেষ্টা করি। তারপরও মনে হয়, আগে যদি আরো সময় দিতে পারতাম!! আমার কাজিনের মেয়ে, আমার থেকে বয়েসে বড়...ওকে আম্মু বলে ডাকি, ওকে কিছু খেতে দেখলেই আমার সেইটা খেতে পুরা মন আনচান করে। আমি না থাকলে ওর ফাইফরমাশ কে খাটবে? আমার বাবা-মা, আমাকে কতটা যে আদর করে আমি সবসময়ই জানতাম, বুঝতে দিতাম না। আমার বাবাটা আমাকে সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেবে না, আম্মু একগাদা মরিচ ভর্তা বানিয়ে ঝাড়ি দেবে “তুই এত মরিচ খাস ক্যান, মরে যাবি”।

আজকাল খুব মন খারাপ হয়, আমি বিদায় নিতে অভ্যস্ত না। সেই বিদায়টা আমাকে নিতে হবে। শুধু ভয় লাগে, “আর যদি ফিরতে না পারি!!” আমাকে নিয়ে আমার ভয় খুব একটা নাই, আমি কাইন্ড অফ লিকুইড। কিন্তু যাদেরকে ফেলে যাচ্ছি তাদেরকে যদি না পাই ফিরে।

ভয় লাগে, খুব ভয় লাগে।

--শহরবন্দী

[সচলে প্রথম লেখা, আমি পাঠক হিসেবে অনেক আগে থেকেই ছিলাম। লিখতাম না, মনে হত পারব না। আজ হঠাৎ করে কি মনে হতে লিখে ফেললাম। সাধু-চলিত মিশ্রন আর লেখার দুরবস্থার জন্য আগে থেকেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।]


মন্তব্য

পুেপ এর ছবি

আপনাকে ইচুবিচু
লেখা ভাল হয়েছে।
ভয় পাঈলে মাঊণ্টেণ ডিউ খান। মজা করলাম রাগ নিয়েন্না মনে।
ভালো থাকবেন।

শহরবন্দী এর ছবি

নাহ, মনে রাগ নেই নাই। ধন্যবাদ

কাজি মামুন এর ছবি

অসাধারণ লেগেছে লেখাটি। হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
মশারী টানানো, বাসে ঘুমানো, মামার দোকানের চা, ভেলপুরি- সব মিলে গেল।
আপনার লেখায় হিউমার আছে, আছে সূক্ষ অনুভূতি, ভাষায় আছে সচ্ছল গতি। সূচনার প্যারাটি আরও ছোট হতে পারত।
এমনি করে লিখতে থাকুন। ভাল থাকুন। নববর্ষের শুভেচ্ছা থাকল!

শহরবন্দী এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রথম লেখাতো, ঠিকভাবে গুছিয়ে বুঝে উঠতে পারিনি।

দ্যা রিডার এর ছবি

লেখাটা " খুব একটা খারাপ লাগে নাই "। আসলে ভালই লেগেছে খাইছে লিখতে থাকুন ।

শহরবন্দী এর ছবি

দেঁতো হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

লিখতে থাকুন। হাসি

শহরবন্দী এর ছবি

হাসি

বনের রাজা টারজান এর ছবি

১০০ তে ১০০। অসাধারন। অসাধারন। অনেক সুন্দর লিখেছেন। মাঝে মাঝে এভাবেই লিখুন।

সবটা লেখা শেষ করে কি যেন হারানোর ভয় , কি যেন এক দুঃখ বুকে চেপে আছে।

শহরবন্দী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

আবুল এর ছবি

বাইরে যাচ্ছেন নাকি মামা?
লেখা পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

শহরবন্দী এর ছবি

বুঝলেন ক্যামনে মামা চিন্তিত

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আমারো কথা সেটাই, খাওয়া লাগবে খা বাবা, প্যাঁপোঁ করিস ক্যান?
মজা লাগলো আপনার লেখা পড়তে।
কোন্দেশে যাচ্ছেন, শহরবন্দী?
যেখানেই যান, সচলায়তন আপনার সাথে থাকবে। হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

শহরবন্দী এর ছবি

হিটলার নানার দেশে যাই। আমিও সচলের সাথে থাকব হাসি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

লেখাটা "খুব একটা খারাপ লাগে নাই" বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু একই মন্তব্য এরমধ্যেই একজন করে ফেলেছে দেখলাম! বেশ ভালো লাগলো। সচলায়তনে লেখালেখিতে স্বাগতম। নিয়মিত লিখতে থাকুন। শুভকামনা থাকলো।

শহরবন্দী এর ছবি

হাসি

কল্যাণ এর ছবি

চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।