আমার ঘোরাঘুরি ও পানাম নগর…

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ৩০/০৪/২০১২ - ৯:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রোমিও, শেক্সপিয়রের নয়, আমার স্কুলের সহপাঠী বন্ধু, খুবসম্ভবত ২০০০ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে আমাকে অফার করে সোনারগাঁ ঘুরে আসার। তখন ঐ নামেই জানতাম আমরা পানাম নগরকে। কখনো কখনো বন্ধুত্বের কাছে অলসতাকে পরাজিত হতে হয়। সেবারও হতে হয়েছিল। আমরা দুই বন্ধু বাসে উঠে বসলাম। প্রতারক স্মৃতি আজ আর মনে করতে দিচ্ছে না ঠিক কোন স্থান থেকে যাত্রার শুরু। তবে মনে আছে সেদিন জয়নুলের করা জাদুঘর বন্ধ ছিল। তাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম পানাম নগরের উদ্দেশে। এখানেও স্মৃতি প্রতারক। পশ্চিম দিকের প্রথম বাড়ি থেকে শুরু করেছিলাম নাকি শেষের পোদ্দার বাড়ি থেকে? তবে এটা মনে আছে পোদ্দার বাড়িতে কাটিয়েছিলাম বেশ দীর্ঘ একটা সময়। পুকুরঘাটে মুগ্ধ হয়ে বসে ছিলাম অনেকটা সময়। যতদূর মনে পড়ে একটা লাল রঙের দেয়াল ছিল বাড়িটাতে। লোহার তৈরী একটা সিড়ির অর্ধেকটা ধসে পড়েছিল বলে একটা দিকের দোতলাতে যেতে পারিনি। বাড়িতে তখনো অনেক ডিটইল চোখে পড়ার মত অবস্থাতে ছিল। কোর্টইয়ার্ড বা উঠানের সিগ্নিফিকেন্স তখনো জানা হয়নি আমার।

এই বাড়িটা থেকেই দুইটা মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। অনেকটা একই রকম যেন। তবে একটাতে ছিল ত্রিশুল অন্যটাতে চক্র-এটা মনে আছে। কাছে গিয়ে দেখেছিলাম একটা মন্দির। পরে জেনেছি সেগুলা আসলে মঠ। মন্দির নয়। মঠটার কাছে যেতে চোখে পড়েছিল কয়েকটা আমগাছ। ফলবতী। বড্ড লোভ হয়েছিল। সেদিনের অতৃপ্ত বাসনার কথা আজো মনে করতে পারি। রোমিও, তুই কি পারিস ?

মূল পানাম নগরের প্রায় পুরোটা ঘুরেছিলাম আমরা সেদিন। অনেকগুলো বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরেছিলাম। ছাদে উঠেছিলাম। ছোট একটা একতলা বাড়ির সিড়িঘর চোখে লেগে আছে আজো। খুব সরু ছিল সেটা । আমার মত ভগ্নস্বাস্থের একজন উঠতে থাকলেও আর একজনের পক্ষে নেমে আসা যায় না। সেই সময় এই সব বাড়ির লোকজন আমাদেরকে কোথাও যেতে বাধা দিয়েছিল মনে করতে পারি না। বরং কেউ কেউ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। কোন কোন সিড়ি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছিল নিরাপদ নয় বলে। নগরের মাঝামাঝি অবস্থিত দুইটা বাড়ির হলরুম দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। বুঝেছিলাম এখানে জলসা বসত। হয়তো বাইজি নাচও হতো। উপর তলা থেকে সেগুলো দেখার ব্যবস্থাও ছিল। খানিকটা সময়ের জন্য এমন একটা জলসা দেখার বাসনা কি জেগেছিল মনে? কি জানি, হয়তো – হয়তো না। তবে এটা বুঝেছিলাম এইবাড়িগুলো আমার থেকে আমার বন্ধু রোমিওকেই বেশি মুগ্ধ করেছে। কিন্তু কিছুদিন পর ও পড়তে গেল দাত নিয়ে আর আমি আটকে গেলাম এই সব ইট কাঠ পাথরের অলিন্দে।

চিরকালীন অলস স্বভাবের আমার পক্ষে পানাম নিয়ে খুব বেশি জানা হয়নি কখনোই। তবুও এই ছোট্ট প্রাচীন নগরীর জন্য খানিকটা ভালোবাসা তৈরী হয়ে গিয়েছিল সেদিনই। তিন দিকে নদী দিয়ে ঘেরা এই সোনারগাঁ সুলতানী আসলে রাজধানী হয়ে ওঠে। সেটা ১৩ শতকের ঘটনা। ১৬০৮ সালে যখন ঢাকা রাজধানী হিসেবে আবির্ভুত হয় তার আগ পর্যন্ত সোনারগাঁই ছিল বাংলার রাজধানী। এরপর থেকে পানাম নগরের প্রশাসনিক গুরুত্ব কমতে থাকে। কিন্তু ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে সোনারগাঁয়ের উত্তর দিকে অবস্থিত পানাম নগরের গুরুত্ব মোটামুটি বহালই থাকে কয়েক শতাব্দি। ঊনিশ শতকের শেষ অথবা বিশ শতকের শুরুর দিক থেকে পানামের গুরুত্ব আবার বাড়তে থাকে। কাপড়ের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন নগরী। কলকাতা, পাটনা এবং মুম্বাই থেকে এখানে কাপড়ের ব্যবসায়ীরা আসত। স্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ীরা এখানে গড়ে তুলতে থাকে বিলাসবহুল বাড়ি। এরা ছিল প্রধানত সাহা এবং পোদ্দার।

ড. জে ওয়াইজ (জানু ১৮৭২) ‘নোটস অন সোনারগাঁ, ইস্টার্ণ বেঙ্গল’ এ বলছেন এখানে কোন মুসলমান পরিবার ছিল না। এখানে বাস করা তালুকদারেরা সরাসরি ঢাকা ট্রজারিতে শুল্ক জমা দিত। যাদের সংখ্যা ছিল নব্বই। এখানে ত্রিশটি ব্রাহ্মণ পরিবার (হাউজ) ছিল। সাহাদের পরিবার ছিল ৬৫ টি। ৫টি পরিবার ছিল ভুইমালী (হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় অন্ত্যজ শেণীর লোক ও বংশানুক্রমিকভাবে ঐ শ্রেণীর পদবী– বাংলা একাডেমী অভিধান/ ঝাড়ুদার — সংসদ বাংলা অভিধান) আর কিছু ছিল নাপিত বা এই ধরণের কিছু। তার দেয়া তথ্য মতে আমিনপুরে একটা সরকারী স্কুল ছিল যেখানে ছেলেমেয়েরা পড়তে যেত।

১৯৮৯ এর এপ্রিলে বুয়েটে আর্কিটেকচারাল কনজারভেশনের উপর একটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় পানাম নগরের একটা ম্যাপ তৈরী করা হয়। বেশকিছু বিল্ডিঙের তখন ডিটেইল স্টাডি করা হয়। সাথে পানামের পানি ব্যবস্থাপনাও গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। দেখা যায় পানাম রোডের দক্ষিণ দিকে চারটি বড় পুকুর আছে। সবগুলো পুকুরেই একাধিক ঘাট আছে। এই পুকুর গোসল এবং অন্যন্য কাজে ব্যবহৃত হত। পুকুরগুলো মোটামুটি কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত। তবে এইসব পুকুরের পানি খাওয়া হত না। খাওয়ার পানির ব্যবস্থা হত কুয়া থেকে। ৮৯এ ১৩ টা এই ধরণের কুয়া সনাক্ত করা হয়। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল উত্তর এবং দক্ষিণে অবস্থিত দুইটা ক্যানাল।

এই স্টাডি থেকে আমরা জানতে পারি পানাম সড়কের প্রস্থ মোটামুটি ৫ মিটার এবং তা লম্বায় প্রায় ৬০০ মিটার। রাস্তার দুই দিকে অবস্থিত মোট বিল্ডিঙের সংখ্যা ৫২ টি। রাস্তাটি পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে দিয়েছে । অর্ধেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর রাস্তাটি খানিকটা উত্তর-পূর্ব দিকে বেঁকে গেছে। বেশিরভাগ বাড়িই উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। বাড়ির ধরণে বেশ কিছু রকমফের আছে। হলঘর (মজলিসঘর) কেন্দ্রিক, উঠান কেন্দ্রিক, উঠান/হলঘর ছাড়া এবং খানিকটা বাংলো ধরণের – মোটামুটি এই চার ধরণের বাড়ি আছে এখানে। পানাম সড়কের বাইরে আমি তিনটি বড় বাড়ির কথা জানি। একটা সরদার বাড়ি যেটা এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর একটি হল পোদ্দার বাড়ি যেটা পানাম সড়ক ছাড়িয়ে থানা-রোডে অবস্থিত। এই বাড়িটাতেই রোমিও আর আমি ঘুরেছিলাম বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। অন্য বাড়িটা হল ঠাকুর বাড়ি। এই বাড়িটাতে যেতে হলে উত্তর দিকের খাল পার হয়ে যেতে হয়। এই বাড়িটার অবস্থাই সবথেকে খারাপ। তারপরও তার জৌলুস টের পাওয়া যায় লাগোয়া পুকুর এবং মঠ দেখেই। এখনো বয়স্ক একজন মানুষ নাকি এই বাড়িতে থাকেন। আমার সাথে দেখা হয়নি। মঠে বছরে অন্তত একবার পূজার আয়োজন হয় এখনো। পানাম সড়কের বাইরে আরো কিছু ছোট ছোট পুরোনো বাড়ি আমি দেখেছি কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে কিছু জানা হয়নি কখনোই।

১০৪৭ এ ইংরেজদের ভারত ত্যাগের সাথে সাথে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ভারতভাগ। ততদিন পর্যন্ত এই হিন্দু ব্যবসায়ীরা এই পানাম নাগরে বেশ একটা জমজমাট নাগরিক জীবনই পার করেছে। ভারতভাগের সাথে সাথেই বেশির ভাগ হিন্দু পানাম নগর ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চলে যায় বাকি রাও(তারিক মাহবুব খান : REVITALIZATION OF PANAM NAGAR: SOCIAL DISPLACEMENT AND THE MINORITY ISSUE-২০০৯)। ১৯৬৫ সালে জারিকৃত শত্রু সম্পত্তি আইনের বলে রাষ্ট্র এই পানাম নগরের মালিকানা নিয়ে নেয়। ১৯৭২ সালের পরে সরকার ৫২টা বাড়ির বেশ কয়েকটিকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়। কয়েকটি তখনকার স্থানীয়রা যারা কিনা মুসলিম ধর্মানুসারী অবৈধভাবে দখল করে নেয় এবং দাবি করতে থাকে যে তারা এটা ছেড়ে যাওয়া হিন্দু মালিকদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে।

২০০৩ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী তখন পানাম নগরের এই ৫২ টি বাড়িতে ২৫০ জন মানুষ বসবাস করত। জরাজীর্ণ এই বাড়িগুলো বাসবাসের জন্য ততদিনেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। তার উপর বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের চাপে সরকার ২০০৩ এর মার্চ মাসে পানামকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে এবং আধিবাসীদেরকে পানাম নগরী পরিত্যাগ করতে বলে। ২০০৬ এ সরকার পানাম নগরকে পুরাপুরি ফাকা করতে সমর্থ হয়।

২০১২ সালের এপ্রিলের ২০ তারিখে আবার পানাম নগরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। মৃত এ পানাম নগর। কখনো কখনো জীবিতদের থেকে মৃতরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখনকার মৃত পানাম নগরী কি তেমন হয়ে উঠতে পারবে কখনো?


মন্তব্য

কালো কাক এর ছবি

ছবি নাই কেন ?

রাজীব রহমান এর ছবি

দুইটা কারণ।।। ছবি তেমন একটা তুলতে পারি না।।। আর কি হবে মৃত পানামের ছবি তুলে?

কীর্তিনাশা এর ছবি

পানাম নগরে ঘুরতে গেছি বেশ কয়েকবার। ঢাকার কাছে ঘুরতে যাওয়ার জায়গাগুলোর মধ‌্যে এটা আমার অন্যতম প্রিয় স্থান।

আপনার লেখায় এ নগরি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ আপনাকে !

লেখার শেষে আপনার নামটা যুক্ত করলে আমরা জানতে পারতাম লেখাটা কে লিখেছে হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

রাজীব রহমান এর ছবি

এখনো কি প্রিয় আছে? যাহোক পড়ার জন্য ধন্যবাদ।।।

ভ্যাগাবন্ড ১ এর ছবি

শেষ দুটো লাইন অসাধারন।

আমি একবার ঘুরতে দিয়ে দেখি ওখানে রেনোভেশনের কাজ হচ্ছে। অদ্ভুত তাদের কার্যাবলী। একবার জার্মানীর একটা চার্চের রেনোভেশনের ভিডিও দেখি। ওরা রেনোভেশনের জন্য নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনের শিক্ষক, ছাত্র, প্রফেশনাল কারুশিল্পীদের দিয়ে কাজ করায়। আর পানামে তখন কিছু রাজমিস্ত্রীকে দেখেছি ইচ্ছে মত রঙ্গীন চুনকাম করছিলো। আর সমস্ত ডিটেইল ইচ্ছেমত খুলে পেস্ট করছিলো। এ ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমরা সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষক ও প্রফেশনালকে জানাই। এবং তাদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত এটা বন্ধ হয়। ঘটনা বোধহয় ২০০৬ এর দিকে। পরে আবারো ২০০৮ এ গিয়েছিলাম। ধ্বংসাত্মক কাজগুলো বন্ধ হয়েছিলো। কিন্তু সব কিছু উদম অবস্থায় রাখা ছিলো। আশেপাশের গ্রামবাসী প্রায়ই নাকি ইট নিয়ে চলে যায়। সংরক্ষনের কোনো আলামত পাইনি শুধু কিছু তুলনামূলক ভাল অবস্থায় থাকা বিন্ডিংগুলো ছাড়া। এরপর আর যাওয়া হয় নি।

ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর এই লেখাটার জন্য। শিঘ্রই আরেকবার ঘুরে আসবো।

রাজীব রহমান এর ছবি

ঘুরে আসুন, অন্তত আমাদের কি করা উচিত না তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।।।।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

"ছোট একটা একতলা বাড়ির সিড়িঘর চোখে লেগে আছে আজো। খুব সরু ছিল সেটা । আমার মত ভগ্নস্বাস্থের একজন উঠতে থাকলেও আর একজনের পক্ষে নেমে আসা যায় না।" - এই বর্ণণা শুনে কিছু চিপাগলির কথা মনে পড়ে গেলো। এক রিকশা ঢুকে পড়লে আরেকটা আর অন্যদিক থেকে আসতে পারে না। হাসি

"কখনো কখনো জীবিতদের থেকে মৃতরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।" চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রাজীব রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ

তারেক অণু এর ছবি
রাজীব রহমান এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পানাম নগর যাওয়া হলো না এখনো। এটা নিয়ে কেউ লিখলে মনে হয় পরের বার যাবোই।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রাজীব রহমান এর ছবি

আমার কখনো মনে হয় আবার যাই।।। আবার কখনো মনে হয় কি হবে গিয়ে।।। কিন্তু প্রতিবারের যাওয়া কেমন যেন নতুন করে যাওয়া বলে মনে হয়।।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।