আমার হিয়ার মাঝে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৮/০৮/২০১২ - ১২:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা গোটা রাত জেগে থাকার ভারী অবসাদ আর সকালে তেল চুপচুপ পরোটা আর ভুনা গরুর মাংসের ভূরিভোজন-পরবর্তী ঝাঁঝালো ঢেকুর-এই দুইয়ের সাথে লেপ্টে রইল সকালবেলার আলস্য জড়ানো অথচ টান্ টান্‌ কামেচ্ছা-আমার সংক্ষিপ্ত বাস যাত্রাটা এই তিনের ঘোরে ঢুলুঢুলু কেটে যেতে পারত। কেটেছিলোও কিছুটা;বেশ আয়েশি একটা অবশতা। কিন্তু আচমকাই ছিঁড়ে গেল এই ত্রিকোন ঘোর। সামনে তাকিয়ে দেখি চলমান জেগে উঠতে থাকা শহরটাকে আগলে কে যেন বসে আছে। একটা মেয়ে। কাঁধের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল থেকে উঠে আসছে একটা অভিজাত করপোরেট সুবাস;সদ্য স্নানের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পানির বিন্দু চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে এক আবেশী মৌতাত। বুকের অনুমোদিত উপরি অঞ্চল-অবধি নগ্ন সুন্দরীর ছবি সাঁটা সাবানের ভুরভুরে গন্ধটাও পেলাম।সব মিলিয়ে একটা ঘন জমে থাকা মাদকতা যেন। এইসব চটকে ঘুম ঘুম আমেজটা ছিঁড়ে গেলেও বাইরের বাস্তবতা ঘাড়ে চেপে বসতে পারেনি তখনো।

“শালা বাঞ্চোত টেরাফিকেরে আমি………………”

ড্রাইভারের খিস্তি কানের পাশ দিয়ে বেরিয়েই যাচ্ছিল অলক্ষ্যে যদি না কড়া ব্রেকটা আমাকে কঁকিয়ে তুলত তার আচম্বিত ধাক্কায়। খোলা চোখে তাকিয়ে দেখি তিলোত্তমার এক রাশ ভালগার ছবিঃ পাকা রাস্তার পাশেই প্যাঁচপ্যাঁচে কাদার বাদামি-কালো পেস্ট পিঁষে ছিটকে উত্তর দক্ষিনে ছুটতে থাকা বিভিন্ন বয়সের ছোঁড়াছুঁড়ি মহিলা বুড়ি,রিকশা সি এন জি বাসের নিজস্ব ঢঙের কানে তালা লাগানো চীৎকার;এসব দেখে শুনে ঘুম চোখের হাল্কা পিচুটি ওঠা অস্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে পড়ি ইলেকট্রিকে থাম্বার উপর আলগোছে ঝুলতে থাকা ইসলামী দাওয়াখানার ছোট্ট টিনের সাইনবোর্ডঃ ধাতু দৌর্বল্য,স্বপ্নদোষ,আগা মোটা গোড়া চিকন ইত্যাকার যাবতীয় সমস্যার গ্যারান্টি সহ সমাধান ২৪ ঘন্টার মধ্যে।এর ঠিক পাশেই জ্বলজ্বল করছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী সুন্দরীর উন্নতবক্ষা প্রচন্ড দীপ্র এক গোলাপি চেহারা।

মেয়েটা আগের জায়গাতেই স্থির।অচঞ্চল।ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখারও যেন তার কিছু নেই।যেন এই নোংরা শহরকে দু’পাশে ফেলে তার গন্তব্যের সুরম্য অট্টালিকায় না পৌঁছান পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। তার সবকিছুই সুররিয়েল তাই—চুলের ইতস্ততঃ ঢেউ, পোষাকের নকশায় আঁকা কোন রুপকথার মাঠ,ডান পাশে মুখ ঘুরিয়ে থাকা প্রোফাইলে অভিজাত গাম্ভীর্য, হাতের ব্রেসলেটে রিনরিনিয়ে ওঠা মিষ্টি ক্যাকোফোনি—সব মিলিয়ে এই কুৎসিত শহরের শরীরে যেন এক ক্ষণিকের ফ্যান্টাসি।

একটা পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে ঘর।একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বে জলছে রোগা আলো। মাঝারি আকারের ঘরটার দু’পাশে দেখা যাচ্ছে দুটো খাট। ঘরের এক কোণায় উঁই খাওয়া ঝুরঝুরে কাঠের গুঁড়া ছড়ানো একটা টেবিল। তার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুইটা চুল জড়িয়ে থাকা চিরুণি,একটা পাউডারের বাক্স,একটা লিপ্সটিক মোছার ত্যানা কাপড়ের টুকরা,একটা অডিও ক্যাসেট।

ঘরের খাটের মাঝখানে হেঁটে ঢুকতে গিয়ে ওকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যাই। ও বসে আছে বাঁ দিকের খাটের মশারির স্ট্যান্ডের চৌকোনা ঘেরাটোপে।ওপরে সেই আদ্দিকালের একটা হলদেটে ফ্যান ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছে। ওর হাতে অলস ভঙ্গীতে পড়ে আছে একটা বাক্স মার্কা রেডিও।ও ক্রমাগত নব ঘোরাতে থাকায় এক স্টেশানে বাজতে থাকা ‘রুপ দেখে তোর হইয়াছি পাগল’ শীষ কেটে ভেঙ্গে পড়ে পরের স্টেশনের আবহাওয়া সংবাদেঃ “আজ রাতে হাল্কা থেকে মাঝারি ধরণের বর্ষণ হতে পারে।

মেয়েটা উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বিছানায় ওর পাশে বসায়। ঘরের রোগা আলোয় সবকিছু কেমন অন্যরকম দ্যাখায়। কেমন একটা সোঁদা পুরণো গন্ধ। আমাকে দেখে মেয়েটা একটুও আড়ষ্ট হয়না। স্বাভাবিক ভঙ্গীতে রেডিওটা বিছানার একপাশে রেখে হাসে। ছড়ানো এলোচুলে বালিশের উপর রাখা একটা চিরুনি চালিয়ে নিজেকে একটানে প্রস্তুত করে নেয়।ওর পরণে কমলার-ভেতরের-রস-আগলে-থাকা-পাতলা-আবরণ রঙা একটা কামিজ। বুকের মসৃণ ঢেউয়ের আবেদন স্বাভাবিক, অচঞ্চল। সামনে ঝুলে থাকা চুলের গোছা মুঠির মধ্যে নিয়ে ছুড়ে দেয় পেছনে। ঠোঁটের ২ কোণায় একটা আবছা হাসি দ্যাখা দিয়েই মিলিয়ে যায়; ঘষা কাঁচের মত ম্লান করে রেখেছে যেন সবকিছু; দেখে কেমন থমকে যাই; অদ্ভূত নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। এই আত্মা ঘিরে ধরা নিঃসঙ্গতা ঘড়ির ভেতরে ঢুকে সময়ের প্রত্যেকটা কাঁটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে – আমার কেমন পিপাসা পেয়ে যায়, অস্থির আর ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে।

৯ টাকার লাক্স মিনিপ্যাক সাবানের গন্ধে কেমন একটা চেনা-অচেনা আবেশ—মগজের কোনা থেকে হারিয়ে যাওয়া বহুদিনের পূরণো একটা গন্ধ সাবানের গন্ধটার সাথে মিশে যায়। করোটির ভেতরের অন্ধকার ঘরের হলুদ আলোকে কেমন কালচে করে তুলেছে। মনে পড়ে আমাদের পাশের বাসায় থাকতো রিক্তা আপারা। শীতের সকালে উনাকে দেখা যেত কমলা আবরণের এই রঙা একটা জামায়। আমাকে দেখে খোলা চুলে হাসতেন, বলতেন ‘জানিস আমার না একটুও শীত করেনা।হা হা হা’ উনার তখন বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনের হাস্যোজ্জ্বল রিক্তা আপাকে একদিন ভোরের আলোয় কাঁদতে দেখে কেমন বিমুঢ় হয়ে যাই। এর তিন দিন পর উনি আত্তহত্যা করার চেস্টা করেন। পারেন নি। পেরেছিলেন বিয়ের ৩ দিনের মাথায়। উনার শ্বশুরবাড়ি থেকে যেদিন খবরটা আসে সেদিন ওদের বেড়াল মিনি সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরলো। কেউ খাবার দিলনা তাকে।আমাদের বাড়ির বারান্দায় এসে নিঃসাড় পড়ে ছিল সারাটা দিন। এই ঘটনার তিন দিন পরে রিক্তা আপার বাবা মা আর ছোটবোন খুব ভোরে বাড়ী ছেড়ে চলে যান। এরপর উনাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মেয়েটা উঠে এসে আমার হাত ধরে বিছানায় ওর পাশে বসায়। আমি আড়ষ্টতায় কথা বলতে পারিনা। সমস্ত শরীর যেন জমে শক্ত হয়ে গ্যাছে। সে আমার ঘাড়ে হাত রাখে,মৃদু আকর্ষণ করে নিজের দিকে, কন্ঠে স্বাভাবিক আমন্ত্রন, বলে ‘আসেন ভাইয়া’। আমি কিছুতেই সহজ হতে পারিনা। ও আমার গালের কাছে মুখ নিয়ে আসলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ও পরপর কয়েকটা আলতো চুমু খেয়ে আমাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।আমার অস্বস্তি কিছুতেই কাটেনা। এই অস্বস্তির ভেতরে হয়ত অন্য কিছু ছিল।এমন কিছু যা আমি বুঝতে বুঝতেও ঠিক বুঝছিলাম না। মেয়েটার অকপট পেশাদারী ভঙ্গীর ভেতর আমি কি যেন খুজছি্লাম।সিনেমাটিক কিছু? ভালবাসা টাসা নাকি? নাকি স্নেহ? কোন একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম লালবাতি এলাকার এক পেশাদার গনিকা একটা চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলেকে তার দরজায় দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল সে পথ ভুলে তার দরজায় এসেছে। ভেতরে ডেকে আদর করে বসিয়ে ছেলেটাকে খেতে দিয়েছিল। কিন্তু এই মেয়েটার তো এমন ভুল হওয়ার কথা নয়।আমি কল্পনার কোন প্রলম্বনেই বাচ্চা ছেলে নই।আর মেয়েটাও বয়স্ক গনিকা নয়।তবে সে আমাকে অমন স্নিগ্ধ স্বরে ভাইয়া বলছে কেন? নাকি এক্ষেত্রে উল্টো হল। মেয়েটাই হয়ত এ পথে নতুন। খদ্দেরকে কিভাবে আপ্রোচ করবে বুঝতে পারছে না। তার চুমু খাওয়ার ভঙ্গীটা বেশ কাঁচা ছিল।প্টাপট বাঁধা কিছূ জায়গায় চুমু খেয়ে দ্রুত উত্তেজনা সৃষ্টি করে আমাকে নির্বাপিত করার সময়টুকুকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা ছিলনা ওর মধ্যে। নাকি ছিল?

আমার ভেতরে কোথায় যেন শৈশবের একটা খোলা মাঠ ভেসে ওঠে-দ্রুত ঘনিয়ে আসা আধারে আমি দৌড়াচ্ছি বাড়ির দিকে। মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য।

অনেক দূরে একটা লাল রঙের ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়।

রাজীব মাহমুদ।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

ইয়ে, বাংলা টাইপিঙে সদ্য হাতেখড়ি? বেশকিছু শব্দে আটকে গেলাম তো.. চিন্তিত
কিছূ> কিছু, চীৎকার > চিৎকার, শীষ> শিস, পুরণো > পুরোনো, অদ্ভূত > অদ্ভুত, আত্তহত্যা > আত্বহত্যা, জলছে > জ্বলছে, চেস্টা> চেষ্টা---- এই রকম।

সচলে স্বাগতম। হাসি
লিখুন আরো।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

সাইদ এর ছবি

আত্মহত্যা হবে বানানটি

অতিথি লেখক এর ছবি

বানান শুধরে ডেয়ার জন‌্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলে বাংলায় টাইপটা এখনো শিখছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাষাটা সুন্দর লাগলো। কিন্তু আমার বুদ্ধির কমতির জন্যই কিনা জানি না মর্মবাণীটা বুঝতে পারলাম না, সরি। তবে সুন্দর সুন্দর উপমাগুলো যেন ঠিক দৈনন্দিন জীবন থেকে বেছে নেয়া।

-অয়ন

ধুসর গোধূলি এর ছবি

দিলেন তো প্রথম লাইনেই প্যাচ লাগায়ে। যাই গরুর মাংসের ঝোল দিয়ে পরোটা খাওয়ার বন্দোবস্ত করি গিয়া...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।