শুধু থাকুক অন্ধকার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৮/২০১২ - ১১:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাকে ঘিরে জটলাটা ক্রমশ বাড়ছে। নানান বয়সী দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু আমি। ৩/৪ জন ছাড়া বাকিরা অবশ্য খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখমুখ ঠিকরে যেভাবে ঘৃণা উপচে পড়ছে তা দেখে আমার এ অবস্থায়ও কেমন আমোদ বোধ হয়। ভাগ্যিস কেউ কোমল চোখে তাকিয়ে নেই। ঘৃণার ভাষায় এতো অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মমতায় আর্দ্র দৃষ্টিতে ইদানীং গা চিড়বিড়িয়ে ওঠে।

আপাতত আমাকে অফিসের একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে। হাত পা দুটো নাইলনের দড়ি দিয়ে যেভাবে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধেছে, মনে হয় না ওরাও চেষ্টা করে আর খুলতে পারবে। কেমন জানি শরীর ভেঙ্গে রাজ্যের ক্লান্তি নেমে আসছে, কতক্ষণে ছাড়া পাব আজ?

আশ্চর্য, আমার একটুও ভয় লাগছে না, কষ্ট হচ্ছে না, কেন? এতো অনুভূতিশূন্য জড় পদার্থ কবে হয়ে গেছি আমি? সেই ছোট্ট আহ্লাদী বিনু, বাবা মা'র একটু কড়া চাহনিতেই যার দুচোখ বেয়ে শ্রাবণ ধারা নামতো, আমি কি সত্যি সে? তাহলে ওই মেয়েগুলো যখন অমন করে মারছিল, আমার কষ্ট হচ্ছিল না কেন? সত্যি আজ নিজের ভেতরটা খুঁড়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, হৃদয়টা আছে তো? নাকি সেটাও ক্ষয়েক্ষয়ে এরমাঝেই মিলিয়ে গেছে?

খুব সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে ছিলাম আজ, সাথে শুধু একটা হ্যান্ডব্যাগ। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক হাঁটলাম, তারপর ওই ব্যাগটাই যেন টেনে নিয়ে আসলো এখানে। গেট দিয়ে ঢুকতে কোন সমস্যা হয়নি। হল গেটে দুজন দারোয়ান বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসেছিল। বোরকা পরা দেখে হয়তো আইডিও দেখতে চাইলো না। অবশ্য তাতেও কোন সমস্যা ছিল না, আইডি ও একটা তৈরি করা আছে আমার। এসব কাজ করতে করতে সবরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়ে গেছি আমি।

তবে আজ দিনটা অন্যরকম ছিল, পুরনো বিনু যেন ফিরে এসেছিল আমার মাঝে। বিনুর চোখ দিয়ে চারিদিক দেখছিলাম। এই ছাত্রী হলে এতবার এসেছি, অথচ কোনদিন চোখে পড়েনি ঢুকতেই সবুজ ঘাসে মোড়া কত বড় মাঠ। ভেতরে কি সুন্দর বাগান আর ঝর্না! মেয়েগুলোকে ফুলপরীর মতো লাগছিল, কি সুন্দর ওরা হাসছে, গল্প করছে। কতকাল পরে পুরনো দিনগুলো ধুলোভরা স্মৃতি ঝেড়ে হঠাৎ উঠে আসছিল আমার কাছে। ঘুরে ঘুরে আপনমনে সব দেখছিলাম। হঠাৎ কয়েকটা মেয়ে এসে আমার ব্যাগটা চাইলো। আমি একটু ইতস্তত করাতে একজন ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে অন্যদের জানালো এটাই সেই ব্যাগ। হ্যাঁ, আমিও জানি এটাই সেই ব্যাগ, ৩/৪ দিন আগে যেটা এখানকার এক মেয়ের ঘর থেকে চুরি করে পালিয়েছিলাম। ভেতরে কি ছিল দেখার সময় হয়নি তখন, বাসায় ফিরে দেখেছি কিছু সোনার গয়না আর টাকা। এখন অবশ্য ব্যাগটায় আমার মোবাইল ফোন আর পঞ্চাশ টাকার একটা ময়লা নোট ছাড়া কিছুই নেই। ওরা আমাকে নানান প্রশ্ন করছিল, অন্যদিন হলে হয়তো আমি ধূর্ততার সাথে পাশ কাটাবার একটা চেষ্টা করতাম। কিন্তু আজ যে আমার মাঝে পুরনো বিনু। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম, ওরা তখন মারতে শুরু করলো। তারপর কখন যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে এই হাউসটিউটর অফিসে। এখন অপেক্ষা করছি, অপেক্ষা করছি আমার নিয়তির জন্য।

জন্মের সময়ই নাকি নিয়তি নির্ধারিত হয়। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে সৃষ্টিকর্তা কি লিখেছিলেন সেসময় আমার জন্যে? বাবা মা আত্মীয়স্বজন সবার মত উপেক্ষা করে যার হাত ধরেছিলাম পরম নির্ভরতায় ভালবাসায়, সে আমাকে বিকিয়ে দেবে পসরার মতো, এই কি নিয়তি ছিল আমার জন্য? না অসচ্ছলতা থেকে বাঁচতে নয়, বরং আরও সচ্ছলতার সিঁড়ি মসৃণ করতে আমাকে ব্যবহার করেছিল আমার স্বামী। ফিরে যাবার পথ কি ছিল আমার জন্য? বাবা মা কি ফিরিয়ে দিতেন তাদের আদরের বিনুকে? হয়তো না। কিন্তু যে ঘর থেকে ভালবাসার অহংকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বেরিয়েছিলাম, সে ঘরে কালি মাখা মুখ নিয়ে ফিরতে পারিনি। শুধুমাত্র একটা মাধ্যমিক ডিগ্রী সম্বল ছিল আমার, একটা ভদ্রস্থ চাকরি জুটিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো সুযোগ, মনোবল কোনটাই আমার হয়নি। নিজেকে শাস্তি দেবার একটা অদ্ভুত ক্রোধও কাজ করছিল আমার মাঝে। অতঃপর সহজ পথটাই বেছে নিয়েছি। রাতদিন শারীরিক মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে গেছি আমি, পচে গেছি, মানুষ থে্কে কীটে পরিণত হয়েছি কখন তা নিজেও জানি না।

তাই বলে ভাববেন না আমার স্বামী আমাকে চুরি করতে বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। এতোটা নীচ অন্তত সে নয়। বরং সে আমাকে বেশ কিছুকাল আগে থেকে তার সব কাজ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। হয়তো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার স্পৃহা শেষ বা হয়তো যোগ্যতর কাউকে নিয়োজিত করেছে, আমার জানা নেই। এখন আমরা এক বাসাতেই দুটি পৃথক মানুষ পারস্পরিক ঘৃণার মধ্যে ডুবে আছি। চুরি করতে হয় আমার নিজের প্রয়োজনেই, প্রচণ্ড ভাবে মাদক নির্ভর আমাকে মাদক কেনার এতো টাকা দেবে কে? গল্পটা হয়তো বেশ পুরনো লাগছে আপনাদের কাছে, কিন্তু মাদকের কাছে আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না যে। সত্যি বলছি আমার কোন গ্লানি নেই, বরং নীচ থেকে আরও নীচে নামার উৎসবে বুঁদ হয়ে আছি। ভালই তো ছিলাম, আজ আবার পুরনো, ওই বোকাবোকা স্বপ্নদেখা বিনুটা এসে সব নষ্ট করে দিল।

অপেক্ষার বুঝি শেষ হল এবার। হাউসটিউটর ম্যাডামরা সবাইকে অফিস থেকে বের করে দিয়ে আমার রুদ্ধদ্বার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। নরমভাবেই বললেন সবকিছু ফিরিয়ে দিলে আমাকে আর পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না। আমার হাসি পাচ্ছিল, নরকবাসিকে ওনারা নর্দমার ভয় দেখাচ্ছেন। আমি কোন কথা না বলে হাসিহাসি মুখে চেয়ে আছি, দেখা যাক ঘটনা কোথায় যায়। এবার ওনারা আমার মোবাইল নিয়ে পরলেন, খুব অল্প কয়েকটা নাম্বারের মাঝে আমার স্বামীর নাম্বার পেতে দেরি হল না। নাটক দেখছি দারুন দিকে এগুচ্ছে। আমার সুবেশী, সুদর্শন স্বামী ঘটনা শুনে কিছুক্ষণ পরই উপস্থিত হল, সাথে সেই গয়না আর টাকা। সবই আমার ঘরে পাওয়া গেছে। আমার স্বামীর চকচকে বিজনেস কার্ডে ঝকঝকে অক্ষরে লেখা পরিচয় ম্যাডামদের আশ্বস্ত করলো। আমার মহান স্বামী আমার হয়ে সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলো। ম্যাডামরা জানতে পারলেন আমি কোন অপরাধী নই, একজন মানসিক রোগী, আমি সচেতন ভাবে চুরি করিনা।

এখন নাটকের শেষ দৃশ্য হচ্ছে। আমার স্বামী আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি মাথা নিচু করে হাঁটছি, আমাদের দুপাশে আবার সেই ভিড়। এবারের ভিড়ে কোন শব্দ নেই, সবাই নিঃশব্দে আমাদের বিদায় জানাচ্ছে। না কোন গ্লানিতে আমার মাথা নিচু নয়, আমি চাই না কারও চোখে আমার চোখ পরুক। কারন আমি অনুভব করছি এই ভিড়ের অনেকের চোখ এখন মমতায় আদ্র আমার জন্য। আমিতো এই মমতার যোগ্য নই। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে যাই, সামনে অপেক্ষা করে আছে আমার অন্ধকার পৃথিবী।

-এক জোনাকি

ekjonakii@gmail.com


মন্তব্য

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

ভালো লিখেছেন। লেখাটাতে একটা উপন্যাসের ম্যাটেরিয়াল দেখলাম। তবে গল্প হিসেবেও চলে যায় দারুন। লিখে যান। শুভকামনা।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, সময় করে পড়েছেন এবং মন্তব্য করলেন। ভাল থাকুন।
-এক জোনাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার গল্প বলার ধরনটা বেশ ভাল লাগল।
আর লিখুন।

--- ঠুটা বাইগা

এক জোনাকি এর ছবি

ধন্যবাদ উৎসাহ জাগানিয়া মন্তব্যের জন্য। ঠুটা বাইগা মানে কি?

তিথীডোর এর ছবি

'ঠুটা বাইগা' বুদ্ধদেব গুহের লেখা মাধুকরী উপন্যাসের চরিত্রের নাম। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথি হাসি
-এক জোনাকি

সত্যপীর এর ছবি

বেশ চলুক

..................................................................
#Banshibir.

এক জোনাকি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

বলার ভঙ্গীটা দারুণ চলুক

হিল্লোল

এক জোনাকি এর ছবি

পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ হিল্লোল।

অতিথি লেখক এর ছবি

তাদের চোখমুখ ঠিকরে যেভাবে ঘৃণা উপচে পড়ছে তা দেখে আমার এ অবস্থায়ও কেমন আমোদ বোধ হয়। ভাগ্যিস কেউ কোমল চোখে তাকিয়ে নেই। ঘৃণার ভাষায় এতো অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মমতায় আর্দ্র দৃষ্টিতে ইদানীং গা চিড়বিড়িয়ে ওঠে।

না কোন গ্লানিতে আমার মাথা নিচু নয়, আমি চাই না কারও চোখে আমার চোখ পরুক। কারন আমি অনুভব করছি এই ভিড়ের অনেকের চোখ এখন মমতায় আদ্র আমার জন্য। আমিতো এই মমতার যোগ্য নই। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে যাই, সামনে অপেক্ষা করে আছে আমার অন্ধকার পৃথিবী।

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

মনের রাজা টারজান/mahinaaa@ymail.com

এক জোনাকি এর ছবি

পপকর্ন নিয়ে বসলেন যে টারজান ভাই? গল্প তো শেষ ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক এর ছবি

সিরিজ আশা করছি।
মনের রাজা টারজান/mahinaaa@ymail.com

এক জোনাকি এর ছবি

ডরাইসি, গল্প লিখতেই যার কলম ভেঙ্গে যায়, সিরিজ লিখতে বসলে তার কি যে দশা হবে কে জানে চিন্তিত

স্যাম এর ছবি

চলুক

এক জোনাকি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তারেক অণু এর ছবি

চলুক
শক্তিশালী অনুভূতি

এক জোনাকি এর ছবি

হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

..........
রংতুলি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নিবিড় এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ঈপ্সিত/চম্পাকলি  এর ছবি

ভালো লেগেছে লেখা। তবে কিছু জায়গা ঠিক বুঝতে পারিনি। আইডি তৈরি ছিল কেন? নকল আইডি? কিসের জন্যে? স্বামী কি প্রায়ই আসে এরকম?
যাইহোক, আরও লেখা আসুক।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। কিছু জায়গা আমি মনে হয় ঠিক পরিস্কার করে বোঝাতে পারিনি। মেয়েটি প্রায় বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত ছাত্রী হলগুলোয় চুরি করতে যায়। হল গেটে সাধারনত মেয়েদের আইডি চেক করে ঢুকতে দেয়া হয়। মেয়েটি এজন্য নকল আইডি সাথে রাখে।
স্বামী প্রায় আসেনা; আসলে আগে কোনদিন মেয়েটি ধরাই পড়েনি, স্বামীর আসার প্রয়োজনও হয়নি।

সেদিন পুরনো বিনুর স্মৃতিকাতরতা মেয়েটিকে দুর্বল করে দেয়ায় সে কিছু বোকামি করে ফেলে ধরা পড়ে যায়। আমি দেখাতে চেয়েছি স্বামীটি খুব বুদ্ধিমান (ধূর্ত) ; মেয়েটিকে মানসিক রোগী পরিচয় দিয়ে সে তার সামাজিক অবস্থান অক্ষুন্ন রেখেছে এবং পরিস্থিতিরও ভাল সামাল দিয়েছে। মেয়েটিও কোন প্রতিবাদ করেনি কারন জীবনের প্রতি সে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত, কিছুতেই তার কিছু এসে যায় না আর।

-এক জোনাকি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাল লাগলো। অনেক অনেক লিখুন। ভাল থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ উৎসাহ দেবার জন্য হাসি । আপনার জন্যও অনেক শুভেচ্ছা।

-এক জোনাকি

পাঠক এর ছবি

আপনার উপস্থাপনা চমৎকার, প্লট তাও খুব মৌলিক। মেয়েটির চরিত্র চিত্রণ খুব ভাল লেগেছ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।