চড়ুইয়ের জীবন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১০/১০/২০১২ - ৩:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাকে আমার সংসার থেকে তাড়ানো কতই সহজ। ‘তুই বিদায় হ, এখানে আর চেহারা দেখাবিনা।’ এটুকুই যথেষ্ট।
কোথায় যাব? পানিতে পড়বনা, সে জানে। ঢাকা শহরে আমার বাবার নিজের একটা ফ্ল্যাট আছে। সেখানে অ্যাটাচড বাথ একটা রুম আমার জন্য সারাজীবনই আছে। বিয়ের পর আব্বু এসি লাগিয়ে দিয়েছেন। জামাই এসে মাঝে মাঝে থাকবে।
ফোন পেয়ে নিতে এসেছিলেন বাবা আর ছোট ভাই। ছোট ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে অনেক কাঁদলাম, যেরকম কেঁদেছিলাম বিয়ের দিন। আমার শাশুড়ি দাঁড়িয়ে রইলেন ছেলের পাশে, বিয়ের দিনের মতই।
লিফট নষ্ট, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অভ্যাসবশত জ্বালাতে যাচ্ছিলাম বাতিগুলো। মাগরিবের আজান পড়েছে।
চলেই এলাম আমার সংসার ছেড়ে। আড়াই বছরে একটু একটু করে সাজানো আমার বাসা।
পর্দাগুলো ঝুলতে থাকল আগের মতই। আড়ং, যাত্রা- ওদের কালেকশন তো কমন। আমার বাসায় চলবেনা। গুলশান ২ এর ছোট্ট একটা দোকান থেকে ফরমায়েশ দিয়ে বানিয়েছিলাম পর্দাগুলো। সাদা-সবুজ বড্ড প্রেডিকটেবল কম্বিনেশস। পাটরঙা কাপড়ের ওপর তাই পাতার স্ক্রিনপ্রিন্ট করিয়েছিলাম। সকালে আলো আসত সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে। সাদা নয়, অনেক নরম একটা রূপ নিয়ে। বিছানা ছাড়ার নয়, আড়মোড়া ভেঙে দুজনকে জড়িয়ে আবার শুয়ে পড়ার মতো আলো। পার পিস এক হাজার টাকা। তিন বছর চাকরির পর এক মাসের ছুটি আর বেতন পেয়েছিলাম, মোটেই গায়ে লাগেনি।
বাথরুমে থাকল আমার কসমেটিকস। বডিশপের শাওয়ার জেল, পিউমিস স্টোন, ফুটস্ক্রাব, ম্যানিকিওর সেট, বায়োডার্মার টোনার সব। সিঙ্গাপুর থেকে কেনা শাওয়ার ক্যাপের পাশে পড়ে থাকল ওর শেভিং সেট, ছোট্ট একটা চেইনওয়ালা ব্যাগের ভেতর ভরা। শেভ করে সিংকের ওপর ফেলে রাখত সবকিছু, এত বিরক্ত লাগত। ব্যাগটাও তাই এনেছিলাম।
কমোডে বসে পেপার পড়ার বিরক্তিকর স্বভাব ওর। পড়া শেষে ফেলে রাখবে ফ্ল্যাশের ওপর। কাল ওটা ওভাবেই থাকবে। বুয়া তো এ বাথরুমে ঢোকেনা।
হাউস অব টারকুইজ, সেভেন্টিনাইন আইডিয়াস, অ্যানথ্রোপলজি- কত কত ওয়েবসাইট দেখে অর্ডার দিয়েছিলাম এই সোফাটার। একদম সাদামাটা, ঝরঝরে চার সিটের সোফা। ওকে বলেছিলাম, আমাদের সোফা আমাদের মতোই স্মার্ট দেখতে। আব্বু বানিয়ে দিয়েছিল। কেন আব্বুকে বললাম, এত দেরি হচ্ছে সামান্য সোফা বানাতে, ঈদ চলে গেল- কত কথা এই নিয়ে। বলেছিল টাকা দিয়ে দিবে। তিন মাস পার হয়ে গেছে।
খালামনি দিতে চেয়েছিল তার ঘরের একটা টি টেবিল। চা গাছ থেকে বানানো। সোফার সঙ্গে যায়না বলে ভ্যান থেকেও ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
আজ সকালেই ব্র্যাক চিকেন থেকে আনিয়েছি বোনলেস চিকেন। স্টেক বানাতাম। অথবা সিপ্রিওট স্টাইল চিকেন, শাক আর পনির দিয়ে। অথবা চিকেন স্কিউয়ার। সবগুলো জেমি অলিভারের রেসিপি। ইউটিউব বন্ধ, কবে আবার নতুন রেসিপি পাব।
ফ্রিজেই পড়ে থাকবে। সাদা, শুকনা হয়ে যাবে। ৪২০ টাকা কেজি।
কাল ঘুম ভেঙে বিছানা গোছানো হবেনা। এ ঘরে ওর, ও ঘরে আমার শাশুড়ির। আমার শাশুড়ি কোনদিনই বিছানা গোছান না। তেমনই পড়ে থাকে সারাদিন। ও ঘরে ঢুকতামই না আর।
ডাইনিং টেবিলে থাকল সবুজ কাচের জগ আর গ্লাসগুলো। ঢাকা শহর ঢুঁড়ে পাওয়া যায়নি, আম্মাকে দিয়ে আনিয়েছিলাম গ্রাম থেকে। মাত্র ২০০ টাকায় ছয়টা গ্লাস আর জগ। কেউ বিশ্বাস করেনা, এগুলো এত কষ্ট করে আনিয়েছি। এখন রিসাইকেল গ্লাসেরই ট্রেন্ড, মুখ টিপে বলতাম। অহংকার চাপা থাকতনা। ইটস অ্যাবাউট রাস্টিক ডেকোর।
এই জগের সঙ্গে ক্রুশের ঢাকনা। আড়ংয়ে পছন্দ হয়নি, জয়িতাতে পেয়েছিলাম ঠিক জগের মুখের আকারের গোল, সাদা ঢাকনি।
ইলিশ মাছের ভাজি সার্ভ করার জন্য কিনেছিলাম মাছ শেপের ট্রে। সবাই আড়ং, যাত্রা থেকে বাসন কেনে আজকাল। চারকোনা একটা প্লেট একবার কিনে খুব ভাবে ছিলাম। পরে দেখি ফেসবুকে অন্তত তিনজনের সেই একই প্লেটের ছবি। ও সান্তনা দিয়েছিল, প্লেটটা তো সুন্দর, সবারই তাই ভাল লেগেছে তোমার মতো। আর কিনিনা ওসব থেকে। একটু খুঁজলে মুন্নু, শাইনপুকুরেই কত আনকমন ক্রোকারিজ পাওয়া যায়।
সব থাকল। কেউ আমার সঙ্গে আসতে চাইলনা। ও কোনদিন খবর রাখেনি এসবের। ওরা এখন থেকে ওর সঙ্গেই থাকবে। ওদের কি। আমার বুয়াটা অবশ্য সকালে গোলমাল টের পেয়ে বলে দিয়েছে, আফা আমনি না থাকলে এই বাসায় আর কাম করুম না।
আমার শাশুড়ি দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজায় ঠেস দিয়ে। একই ভঙ্গিতে- যখন তাঁর ছেলে বিছানায় ফেলে আমাকে মারছিল। বের হবার সময় আব্বুকে বললেন, বেয়াই চা খেয়ে গেলেন না।


মন্তব্য

মেঘা এর ছবি

অতিথির নাম কি? ইয়ে, মানে... লেখার শেষে নিজের লেখক পরিচয়টা দিয়ে দিলে জানা হতো ব্যক্তি লেখককে হাসি

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

খাইশুই এর ছবি

লেখার ধরনটা দারুন। কোথাও আটকাতে হয় না। পছন্দ হয়েছে।

মেঘা এর ছবি

ইস! বিষাদময় লেখা!

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

অগ্নির এর ছবি

কি অদ্ভুত বিষাদময় লেখা । অসম্ভব ভালো লাগলো । আসলেই মেয়েদের চড়ুইয়ের জীবন । সবকিছু থেকেও কোনকিছুই না থাকা....এই অনুভূতিটা কখনোই কোন ছেলে কি বুঝতে পারবে ?

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

নাম কই?
গল্প হিসেবে ভাল লাগেনি খুব একটা। পুরো গল্প জুড়ে টাকা পয়সা আর আভিজাত্য খুব চোখে লাগছে, মূল পয়েন্টকে অনেকটাই আউট অব ফোকাস করেছে মনে হল। আমার ব্যক্তিগত মতামত। আরেকটা ব্যক্তিগত মতামত - আপনার লেখার হাত ঝরঝরে। লিখতে থাকুন।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর তরতরে গদ্য। ছোট ছোট জিনিসের প্রতি মমতার মাধ্যমে সংসারের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশটা ভালো লেগেছে। কিন্তু ঘটনার আগে পরে কই?

ও সান্তনা দিয়েছিল, প্লেটটা তো সুন্দর, সবারই তাই ভাল লেগেছে তোমার মতো।

এটা দিয়ে দুজনের মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে - কিন্তু সেই মমত্ব ফিকে হয়ে গেলো কেন তার কোন সুদূরতর চিহ্নও নেই। ঘটনাটা তাই একটু আরোপিত মনে হলো।

লিখতে থাকুন আর লেখায় নাম দিন। ভালো লাগছে লেখা।

-অয়ন

আইলসা এর ছবি

ভালো লাগছে।

যুমার এর ছবি

লেখাটা পড়ে মনটা খারাপ লাগল,কেন মিছে ঘর বানায় মানুষ?

ঘুমকুমার এর ছবি

লেখা ভাল হয়েছে। একটানে পড়ে ফেললাম। কিন্তু কি যেন একটা নেই। বক্তার কষ্টটাকে মনে দাগ কাটল না।
লেখা চলুক। হাসি

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ভাল লাগল।
আরো লিখতে থাকুন।

এক জোনাকি এর ছবি

মোটামুটি লেগেছে। ত্রিমাত্রিক কবি এবং অয়নের মন্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করছি। আড়াই বছরের সংসারে মানবিক সম্পর্কগুলো থেকে বস্তুগত ব্যাপারগুলো (ঘরের আসবাব, প্রসাধন) অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। গল্পের থিমটা ভালই ছিল, কিন্তু গল্পের বিস্তারের সাথে সাথে থিম এগিয়ে না গিয়ে বরং খেই হারিয়ে ফেলেছে। গল্পের শিরোনাম অবশ্য বেশ মানানসই মনে হয়েছে।

যদিও নাম লেখেননি, লেখার ধরণে মনে হচ্ছে চিনতে পারছি। আপনার ঠিক আগের গল্পটিও পাঠকের কাছে সেভাবে পৌঁছুতে পারেনি শেষ পর্যন্ত গল্পের মুল সুরটা ধরে না রাখতে পারার কারণে। একটু সময় নিয়ে লিখলে মনে হয় ভাল হবে। অনেক শুভকামনা রইল।

সাত্যকি এর ছবি

বাহ। তবে শেষ লাইনটুকু ছাড়া বাকিটুকু মুছে দিলেও এটি একটি চমৎকার ছোটগল্প হতো।

তাপস শর্মা এর ছবি

একজন সাদামাটা মানুষ আপনার এই বৈভব্যপূর্ণ বর্ণনার সাথে এবং জীবনচর্যার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর সাথে রিলেট করতে পারবেনা। পারার কথাও নয়। তবুও শেষ লাইনে এসে থমকাতেই হয়। একটাই কথা - যেহেতু আপনার জীবনটাও আপনার কাছে আপনার মতোই তাই আপনার দুঃখ বেদনা এবং অপ্রাপ্তিগুলোও আপনার কাছে অনেক বেশীই হবে

০২

লিখুন আপনার কথাগুলি এখানে। জীবনের প্রতিটি জিনিষের মূল্য একেজনের কাছে একেক রকমই হয় সে যতই অ্যাবসার্ড হোক না কেন

এনায়েত এর ছবি

লিফট নষ্ট, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অভ্যাসবশত জ্বালাতে যাচ্ছিলাম বাতিগুলো __অদ্ভুত বিষাদময় লেখা। ঝরনার মতো ঝর ঝরে।
খুব ভালো লাগলো----

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

চলুক ভালো লাগলো ।

তিথীডোর এর ছবি

ভাল্লাগলো।
তবে বারবার উঠে আসা অন্দরালঙ্কারের বর্ণনা বাহুল্যে হোঁচট খেয়েছি। এত শখ করে টুকটুক করে সাজানো সংসার তাসের মতো ভেঙে গেল কেন, সেটা অবশ্য ঠিক ধরতে পারিনি।

লিখুন আরো। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

লেখাটা ভালো লেগেছে, কিন্তু সংসারের বিভিন্ন উপাদানের দামগুলো শুনতে শুনতে মায়াটা হারিয়ে গেলো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

এই গদ্যের লেখক কি আজো হাজির হই নাই?
তাজ্জব ব্যাপার!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।