ঈদ উৎসব, আমরা যখন সংখ্যা লঘু!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২১/১০/২০১২ - ৬:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক একটি স্যুটকেসে পার্থিব জীবনের স্মৃতির টুকরো টাকরাকে গুছিয়ে, একই নামের, গায়ে গতরে একই মানুষ, যখন নুতন দেশে বসত গাড়ে, তখন বাড়ী, কর্মস্থল, ব্যাংক একাউন্ট, ঠিকানা বদলে যায়, বদল হয় জীবন বোধের, ভিন্ন আঙ্গিকে জীবন যাপন। জাত, বিশ্বাস, বর্ন, ভাষাগত কারনে নুতন দেশে সংখ্যা লঘুর পরিচয়ে পরিচিত হওয়া। সংখ্যালঘু… … এ বড় যাতনার, অসহায় মানুষের মনকে প্রতিদিন খুবলে খুবলে খায়। প্রাত্যহিক দিন গুলি যাও কাটে পালা পার্বনে সংস্কৃতির অভাবটা খুব দুর্বিসহ মনে হয়। সংখ্যাগুরুর জাত পাতের অহমিকা সবখানেই আছে। নিজের অবস্থান নিজেই করে নেয়ার চেস্টা।
শিকড়ের সংস্কৃতি, বিশ্বাসের সতরঞ্চিতে শক্ত পায়ে দাড়িয়ে ভিনদেশি সেই ঝাকের কৈএর সাথে খাপ খাওয়ানোর এ অন্যরকম গল্প।

ঈদ মানে হচ্ছে খুশি। সাপ্তাহিক দিনে ঈদ হওয়ায় প্রবাসের প্রথম বছরে দিনটা খুব খারাপ কাটে, ঈদের নামাজ পড়ে ঘরেই ছিলাম, কেউ আসেনি বেড়াতে, আমরাও যাইনি কোথাও, কারন পরিচিত জনেরা সবাই কাজে। মনের খুশির সেই আমেজের সন্ধানে, নিজের গরজেই খোঁজ লাগালাম আশে পাশে কোন স্লটার হাউস আছে কিনা, খুব সহজেই মিলে গেল ঠিকানা। আসল কথা দৌড়ের উপরে এই জীবনে ঈদে কোরবানী দেয়া; এ এক উটকো ঝামেলা। তারপর দাম! দেশে আস্ত এক গরুর দামের প্রায় সমান পড়ে যায় একভাগা গরু বা তার থেকেও বেশি পড়ে ছাগল ভেড়া কোরবানী দিতে গেলে। সমাজে কিছু মানুষ থাকেন যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ব্যাপক আনন্দ পায়, তেমন একজন খুশি মনে দায়িত্ব নিলেন গরুর দরদাম, ঈদের দিনে চল্লিশ মাইল দুরের স্লটার হাউসে গিয়ে কোরবানী দিয়ে, আবার চার পাঁচ দিন পড়ে গিয়ে ফের সব্বার মাংশ নিয়ে আসার।

ভাড়া করা হোল কমিউনিটি সেন্টার। সেখানে পটলাকে এক একজন একেক রকম রান্না করে ঈদ উদযাপন করা হোল, নিজের গরজেই আমরা ছেলে মেয়েদের শিকড় চেনানো আর সামাজিক ভালো লাগাটুকু চেনানোর দায়িত্বটা নিলাম। গরীবের ভাগটা তিনি সবার কাছ থেকে সংগ্রহ করে খুজে বেশ কিছু পরিবারকে
দেয়ার ব্যাবস্থা করেন।

দুই

নাইন ইলেভেন, সারা বিশ্বেই এর সুদুর প্রসারী প্রভাব পড়লো। আর পশ্চিমের বাদামী সংখ্যালঘু মানুষের মাথায় পড়লো গুরুদন্ড। মোহাম্মদ, আহম্মদ, ইসলাম রাহমান ইত্যাদি নামের মানষগুলি যে নাজেহালের শিকার হোল সেটা না হয় আরেক দিন হবে। এখানে বাদামীরা শিক্ষিত, উচ্চ পদস্থ কর্মে আসীন, অর্থ বিত্তের মালিক, তারা ঘটনার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত না হয়ে, সামাজিকতায় নিজের গন্ডির সীমানা পেড়িয়ে মুল সমাজে ক্রিয়াশীল হতে চেস্টা করতে লাগলেন। কর্ম ক্ষেত্রে ফলদায়ক কাজের খাতিরে এমনিতে সবাই টীম প্লেয়ার, কিন্ত কাজের শেষে নুতন দেশের নুতন সমাজে দেশ বিদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক আচরনের পার্থক্য তো থাকবেই, তাই ভাষা, বাচনভঙি, কাপড়চোপর, খাবার দাবার, প্রার্থনা, পালা পার্বনে সামাজিক মানুষের মধ্যকার মিল টুকু নিজেরাও সচেতন হলেন জানা ও জানানোর জন্য। মাত্র কয়েকজন হটকারী সন্ত্রাসী পুরো বাদামি জাতীকে জিম্মি করার সুযোগ শুধু টেড টার্নার আর মারডকের উপর ছেড়ে না দিয়ে বাদামিরা নিজেরাই উদ্যেগি হোলেন। কর্ম ক্ষেত্রের মত সমাজেও টীম প্লেয়ার হবার উদ্যেগ নিলেন। ধীরে ধীরে ইলেকসনের আগে আমন্ত্রিত লোকাল কাউন্সিলর, মেয়রও আসলেন জুম্মার আগে নিজেদের ক্যাম্পেনে ভোটের জন্য। পর্দাটানা ঘরে আত্বগোপনের চাইতে বাদামিরা এগিয়ে গেলো বিভিন্ন নাগরিক কর্মকান্ডে স্বেচ্চাশ্রমে নিজেদের পরিচিত করতে। একই ভাবে শিকড়ের সন্ধানে মসজিদ, মন্দির, গুরুদোয়ারায় মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষনীয়। ধীরে ধীরে দেয়ালী বা ঈদে বাড়িতে বাড়িতে ঝিক মিক টুনি বাল্বের আলোয় পুবের মানুষের উৎসব সম্পর্কে জানলো সংখ্যাগুরু পাড়া প্রতিবেশি। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষের ধর্মীয় কাহিনী, নবী রসুলের ত্যাগ উপদেশে মিল অনেক। তাই আমাদের ‘রামাদান’ বা ‘আব্রাহাম’স ফেস্টিভেল অফ স্যাক্রিফাইস’ এর উৎসবে কানাডিয়ানরা খুব অবাক হয়না, বরঞ্চ ব্যাবসায়িক স্বার্থে কানাডিয়ান সুপার মার্কেটের ফ্লায়ারে হ্যাপী ঈদ বা হ্যাপী দেয়ালী উপলক্ষে সেল দেয়া বিভিন্ন এথেনিক পন্যের তালিকা থাকে; খ্রিস্টমাসের মত।

তিন

উৎসবের কাপড় চোপর কেনায় এখন অনেক সুবিধা, বড় বড় শহরের এথেনিক দোকান গুলিতে দেশ থেকে লেটেস্ট ফ্যাসানের ডিজাইন গুলি চলে আসছে। অনেকে নিজেরাই স্যুটকেস বোঝাই করে আনা কাপড় কোন কমিউনিটি বিল্ডিং ভাড়া করে বিক্রি করছেন। প্রাচ্যর ভিন্ন ডিজাইনের গয়না এদেশীদেরও পছন্দের। এখনকার উঠতি কানাডিয়ান তরুনিদের নাক ফুটানো ব্যাতিক্রমি ফ্যাসান তাই ঐ সব ঈদ বাজারে নাকফুল, ঝুমকো দুল, টিকলি গলার বাহারি গয়নার জমাট ব্যাবসা হয় ক্ষুদে ব্যাবসায়ীদের তাদের মাপে। অরোগেনিক টাট্টু হিসেবে পরিচিত মেহেদির অপরুপ নকশায় হাত, পা, ছোটদের গালে কপালে রাঙ্গানো জনপ্রিয় হয়েছে। বাজারের দেশি খাবার বিশেষ করে বিরিয়ানী, কাবাব, তন্দুরি, সমুচা চুটিয়ে ব্যাবসা করে। মসলাদার খাবার এখানে অনেক জনপ্রিয় হচ্ছে, এথেনিক রেস্টুরেন্ট গুলি ভালো ব্যাবসা করছে।

উৎসবের দিনে সকালে সপরিবারে কমিউনিটি সেন্টারে যায় সবাই। নামাজ শেষে দেশি ভিনদেশিদের সাথে কোলাকুলি আর মোবারকবাদ জানিয়ে যার যার কমিউনিটির ওপেন হাউজে। ঘড়ি ধরে একেকটি পরিবার লোকজনকে আমন্ত্রন জানান, টেবিলে সাজান দেশি পরবের খাবার দাবার, বাচ্চা কাচ্চাদের দেন ঈদ উপহার। সাথে সাথে নিজেরাও চলে যান টাইম মেশিনে হাজার হাজার মাইল পার হয়ে কত যুগ আগের নিজেদেরই শৈশবের দিন গুলিতে যা জীবনের মধুরতম স্মৃতি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়া, সারা দিনের আনন্দময় উৎযাপন।

তিন দিনের এই ঈদে স্লটার হাউস গুলি অসম্ভব ব্যাস্ত থাকে। বিভিন্ন অর্গানাইজেশান, বিভিন্ন এশিয়ান দোকান পে-প্যাল, ডেবিড, ক্রেডিট, চেক বা ক্যাসে অর্থ সংগ্রহ করে কোরবানীর ব্যাবস্থা করে থাকেন। সপ্তাহান্তেই পরিস্কার, পছন্দমত টুকরো করা টাটকা মাংস পেয়ে যান, রেঁধে নিজেরা খান, বন্ধুদের খাওয়ান, আর এক তৃতিয়াংশ মাংস গরীব দুঃখির জন্য বিলিয়ে দেন। প্রত্যেকের দানের এই মাংস অর্গানাজেশানের ঠিকানা থেকে কানাডিয়ান ফুড ব্যাংক অত্যান্ত খুশির সাথে কয়েক মন তাজা মাংস নিয়ে যায় অটোয়া শহরের ফুড স্ট্যাম্পে বাস করা কানাডিয়ান গরীব দুঃখিদের জন্য। সমাজের স্তরে স্তরে যে বিভাজন, যেকোন সামাজিক উৎসবে সেটাকে ভোগের, ত্যাগের, বিচক্ষন মানবিক আবহে সামনে নিয়ে আসে মিলন মেলায়। এদেশ প্রথম এসে মাংস খাওয়া নিয়ে যে বিতর্ক দেখেছিলাম সেটা কিন্ত এখন আর নেই। বড় বড় শহর গুলিতে মুল ধারার সুপার মার্কেটেই কোশার মিটের মত হালাল মাংসও সুলভে পাওয়া যাচ্ছে।

সুলভ ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক সুবিধা, প্রাচ্যর স্বল্প মুল্যে নির্ভরযোগ্য শ্রমিক, মাল্টন্যাশনাল কোম্পানির অসীম ক্ষমতা, পাশ্চাত্যর কিছু প্রতিভাবান আবিস্কারক, এই পৃথিবীকে অনেক বদলে দিচ্ছে। নিছক ধর্ম, বর্ন, বিশ্বাস, জাতী, উপজাতী বা দেশের হিসেবে সংখ্যা লঘু বা সংখ্যা গুরুর সংজ্ঞা দিতে ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ গন ফায়দা নেয়ার চেস্টা করছেন, সমাজবিদেরা আরো ভালো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্ত ব্যাপার হচ্ছে আদিম যুগ থেকেই মানুষের অস্তিত্বের সংকট, পরিচিতি (আইডেনটিটি) সংকট, প্রাত্যাহিক অর্থনৈতিক সংকট, মানুষের মনকে অনেক ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে মনকে গুহাবাসী না করে, যে দেশে আছে, সে দেশের আইন কানুন মেনে এই সমাজের সাথে চেনা জানার মাধ্যমে নিজেকে সম্পর্কিত করা। মন থেকে সংখ্যালঘুর অসহায় বোধটাকে দূর করে চলমান সমাজে নিজেদের উৎসবে প্রার্থনায়, সংস্কৃতিতে নিজেদের স্বাক্ষর রাখা অনেক মংগলময়।

আসমা খান


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কানাডিয়ান গরীব দুখী চিন্তিত

অমি_বন্যা

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রাচুর্যের দেশেও অনেক গরীব আছে, সরকারি অনুদান সকলের জন্য নয়, এবং দিন চালানোর জন্য যথেস্ট নয়, তাই তারা ফুড ব্যাংকের শরনাপন্ন হয়।

ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য।

আসমা খান

পুতুল এর ছবি

কবে কখন কোন দিক দিয়ে ঈদ আসে আর যায় তার খবরও পাই না। কোরবানী দেওয়া তো পরের কথা। এমনই অষ্ঠে-পৃষ্ঠে বেঁধে রাখে সাদা চামড়ার মানুষ অন্য সংস্কৃতির মানুষকে। ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এইতো এই উইকএন্ডেই ঈদ! আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা!

পুতুল এর ছবি

ঈদের শুভেচ্ছা বুমেরাং হয়ে আমার কাছে ফিরে এলো। ঈদ-পূজা-পার্বণে শুভেচ্ছা বলে কিছু নেই। আছে শুধু খানাদানা। বউ বাচ্চা দেশে গেছে ঈদ করতে। প্রথম সপ্তাহ গেছে বউ যা রাইন্দা দিয়া গেসে হেইডা খাইয়া। দ্বিতীয় সপ্তাহ গেল রুটি-বাটার-জেলির উপ্রে দিয়া। টিকতে না পাইরা আজকে নিজেই রানলাম। ভাত মনে হয় দুনিয়ার শ্রষ্ঠ খানা। তাই ঈদে ভাত মোবারক।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলেই ভাত দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ খানা। হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আমার কাছে ঈদ মানে এখন ভুলে থাকা। বাবা-মা-ভাই-বোন সবাইকে ভুলে থাকার জন্যে বাসায় বাসায় ঘুরে খাবার খাই। সংখ্যালঘুত্বের অনুভূতি গ্রাস করে না। বরং ক্লাস বা কাজ থাকলেই ভাল, ভুলে থাকাটা সহজ হয় হাসি

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রবাসে ঈদ মানে হচ্ছে দেশ, আত্বিয়, বন্ধুকে স্মরন করা, নুতন এই দেশকে বসবাসের জন্য বরন করে নুতন বন্ধু বানানো। কিছু মজার খাবার খাওয়া, খাওয়ানো, কিছু দান করা।
ঈদ মোবারক!!
আসমা খান

অতিথি লেখক এর ছবি

যে কোন উৎসব শেষ পর্যন্ত অনেকটাই পরিবারিক মিলনমেলার মত ঠেকত আমার কাছে। রিইউনিয়ন প্রবাসে থেকে সম্ভব হচ্ছেনা, তাই সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কাজ থাকলে ভাল, তা নাহলে ঘুরতে বেরিয়ে যাই; ভুলে থাকার প্রয়াস, গান-মুভি-গল্প-কবিতা মিলে ভালই কেটে যায়।

দিবাকর

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার মা যেকোন উৎসবে প্রথম জীবনে কাঁদতেন অনেক দুরের বাবা মা ভাইদের জন্য, শেষের জীবনে কাঁদতেন দেশে বিদেশের ছেলে মেয়েদের জন্য। আমিও মনে মনে খুঁজতে থাকি প্রিয়জন, সবাই ব্যাস্ত, 'পরকে আপন করলাম আমি আপন হৈল পর' আশে পাশে চেনা জানার মধ্যই খুজি আনন্দ।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনাদেরতো ২৬ তারিখে ঈদ। ভাল থাকুন আনন্দে থাকুন। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বি ২৬ তারিখেই ঈদ। ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। হাসি

আসমা খান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।