তুই রাজাকার, তুই রাজাকার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৯/০২/২০১৩ - ২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪ দিন হল শাহবাগ চত্বর প্রজন্ম চত্বরে পরিণত হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ছিলাম, সে যেন এক প্রাণের মেলা, তারুণ্যের জাগরণ। একটা দল, নাম নেই, ব্যানার নেই, কিছু তরুণ তরুণীর স্লোগান আছে শুধু। পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, আমাকে দলে ডেকে নিল। শুরু করলাম তাদের সাথে স্লোগান দেয়া।
ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
গ-তে গোলাম আজম, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
আরো কত কি স্লোগান। একসময় তারা সবাই বসল, শুরু হল গল্প। কে কোথা থেকে এসেছে, কি করে, এই সব। বুঝতে পারলাম আমি এদের মধ্যে সবচেয়ে বুইড়া পাবলিক। কথায় কথায় একজন বলল, "আচ্ছা ভাই, এই যে ছাগু নামে একটা গ্রুপ আছে, এরা কি বুঝেনা রাজাকার কি জিনিস? এদের কেউ কি শিখায় নাই?"

আমার মনে পড়ে গেল আমার সাথে রাজাকারের প্রথম পরিচয়ের কথা। মা বলে ছোট থাকতে মুখে বুলি একটু তাড়াতাড়ি ফুটেছিল। বাচাল উপাধিটা পেতেও সময় লাগেনি। টিভিতে নাটক দেখতে দেখতে ২টা সংলাপ নাকি সারাদিন আওড়াতাম। "ক্যারেম ক্যারেম যুদ্ধ হবে, তোমার সাথে আমার সাথে", আর " তুই রাজাকার"। বুঝতাম না রাজাকার জিনিসটা কি, তবে সারাঘর দাপিয়ে বেড়াতাম এই দুটি সংলাপ নিয়ে। মা গল্পে বলত রাজা-রাণীর কথা। ভাবতাম রাজাকারও হয়তো সেইরকম কিছু। কিন্তু মা বলত রাজাকার খারাপ। আমি মনে মনে ভাবতাম, এটা আবার কি কাহিনী?

১৯৯৪ অথবা ১৯৯৫ সাল, তখন চট্টগ্রামে থাকি। সপরিবারে সিনেমা দেখতে গেলাম, একাত্তরের যীশু। সিনেমাটা যত দেখি তত অবাক হই। দেখি খাকি পোশাকে পুলিশ আসছে, ডাকাত ধরছে, কিন্তু একটা লোক ডাকাতগুলোকে সাহায্য করছে। কিন্তু হল ভর্তি লোক দেখি পুলিশগুলোকে গালি দিচ্ছে আর ডাকাতগুলোর পক্ষে তালি বাজাচ্ছে তাদের সাফল্যে। বাবাকে ডেকে বললাম, বাবা সবাই পুলিশকে গালি দেয় কেন?
- ওগুলা পুলিশ না বাবা, ওরা পাকিস্তানি সৈন্য, বাঙ্গালী মারতে এসেছে
- তো ওরা চার্চে কি করে? (চার্চ জিনিসটা বুঝতাম কারণ সেন্ট মেরি'স স্কুলে পড়তাম)
- মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে
- ওই ডাকাতগুলো?
- ডাকাত না, মুক্তিযোদ্ধা, ওরা পাকিস্তানি সৈন্যদের হারাতে এসেছে, পাকিস্তানিরা বাঙ্গালী পছন্দ করেনা
- তো ওদের সাথে যে কয়েকটা বাঙ্গালী ঘুরে?
- ওরা রাজাকার বাপ, ওরা চায় পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে থাকুক, বাঙ্গালী মারুক

পাশের এক দাদু বাপ-বেটার অন্তরঙ্গ আলাপে বিরক্তি প্রকাশ করে আমাকে দিল ধমক, মুখ কালো করে বসে বসে দেখলাম কি হয়। দেখলাম ছেলেগুলো ভাত খেয়ে অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পরলো, পাকিস্তানি মেরে আসলো। মনে মনে বললাম, বাঁচলাম, নইলে আমাকে মারতে আসত পাকিস্তানি। ওমা, শেষে কি হল? পাকিস্তানিরা ধরে ফেলল, মেরে ফেলল। এত মানুষ ভর্তি হলে ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিলাম, কেউ তো থামাতে পারে না। কি আর করার আমাকে সপরিবারে হল ত্যাগ করতে হল। আমার বাবার জানিনা কতক্ষণ লাগল বুঝাতে যে পাকিস্তানিরা আর বাংলাদেশে নাই, মুক্তিযোদ্ধা অনেক ছিল, একসময় পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। বাবা বলেনি, রাজাকার রয়ে গিয়েছে।

২য় শ্রেণী থেকে একে একে বীরশ্রেষ্ঠের কথা জানতে শিখি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানতে শিখি। একদিন বুঝি, মুক্তিযোদ্ধা অনেক ছিলনা, তাদের অস্ত্রও ছিলনা তেমন পাকিস্তানিদের তুলনায়। তবু কীভাবে যেন ৯ মাসেই তারা দেশটাকে স্বাধীন করে ফেলেছিল। ৭ম শ্রেণীতে এসে রাজাকারদের ব্যাপারটা ভালমত বুঝতে পারি। দৈনিক জনকন্ঠ কোন রাজাকার এখন কি হালে আছে রোজ রোজ তার বর্ণনা দিত। আমি পড়তাম, অনেক উৎসাহ নিয়ে।এখন অনেক বড় হয়েছি, এর মধ্যে অনেকবার একাত্তরের যীশু দেখেছি, আগুনের পরশমণি দেখেছি, দেখেছি মুক্তির গান। পড়েছি দেশের ইতিহাস, ভুল ও বিকৃত অংশগুলো বাদ দিয়ে।
রাজাকার কি, রাজাকার কারা, তারা কি করেছে, তারা কি করতে সাহায্য করেছে, এসব নিয়ে সংশয়, দ্বন্দ্ব বা অজ্ঞানতায় ভোগা অভাগা আমি নই।

বাবা, মা, তোমাদের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ। আমাকে পৃথিবীতে এনেছ, আর যাতে সেই অভাগাদের দলে পতিত না হই তাও নিশ্চিত করেছ।

তাই আমি জেনে, বুঝে স্লোগান দেই...

ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
গ-তে গোলাম আজম, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
স-তে সাইদী, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
স-তে সাকা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
ন-তে নিজামী, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার


মন্তব্য

একাত্তর এর ছবি

দারুন লেখা। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ছাগুরা বোঝেনা কারণ গোআ ওদের বাপ লাগে। আর বাপ রাজাকার ছাও রাজাকারের কাছে নিজের নুরানী চেহারার বর্ণনা দেবে কেনু...

*লেখক নাম লিখতে ভুলে গেছেন।

কড়িকাঠুরে

সৌরভ কবীর এর ছবি

নব্য রাজাকারগুলোর বিচার হবে একদিন।

__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে

মানিক মনিরুল এর ছবি

অনেক ভালো লিখেছেন চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

বিচার চাই,হতে হবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।