আমার বইমেলা পুরোটাই রসে ভরা!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০৩/২০১৩ - ১:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(তারিফ শেরহান শুভ)

বইমেলায় হাঁটতে হাঁটতে যখন একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হয় তখন আমি করি কি কোন স্টলের সামনে যেয়ে খুঁজে খুঁজে একটা জোকসের বই বের করে পড়তে শুরু করি। এবারও তাই করেছি। তবে এবার আবার একই স্টলের একই বইই প্রত্যেকবার যেয়ে পড়েছি। প্রতিবারই সেখানকার দোকানীরা বলেছে, “বইটা নিতে পারেন। ভালো লাগবে। দিব ভাই এটা?” আমি প্রত্যেকবারই খুব গম্ভীরভাবে বলেছি, “দেখছি। দেখি নেওয়া যায় কিনা।” ২৮ ফেব্রুয়ারি মেলার শেষ দিন আবার মেলায় যেয়ে ঐ বইটাই পড়ছিলাম। এই কয়দিনে বইয়ের প্রায় অর্ধেক পড়া শেষ। হঠাৎ দোকানীদের একজন একটু হেসে বলে ফেললেন, “ভাই, আপনি এই কয়েকদিন যতগুলো পাতা পড়েছেন তাতে বইটা না কিনলেও অর্ধেক দাম দেওয়া উচিৎ হয়ে গিয়েছে।” খোঁচাটা বুঝে লজ্জাই লাগলো। তবু অবশ্য বইটা কিনিনি।
বইমেলা আমার জীবনে একটি ঘটনাবহুল ব্যপার। একবার বইমেলায় যেয়ে এক স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলো দেখছি। একটা বইয়ের নাম জোরে জোরে উচ্চারণ করলাম- “বিয়ের আগে রূপচর্চা”, তারপর পাশের বন্ধুকে মজা করে বললাম, “দোস্ত, এই বইটার একটা সিক্যুয়াল কিন্তু সামনের মেলায় আসা উচিৎ- ‘ডিভোর্সের পড়ে রূপচর্চা’।” এই কথা শুনে বই বিক্রেতা বেশ হো হো করে হেসে উঠলেন। তবে এভাবে ফাজলামো করা যে বিপজ্জনকও হতে পারে এটাও টের পেয়েছি কয়েকবার।
সেদিনও বন্ধুদের সাথে গিয়েছি। একটা বইয়ের নাম ‘পরীক্ষায় ভালো করবার ১০০টি উপায়’। সেটা দেখিয়ে বন্ধুদেরকে বললাম,“এই বই পড়ে সময় নষ্ট না করে সেই সময়টা পড়াশোনার বই পড়লেও রেজাল্টটা ভালো হয়।” যেই না বলেছি অমনি স্টলে বসে থাকা এক বয়স্ক ব্যক্তি রেগেমেগে বললেন, “আপনি কি এই বইটা পড়েছেন? এই ধরণের আর সব বইয়ের চেয়ে এটা আলাদা কি না যাচাই করে দেখেছেন?” কি আর বলব। বাস্তবতা হচ্ছে আমি এই ধরণের বইয়ের কোনটাই কখনো পড়িনি। যাচাই করা তো দূরে থাক। পরে জেনেছি ঐ ব্যক্তি ছিলেন বইটার লেখক!!! এই রকম আরেকটি ঘটনা আছে যেটি একটু পড়ে বলছি আপনাদের। ওটা এতটাই লজ্জাজনক যে লিখতেও লজ্জা পাচ্ছি। ততক্ষণ অন্য ঘটনা বলে লজ্জার কাহিনী বলার জন্য একটু প্রস্তুত হয়ে নেই।
এক স্টলে রূপচর্চা বিষয়ক প্রচুর বই সাজানো। আর বইগুলো নিয়ে বসে আছেন এক মহিলা দোকানী। মহিলা যেভাবে কড়া মেকআপ করে বসে আছেন তাতে কেউ যদি মনে করে বসে যে উনি বিয়ের মঞ্চ থেকে পালিয়ে এসেছেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। আবার কেউ এমনও ভাবতে পারে যে রূপচর্চার বইগুলোতে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী উনি সাজুগুজু করেছেন, অর্থাৎ উনি ডেমো দেখাচ্ছেন।
যাই হোক, যখন দোকানটার সামনে দিয়ে প্রায় পার হয়েই গিয়েছি তখন মহিলা আমাকে ডেকে বললেন, “ভাইয়া বই লাগবে?” আমি বললাম, “এখানে তো সবই প্রায় রূপচর্চার বই অথবা বাচ্চাদের বই। আমি আর কি নিব বলেন?” উনি একটা বই বের করে বললেন, “এই যে দেখেন ছেলেদেরও রূপচর্চার বই আছে। কখন কোন শার্ট, গেঞ্জি বা প্যান্ট পরা উচিৎ, কিভাবে কখন চুল আঁচড়াবেন এসব আছে এটাতে। বইটা ফলো করলে অনেক উপকার পাবেন।“ আমি নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম উনি এমনি ঐ বই আমাকে কিনতে বলেননি, যথেষ্ট কারণ আছে। যেই গেঞ্জি পরে রাতে ঘুমিয়েছিলাম সেটাই পরে এসেছি, প্যান্টটা দশদিন ধরে পড়ছি তাই প্রচণ্ড ময়লা, স্যান্ডেল রঙ করিনি বহুদিন- ওটার রঙটাই পাল্টে গিয়েছে।

আমার এক বন্ধুর নারীপ্রীতি খুব বেশি। বানিজ্য মেলা হোক আর বইমেলা- তার মূল উদ্দেশ্য নতুন কোন মেয়ের সাথে কথা বলা ও শেষে তার সেলফোন নাম্বার চাওয়া। এত সহজে ও সাবলীলভাবে সে কন্টাক্ট নাম্বার চায় যেন মনে হয় নাম্বারটা চাওয়া ও পাওয়া তার ন্যায্য অধিকার। কয়েকটা স্টলের মহিলা বিক্রেতাদের সাথে সে খুব ভাব জমানোর চেষ্টা করলো। লাভ হল না। এমন সময় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এক সুন্দরী টিভি উপস্থাপিকা আমার ঐ বন্ধুটিরই সাক্ষাৎকার নিতে আসলো। সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পর আমরা বাকিরা ঠিক যা আশঙ্কা করছিলাম তাই হল। ঐ বন্ধুটি সাক্ষাৎকার শেষ হতেই কথা নেই বার্তা নেই উপস্থাপিকার কন্টাক্ট নাম্বার চেয়ে বসলো! মেয়েটা তো হা হয়ে গেলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে বন্ধুটিকে নিয়ে সরে আসলাম। টিভিতে অনুষ্ঠানটা যখন হওয়ার কথা সে সময় দেখলাম সযত্নে তারা আমাদের বন্ধুর সাক্ষাৎকার বাদ দিয়ে প্রচার করলো। খুব স্বাভাবিক।

ছোটরা দেখলাম বইমেলা থেকে খুব ভূতের গল্পের বই কেনে। তেমনই এক ছোট্ট ছেলে ভূতের বই কিনছে আর তার কিশোরী বোনকে অবাক হয়ে বলছে যে সে কেন ভূতের বই কিনছে না। তার বোনের উত্তরটা শুনে মুখ চেপে হেসেছি। হাতে একটা গণিতবিষয়ক বই নিয়ে সে বলল, “আমি তো আর ভূতের গল্প পড়ে ভয় পাই না। তবে ভয় পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে আমি এই বইটা কিনতাম। আমি শুধু গণিতেই ভয় পাই।“

অন্যপ্রকাশের সামনে এবারও ভিড়। ক্রেতারা স্টলটার সামনে যেন দেয়াল তৈরি করে রেখেছে মূলত হুমায়ূনের ‘দেয়াল’ উপন্যাসটা কেনার জন্য। অন্যপ্রকাশের সামনে দিয়ে যেতেই সেই লজ্জাজনক ঘটনাটা বেশি মনে পড়ে গেলো। কারণ ঘটনা ঘটার পর হাসাহাসি করেছিলাম অন্যপ্রকাশের সামনে এসে। এবার সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লেখাটার ইতি ঘটাচ্ছি।

মেলায় গিয়েছি আমার দুই কাজিনকে নিয়ে। এক স্টলে গিয়ে দেখলাম এক নতুন লেখক তার বইগুলোর প্রায় সবগুলোতেই প্রচ্ছদে নিজের ছবি দিয়েছে। ছবিগুলো বেশ উদ্ভট। মুখভরা দাড়ি। মালা পরেছে। এডিট করে মুখটা বেশ ভয়ংকর বানিয়েছে। আমি বললাম, “কি অবস্থা! এই লেখক এমন কেন? দেখে কেমন নেশাখোর নেশাখোর লাগে।” এক বোন তাতে সায় দিলো, “ঠিক বলেছ। আমার কাছেও এরকম মনে হয়েছে। অদ্ভুত!” এই আলোচনা চলতে চলতেই হঠাৎ একজন দুটো বই আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন নেশাখোরের আরও দুটি বই।” তাকিয়ে দেখি উনি সেই লেখক!!! তবে মুখে দাড়ি নেই। স্মার্ট চেহারা। আমরা তো লজ্জায় লাল। লেখক সাহেব হাসছেন, “এখনও কি নেশাখোর নেশাখোর লাগছে?” আমরা লজ্জায় কিছুই বলতে পারছিনা। একটু বোকা বোকা হাসি দিয়ে সরি বলতেই উনি বললেন, “না না আমি কিছু মনে করিনি। এই বই দুটো নিয়ে যান। গিফট দিলাম।” কোনমতে বইটা নিয়ে চলে এলাম। এরপর কিছুক্ষণ খুব হাসাহাসি করলাম। খুবই মজা পেতাম যদি জানতে পারতাম যে উনি এই লেখাটা পড়েছেন। আমার মনে হয় ওনারও ঘটনাটা মনে আছে। এখন পর্যন্ত বইমেলায় এটাই আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ও বিস্মরণীয় ঘটনা।
তারিফ শেরহান শুভ, মার্কেটিং ৩য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বইমেলা মানেই ঘটনার ঘনঘটা। এমুন কাহিনী তো প্রতিদিনই খান দুয়েক হবেই হবে। আপনার লেখা সুন্দর হয়েছে। ভালো লাগলো পড়ে। চলুক
তবে চাখম হয়েছে টিভি উপস্থাপিকার ঘটনাটা। দেঁতো হাসি

সামি

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলায়তনে এই প্রথম লিখলাম। সেই হিসেবে সামি ভাই- যিনি প্রথম ব্যক্তি (হয়তো উনিই একমাত্র হয়ে রইবেন খাইছে ) হিসেবে আমার লেখায় মন্তব্য করলেন তাকে এত্তগুলা ধন্যবাদ। আপনার কথা মনে থাকবে সামি ভাই।

পারভেজ এর ছবি

ভালো লাগলো। আমার কথাও মনে রাখবেন নিশ্চয় দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলে এখন পর্যন্ত্য কোনো লেখায় একটা মন্তব্য পরে নাই। একসময় অতিথিদের লেখাতে ২০-২৫ মন্তব্য আর হিমু ভাই, চরম উদাস ভাই এদের মত সচলদের লেখায় কমেন্টের বন্যা হতো। সো আমি একা থাকবো না। দেঁতো হাসি

নতুন লেখার অপেক্ষায় আছি। আসবে কবে। হাসি

সামি

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

অবশ্যই পারভেজ ভাই, আপনার কথাও মনে থাকবে। আর সামি ভাই, কমেন্টের বন্যা আনার মত লেখা যেন লিখতে পারি সেই দুআ রাখবেন। তবে এই লেখাতে কমেন্টের বন্যা না হোক, কমেন্টের ছিটেফোঁটা যে এসেছে এইজন্যই মজা লাগছে। লইজ্জা লাগে
তারিফ শেরহান শুভ

মর্ম এর ছবি

“আমি তো আর ভূতের গল্প পড়ে ভয় পাই না। তবে ভয় পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে আমি এই বইটা কিনতাম। আমি শুধু গণিতেই ভয় পাই।“

এ জায়গাটা সবচেয়ে মজার লাগল। তবে ভাল লাগাটা অন্য জায়গায়।

৩ বছর হল এখানে আসি বা আছি, এই প্রথম নিজের ডিপার্টমেন্ট-এর কেউ এখানে লিখছে দেখাটা অদ্ভুত রকম আনন্দের কেন কে জানে?!

স্বাগতম, স্বাগতম!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

সালাম আপু সালাম। আনন্দ বোধহয় আপনার চেয়েও আমার কিঞ্চিৎ বেশি। তবে নিজ ডিপার্টমেন্টের হওয়াতে আপনার থেকে প্রত্যাশাটাও বেশি রাখছি। সচলায়তনে আমার কর্ম মর্ম আপুর কমেন্ট দিয়ে সিক্ত হবার আশা রাখতেই পারে। হাসি

তারিফ শেরহান শুভ

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

সালাম আপু সালাম। আনন্দ বোধহয় আপনার চেয়েও আমার কিঞ্চিৎ বেশি। তবে নিজ ডিপার্টমেন্টের হওয়াতে আপনার থেকে প্রত্যাশাটাও বেশি রাখছি। সচলায়তনে আমার কর্ম মর্ম আপুর কমেন্ট দিয়ে সিক্ত হবার আশা রাখতেই পারে। হাসি

তারিফ শেরহান শুভ

মর্ম এর ছবি

আপু?! ওঁয়া ওঁয়া অ্যাঁ ইয়ে, মানে... খাইছে

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

লইজ্জা লাগে খাইছে

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

খুবই লজ্জিত ও দুঃখিত। সন্ধ্যায় আপনার ফিরতি কমেন্ট দেখে লজ্জায় কিছু লিখতে পারিনি। আসলে কেন যেন মর্মর শব্দটা মস্তিষ্কে মনের অজান্তে এক বড় বোনের ছবি এনে দিলো। যিনি আমার মতই আমাদের বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে যান এবং ফ্যাকাল্টিতে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা মারেন। আপনার কমেন্ট দেখেই প্রথম মনে হল মর্মর শব্দটা মেয়েদের চেয়ে বরং ছেলেদের নাম হিসেবেই মানানসই। অর্থাৎ আমি বিরাট ভুল করে ফেলেছি! খাইছে কিছু মনে নিয়েন না যেন প্লিজ। আর আপনি কততম ব্যাচের জানালে খুশি হতাম। হাসি

তারিফ শেরহান শুভ

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

আবারও ভুল। মর্ম শব্দটার সাথে কেমনে যেন 'র' যুক্ত হয়ে গিয়েছে!

অতিথি লেখক এর ছবি

“আমি তো আর ভূতের গল্প পড়ে ভয় পাই না। তবে ভয় পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে আমি এই বইটা কিনতাম। আমি শুধু গণিতেই ভয় পাই।“
হাসতেই আছি। গড়াগড়ি দিয়া হাসি
সৌম্য

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

আপনি হাসছেন? ঐ মেয়েটির মত কিংবা আমার মত যারা গনিতে ভয় পায় তাদের জন্য যে ঘটনা কত ভয়ংকর তা যদি বুঝতেন! খাইছে
তারিফ শেরহান শুভ

আচার্য এর ছবি

“আমি তো আর ভূতের গল্প পড়ে ভয় পাই না। তবে ভয় পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে আমি এই বইটা কিনতাম। আমি শুধু গণিতেই ভয় পাই।“ গড়াগড়ি দিয়া হাসি
লেখাটা খুব ভাল লেগেছে!

============================
কত আর রবে দেশ রাহু গ্রাস কবলে?
সমূলে উপড়ে ফেলি দূর্নীতি সবলে।

তারিফ শেরহান শুভ এর ছবি

ধন্যবাদ। সবাই দেখি এই লাইনটিই বেশি পছন্দ করেছে। উক্তিটি যেই মেয়েটির তার প্রতি কৃতজ্ঞ। গুরু গুরু জয় গণিতভীতি। হাততালি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।