কংক্রিটের বিভাস

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৭/০৩/২০১৩ - ৯:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এর বেশি খুব একটা আশাও করিনি...
সময় সময়ের নিয়ম ভাঙ্গেনা,সময়ের পরিবর্তনে বিমূড় হয় স্থবিরতা আর চঞ্চলতার শেষ ঠাঁই হয় প্রয়াণে নয়ত মহাকালের অ্যালবামে।
তবে আমার দেয়ালের আয়তাকার কালো অংশটায় আধো আধো কাঁপাকাঁপা কোমল হাতের বানান ভুলে সমৃদ্ধ ছড়া-টা বোধ হয় সময়কে পাত্তা দিতে পুরোদস্তুর কৃপণ!
খুব সম্ভবত শেষ যে দিন-টায় ক্লাস হয়েছিলো সেদিন ছিলো এটার প্রকাশকাল।
আজ অবধি ঐ একই রকম আছে,শুধু সঙ্গী হয়েছে ফাঁটা দেয়াল আর কিছু মাকড়শা'র আবাস।

শুরুটা অনেক আগে।
জমিদারবাবুর কি খেয়াল হলো তিনি গ্রামে স্কুল চালু করবেন।
অমনি শহর থেকে ইট এলো,সিমেন্ট এলো,কারিগর এলো আর ইটের উপর ইট বিছিয়ে গাঁথনি দেয়া হলো আমার সূচনার।
জমিদারবাবু পন্ডিত মানুষ ছিলেন,তিনি শিক্ষার মর্ম বুঝতেন।
একসময় দাঁড়িয়ে গেলো আমার কাঠামো।
আমি হয়ে গেলাম চারকোনায় আবদ্ধ শিক্ষার এক আধার যেখানে কিনা মনুষ্যশিশুরা আবদ্ধতা থেকে জ্ঞ্যানের স্বতঃস্ফূর্ততায় নিজেকে উজাড় করে চিনতে শেখে।

তিনজন পন্ডিত মশাই পড়াতেন।
তখনকার দিনেও মেয়েরা পড়তে আসতো।
নিতাই স্যার বেশ মজা করে পড়াতেন।যারা পড়তে আসতো তাদের নিজেদের নাম নিতাই স্যার কখনই মনে রাখতে পারতেন না।তাই নিজেই নিজের নিজের মতো যার যার নাম দিয়ে দিতেন।ভাগ্য ভালো থাকলে ভালো নাম পড়তো,নয়ত কারো গলায় ঝুলে যেত লেঞ্চু,ঘন্টা কিংবা বোতল-এর মত নাম!
কখনো আবার সেটাও ভুলে যেতেন।তখন দেখা যেত ঘন্টা-কে ডাকছেন ব্যাটারি বলে নয়ত ব্যাংগা-কে লেঞ্চা!
এ নিয়ে পুরো ক্লাসঘরে হাঁসির রোল পড়ে যেত।অনেকের নাম এতই জনপ্রিয় ছিলো যে আসল নামটা মনে করাটাও প্যারা হয়ে যেত।

হেকমত স্যার আবার জ্যান্ত দৃঢ় অগ্নিমূর্তি!
তাঁর তেলতেলে ৩নম্বরি বেত আর আগুন লাল চোখ এন্মিতেই কে কারচেয়ে ভয়ঙ্কর তাঁর সাথে পাল্লাপাল্লি করে!তার উপর কারও উপর তিনি চটেছেন তো খবর ছিলো!
একবার ঘন্টা-কে জিজ্ঞেস করা হলো "টিচার বানান কি?",
সাথে উঁকি দিয়ে ছিলো স্যারের ৩নম্বরি বেত আর ভ্রুর নিচে দুটি রক্তলাল দর্শনযন্ত্র...
ঘন্টা এদিকে বিনা সঙ্কেতে হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে বজ্রনাদ ঘটালো যাতে কিনা আমার মেঝে আর ক্লাসের সবার ত্রাহিত্রাহি অবস্থা!
আমার তো ঘ্রাণের অনুভূতি নেই তবে নিজের মেঝেতে মনুষ্যবিষ্ঠা দেখলে যারপনাই ঘিনঘিন করে! ক্লাস না থাকলে বিচ্ছু গুলো চিৎকার মারামারি আর আর আমার গায়ে চিত্রশিল্পের আস্ফালন ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা।দেয়াল খুঁজলে হয়তো এখনও পাওয়া যেত "ঘণ্টা না বাজিয়ে হাগা ঠিক না"!
আমার এই ছোট্ট আশ্রয়ে কতো বিদ্যার্থী আলোকিত হলো তার হিসেব কখনো রাখিনি,শুধু মনে মনে রেখে দিয়েছি তাদের নিত্য চলাচল আর চঞ্চলতার স্মৃতি।

হঠাত সবাই কেমন যেন হয়ে গেলো!
কেও আমার কাছে আসে না,আমি আবদ্ধ থাকি অন্ধকারে!
আকাশে বাতাশে তখন ৭১-এর উত্তাপ।
আমি বুঝিনা এই ৭১কি?
নিতাই স্যারের শেখানোয় ভুল না থাকলে এটি দুই অঙ্কের একটি সংখ্যা মাত্র!

অবশেষে আমার দরজা খুললো একদিন।
এ কি?
ছাত্ররা কোথায়?
এরা কারা???
কি সব অদ্ভুত পোশাক এদের!
হাতে লোহার ভারী সরঞ্জাম!

বেশিদিন লাগেনি...জানতে পারলাম এরা অনেক দূর থেকে এসেছে।
এরা এদেশের মানুষ-কে সায়েস্তা করতে এসেছে।
কেন?
এরা নাকি কূটকথায় ধর্ম বদলায়,বিধর্মীদের ভাষায় কথা বলতে চায়,হিন্দুদের প্রতি এদের অনেক ক্ষোভ।
আমি তো বাপু তোমাদের ধর্ম জিনিষ-টা ঠিক বুঝলাম না!
কেন এই পার্থক্য?
জয়ন্ত আর আসলামের মাঝে কি তফাত যে ধর্ম তাদের পৃথক করে দিলো???
যাই হোক বাপু,তোমরা মানুষ কি ভালো ভাবো তোমরাই বোঝো...আমি সাধারণ ইটের জঞ্জাল এত বুঝে কি করবো???
অনেক দূর থেকে যারা এসেছিলো তাদের নাকি পাকিস্তানি আর্মি বলা হতো।
তাদের সায়েস্তা করার ধারা গুলো ছিলো অনেক বীভৎস!
কোথা থেকে যেনো রোগা পটকা ছেলে গুলোকে ধরে নিয়ে এসে চেয়ারে বেঁধে বলতো "মুকি কিধার হ্যায়?"
যেন তাদের মুখের ভাষায় এই কথা ছাড়া আর কোনো কথা নেই!
ছেলেগুলোও চরম যেদি!
কিছুতেই বলেনা!
এরপর নখে মোটা সুঁই ঢুকিয়ে দিতো,উপড়ে ফেলতো নখ,একে একে সুপারি কাটার বাঁট দিয়ে প্রত্যেকটা আঙ্গুলের সমূলে উচ্ছেদ।
ইলেক্টিক শক,গায়ে গরম তেল,লবনের ছিটায় ক্ষতবিক্ষত চিৎকারের প্রতিধ্বনি কিছুই বাদ গেলোনা
তবুও ছেলে গুলো বলেনা মুক্তি কিধার হ্যায়!
আমারই ক্ষুদ্র আলয়ে একসময় যেখানে জ্ঞানের উন্মুক্ত আসর বসতো সেখানে ওরা ধরে নিয়ে আসতে শুরু করলো গ্রামের যুবতি মেয়েদের।
তারপর?
সে অত্যাচারের ভাষা আমাকে যে জামশেদ স্যার শেখাতে পারেন নি...
একদিন মতবর আলীর মেয়ের উপর ওরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়লো!
সংখ্যায় গুনলে দাঁড়াবে ২৪!
মেয়েটা এই স্কুলেরই ছাত্রী ছিলো...
কি দুরন্তপনাই না করতো পুরো ক্লাস জুড়ে!
নিতাই স্যার ওর নাম দিয়েছিলো তক্ষক।
মেয়েটা সইতে না পেরে একজনকে দিলো লাথি।
সাথে সাথে শুয়োরটা বাইরে চলে গেলো,ফিরে আসলো ৩টা গর সেদ্ধ ডিম নিয়ে!
এরপর একটা...দুইটা...তিনটা...

চিৎকার!ক্রন্দন!মৃত্যুনাদ...

নিরবতা...
হেকমত স্যার কেন আমাকে গুনতে শেখালে???
আমি চিৎকার করি!
হাহাকার করি সেই স্রষ্টার কাছে!
আমাকে চোখ দিলে,তবে তা বন্ধ করতে কেন দিলেনা???
আমাকে মুখ দিলে,তবে গর্জন কেন দিলেনা???

মেয়েটা মারা গেলোনা।
তবে কেমন জানি ফ্যালফ্যাল করে আমার দেয়ালে তাকিয়ে থাকতো।
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা শায়েস্তা নয়,এটা অত্যাচার!
ঐ রোগা ছেলেটার চোখে যে আগুন আমি দেখেছি তাতে এদের পুড়ে অঙ্গার হতে আর বেশি দেরি নেই।

একদিন নিতাই স্যার,তার ছেলে শ্রীমান আর একটা অপরিচিত মেয়ে-কে ধরে আনলো পূর্ব পাড়ার শিকদার।
এই শিকদার-ই তো গতবছর স্কুলের টিন চুরি করে মার খেয়েছিলো স্কুলের মাঠে!তবে ও কেন এদের সাহায্য করছে??? নিজের অস্তিত্বের সাথে এতবড় বেঈমানি!!!
নিতাই স্যারের ছেলের কদিন আগে বিয়ে হয়েছে শুনেছি,তবে কি মেয়েটা স্যারের পুত্রবধু?
শ্রীমানের দোষ ও মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাবার সময় ধরা পড়েছে।
এম্নিতে শিকদার-রা নাকি দেশ রক্ষায় রাজাকার নামে কি সংগঠন খুলেছে তারা গ্রামের তরুণ যুবকদের কড়া নজরে রাখতো।
শ্রীমান-কেও একই প্রশ্ন "মুক্তি কিধার হ্যায়?
"শ্রীমান নির্বিকার...
শ্রীমানের নির্লিপ্ততা প্রতিধ্বনিত হবার আগেই চোখের সামনে ধর্ষিত হলো তার অর্ধাঙ্গিনী...
নিতাই স্যারের সদা হাস্য মুখ-টাও হাহাকার আর সর্বহারাময় মলিন।
"ইয়ে মালাউন কা বাচ্চা নেহি বোলেগা!
খাতাম কারদো দোনোকো!"
শিকদার আর তার দলবল পা চাটা প্রভুদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর...

নয় মাস...
আমাকে ভুল করিনি!
আমি গুনতে শিখেছি!
নয় মাস আমি দেখেছি,শুনেছি...তবে চোখ বন্ধ করতে পারিনি,পারিনি বজ্রনিনাদ করতে!

মানুষ গুলোর কাছে দেশ-টা ছিলো মায়ের মতন।
ত্যাগ,প্রতিশোধ আর মায়ের স্বীকৃত অবয়ব পাবার তৃষ্ণার তৃমিলনে ক্যালেন্ডারে ১৬ই ডিসেম্বর আসে।
আসে মুক্তি,
আসে উল্লাস,
আর পাখির মতো উড়বার স্বাধীনতা!

হায়েনা গুলো হয়ত এই রোগা পটকা ছেলেগুলোর নাজুক স্বাস্থ্যই দেখেছিলো চোখে জ্বলন্ত ঠিকরে বের হতে চাওয়া প্রতিশোধের প্রতিবিম্বটা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল...তবে সত্য এটাই পলিমাটির শান্তিকামী এই ভূমির বিজয় হয়েছে...

তোমরা মানুষ গুলো বড় বেশি স্বার্থপর গো!
আমার প্রয়োজন শেষ...
তোমাদের দেয়া বিশেষণে আমি এখন বার্ধক্যে...
কয়দিন পর আমার যায়গায় উঠবে স্কুলের নতুন লাইব্রেরী ভবন।
স্থবির এই কংক্রিট আমি অনেক স্মৃতির নিরব দর্শক।
তবে তোমাদের কাছে আমারও যে কিছু প্রশ্ন আছে!
শিকদারদের বিচার কেন তোমরা করতে পারলে না???
শুনেছি ওদের গাড়িতে তোমরা তোমাদের পতাকাও তুলে দিয়েছ!!!
লজ্জায় আমার গা থেকে চুন সুরকি সরে যায়!
হে মনুষ্যজাত জীবেরা তোমাদের কি লজ্জা হয় না???

আর কয়দিন পর আমার অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে...
তবে গর্ব হয় এখনও আমার দেয়ালে ধারণ করে আছি "রাজাকারের ফাঁসি চাই"

-পৃথ্বীরাজ সৌরভ।


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

চলুক

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

পৃথ্বীরাজ সৌরভ এর ছবি

দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।