স্যুরিয়াল ফিল্ম - পর্ব ১ (ডেভিড লিঞ্চ ও ইরেজারহেড)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৫/২০১৩ - ৮:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


(স্পয়লার অ্যালার্ট)
স্যুরিয়ালিজম এর প্রতি আমি সবসময় ই এক বিপুল আকর্ষণ অনুভব করি। সিনেমা নিয়ে স্বপ্ন দ্যাখার জন্য যে ব্যক্তিরা আমাকে সবসময় অনুপ্রেরনা দিয়েছেন তাঁদের মাঝে অন্যতম ডেভিড লিঞ্চ – আমেরিকান স্যুরিয়াল ফিল্মের মাস্টার। বুন্যুয়েল আমাকে শিখিয়েছেন স্বপ্ন দেখতে আর লিঞ্চ শিখিয়েছেন গন্ডির বাইরে যত দূর যাওয়া যায় ততদুর পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে। লিঞ্চ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নাই তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি কেবল একজন সিনেমা কারিগর ই নন- একই সঙ্গে তিনি একজন আর্টিস্ট এবং মিউজিশিয়ান।
এখানে অবশ্য আমি তাঁর ফিল্ম নিয়েই কথা বলবো।
লিঞ্চের ফিল্ম মানেই উদ্ভট, বিক্ষিপ্ত, কিম্ভুত কিছু দৃশ্যের পিঁপড়ের মত সারি বেধে চলা। একটা আবসার্ড জগত – কেউ কেউ বিকৃত মস্তিস্কের অভিপ্রায় ও বলে। এ সকল অ্যাবসার্ড ফিল্ম নিয়ে তিনি কখনোই কিছু খোলাসা করেন নি এমনকি তাঁর ফিল্মের অর্থ নিয়ে কখনোই কথা বলেন নাই- নেগেটিভ বা পজেটিভ কোন কিছুই না। অবশ্য জগতের প্রায় সকল স্যুরিয়ালিস্ট আর্টিস্ট দের একই বৈশিষ্ট্য। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-

“Absurdity is what I like most in life.”

যাহোক ভেবেছি এই কিংবদন্তি কারিগরের সিনেমাসমুহ নিয়ে এই সিরিজটা লিখবো – ক্রমিক অনুযায়ী প্রথমেই আসে তাঁর শর্ট ফিল্ম ‘Six Men Getting Sick’ কিন্তু আমি শুরু করতে চাচ্ছি তাঁর ফিচার ফিল্ম থেকে। এবং এর ধারাবাহিকতায় আসে ‘Eraserhead’ ।
একজন মানুষের প্রথম ফিল্ম যা মাস্টারপিসে রুপান্তর হয়েছে – এটা একটা দুরহ ব্যাপার, এ ধরনের ঘটনা ফিল্মের জগতে খুব কম ই ঘটে। এটা ঠিক যে ইরেজারহেড - ব্লু ভেলভেট বা দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান এর মত খ্যাতি পায়নি কিন্তু খ্যাতি না পেলেও এটা যে অন্যতম একটা মাস্টারপীস সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।

ইরেজারহেড নিয়ে বলার আগে সিনেমার আগের কিছু ঘটনা বলে নেয়া প্রয়োজন। এই ফিল্ম তিনি লিখেছিলেন দুইজন প্রখ্যাত ব্যক্তির ছোটো গল্প থেকে অনুপ্রানিত হয়ে- আমি নিশ্চিত এই দুজন গল্পাকার আমাদের অনেকের ই প্রিয় তালিকার শীর্ষে। একজন ফ্রাঞ্জ কাফকা আর একজন নিকোলাই গোগোল । ‘দ্য মেটামরফোসিস’ আর ‘দ্য নোজ’ থেকে অনুপ্রানিত হয়ে তিনি লেখেন ইরেজারহেড। ইরেজারহেডের কাজ শুরু হয় ১৯৭১ সালে, লিঞ্চ এ সময় আর্থিক সঙ্কটে পড়েন। তারপরেও দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অনেকের সহায়তায় ১৯৭৬ এ কাজ শেষ হয় ইরেজারহেডের।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ইরেজারহেড মাত্র একুশ পাতার একটা স্ক্রিপ্ট, তিনি শুরুতে একুশ পাতার স্ক্রিপ্টের কাজে অনুমতি পান ৪২ মিনিটের ফিল্মের। এই ৪২ মিনিটের ফিল্ম অবশেষে পৌছায় ১২৬ মিনিটে। মাত্র একুশ পাতার স্ক্রিপ্টে ১২৬ মিনিটের ফিল্ম- আমার কাছে প্রায় অকল্পনীয়!!


এখন মুভি তে ফিরে আসি- মুভির মূল চরিত্র হেনরি স্পেন্সার (জ্যাক ন্যান্স) যে একটা কারখানায় কাজ করে। বাস করে এমন এক শহরে যেখানে বসতি প্রায় নাই বললেই চলে। চারপাশে কেবল বৃহৎ আকৃতির কারখানা , যন্ত্রপাতি। যান্ত্রিক শব্দ, রাস্তাঘাট ফাকা, তার বসবাসের স্থান জরাজীর্ণ পুরাতন এক বাড়ি। যে খানে ইলেক্ট্রিসিটির নিয়ত সমস্যা। তার ঘর জুড়ে আলো আধারির খ্যালা। এমন একটা সময় যখন মানুষের জীবনে কোন লক্ষ নাই- কোন জিজ্ঞাসা নাই, কোন প্রশ্ন বা আগ্রহ নাই। জীবন যাপন বা কাজে কোথাও কোন প্রান নাই, এক প্রানহীন নগর, সুতরাং মানুষের কথা বলার ও যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা কমে আসে ধীরে ধীরে।
মেরি স্পেন্সারের প্রেমিকা যার গর্ভে জন্ম ন্যায় এক বিকৃত শিশু। যা ঠিক মানব শিশু নয়। সেই শিশুর প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে মেরি চলে যায় তার মায়ের কাছে। স্পেন্সার থেমে থাকে তার নির্লিপ্ত জীবনে, প্রতি রাতে অদ্ভুত এলোমেলো দুঃস্বপ্ন দ্যাখে। কখনো এক মহাজাগতিক গ্রহ, সেই গ্রহে এক কদাকার ব্যাক্তি যে একটা জানালার পাশে বসে কেবল লিভার টানে। কখনো তার স্বপ্নে আসে এক অদ্ভুত রমনী যে তাঁকে সৌন্দর্যের গান শোনায়-

‘ইন হেভেন এভ্রিথিং ইজ ফাইন’

এরকম নির্লিপ্ত অথচ বিজারে একটা সময়ে তার সাম্নের ফ্লাটে বসবাসরত এক রুপবতীর সাথে সঙ্গম হয়। তার জীবনে কিছুটা হলেও যেন প্রান ফিরে আসে এবং এক যৌনাকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয় সে সময় তার দুঃস্বপ্নের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় সকল ভয়াবহতা। একদিন সেই রমনী কে অন্য এক পুরুষের সাথে দেখে স্পেন্সারের ক্রধ ভর করে। সে একটা কাচি নিয়ে তার বাচ্চার শরীরে মোড়া ব্যান্ডেজ কেটে দ্যায় এবং অবাক হয়ে দ্যাখে তার কোন চামড়া নাই তার হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, নাড়ি ভুড়ি সকল প্রত্যঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে আসে।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে পুরো ফিল্ম কিছু বিক্ষিপ্ত ছবি যা দর্শক কে গুছিয়ে নিতে হবে। এ এমন এক আবসার্ড ভাবনা যাকে কথায় প্রকাশ করা সম্ভব না।

পুরো সিনেমা অসংখ্য ভায়োলেন্স ও বীভৎস দৃশ্যে পূর্ণ। এমন কি মানুষের ব্যবহার – কথা বার্তা সকল কিছুই উদ্ভট।
পুরো সিনেমায় জ্যাক ন্যান্স অসাধারন অভিনয় করেছেন। তিনি নাকি দীর্ঘ পাঁচ বছর এই অদ্ভুত চুল রেখেছেন ফিল্ম শেষ করার জন্য। সিনেমায় চমৎকার আলো আঁধার এর খ্যালা রয়েছে। আর রয়েছে ক্রমাগত মানসিক চাপ তৈরি করা অর্গান মিউজিক। সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারন। লাইটের কাজ গুলোকে যেভাবে দ্যাখানো হয়েছে তা অভূতপূর্ব। এটা কখনোই সাধারন কোন হরর ফিল্ম নয়। এর আলো আধারী কাজ এতই অসাধারন যে কেবল তা দেখেই দর্শকের মানসিক চাপ তৈরি হতে বাধ্য। লিঞ্চ একজন সার্থক ফিল্ম মেকার সিনেমার শুরু থেকেই তিনি ক্রমাগত দর্শকের ওপর মানসিক চাপ ফেলতে শুরু করেছেন যা শেষ অবধি যেতে যেতে ক্রমান্নয়ে বাড়তে থাকে। শেষের দিকে এসে মনে হতেই পারে আপনার মাথা ফেটে সকল কিছু বেরিয়ে আসবে।
মুভির বেশ কিছু মেকিং এর ব্যাপারে অবাক হতে হয় সেই সময় এ ধরনের মেকিং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হওয়ার কথা। তিনি কিভাবে সেই মিউটেন্ট শিশু তৈরি করেছেন এবং তাকে ক্রমাগত অভিনয় করিয়েছেন তা একটা মিস্ট্রি এই মিস্ট্রি দর্শককেও ভাবাবে। ফিল্মে তিনি কি বলেছেন বা বুঝিয়েছেন তা দর্শক কেই খুঁজে নিতে হবে- তিনি শ্রেফ একটা পাজল দিয়ে দিয়েছেন যার সমাধান করা দর্শকের দায়িত্ব। হতে পারে এটা কোন হতাশ মানুষের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশেল, হতে পারে একজন ব্যক্তির সামাজিক হতাশা চাপ, ও অসুখি যৌন জীবনের বহিপ্রকাশ, হতে পারে এই যান্ত্রিক সমাজের মানুষের আর রোবোটিক হয়ে ওঠার গল্প। আবার হতে পারে কোন মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের প্রকাশ।
তবে এ মুভির ব্যাপারে তিনি একবার বলেছিলেন-

“Eraserhead is my most spiritual movie. No one understands when I say that, but it is.”

বিঃ দ্রঃ তিনি তার মুভি সম্পর্কে ভুল ধারনা তৈরির জন্য মাঝে মাঝে উদ্ভট কথাও বলেন। 

ইরেজারহেডের দুইটা শট

মুভির বহু শটে অভিভূত হয়েছি , এতো শটের কথা এখানে বলা সম্ভব না তবে একটা শটের কথা বলি-
স্পেন্সরের সেই রূপবতীর সাথে সঙ্গমের শট টা অসাধারন- তাঁদের বিছানা টা একটা অদ্ভুত বাথ টাবে রুপান্তর হয়। দুজন ধীরে ধীরে সেই বাথটাবে ডুবে যেতে থাকে।

দুঃখজনক হচ্ছে এই মুভি কান বা নিউ ইয়র্ক ফেস্টিভালে দ্যাখানো হয় নি কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা পৃথিবীর সবচে ভয়াবহ ২৫ মুভির তালিকায় স্থান নিয়েছে। এই মুভি টা সর্বসাধারণের জন্য নয়। আপনি যদি ডিপ্রেসড থাকেন বা দুর্বল মনের মানুষ হন। অথবা ‘গ্লুমি সানডে’ বা ‘গ্রেট গিগ অন দ্য স্কাই’ শুনে যদি কখনো ছাদ থেকে লাফ দিতে ইচ্ছে করে তবে আপনার এই মুভি না দ্যাখাই শ্রেয়। যে প্রচন্ড মানসিক চাপ লিঞ্চ তৈরি করেছেন তা দুর্বল চিত্তের মানুষ সহ্য করতে পারবে না। আর হতাশ দর্শক কে আরো বেশি হতাশা গ্রাস করবে। সুতরাং সাবধান।
হতাশ বা দুর্বল ব্যক্তির জন্য এই মুভি না দ্যাখা ভালো


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

চলুক লেখা ভাল লাগল। আরো লিখুন,

লেখকের নাম যেন কী?

অতিথি লেখক এর ছবি

--- পিনাক পাণি----
দুঃখিত লইজ্জা লাগে নাম দিতে ভুলে গেছি অনু'দা লইজ্জা লাগে

মরুদ্যান এর ছবি

আমি তো জানতাম উচ্চারণ টা 'সারিয়্যাল'।

যাই হোক, এইসব মুভি আমার মতন নাদান লোকের জন্য না এইটা বুঝছি। দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি যতদুর জানি- উচ্চারন টা স্যুরিয়াল বা স্যুরিয়্যাল এর মতই হবার কথা। 'র' এর উচ্চারনে সামান্য একটু জোর দিতে হবে বোধয়। হাসি
হতাশ না থাকলে বা ভয় না পাইলে দেখে ফেলেন হাসি

----
পিনাক পাণি

রাতুল এর ছবি

ভাই, আপনার লেখা পড়ে মুভিটা দেখলাম, কিচ্ছু বুঝি নাই। পুরাই মাথার উপর দিয়ে গেল। মন খারাপ

পিনাক পাণি এর ছবি

আরো বেশ কিছুদিন মুভি টা নিয়ে ভাবতে থাকেন হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

সিনেমাবোদ্ধা না হলেও মুভি দেখা হয় মাঝে মাঝে । 'স্যুরিয়াল ফিল্ম' শব্দটাও তাই আমার কাছে নতুন মনে হচ্ছে । তবে আপনার লেখাটা বেশ সহজবোধ্য ছিল । পড়ে বেশ ভালো লাগলো, সহজেই অনুমেয়, এরকম মুভির রিভিউ আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়ার মত । সময়, সুযোগ পেলে খুঁজে নেব মুভিটা একসময় । যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে । নিকোলাই গোগল+ফ্রানত্‍স কাফকা থেকে অনুপ্রাণিত বলে আরো আগ্রহবোধ করছি

তালেব মাষ্টার

পিনাক পাণি এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি মুভি টা দেখে ফেলেন ভালো লাগবে। নসন্দেহে কাফকা ও গোগল এর ফিলিংস পাবেন হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার

পিনাক পাণি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

বসতিহীন জায়গায় কারখানা? কেমন যেন হরর ফিলিং পাচ্ছি।।।।

রেজাউল হক সাগর

পিনাক পাণি এর ছবি

এটা হরর জোনরা এর। তবে ভুতের নয়। এ এক ভিন্ন ধারার হরর। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।