সমান্তরাল জীবন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২০/১২/২০১৩ - ১২:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাসপাতালটার ঠিক উল্টোদিকেই অনেকগুলো দোকান, বেশিরভাগই খাবারের। দোকানগুলোর বৈচিত্রও চোখে পড়ার মতো – একটা ঝকঝকে চেহারার দামি ফাস্ট ফুডের দোকান, গোটা দুয়েক মাঝারিমানের হোটেল, আর একদম বামদিকের কোনায় একটা খুপড়িঘরে চায়ের দোকান। বোঝাই যায় যে হাসপাতালটা থাকার কারনেই এখানে এতগুলো দোকান গজিয়ে উঠেছে, এবং সবকয়টাই মোটামুটি ভালো চলে। বিশেষ করে এই শেষ বিকালের সময়টাতে চায়ের দোকানের ভিড়টা বেশ ভালোই জমে উঠেছে।

আসিফ হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ভিড় থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যহাতে এক পিস কেক, পালা করে এক কামড় কেক আর এক চুমুক চা খাচ্ছে আসিফ। ওর চোখ হাসপাতালের মেইন গেটের দিকে, পরিচিত কেউ ঢুকছে বা বের হচ্ছে কিনা সেইদিকে খেয়াল রাখছে।

কেকটা শেষ করে জিন্সের প্যান্টেই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আরেকটা চুমুক দিতে গিয়ে আসিফ তের পেলো কাপটা খালি। হঠাৎ করেই ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। আসিফের মতে শেষ চুমুকটা ভালোভাবে না দিতে পারলে চা খাওয়ার অর্ধেক মজাই নষ্ট। একবার ভাবলো আরেক কাপ চা নেবে কিনা, কিন্তু পরমুহুর্তেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলো। মা সারাদিন কেবিনে একা, ও যাবার পরেই যা একটু বিশ্রাম পাবে। বিলটা দিয়ে, বাকি টাকা রেখে দিতে বলে আসিফ ধীর পায়ে হাসপাতালের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

একহাতে অনেকগুলো ব্যাগ আর অন্যহাতে মোবাইল নিয়ে ইমরান হাসপাতালের গেটে এসে দাঁড়ালো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিজেদের গাড়ি দেখতে না পেয়ে ড্রাইভারকে ফোন করতে যাবে, ঠিক এমন সময় রাস্তার ওপারে চায়ের দোকান থেকে ড্রাইভার রমিজই ইমরানকে দেখতে পেয়ে দৌড় দিলো, তবে ওর দিকে নয়, গাড়ির দিকে। ইমরানও দ্রুত পায়ে সেইদিকে হাঁটা শুরু করলো। যদিও তাড়াহুড়ার কোন কারন নেই, শুধু কয়েকটা ওষুধ কিনতে হবে আর বাসা থেকে রাতের খাবারটা আনতে হবে, কিন্তু তাও ইমরানের মনটা কেমন ছটফট করছে। হয়তো হাসপাতালের পরিবেশটাই এমন যে মন সবসময় অস্থির হয়ে থাকে। হাতের ব্যাগগুলো পিছনে রেখে ইমরান সামনের সিটে উঠে বসলো। “আগে জসিমুদ্দিন রোডে ওষুধের দোকানে চলেন।” ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে ইমরান কয়েকটা জরুরী ফোন সেরে নিতে শুরু করলো।

চারতলায় লিফট থেকে বের হয়ে ডানদিকের দ্বিতীয় কেবিনটাতে আসিফের বাবা আছেন গত দশদিন ধরে। কেবিন নাম্বার ৪০৭, দরজা খুলতেই এক দমকা ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। কেমোথেরাপি নেওয়া শুরু করার পর থেকেই বাবার সবসময় প্রচণ্ড গরম লাগে। যেই মানুষ একসময় অক্টোবর মাস আসতেই গরম কাপড় পরা শুরু করতেন, এখন তাঁর জন্য সারাদিন এসি ছেড়ে রাখতে হয়। বিশেষ করে এই মে মাসের গরমে এসি একদম সবচাইতে ঠাণ্ডা করে না রাখলে চলেই না।

বাবা বেডে, আধো ঘুম অবস্থায় শুয়ে আছেন, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে গত তিনদিন ধরে, মিনিট পাঁচেকের বেশি অক্সিজেন ছাড়া রাখা যাচ্ছেনা। মা কেবিনের অন্যপাশের বেডে বসে কেমন একটা শুন্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষের চোখে রাগ, হতাশা, ঘৃণা, সব সহ্য করা যায়, কিন্তু এমন অসীম শূন্যতা সহ্য করা যায়না। আসিফ সোফায় বসে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে, চেষ্টা করে যাচ্ছে মায়ের সাথে চোখাচোখি না হওয়ার।

দরজায় হালকা একটা টোকার আওয়াজ হতেই আসিফ উঠে দাঁড়ালো, তবে ও দরজা খোলার আগেই নিজেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন ডাক্তার শরীফ। গত বছর নভেম্বরে একবার বাবার হঠাৎ করে খারাপ লাগতে থাকায় বাসার কাছে বলে এই হাসপাতালে আনা হয়েছিলো, তারপর থেকে উনিই বাবার হার্টের চিকিৎসা করছেন। হার্ট দুর্বল বলে প্রায় ছয়মাস কেমোথেরাপি দেওয়া হয়নি, কিন্তু ডাক্তার শরীফের কাছে প্রায় প্রতিমাসে একবার করে আসতে হয়েছে। অত্যন্ত ভদ্র মানুষ, খুব যত্ন করে রোগী দেখেন, বাবাও তাঁর অপর অনেকটা ভরসা করেন এখন। এমনিতে বাবা ডাক্তারদের বিষয়ে খুব খুঁতখুঁতে, বিশেষ করে হার্টের ব্যাপারে আসিফের এক মামা ছাড়া কারো কথা মানতেই চাইতেন না। কিন্তু মামা থাকেন সেই মগবাজার, চেম্বারও হাতিরপুলে। বাবার এই শরীর নিয়ে বারবার উত্তরা থেকে অতদুর যাওয়া সম্ভব না।

ডাক্তার শরীফ জুনিয়র ডাক্তারের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে, বাবার বিভিন্ন চার্ট আর টেস্ট রেজাল্ট দেখে তারপর আসিফের মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন।

“খালাম্মা, আপনি এত কাহিল হয়ে গেলে কি করে চলবে? আপনাকে বলেছি তো, আপনার নিজের ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রাম করা এখন রোগীর যত্ন করারই একটা অংশ!”

মা দুর্বলভাবে একটু হেসে বললেন, “ওনাকে কেমন দেখলেন?”

“এখন তো আগের চাইতে অনেকটাই ভালো। শ্বাসকষ্টটা একটু কমে আসলেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।”

“বাসায় যাওয়া নিয়ে আমার কোন তাড়া নেই বাবা। তাড়াহুড়া করে নিয়ে গেলাম, তারপর আবার হঠাৎ করে শরীর খারাপ হয়ে গেলো, তার চাইতে এইখানে কয়েকটা দিন বেশীই নাহয় থাকলাম।”

“তা ঠিক, তবে ওনার বয়সে বেশীদিন হাসপাতালে না থাকাই ভালো। নানানরকম ইনফেকশনের ভয় থাকে। আপনি নিজের দিকে খেয়াল রাখেন খালাম্মা, আর শক্ত থাকেন। একটা না একটা উপায় হয়েই যাবে।” ডাক্তার সাহেব আরেকবার বাবার দিকে তাকিয়ে তারপর বের হয়ে গেলেন।

পিছনে দরজা বন্ধ হতে ডাক্তার শরীফ জুনিয়রের দিকে তাকালেন।

“কি মনে হলো?”

“স্যার, আমি তো খুব একটা ভালো দেখলাম না। শরীরে অক্সিজেন ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছেনা, পায়ের অনেকগুলো ভেইন অলরেডি ব্লক হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে হার্ট আর ব্রেইনও... ”

“তোমার ডায়াগনোসিস ঠিক আছে। কিন্তু যতই নির্ভুল হোক, এই কথাগুলো রোগীর স্ত্রীকে বলা যাবেনা। তুমি সুযোগ পেলে ওনার ছেলেকে একবার ডেকে কথা বোলো। সে হয়তো বুঝেশুনে নিজের মাকে বলতে পারবে।” কথাগুলো বলতে বলতে ডাক্তার শরীফ পরের রোগীকে দেখার জন্য হাঁটা শুরু করলেন।

কেবিন নাম্বার ৪০৮। ইমরান আর ইমরানের আম্মা বেডের পায়ের কাছে দাঁড়ানো, ডাক্তার রাব্বী ইমরানের স্ত্রী আনিকার চেকআপ করতে ব্যস্ত। রুমের এককোনায় টিভিটা চলছে, তবে আওয়াজ একদম বন্ধ করে রাখা। জুনিয়র ডাক্তার একটু পরপর সেইদিকে তাকিয়ে আবার সাথেসাথেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ডাক্তার রাব্বী নিজের কাজ শেষ করে ওদের দিকে ঘুরে তাকালেন।

“চিন্তার কোন কারন দেখিনা। আগামীকাল বা পরশুর মাঝে এক্সপেকটেড ডেলিভারি ডেট। তবে আগের কয়েকদিন হাসপাতালে এনে রেখে ভালোই করেছেন। ও, একটা ব্যাপার। অপারেশানের সময় অনেক রক্ত লাগতে পারে, এখন থেকে জোগাড় করার ব্যবস্থা শুরু করে ফেলুন। আর ওনাকে একটু আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া দরকার, আমি লিখে দিয়েছি, নিচের ফার্মেসিতেই পাবেন। টেনশান করবেননা, সবকিছু একদম আন্ডার কন্ট্রোল!” একনাগাড়ে অনেক কথা বলে ফেলা ডাক্তার রাব্বীর স্বভাব, এটা ইমরান একদম প্রথমদিকেই লক্ষ্য করেছে। কথা শেষ করে দ্রুত হাতে প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করেছেন ডাক্তার, শেষ করে প্যাড থেকে ছিঁড়ে কাগজটা ইমরানের হাতে দিয়ে হাসিমুখে তাকালেন। “আর কোন প্রশ্ন ছিলো?” ইমরান মাথা নাড়তেই তিনি ঘুরে বের হয়ে গেলেন।

ইমরান আস্তে করে আনিকার পাশে গিয়ে বসলো। মায়ের সামনে বউয়ের সাথে খুব একটা কথা বলতে ওর কেমন যেন লজ্জা করে, তাও আস্তে করে বললো, “আমি তোমার ওষুধটা নিয়ে আসি। কিছু খেতে ইচ্ছা করছে? থাই সুপ নিয়ে আসবো?” আনিকা আলতো করে মাথা নেড়ে আবার সাথেসাথে বললো, “আজকে রাতে আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খাবো!” ইমরান কিছু বলার আগেই মা বলে উঠলেন, “আমি বাসায় বলে দিচ্ছি, করে রাখবে। তুই গিয়ে নিয়ে আসিস।”

মায়ের গলা শুনে যেন হঠাৎ করেই ইমরানের মনে পড়ে গেলো তিনি ঘরে আছেন। চট করে একবার আনিকার চুলে হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও। “ঠিক আছে তাহলে, আমি ওষুধটা কিনে বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসি। তোমার কিছু লাগবে আম্মা?”

“না, তুই একবারে ফ্রেশ হয়ে আসিস। তুই আসলেই আমি বের হয়ে যাবো। আর এই প্লেট আর বাটিগুলি বাসায় নিয়ে যা।”

ইমরান সবকিছু হাতে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে এমন সময় মা পিছন থেকে বললেন, “ওষুধ কিন্তু লাজ ফার্মা ছাড়া কিনবিনা!” ইমরান বন্ধ হতে থাকা দরজার ফাঁক দিয়েই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

রাত বেশ গভীর হয়েছে। বাবা গত দুই-তিনদিন ধরে তেমন কিছুই খাচ্ছেন না, আজ রাতে তাও একটা মগে করে অল্প একটু সুপ খেয়েছেন। রাতে অন্যান্য ওষুধের সাথে ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়, কাজেই বাবা এখন গভীর ঘুমে। আসিফ অন্য বেডটাতে উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইলেই একটা বই পড়ছে। এমনিতেই ওর রাত জাগার অভ্যাস, তাছাড়া হাসপাতালের কেবিনে যেন ঘুম আর আসতেই চায়না। এখানে থাকলে মায়ের একদম বিশ্রাম হয়না, সারারাত ছটফট করেন আর একটু পরপর বাবার বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। আবার রাতে বাসায় একা থাকলেও ঘুমাতে পারেন না। এইসব ভেবেই মাকে একরকম জোর করেই খালার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে আজকে। ভোরবেলায়ই আবার খালার ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে যাবে। আসিফ একবার উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো, হাতে মোবাইলটা নিয়েই। রাত ১২:৩০টা বাজে। বাইরে একফোঁটা বাতাস নেই, কেমন একটা ভ্যাপসা গরম। আসিফ কেবিনে ফিরে মোবাইলটা চার্জে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আলো জ্বলতেই থাকলো। হাসপাতালের কেবিনে একদম অন্ধকার হয়ে গেলে ওর কেমন জানি একটা অস্বস্তি লাগে।

মা বাসায় চলে গেছেন আরো প্রায় ঘন্টাদুয়েক আগে। আনিকাও শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ইমরান সোফায় বসা, চোখ টিভির দিকে। একে রাত হয়েছে, তারওপর আনিকা নিজেই ঘুম, তাই ভলিউম একদম কমানো। ইমরান স্রেফ ছবি দেখে বোঝার খবর বোঝার চেষ্টা করছে। মনটা অস্থির লাগছে। সম্ভবত কালকে সকালেই আনিকার অপারেশান। এটাই ওদের প্রথম সন্তান। ডাক্তার সাহেব যদিও ওদেরকে অনেকবার আশ্বাস দিয়েছেন যে সব স্বাভাবিক আছে, তবু টেনশান থাকেই। মা আজকে রাতে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইমরান এইমুহুর্তে বাসায় চলে যাবার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। তাছাড়া বাসা কাছেই, দরকার হলে হাসপাতালে চলে আসতে দশ মিনিটও লাগবেনা। এইসব ভাবতে ভাবতে সোফায় বসেই ওর চোখ লেগে এসেছিলো, আবার চোখ খুলতে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ বুজে আসার আগে একবার দেওয়ালঘড়িতে দেখলো, রাত ১২টার সামান্য বেশি বাজে।

ভোর ৬:৩০টা। আসিফ আইসিইউ-এর বাইরে লবিতে দাঁড়ানো, ওর পাশে ওদের বাসার কেয়ারটেকার শাহজাহান। ভোর ৪টা থেকে আসিফ এইখানে দাঁড়ানো। ভিতরে যাবার ব্যাপারে হাসপাতালের কড়াকড়ি তো আছেই, তাছাড়া আসিফের নিজের মনও সায় দিচ্ছেনা। বাবার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। আসিফ খুব দুর্বল, স্বার্থপর একজন মানুষ, বাবার এই তীব্র কষ্ট, ওই ব্যাথায় কাতর চেহারাটা ওর দেখতে ইচ্ছা করছেনা। গত ২ ঘণ্টা ধরে ও এইখানে দাঁড়িয়ে নিজের ছোটবেলার কথা, বাবার সুদর্শন চেহারার কথা মনে করার চেষ্টা ক্রে চলেছে। ৬টার দিকে মা ফোন করেছিলেন, বাবাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে শুনেই তিনি বাসায় ফোন করে শাহজাহানকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও রওনা হয়েছেন। শাহজাহান এসে ঢুকেছে মিনিট পনের আগে, তারপর থেকে দুইজন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কিসের যেন অপেক্ষায়।

ভোর ৬টা। আধঘণ্টা আগে আনিকাকে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেছে। ডাক্তার রাব্বী মাত্র এসে পৌঁছালেন। ইমরান বাইরে লবিতে পায়চারি করছে, সামনের সারির চেয়ারে ওর মা, আনিকার মা আর আনিকার ছোট বোন বসে আছে। ইমরানের চেহারায় গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। মানুষের মস্তিষ্ক মাঝেমাঝে খুব নিষ্ঠুর কিছু কাজ করে। ঠিক লঞ্চে ওঠার আগে লঞ্চডুবি, বিমানে ওঠার আগে বিমান দুর্ঘটনা, কাশি হওয়ার সাথে সাথে ফুসফুসের ক্যান্সার নিয়ে চিন্তা শুরু করে দেওয়া, এই ধরণের কিছু নিষ্ঠুরতা। এখানেও তাই হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন সবার ডেলিভারি সংক্রান্ত জটিলতার সব গল্প একসাথে মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে। ইমরানের সিগারেটের নেশা নেই, কিন্তু এই এখন দ্রুত পায়ে পায়চারি করতে করতে মনে হচ্ছে এমন কোন একটা নেশা থাকে ভালো হতো, হয়তো দুশ্চিন্তাটা একটু কম লাগতো।

ভোর ৬:৩০টা। আসিফ আইসিইউ এর দরজা পেরিয়ে একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, ডিউটি ডাক্তার ওকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। এনার সাথেই গতকাল সন্ধ্যায় একবার কথা হয়েছে আসিফের।

“আপনাকে গতকাল কিছু কথা বলেছিলাম।”

“জ্বি, আমার মনে আছে।”

“প্রায় ৩০ মিনিটের উপর হলো ওনার হার্ট থেকে গেছে। আমরা এতক্ষণ পাম্প করলাম, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এইজন্যই আপনাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।”

একজন নার্স একটা বড় চার্ট হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তার সেটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন, “আপনি দেখুন...”

ডাক্তার অনেককিছুই বললেন, কিন্তু আসিফ একটা শব্দও শুনতে পেলোনা। আসিফ তখন ভাবছে প্রকৃতি কতরকম অদ্ভুত রসিকতাই না করে। ৬ বছর ধরে বাবার ক্যান্সার। আসিফ খুব বাস্তববাদী ছেলে, কয়েকমাস আগেই ও মেনে নিয়েছিলো একদিন সকালে শুনবে বাবা আর নেই। বিধাতার মনে হয় সেই সহজভাবে মেনে নেওয়াটা ভালো লাগেনি, তাই শুধু মেনে নিলেই চলবেনা, আসিফকে এখন নিজে থেকে সেই খবরটা শুনতে হবে, সবাইকে বলতে হবে, মাকে বলতে হবে...

“আপনার অনুমতি পেলে আমরা এখন আর চেষ্টা করা বন্ধ করে মেশিন খুলে ওনাকে ক্লিন করা শুরু করতে পারি।”

আসিফের হঠাৎ করে হাসিই পেয়ে যাচ্ছিলো। আসলেই তো। শুধু মেনে নিলে চলবে না, শুধু মাকে খবরটা দিলেই চলবে না। আসিফকে এখন ওর বাবার লাইফ সাপোর্ট খোলার অনুমতিও দিতে হবে!

আসিফ খানিকক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর বললো, “মেডিকালি আর কোন আশা না থাকলে আপনারা চেষ্টা বন্ধ করে দিতে পারেন।” আসিফ অনেকটা প্রশ্নের সুরেই বললো।

“এখন আর কোন আশা নেই।”

“তাহলে ফাইন, আমি অনুমতি দিচ্ছি।”

ডাক্তার কিছুক্ষণ আসিফের দিকে তাকিয়ে কি যেন বললেন। আসিফ কেমন যেন ঘোরের মধ্যে, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে তিনি আবার একই কথা বললেন। এইবার আসিফ শুনতে পেলো। আস্তে করে এগিয়ে গিয়ে আসিফ বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে কালিমা পড়তে শুরু করলো।

অপারেশান সফলভাবে শেষ, ডাক্তার রাব্বী ওদেরকে ব্রিফ করে চলে গেছেন। এইমাত্র আনিকা আর ওদের সদ্যজাত ছেলেকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। সকাল প্রায় ৮টা বেজে গেছে, ইমরান নিজে গেছিলো অন্তত ওর মা, শ্বাশুড়ী আর শালীর জন্য নাস্তা আনতে। ঘরে ঢুকতেই মা একসাথে অনেক কিছু বলা শুরু করলেন। এতকিছুর মাঝে ইমরান সবার আগে যেইটা বুঝলো সেইটাই করার উদ্দেশ্যে আনিকার পাশে ওর ছেলের কানের কাছে ঝুকে দাঁড়িয়ে ভাবলো, আযান যেন কিভাবে শুরু করে?

হাম্মাদ আলী


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

আপনার লেখার ধাঁচ ভাল, পড়তে গিয়ে আটকাতে হয় না। চলুক
দু-একটা টাইপো আছে, “প্রায় ৩০ মিনিটের উপর হলো ওনার হার্ট থেকে>থেমে গেছে-- এরকম। ব্যাপার না। হাসি

কেমোথেরাপি নেওয়া শুরু করার পর থেকেই বাবার সবসময় প্রচণ্ড গরম লাগে। যেই মানুষ একসময় অক্টোবর মাস আসতেই গরম কাপড় পরা শুরু করতেন, এখন তাঁর জন্য সারাদিন এসি ছেড়ে রাখতে হয়।

ইস্কুলজীবনের অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মাকে ঠিক এই অবস্থায় দেখতে হয়েছিল বছর চারেক আগে...

লিখুন আরো।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপু। টাইপোগুলো পরে আমারও চোখে পড়েছে। খুবই লজ্জিত লইজ্জা লাগে

আমার বাবা গত মে মাসে অনেকটা এইভাবেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আসিফের বাবার পুরো ঘটনাটা সেই আদলেই লিখা। বাকিটা আমার নিজের কল্পনা।

রাদিন আহমেদ এহসান এর ছবি

চোমোতকার লেখা। আবেগ যখন সাহিত্য।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক
বেশ লিখেছেন। ভালো লাগল। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

লেখার ধরন সুন্দর। বেশ তরতর করে পড়ে যাওয়া যায়। তবে পরিবেশের পরিবর্তনটা শুধু প্যারা দিয়ে আলাদা না করে অন্য কোন একটা সিম্বল ব্যবহার করতে পারতেন - যেমন প্যারার শুরুতে একটা * দিয়ে দেয়া বা কয়েকটা - দিয়ে দেয়া (---)।

লিখতে থাকুন। সচলে নতুন? সুস্বাগতম।

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।