বীরাঙ্গনা, মা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ৩১/০১/২০১৪ - ১১:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“অনেক দিন আগের কথা, তেইশ বছর পার হয়ে গেছে। ১৯৭৩ সালে আমি খুলনা গেছি। দৌলতপুর কলেজে আমার কয়েকজন ছাত্র ছিল। ইচ্ছা ছিল ওদের একটু খোঁজ খবর নেওয়া, কে কেমন আছে, দেশের খবর নেয়া ইত্যাদি। দেখলাম এক মহিলা কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি চাও তুমি? রক্তচোখ মেলে বললো, কলেজে পড়বো। বুঝলাম মেয়েটি স্বাভাবিক নয়। বললাম, তোমার নাম কি? নাম? ফতি পাগলী, হয়েছে। এবার যান। এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করায় বললো, উনি একজন বীরাঙ্গনা। উনি অসুস্থ, প্রায়ই আসেন। ঘুরে ঘুরে চলে যান।”

- জানিনা ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটা উচ্চারণের সময় ওই ছাত্রের অভিব্যাক্তি কিরকম হয়েছিল, আমার নিজের অভিব্যাক্তিই কিরকম হয় আমি জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি শেখ মুজিব এই শব্দটাকে যতটুকু তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছিলেন, এই শব্দটি তা হয়ে উঠতে পারে নি; তখনতো নয়ই, এখনো নয়। শব্দটার একটা নতুন মানে, একটা নতুন মহত্ত তৈরি হলেও তা অভিধানেই আটকা পড়ে আছে। বীরঙ্গনা উপাধিযুক্ত নারীদের অবস্থাও অভিধানে বন্দী ঐ শব্দটার মতোই অবস্থা, সমাজে তার চলন নেই; সমাজ উনাদের গ্রহণ করেনি। কাপুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ বীরাঙ্গনাদের বীরাঙ্গনা হতে দেয় নি। যে সমাজে পিতা মেয়েকে নিতে অপারগ, ভাই বোনকে স্বীকার করে না, স্বামী স্ত্রীকে গ্রহণ করে না, কারণ ওই মেয়েটি বোনটি স্ত্রীটি কিছু হায়েনার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে; সে সমাজকে কাপুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলাই যৌক্তিক। সে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ সমাজের জন্য করুণা হয়। সে সমাজের আত্মার বিশুদ্ধি দরকার।

না, ফাতেমা পাগল ছিলেন না, উনার কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু সমাজের নোংরা রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কলেজে পড়া হয়নি। যে রাষ্ট্রের জন্য, যে সমাজের জন্য তাকে এতবড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, সে সমাজ- রাষ্ট্র কি প্রতিদান দিয়েছে? কলেজে পড়ার ইচ্ছাটুকুও পূরণ করতে পারে নি। কিন্তু উনি বেঁচে আছে আর বেঁচে থেকে আমাদের সমাজের নির্মম আচরণের সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

ফাতেমার বাবা-মা বেঁচে ছিলেন, আশ্রয়ও মিলেছিল, কিন্তু চাঁপা’র বাবা-মা বেঁচে ছিলেন না, তাঁর চোখের সামনে বাবা-মা-ছোট ভাইকে মেরে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, উনার আশ্রয় জুটেনি ভাইদের কাছে, যোগাযোগও রাখেনি তারা। তবে চাঁপা হার মানেন নি, তিনি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন এবং তাই করেছেন। নার্সিং এর ট্রেনিং নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন।

এরকম কিছু বীরাঙ্গনার কাহিনী জানলাম নীলিমা ইব্রাহীম’র ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি পড়ে; সেনা ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর স্বাধীন দেশটা তাঁদের জন্য আরেক কারাগার হয়ে দাঁড়ায়, সমাজে, পরিবারে তাঁরা অবাঞ্চিত হয়ে যায়। তেমনি এক বীরাঙ্গনা তারা ব্যানার্জী। ২৭শে মার্চ সকালে যখন ডাক্তার বাবার সাথে করে রাজশাহী থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা করেন, তখন এলাকার চেয়ারম্যান এসে উনাকে জীপে তুলে নিয়ে উপহার দেয় পাক আর্মিদের। দেশ স্বাধীন হবার পর উনাকে উদ্ধার করা হয়, তিনি আসে ধানমন্ডি পুনর্বাসনকেন্দ্রে। এখান থেকে আরো কয়েকজনের সাথে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথেও দেখা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের বলেছিলেন, “তোরা আমার মা, তোরা জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কি?” খবর পেয়ে তারা’র বাবা-ভাই তাঁকে দেখতে আসে কিন্তু উনাকে ফিরিয়ে নিতে বাবা অপারগ। তারা ব্যানার্জী হার মানেন নি, তিনি ওইখানের এক পোলিশ মহিলা ডাক্তারের সহযোগিতায় একটি বৃত্তি যোগার করে দেশের বাইরে পাড়ি জমান; বঙ্গবন্ধুর মা হয়েও তারা’র দেশে জায়গা হয়নি, এ সমাজ বঙ্গবন্ধুকেই তো অস্বীকার করে। তারা ব্যানার্জী এখন মিসেস টি নিয়েলসেন, ডেনমার্কের নাগরিক। স্বামী ছেলে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে, বাবা-মা-ভাইয়ের সাথে দেখাও করেছেন; যে বাড়িতে তারা’র আশ্রয় মেলেনি, মিসেস টি নিয়েলসেন সেখানে স্বাগত। রাজাকারেরা পুনর্বাসিত হয়, মন্ত্রী হয় এ দেশে, শুধু তারা ব্যানার্জীদের জায়গা হয় না।


“দেশ স্বাধীন হয়েছে, কেউ গাজী-কেউ শহীদ। কেউ বীরউত্তম, বীরশ্রেষ্ঠ, কেউ মন্ত্রী, কেউ রাষ্ট্রদূত সবার কতো স্মমান সুখ্যাতি। আর আমি? আমি কিছুই চাই নি, চেয়েছিলাম শুধু আমার নারীত্বের মর্যাদা আর প্রিয় জন্মভূমির বুকে আশ্রয়। স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই, তারা ব্যানার্জী মরে গেছে। সেখানে সেদিন সম্মান মর্যাদা সবই পেলো মিসেস টি নিয়েলসেন আর টমাসের মা। আমি কোথায়? ওদের কাছে আমি ঘৃণ্য, নিন্দিত, মৃত।”

আমরা কি জানি সুপ্রিয়া নায়েককে? ’৭১ এর মে মাসে তাঁকে পাকবাহিনী তুলে নিয়ে যায় হবিগঞ্জের লঙ্কাপুর চাবাগান থেকে, বয়স ছিল ষোল। ক্যাম্প নিয়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পরে বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য, সেটা ছিল শুরু মাত্র। তারপর প্রতিরাতে অন্তত চার-পাঁচ জন করে তাঁর উপর অত্যাচার চালাত। ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে, অবস্থান পরিবর্তন হলেও অত্যাচারের পরিবর্তন হয়নি। একবার পালিয়েছিলেন কিন্তু ধরা পরে যান আবার। ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে এই অত্যাচার। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না পেলেও নির্যাতনের কোন কমতি পাননি। দেশ স্বাধীন হবার পর বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন কিন্তু স্বাধীন দেশেও অপমান গঞ্জনা অপবাদের কমতি ছিল না তাঁর জন্য। এখন কোথায় আছেন কে জানে? স্বাধীন দেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের কেউ খোঁজ রাখেনি আর আমরা পরবর্তী প্রজন্ম খোঁজ করিনি। কারোরই খোঁজ রাখিনি, খোঁজ করিনি আমরা; দেশ গঠনে ব্যস্ত, ঐ দিকে নজর দেওয়ার সময় কই?

এরকম হাজারো নির্যাতনের কাহিনী আমাদের অজানা, আর পরবর্তীতে স্বাধীন দেশে গঞ্জনা-অপমানের শিকার। কি করে জানবো, সমাজ যে তাঁদের মুখে কুলুপ এটে দিয়েছে। আমরা তাঁদেরকে দূর থেকে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছি। নির্যাতনের স্বর্গ সেই ক্যাম্পগুলোর একটিও সংরক্ষণ করিনি নিদর্শন হিসেবে, উপরন্তু ঢেকে দিচ্ছি এমনভাবে যেন তাঁদের পাপ ঢেকে দিচ্ছি। তাঁদের সম্মনার্থে কোন ভাস্কর্য বা সৌধ নির্মাণ করিনি, কোন রাস্তাঘাটের নামকরণও তাঁদের নামে হয়নি; যেন প্রাণপণে চেষ্টা করছি তাঁদের দুঃসহ স্মৃতি ভুলিয়ে দেবার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁদের অবদানকে, মর্যাদাকে অসম্মান করে যাচ্ছি।

এখন শুনি অনেকেই বলে অতীত ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। কোন অতীত ভুলে যাব? এখন পর্যন্ত তো জানাই হল না, না জানা অতীত কি করে ভুলে যাব। আর ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে অবজ্ঞা করে যে ভুল করেছি তাঁর মাশুল তো আগে দিতে হবে; সেই ভুল তো আগে শুধরাতে হবে। এত বছর ধরে যাদের অসম্মান করে আসছি তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা তো আগে ফিরিয়ে দিতে হবে। আগেতো নির্যাতনের ব্যপকতা সম্পর্কে জানি!


ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি সামগ্রিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে জানা যায়-
১. স্পট ধর্ষণ, স্পট গণধর্ষণ ও বন্দী নির্যাতিতার সম্মিলিত সংখ্যা চার লাখ আটষট্টি হাজার (স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার তিন লাখ সাতা হাজার ছশ এবং বিভিন্নভাবে পাকিস্তানীদের নিকট বন্দী নির্যাতিত নারী এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’ নারী)।
২. চিহ্নিত স্থানে নির্যাতিতা নিহত ও অপহৃতসহ স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার- তিন লাখ ষাট হাজার। এঁদের মধ্যে শুধুমাত্র স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার প্রায় তিন লাখ সাতাশ হাজার যা মোট নির্যাতিতার সত্তরভাগ। এঁদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন প্রায় ত্রিশভাগ অর্থাৎ এক লাখ আট হাজার নারী।
৩. নির্যাতিত বন্দী নারী প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার (এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’) যা মোট নির্যাতিতার প্রায় ত্রিশভাগ। এরমধ্যে কারাগার, ক্যাম্প, বাঙ্কার প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিতার সংখ্যা মোট নির্যাতিদের প্রায় আঠারভাগ। এছাড়াও বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট, মার্শাল ল’ আদালত এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘর, অফিস আদালত, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিত হন বারোভাগ (ক্যাটাগরি দুই-শতকরা পাঁচভাগ এবং ক্যাটাগরি তিন-সাতভাগ)।
৪. বন্দী নির্যাতিত নারীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা আশিভাগ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছিয়াশি হাজার। এঁদের মধ্যে চল্লিশভাগকে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাঁরা নিজেরাই আত্মহত্যা করেছেন।

আমরা খুব সহজেই বলে ফেলি, ‘দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিরিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি।’ আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত কি এতই ঠুনকো কিছু হায়েনা মিলে খেলা করলে তা চলে যাবে। কুকুর মানুষকে কামড়ালে কুকুর সে কুকুরই থাকে মানুষ হয়ে যায় না বা মানুষটি কুকুর হয়ে যায় না। আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত আমাদের কাছেই আছে, হায়েনার দল নিয়ে যেতে পারে নাই; আর এই বীরাঙ্গনাদের নারীত্বের মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েই আমাদের তা প্রমান করতে হবে। যেদিন বীরাঙ্গনার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে হবে, যেদিন বীরাঙ্গনার পদস্পর্শ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হবে, সেদিনই আমরা প্রকৃত বিজয়ী হব। আমাদের জানতে হবে তাঁদের কথা, শুনতে হবে তাঁদের শোকগাথা, তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তাঁদের নামে করতে হবে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, তৈরি করতে হবে ভাস্কর্য তাদেরকে দিতে হবে মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা, পালন করতে হবে বীরাঙ্গনা দিবস। এক বীরাঙ্গনার ছোট একটি আকাঙ্ক্ষার কথা বলে লেখাটা শেষ করতে চাই-


“একটি মেয়ে তার জীবনের যা কামনা করে তার আমি সব পেয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। কিসের অভাব আমার, আমি কি চাই? হ্যাঁ একটি জিনিস, একটি মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুন অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তের পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইব।”

সূত্রঃ
১. আমি বীরাঙ্গনা বলছি- নীলিমা ইব্রাহীম
২. http://www.somewhereinblog.net/blog/tanmoytahsanblog/29061376
৩. Discovery of numerous Mass Graves, Various types of torture on Women” and “People’s Attitude”
- Dr. M A Hasan

কুণ্ঠিত পান্থ


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

এঁদের মধ্যে চল্লিশভাগকে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাঁরা নিজেরাই আত্মহত্যা করেছেন।

এই চল্লিশভাগের মধ্যে আমার একফুপিও আছেন। না তাঁর কথা সেভাবে বলা হয়নি কখনোই।
অনেক বড় হয়েই জেনেছি তাঁর কথা! যখনই এঁদের প্রসঙ্গ আসে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু লজ্জায়, সংকোচে সেটাও পারা যায় না।
নিজেদের নিজেরাই সম্মান করতে ভুলে যাবার মত যাতনা আর কী হতে পারে বলুন!
আপনি আরো লেখুন এ ইস্যুতে প্লিজ! প্লিজ!!

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

তুমি একদিন লেখনা তোমার ফুপির গল্প। খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। প্লিজ লেখ।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

এক লহমা এর ছবি

ঠিক বলেছ সফিনাজদিদি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

কাপুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ বীরাঙ্গনাদের বীরাঙ্গনা হতে দেয় নি। যে সমাজে পিতা মেয়েকে নিতে অপারগ, ভাই বোনকে স্বীকার করে না, স্বামী স্ত্রীকে গ্রহণ করে না, কারণ ওই মেয়েটি বোনটি স্ত্রীটি কিছু হায়েনার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে; সে সমাজকে কাপুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলাই যৌক্তিক।

চলুক

আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত কি এতই ঠুনকো কিছু হায়েনা মিলে খেলা করলে তা চলে যাবে। কুকুর মানুষকে কামড়ালে কুকুর সে কুকুরই থাকে মানুষ হয়ে যায় না বা মানুষটি কুকুর হয়ে যায় না। আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত আমাদের কাছেই আছে, হায়েনার দল নিয়ে যেতে পারে নাই; আর এই বীরাঙ্গনাদের নারীত্বের মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েই আমাদের তা প্রমান করতে হবে। যেদিন বীরাঙ্গনার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে হবে, যেদিন বীরাঙ্গনার পদস্পর্শ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হবে, সেদিনই আমরা প্রকৃত বিজয়ী হব।

জানিনা সত্যি কোনদিন প্রকৃত বিজয়ী হতে পারব কিনা। এখন তো আশে পাশে এমন মানুষ দেখা যাচ্ছে যারা মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায়না।

যতবার "আমি বীরাঙ্গনা বলছি"- বইটি পড়ি ততবার আমি কষ্টের অতলে তলিয়ে যাই। কি ভয়াবহ অমানবিকতা, কি পৈশাচিক নির্যাতন। যুদ্ধের মাসগুলোর কষ্টের পর নতুন করে অপমান, কষ্ট, লাঞ্ছনা পরিবার থেকে, বাবা, মা, স্বামী, ভাই সকল আপনজন থেকে। যেখানে তাদের বুকে টেনে চোখের জল মুছিয়ে দেবার কথা ছিল সবার, যেখানে মমতা দিয়ে বেদনা ভুলিয়ে দেবার কথা ছিল, যেখানে তাদের ক্ষত ভুলাতে অনেক বেশী পরিচর্যার প্রয়োজন ছিল সেখানে তাদের আমরা দূরে ঠেলে দিয়েছি নিদারুণ অবহেলায়, সেখানে তাদের শুধু একটা নাম দিতে পেরেছি। যেখানে তাদের নিয়ে আমরা গর্ব করব সেখানে আমরা তাদের অপমান করেছি, শুধু একটা নাম দিতে পেরেছি। তাও সেই নাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে উচ্চারন করে। এই সব দেখলে ইচ্ছে করে সব কিছু তছনছ করে দিতে।

এ প্রজন্মের একটি তরুন অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তের পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইব।”

বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, আমরা তোমাকে ভালবাসি, আমরা তোমাদের অবদান কোনদিন ভুলবনা।
ভালবাসা নিও।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটির জন্য। এমন লেখা আরও আসুক।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

এই সুদূর প্রবাসে বসে যখন বইটা পড়ছিলাম তখন বর্ণিত দিনগুলোর কথা কল্পনা করতে গিয়েও কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম, থেমে গেছি, কল্পনা করারও দুঃসাহস হয়নি আর। আর উনারা সেই দিনগুলোর পরও বেঁচে ছিলেন আরো কিছু অপমান সহ্য করার জন্য। জানিনা কবে সেই সুদিনটি কবে আসবে, যেদিন বীরাঙ্গনার পা ছুঁয়ে বলতে পারব আজ আমরা ধন্য হলাম। সেদিনের অপেক্ষায়........................

অতিথি লেখক এর ছবি

নিজেদের নিজেরাই সম্মান করতে ভুলে যাবার মত যাতনা আর কী হতে পারে বলুন!

আমাদের চারপাশে তাকালে তাই মনে হয় আমার কাছে- আমরা নিজেদের সম্মান করতে পারিনা। নিজেদের কথা বলতে গেলে অদ্ভুত এক ধরণের হীনমন্যাতা ঘিরে ধরে। বন্ধু বা পরিচিতদের আড্ডার মাঝে এ ব্যাপারে কথা উঠলেই জানিনা বলে পাশ কাটিয়ে যাই আমরা সবাই। যে যতটূকুই জানি সেটুকুই যদি বলতে পারতাম তবে জানার পরিমাণটা আরো বাড়ত।
এ লজ্জা ও সংকোচ শুধু আপনার না, আমাদের সবার।
কুণ্ঠিত পান্থ

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

"ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তের পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইব।” - অবশ্যই আছে। বাবার পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বের হওয়া জারজগুলো ছাড়া ১৯৭১ এর সকল বাংলাদেশীই মুক্তিযোদ্ধা - সে সম্মুখ সমরে থাকুক কিংবা নিজের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধা লুকিয়ে রাখুক কিংবা কিছু হায়েনার দংশনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকুক।

____________________________

এক লহমা এর ছবি

এই বীর মেয়েদের প্রাপ্য ছিল সারা দেশের শ্রদ্ধা ও সম্মান। বদলে তারা পেলেন দুর্দশা আর অপমান, উপেক্ষা আর অবহেলা। এ মর্মান্তিক বঞ্চনার নির্মমতার কোন পরিমাপ হয় না। নিজেকে বাংলাদেশ-এর সন্তান বলা প্রতিটি মানুষ যেন বলে, "বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। "

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

পোস্ট ভালো লেগেছে।

ইউক্লিড

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরাও আছি এক চমৎকার প্রজাতি। আজ আমরা ঘুরি ফিরি কিন্তু ক'জন ভাবি দেশটা কিভাবে স্বাধীন হয়েছিল?
এর জন্য যে মূল্য দিতে হয়েছিল, সেই ঋণ আমরা কি মনে রেখেছি?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।