বাজার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৪/০৩/২০১৪ - ৫:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার কড়ে আঙুল ধরে নেভা হাঁটছে আর অবিরাম প্রশ্ন করে যাচ্ছে এটা কি, ওটা কি? আর প্রতিটিই জবাবের পর অবধারিত পরের প্রশ্ন- 'কেন'? মেয়ের কাছে পৃথিবীর সবজান্তা আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি অবিরাম। 'এটা? এটা হচ্ছে ডাস্টবিন। ময়লা ফেলে।'

'কেন?'

'রাস্তা নোংরা হয়ে যাবেতো তাই সবাই একজায়গায় ফেলে; এটাতে ফেলে।'

'ও আত্তা' (আচ্ছা)। আমার বিরাট জ্ঞানী মেয়ে অল্পতেই বুঝে যায়। তিন বছর পুরোয়নি এখনো, ছুঁই ছুঁই করছে। তার 'এটা কি' আর 'কেন'র অত্যাচারে বাসার সবাই রীতিমত অতিষ্ঠ। আমার জন্য সেটা সমস্যা না, আমার সবচে' বড় সমস্যা হচ্ছে আমার প্রতিকুল সময়ে তার অতীত মনে পড়ে। উদাহরণ দিচ্ছি- বাসায় সামরিক আইন জারী হয়েছে ধূমপান নিষিদ্ধ। নন স্মোকিং জোন।

'নো স্মোকিং জোন করে কি হবে?'

'মেয়ে বড় হচ্ছে, দেখছে, ক'দিন পরে তোমার প্যাকেট থেকে নিয়ে খাবে। আর বাসার পরিবেশ নষ্ট করছ, মেয়ের দিকে খেয়াল আছে তোমার?'
অগত্যা সাত তলা থেকে নিচে নেমে অপকর্মটি সারতে হয়। তাতেও মুক্তি নেই। বাইরে যাবো বললেই মেয়ে লাফাতে লাফাতে চলে আসে। 'আমিও দাবো' (য, জ সে এখনো পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারেনি)। ম্যাডামতো পুরাই AKTEL , মানে একধাপ এগিয়ে! 'যাও মা, পাপার সাথে ঘুরে আসো'।

সে জানে মেয়ের সামনে আমি ওটি খাবোনা। লাটে উঠে আমার সিগারেট খাবার ইচ্ছে। কিন্তু বাইরে যাওয়া এড়ানো যায়না। মেয়ে গলা ছেড়ে হেসকি তোলে- 'বাইরে দাবো'। লোভ সামলাতে না পেরে একবার ওকে একটা চকোলেট আর সস্তা বেলুন নিয়ে মাঠে খেলতে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে ফেরার সময় টেস্ট বেসিস জিজ্ঞেস করলাম- 'তুমি কি খেয়েছো মা?'

'আমি চকেট খেয়েছি, তুমি সিগেট খেয়েছো'। চোখ বড় বড় করে সে গলগল করে বলে। আমি প্রমাদ গুনি। মেয়ের সামনে এই অপকর্ম করেছি জানলে বাসায় রিক্টার স্কেলে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের সমূহ সম্ভাবনা। অগত্যা ওকে নিয়ে আরো কিছুক্ষণ হাঁটলাম। একটা চিপস কিনলাম, দুজনে খেলাম, আরো একটা চকোলেট ওকে দিলাম। গেইটে এসে জিজ্ঞেস করলাম 'মা'মনি আমরা কি খেয়েছি'? 'চিপস খেয়েছি, চকেট খেয়েছি'। বাহ্! স্মৃতি, স্বস্তি নিয়ে বাসায় ফিরি। নেভা তার 'চকেট' চুষতে চুষতে মা'মনির কোলে ঝাপদেয়। তার ডিটেক্টিভ মা'মনিও আদর করে মেয়েকে শুধোয়- 'তোমরা কি খেয়েছো সোনা'?

আমি মনে মনে হাসি আর ভাবি, আমারে মফিজ পাইছো? ফিট কইরা আনছি।

মেয়ে চোখ বড় বড় করে বলে- 'আমি চকেট খেয়েছি, পাপা সিগেট খেয়েছে'!

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে কি যেন একটা নেমে যায়! কোন মানে হয় এই মীরজাফরীর? অগত্যা একগাদা মধুর বাণী অতিশয় নির্দয় ভাবে আমার কর্ণে প্রবেশ করে বিনা প্রতিবাদে।

পূজোর ছুটিতে গ্রামে আসলাম সবাই। কার্ত্তিক আসি আসি করছে। আবহাওয়াও বেশ ভালো। বেশ ছুটোছুটি করছে মেয়ে। আমিও রিলাক্স মুডে 'পূর্ব পশ্চিমের' পাতা উল্টাছিলাম। সেই কলেজ জীবনে পড়েছিলাম, বেশ ভালো লাগছে আবার। পিকলু পানিতে নামছে। বেশ টানটান একটা যায়গা। অমনি মেয়ে এসে হাজির।

'এটা কি'?

'এটা বই' আমি মুখ না তুলেই জবাব দেই । 'পাপা পড়ছেতো তুমি মা'মনির কাছে যাও?'

'কেন?'

আমি ধন্ধে পড়ে যাই। কি কেন? পড়ছি কেন, নাকি মা'মনির কাছে যাবে কেন? কিন্তু ভাববার দরকার হয়না। ভাগ্যদেবীর মতো মেয়ের মা'মনি এগিয়ে আসছে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। আবার বইয়ে মন দেই।

'শোনো, রুটি বেলার বেলন লাগবে। নিয়ে আসো'।

'হু।'

'হু কি?'

'আনবো। এই চ্যাপ্টারটা শেষ করে যাচ্ছি।'

'শোন, ফিউচার টেন্সে কোন কথা বলবা না, স্যামুয়েলসনের কথা মনে রাখবা সব সময়, ভবিষতে আমরা সবাই মৃত। এখনই যাও।' গিন্নি আমার অর্থনীতি ঢুকিয়ে দেয় কথার মাঝখানে। মেয়েকে নিয়ে চলে যাবার সময় ডিবি পুলিশের মতো হঠাৎ জিজ্ঞেস করে 'কি আনতে বলছি বলতো?'

আমি বই থেকে মুখ না তুলেই বলি- 'ঐতো ময়লা ফেলার মেশিন।'
বলেই জিবে কামড় দেই। এই সেরেছে! ম্যাডাম কি আনতে বলছে শুনিনাইতো! চরম ক্লাইমেক্সে ছিলাম। আর যাই কোথায়। '

এই ছাইপাশ ফালাও। সংসারতো হাওয়ার উপর চলে, না? গ্রামে কি আমি যাব নাকি বাজারে? এক্ষন যাও। নো বই-ফই!'

অগত্যা বাজারের উদ্দেশ্যে রেডি হই। মেয়েও রেডি। 'বাদারে দাবো'।

মেয়েকে নিয়ে হাঁটছি আর অবিরাম উত্তর দিয়ে যাচ্ছি কি এবং কেন। গ্রামে এসে সে নূতন রূপ নিয়েছে। কি এবং কেনর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ঐ কি- কেন'র পাশ থেকে নড়েনা।

'এটা? এটা পুকুর। ওগুলো পাখিনা মা, ওগুলো হাঁস।' সুন্দর শান্ত একটা পুকুর, পাড় ঘেঁষে অল্প ক'টি কচুরি পানা ভাসছে। মাঝখানে ছবির মতো সুন্দর ধবধবে সাদা গোটা দশেক হাঁস ভাসছে। পুকুর দর্শন শেষে আমরা হেলেদুলে এগুই। বাজারে এসে সিগারেট ফুঁকার লোভটা সামলে সামনে এগুচ্ছি।

'পাপা এটা কি?'

আমি থমকে দাঁড়াই। বুঝতে পারিনা কি বলবো। নেভা দাঁড়িয়ে পড়েছে তার কি'র জবাবের জন্য। আমিও এগুতে পারছিনা। কারণ কি জবাব দেবো সেটা ঠিক করতে পারছিনা। সামনে কিছু লোক সারি বেঁধে উবু হয়ে বসে আছে খদ্দেরের আশায়। বিমর্ষ মুখ, দিকভ্রান্ত দৃষ্টি, ময়লা কাপড়। কোন এক গৃহস্থী লোক এঁদের শ্রম কিনবে সেই আশায়। যাঁর শ্রম বিক্রি হবে আগামিকাল তাঁর বাড়িতে হাঁড়ি হয়তো চড়বে চুলায়, না হলে নয়। ওঁরা বাজারে এসেছে পণ্য হিসেবে, বিক্রির জন্য। নিজেকে। নেভা ওঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আঙুল দেখিয়ে বলছে এটা কি? আমি কি কখনো দেখেছি? দেখে প্রশ্ন করেছি এটা কি এবং কেন? সারা জীবন শুধু এড়িয়ে এসেছি, এড়িয়ে চলেছি। কি হবে পশ্চাতে চেয়ে? যতোই রবিবাবু বলুক - ‘পশ্চাতে রাখিছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’।

-----------------------------------------------------
দেব প্রসাদ দেবু


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আপনার আগের গল্পগুলোর তুলনায় এটা অনেক বেশি পরিণত লেগেছে।
আপনার বর্ণনা করার ক্ষমতাও খুব ভালো।

উৎসাহ দিচ্ছি, আরও লেখার জন্য হাসি

শুভেচ্ছা

অতিথি লেখক এর ছবি

@মেঘলা মানুষ, আপনার এই উৎসাহ আমাকে গুছিয়ে নিতে সহায়তা করবে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

-দেব প্রসাদ দেবু

দীনহিন এর ছবি

গল্পটি পড়তে ভাল লাগছিল, কিন্তু শেষটা জমল না তেমন; যা বলতে চাওয়া হয়েছে, তা বলার জন্যও একটা প্রেক্ষাপট দরকার হয় বৈকি! ফলে পাঠককে ধাক্কা দিল শুধু, রেখাপাত করতে পারল না তেমন।

স্যামুয়েলসনের কথা মনে রাখবা সব সময়, ভবিষতে আমরা সবাই মৃত।

কথাটা স্যামুয়েলসনের না, তার গুরু কেইনসের।

গ্রামে কি আমি যাব নাকি বাজারে?

এমনি আরো কিছু টাইপো সামান্য এডিটিং করেই ঠিক করা যায়।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

অতিথি লেখক এর ছবি

@দীনহিন, গুরু শিষ্যের তথ্য বিভ্রাটটি ঠিক করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি আসলে হালকা ফান থেকে হঠাৎ একটি সিরিয়াস জায়গায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। প্রেক্ষাপট তৈরি করে ছাড়লে ভালো হতো বুঝতে পারছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

-দেব প্রসাদ দেবু

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

গল্পের শুরুটা বেশ আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু শেষে এসে সেটা আর ধরে রাখা যায়নি। পুরো গল্পটা আসলে শেষ প্যারাটার জন্য ভিত্তি তৈরী করাতে ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু শেষ প্যারাটা তার সুবিচার করতে পারেনি।

আপনার গল্প বলার ভঙ্গিটা ভালো, আগেও বোধহয় বলেছি। কিন্তু শেষ কয়েকটি গল্পে আপনি কাহিনি ঠিকমতো জমিয়ে না তুলেই পাঞ্চ লাইনে চলে এসেছেন বলে মনে হয়েছে আপনি তাড়াহুড়ো করে গল্প শেষ করতে চাইছেন। এদিকটাতে একটু খেয়াল রাখলে গল্প আরো উপাদেয় হবে নি:সন্দেহে।

লিখতে থাকুন।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

@প্রোফেসর হিজিবিজবিজ, আপনি বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমার অখাদ্যগুলো গেলার চেষ্টা করে আমাকে লাইনে আনার চেষ্টা করছেন। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আপনার সত্যি শেষটায় এসে তাড়াহুড়ো করে ফেলি। আর কতো----! কথা দিচ্ছি ভবিষতে যত্নবান হবো।

-দেব প্রসাদ দেবু

অতিথি লেখক এর ছবি

দেব প্রসাদ দেবু, আপনার পুরো লেখাটা একটা কন্সেপ্টের উপরে লেখা। এখান স্পষ্ট নিতান্ত অবুঝ বাচ্চা কখনই আমাদের মত কখন কী করবে বুঝেনা। বাবার কাছে মেয়েতো নাইই। এখানে আমার মনে হচ্ছে আপনার পুরটা কন্সেপ্টকে তারাহুড়োর মধ্যের শেষ করার পেছনেও হয়ত সেই ছোট্ট মেয়েটির ভুমিকাই বেশি!!!

আপনি সময় নিয়ে লেখলে নিশ্চিত আরও দারুণ লেখা পাবো। হাসি

Shah Waez (শাহ্‌ ওয়ায়েজ।)
Facebook

..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল

অতিথি লেখক এর ছবি

@ ওয়ায়েজ, ছোট্ট নেভা আসলে তার নিয়মিত কৌতুহল থেকে জানতে চেয়েছিলো এটা কি, তাকে একটা কিছু বলে দিলেই সে চুপ করে যেতো, কিন্তু তার বাবা হঠাৎ করে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিষয়টিকে দেখাতে সে আটকে গিয়েছে। হাতড়ে জবাব খুঁজে পায়নি। সে তার মেয়ের কাছে সৎ থাকতে চেয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আশাবাদের জন্য, উৎসাহ দেয়ার জন্য।

-দেব প্রসাদ দেবু

এক লহমা এর ছবি

গল্প ভাল লেগেছে। সংক্ষিপ্ত মনে হয়নি। তবে রবিবাবুর উদ্ধৃতিটি সম্ভবতঃ "পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে"। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

@ এক লহমা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

-দেব প্রসাদ দেবু

মরুদ্যান এর ছবি

ভাল্লাগসে। কটু সত‌্যগুলা আমরা সবসময়ই এড়িয়ে যেতে পছন্দ করি। আর ব্যাপারগুলা এতই সহজ হয়ে গ্যাছে যে তার জন্য আলাদা প্রেক্ষাপটেরও দরকার হয়না। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য মানুষ ফেসবুকে কান্দে, কিন্তু ঘরের পাশের মানুষের দু:খের খবর রাখেনা।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

@মরুদ্যান,
আসলেই তাই, আমাদের ভার্চুয়াল আবেগগুলো কখনো কখনো বড্ড বেশি আরোপিত মনে হয়। যেখানে আমাদের প্রত্যক্ষ সহায়তা করার সুযোগ নেই সেখানেই বোধকরি আমাদের আবেগ গুলো বড্ড বেশি উপচে আসে। পাশের বাড়ির কথা বাদ দিলাম অনেক সময় আমরা পরিবারের দুর্বল মানুষটির প্রতিও সুবিচার করিনা। হোক সে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল কিংবা শারীরিক ভাবে। সচ্ছল পরিবারের সিনিয়র সিটিজেনের বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থান সেটিকেই ইঙ্গিত করে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার অ্যাপ্রিসিয়েসান আমাকে উৎসাহ দেবে নিঃসন্দেহে।

-দেব প্রসাদ দেবু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।