দুপুরের গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৪/২০১৪ - ১০:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'সিরাজুদ্দৌলা' রোলটা ছেড়ে দেয়ার চাপা কষ্ট শীত শীত দুপুর টা উপভোগ করতে দিলোনা !
মাতব্বরের ছেলের কথায় উচ্চবাচ্চ করে কি করে !
এমনিতেই পানুর দিকে চোখ ছোকরার ।
করুক সিরাজ ।
ডোবাবে , ডোবাক !
আমার কি !
বাড়ির সামনে অলস সময়ে একটা ফিলযফিক্যাল স্বান্তনা খুঁজে রফিক !

পাশের বাড়ির বেড়ার ওপাশে পানুর নড়াচড়া টের পায় !
এত ভীর ভাট্টা , এত মুহুর্মুহু শব্দ , জল , শিশির , পাতা ঝরা , ভাঙ্গা রাস্তার চেচামেচি , এত মানুষ , ধান কাটাকাটি , ঝগড়া ঝাটি , হাইওয়ের এক্কা দোক্কা গাড়ি , সব কিছু ছাপিয়ে পানুর পলকা পায়ের আওয়াজ ঠিক ভেসে আসে কানে !

পানু এখন এঘর , ওঘর করবে কিছুক্ষন।
বার তিনেক তাকাবে কাঁচা শোলার বেড়ার নিশ্ছিদ্র বাধায় !
একপাশের বেণি করা চুল হালকা করে ধরে লাফ দিয়ে ডিঙ্গাবে ঘরের চৌকাঠ !
পরতে পরতে সামলে নিবে ।
তারপর নিজের মত করে লজ্জার হাসি হেসে উঠে যাবে নিজের ঘরে !

দক্ষিনের জানালা খুলে গুন গুন করে উঠবে পানু ।
পুকুরে তখন একশটা জলপোকা সরসর করে সরে যাবে বুড়ো আমগাছটার জল ছুঁই ছুঁই হাজারটা শেকড়ের ফাঁক ফোকরে ।
তখন একটা ভুলোমন বাতাস পানুর গোসলের আগের লালচে নরম চুলগুলো নেড়ে দিয়ে যাবে !
আর একখণ্ড সোনা রঙ রোদ এসে গেথে যাবে পানুর অমন নিষ্পাপ ছোট্ট কপাল , অমন ডাগর চোখ , আর মসৃণ শ্যামল মুখটাতে !

আমগাছটার আড়ালে তখন,
আব্দুল লতিফ এর বড় ছেলে রফিক হুরমুর করে মরে যাবে ভালোবাসায় !
হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে তার অনেক্ষন!
কেবল পানু জানে এসব !

কি শরমের কথা !
এই গ্রামে আগে কেউ এই সব শুনছে কখনো !
মাগরিবের নামাজ পরে বের হয়ে পানুর বাবার কথা শুনে মর্মে মরে যান আব্দুল লতিফ !
থিয়েটার ই মাথা খাইছে ছোকরার ! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করে তার !
পানুর বাবা বুদ্ধিমান মানুষ ।
রফিক ছেলে খারাপ না ।
কি দরকার ঝামেলার ! বিয়ে পরিয়ে দেই চলেন ।
থাকবে তো দুই জন , আমরা আর কত দিন ! ভালো থাকলেই তো হইলো !
মাগরিবের নামাজ শেষের অন্ধকারে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দিন ক্ষন পাকাপাকি করে ফেলেন দুই জন !

পানুর ছায়া ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায় পুকুরের নরম ঢেউ এ !
রফিকের হঠাত ভিষন লজ্জা লাগে !
কি কি সব বলতে ডেকে নিয়ে এসে নিজেই চুপ করে বুড়ো আমগাছটায় হেলান দিয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে রফিক !
পানু গালে এক বিন্দু টোল ফেলে মিটিমিটি হাসে !
শোন , ঢাকা থেকে যে শাড়ি কিনবা , দোকান চিনো তুমি !
থিয়েটারের ঘষেটি বেগমের কস্টিয়ুম নিয়া আসবা নাতো আবার !
রফিক চুপ করে থাকে !
ঢেউ আর রোদ , রোদ আর ঢেউ আর সমস্ত জলপোকার অস্থির নড়াচড়া , বুড়ো গাছটার শ্যাওলা ধরা শীকর , নুইয়ে থাকা পানুদের নারকেল গাছ এই সব দেখে !
বলনবানা কিছু ?
লজ্জায় রফিক কথাই বলেনা আর !
যাওয়ার সময় হয়ে আসে ।
আমি একটা নীল শাড়ি যদি কিনি ?
বিয়েতে কেউ নীল শাড়ি পরে !
লালা শাড়ি না পরলে বউ বউ লাগবে !
রফিক হঠাত কেমন এলোমেলো হয়ে যায় অস্বস্তিতে !
কিছু বলে না আর ! পুকুরের ধার ধরে বাড়ি ফিরে আসে দ্রুত !

কেনা কাটা শেষ হতে হতে অন্ধকার হয়ে আসে ।
আজ আর ফেরা হলো না । ঢাকার অবস্থাও ভালো না । মিছিলে , মিটিঙে , কার্ফিউএ থম ধরে আছে শহরটা ! উর্দু আর বাংলা নিয়ে টানাপড়েনে টানটান অবস্থা !
পৃথিবীটাই মাতুব্বরদের জায়গা !
যেমন খুশি চাপিয়ে দেয়া কেবল !
ক্ষমতাহীন , সাধারণের কোন দাম নাই কোথাও !
সকালে হাটতে হাটতে ঢাকা মেডিক্যেল এর দিকে আসতেই মিছিলটা চোখে পরে রফিকের ।
একটা বাঁধ ভাঙ্গা মিছিল !উষ্কখুষ্ক উজ্জ্বল চেহারার ছেলেমেয়ে গুলো বসন্তের রোদে ঝিক মিক করে !
সিরাজুদ্দোউলার কথা মনে পরে রফিকের ! কত ছার দেবে আর ! পরে পরে মরে যাবে আর কত !
ছেরে দিতে দিতে কোণঠাসা হয়ে বেঁচে থেকে নিজেকে মানুষই মনে হয় না কত কাল ! এইবারে নিজের মত কথাটাও বলতে দিবেনা ! নিজের ভাষাটাও কেড়ে নেবে মুখ থেকে !

কি একটা হয় রফিকের । একটা প্রবল ঝড় বইতে থাকে শরীর জুড়ে ! একটা বোবা রাগে সমস্ত শরীর টা কাঁপে । হাত শক্ত করে মুঠো করে খোলস ভেঙ্গে সাই করে মিছিলে ঢুকে পরে রফিক !
অন্য হাত তবু ধরে রাখে বিয়ের সমস্ত মেয়েলি সদাই !

তারপর আর কেউ কিছু জানে না !
কেবল একটা সোনালী রঙের চ্যাপ্টা বুলেট জানে বাকি ইতিহাস!
জানে কি করে এক ঝাক রোদ্দুরে আকাশের দিকে উড়ে চলে গেলো এক খন্ড কোরটি !
জানে কতটা ভালোবাসা ভরা থাকে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়া সদ্য স্থির হৃৎপিণ্ডেও !
আর জানে কি অবলীলায় ঝকঝকে কালো পীচের মাঝখানে গাড় নীল শাড়িটা বুকের সমস্ত রক্তে নিমিষে লাল হয়ে যায় !

পানুর তখন দক্ষিনের জানালা খোলা ।
আর শত শত জল পোকা স্থির বসে আছে স্বচ্ছ স্ফটিক জলের আয়নায়।

ইমরান কায়েস।


মন্তব্য

দীনহিন এর ছবি

এই গল্পের পাত্রপাত্রীরা সব চেনা আমাদের, ভূগোল ও ইতিহাস ও আমাদের খুব করে জানা। তবু যে গল্পটি এমন করে হৃদয় ছুঁয়ে গেল, তার কারণ এর নন্দিত শব্দ, ছোট্র ছোট্র বাক্যগুলি যেন এক একটি ঢেউ, সব মিলিয়ে যা তৈরি সুরের মূর্ছনা, কখনো আনন্দের, কখনো করুণ!

লেখককে অনুরোধ, আরও লিখবেন সচলে। আর অবশ্যই টাইপোগুলি শুধরে নেবেন।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লাগলো টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোকে একসুঁতোয় বেঁধে আনার জন্য।

কিছুকাল আগে এক ভারতীয়কে বোঝাচ্ছিলাম আমাদের সাথে পাকিদের রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা- ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত।
৫২ তে এসে খেয়াল করলাম রাগে হাত-পা শক্ত হয়ে যাচ্ছে, ইংরেজি জড়িয়ে যাচ্ছে রাগে।
জানি না সে সময়ের সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার -দের রক্ত কত তাপমাত্রায় ফুটে উঠেছিল!

মোহাম্মদপুরে সরে আসার আগ পর্যন্ত একসময় নাখালপাড়ায় থেকেছি প্রায় ১৬ বছর। ফার্মগেট যাবার পথে একটা ছোট ঝুপড়ি মত টিনশেড বাড়ি দেখতাম, যেটায় লেখা ছিল "ভাষাশহীদ ***** (সম্ভবত বরকত) এর পরিবারের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত বাসভবন"। পরে শুনেছিলাম, ঐ জায়গা যারা নিয়েছিল, তারা আসলে প্রতারক! খুব কষ্ট পেয়েছিলাম খবরটা শুনে।

পত্রিকায় যখন পড়ি দেশের জন্য এত ত্যাগ করার পর (প্রকৃত) মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের পরিবার কষ্টে দিন পার করছেন, তখন জাতি হিসেবে লজ্জা পাওয়া ছাড়া কোন গতি থাকে না।

আবেগে ভেসে গিয়ে অনেক কথা বলে ফেলেছি মন্তব্যে।

আপানাকে শুভেচ্ছা, ইমরান কায়েস হাসি
ভাল থাকুন।

এস এম নিয়াজ মাওলা এর ছবি

আরো আরো অনেক লেখা আশা করছি আপনার থেকে।
ভালো থাকুন অবিরত।

-------------------------------------------
এমনভাবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নাকি
ভিড়ের মধ্যে ভিখারী হয়ে মিশে যাওয়া?
এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গ থেকে ধুলোর মর্ত্যে
মানুষ সেজে এক জীবন মানুষ নামে বেঁচে থাকা?

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ছোট্ট একটা গল্পের মধ্যে যেভাবে তুলে এনেছেন ছোট্ট ছোট্ট স্থির চিত্র, তাতে করে আপনার কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেলো অনেক। পরের বার টাইপোগুলো খেয়াল রেখেন তাইলেই হবে। (লেখার ঘন্টাখানেক পরে একবার পড়ে নেবেন, তারপর সাবমিট করবেন। তাহলে টাইপোগুলো দৌড়ানোর জায়গা পাবে না!!)

____________________________

তীরন্দাজ এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর একটি লেখা পড়লাম। এতো বেশী মমতার রঙে সাজানো চিত্রকল্প, সবার জানা কাহিনীর শৈল্পিক পরিবেশন! ভালো থাকবেন।

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।