কিছু স্মৃতি-বিভোরতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৩/০৪/২০১৪ - ১০:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শরতের ভোরে আমি চুপি চুপি পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াতাম সবুজ ঘাসের মাঠে। স্যান্ডেল খুলে নগ্নপায়ে হাঁটতাম শ্যামল কোমল শীতল ঘাসের উপর। প্রকাণ্ড সোনার থালার মতন চাঁদ উদিত হতো পূর্ব দিগন্তে। ঝোপের ভেতর ছোট ছোট বেলীফুলগুলিতে, ঘাসে ও গাছের পাতায় বিন্দু বিন্দু শিশির লেগে থাকতো অশ্রুবিন্দুর মতন। নবারুণের সোনালি আভায় শিশিরবিন্দুগুলি হীরের কুচি হয়ে উঠতো। মনে হতো, বুনোফুল ঘাস আর পাতাগুলি সেজেছে হীরের আভরণে। ঘাস পাতা আর বুনোফুলগুলি আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। শীতলতা ও কোমলতায় আমার অন্তরাত্মা ভরে যেতো। আঙুলগুলি সিক্ত হয়ে উঠতো। দু’হাত ভ’রে শিশিরের হীরককুচিগুলি আমার কপোলে মেখে নিতাম। প্রজাপতি আর ঘাস ফড়িঙেরা খেলা করতো আমাকে ঘিরে। আমি তাদের একজন হয়ে যেতাম। হয়ে যেতাম, একটি পাপড়ি, একটি পাতা, একটি ঘাস, একটি ফড়িং, একটি প্রজাপতি কিংবা একবিন্দু শিশির।

নির্জন রাতে জানলার ধারে বসে রইতাম আমি। সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। জেগে রইতাম আমি। আমার সাথে জেগে থাকতো একটি আকাশ, আকাশের অনন্ত নক্ষত্র, একটি চাঁদ, জানলার পাশের গাছগাছালিরা, বুনো ফুলের সুবাস, কিছু উদাসী বাতাস, নির্জনতা, আর অগণিত জোনাকি। নারকেল সুপুরি গাছের ওপার হতে চিরল চিরল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দিতো আমায়। আমি আর চাঁদ চোখাচোখি হতাম। আমার মুখে গ্রীবায় চুলে চোখের পাপড়িতে জোছনা খেলা করতো। নক্ষত্রের ফুল ফুটতো দূরের আকাশে। ওদের দৃষ্টি আর আমার দৃষ্টি মিলে যেতো। ওরা মিটিমিটি হাসতো আমার পানে চেয়ে। আমিও হাসতাম তাদের পানে চেয়ে। গাছের পাতার মৃদু বাতাস আমার কপোল ছুঁয়ে যেতো পরম আদরে। আমার চুল এলোমেলো করে দিতো। রিনিরিনি গানে আমাকে শোনাতো ওদের কতো কালের না বলা কথা! আমি পরান পেতে শুনতাম তাদের কথা। আমার কথাও গুনগুন করে বলতাম তাদের। পাতাদের নিঃশ্বাসে সাথে আমার নিঃশ্বাস মিশে যেতো। জোনাকিরা আলোর মালা গেঁথে আমার গলে পরাত। আমি নির্জনতা ও নৈঃশব্দের মাঝে গাছের পাতা, চাঁদের জোছনা, মৃদু বাতাস, অনন্ত নক্ষত্র, জোনাকি ও রাতের সাথে একলা হয়ে তন্ময়তায় বিভোর হয়ে রইতাম। মনে মনে চাইতাম, এই ক্ষণ, এই আবেশ, যেনো অনন্ত হয়। আমি যেন এভাবেই বেঁচে থাকি। এভাবেই যেনো মরে যাই।

আঁকাবাঁকা মেঠোপথের ধারে আমি দাঁড়িয়ে রইতাম। আম বাগানের ভেতর দিয়ে, কাঁঠাল বাগানের পাশ দিয়ে, ক্ষেতের ধার দিয়ে, কবিতাদের বাড়ির ধার দিয়ে, শিল্পীদের বাড়ির কাছ দিয়ে নদীর মতন এঁকে বেঁকে, হাঁসের মতন কোমর দুলিয়ে ওই পথ কোথায় কোন সুদূরে চলে গিয়েছে; ভেবে ভেবে বিহ্বল হতাম। কতো চেনা-অচেনা পথিক ধুলো উড়িয়ে হেঁটে যেতো সেই পথ দিয়ে। হারিয়ে যেতো পথের বাঁকে। আমার চোখের অদৃশ্য হয়ে যেতো। কতো গরু হেঁটে যেতো রাখাল বালকদের সাথে গোধূলি উড়িয়ে। আমি পথের বুকে তাদের পদচিহ্নের দিকে চেয়ে ভাবতাম, এতো এতো পথিকের পদধ্বনি, পদচিহ্ন, গন্তব্য সব কি তোমার মনে গেঁথে থাকে, হে বাঁকা মেঠোপথ? পথকে আমি শুধাতাম, কোন সুদূরে, কোন অজানায় চলে গিয়েছ তুমি? তোমার বুকে হেঁটে সবাই আপন আপন গন্তব্যে পৌঁছয়, তোমার নিজের গন্তব্য কোথায়? তাকে বলতাম, আমার নিয়ে যাবে কি পৃথিবীর শেষপ্রান্তে? আমিও তোমার মত পেরিয়ে যাবো অন্তহীন পথ। পথ বোবা হয়ে রইতো। কথা কইতো না।

কাল বোশেখীতে আকাশ-পাতাল কালো হয়ে ঝড় আসতো। বড় বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়তো। ঘরের চাল উড়ে যেতো। শীলা পড়ে ফসল নষ্ট হতো। এলোমেলো হয়ে যেতো সবকিছু। তবুও সেই ঝড় ছিল আমার কাছে উৎসবের মতন।বৈষয়িক ক্ষয়-ক্ষতি কী হচ্ছে সেটা আমি বুঝতাম না। বিশাল বিশাল ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তো। বৃষ্টির সাথে ঝুরঝুর করে পড়তো শীলা। আমি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যেতাম। পাতিল নিয়ে দৌড় দিতাম শীলা কুড়াতে। অজস্র শীলায় পাতিল ভরিয়ে ফেলতাম, ভরিয়ে ফেলতাম কোঁচড়। টপাটপ কয়েকটা মুখে পুরে দিতাম। মনে হতো, এমন অমৃতের ন্যায় উপাদেয় খাদ্য আর জীবনে খাইনি। পাতিল ও কোঁচড় ভর্তি শীলা ঘরে নিয়ে আসতাম। একটু পরেই গ’লে জল হয়ে যেতো। ফেলে দিতাম। তেমনি ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা আম কুড়াতে আনন্দ লাগতো। কাঁচা আম খাওয়ার শখ আমার তেমন ছিল না। কুড়াতে ভাল লাগতো। তাই কুড়াতাম। মনে মনে চাইতাম, এমন ঝড়, এমন কাল বোশেখী, এমন শীলাপাত প্রতিদিন হোক।

পুকুরের পারে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ জলের পানে আমিও স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইতাম। জলের সাথে মনে মনে কথা বলতাম। কখনও তাকিয়ে দেখতাম, পুকুরের ওপারে সবুজ ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। তারপর সারি সারি কয়েকটি বাড়ির পুকুরের পার দেখা যেতো। তারপর নাকি বাজার, তারপর চৌরাস্তার মোড়, তারপর আরও ফসলের মাঠ, আরও বাড়ি, আরও পুকুর, আরও জনপদ। তারপর নাকি হাট। আমার দৃষ্টি যেতো না অতদূর। অন্য বাড়ির পুকুরপারের গাছগাছালিতে গিয়ে ঠেক যেতো। আমি মনের চোখ দিয়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে, মনের মাঝে দেখে নিতাম না দেখা জায়গাগুলি, দৃশ্যগুলি, আরও আরও জনপদগুলি, পুকুর, গাছপালা ও রাস্তাগুলি। মাঝেমাঝে মৃদু বাতাসে পুকুরের স্তব্ধ জল ঝিরঝিরিয়ে কেঁপে উঠতো।জলের সেই কম্পনে আমার মনেও কম্পন লাগতো। আমার চুল উড়তো দক্ষিণা বাতাসে। চোখের পাপড়িতে কম্পন ধরতো। আবার তাকাতাম সুদূরের পানে। দেখতাম, দীপুদের বাড়ির ওই পাশটার একটু দূরে আকাশ মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। আমার মনে হতো, ইশ! একবার যদি ছুটে যেতে পারতাম ওই পর্যন্ত! একটা দৌড় যদি লাগাতে পারতাম! আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। আকাশের নীল মেখে নিতাম গায়ে, মুখে, চোখে, চুলে, খুব করে। মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। অশ্রুসজল উড়ন্ত মেঘ থেকে ওর কান্নার জল পান করতে পারতাম বুক ভ’রে। খুব বেশি দূর তো নয়! সবাই যেতো ওই দিকটায় ঘুড়ি ওড়াতে। আমি যেতে পারতাম না। আমি শুধু চাতকের মতন তাকিয়ে থাকতাম, মেঘ ছুঁয়ে উড়া ঘুড়ির পানে, দিগন্তে নুয়ে পড়া আকাশের পানে।

আজও নিঃশ্বাস টানলে যেনো সেই সময়ের গন্ধ পাই। স্মৃতির পাতাগুলি উল্টাতে থাকে একে একে। তন্ময়তায় বিভোর হয়ে থাকি কিছুক্ষণ।

তামান্না ঝুমু


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

নগণ‌্য পাঠক হিসেবে মন্তব্য করছি, যদিও সাহিত্যে আমার দখল নেই তেমন।

আপনার পদ্যময়তায় মোড়ানো লেখা ভালো লাগছিল, আপনার বাংলা বাক্য নিয়ে খেলার ক্ষমতাও ঈর্ষণীয়। কিন্তু, দুটো অনুচ্ছেদ পড়ার পর মনে হচ্ছিল যে একই ধরণের জিনিসই পড়েই যাচ্ছি, পরেরটুকু পড়ার ইচ্ছে মিইয়ে আসছিল সাথে সাথে। সত্যি বলতে, একটু একটু একঘেঁয়েও লাগা শুর হচ্ছিল শেষের দিকে আসতে আসতে।

এধরণের লেখা আরেকটাু ছোট আকারের হলে মনে হয় ভালো লাগে বেশি।

[এই আলোচনা পুরোটাই পরামর্শ; 'খুঁত সন্ধান' না। আর, একে সাধারণ পাঠকের ভাবনা ধরে নেবেন। আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে আপনার কবিতা লেখার হাত খুব চমৎকার হবার কথা]

আশা রাখছি কোনভাবে আহত করিনি।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার মনে হয় সকল ভালো লাগা অনুভূতিগুলি অনেকটা একই রকম।একবিন্দুতে এসে মিলিত হয় সব ভালোলাগা। তাই তার প্রকাশ ও প্রকাশের ভাষা কিংবা অভিব্যক্তিও এক রকয় হয়ে যায়। আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
'খুঁত সন্ধান' মানে ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেবার কথা যে বললেন, সেটা করলে আরও খুশি হবো। আমি নিজের লেখা আরও শোধরে নিতে পারবো তাহলে।
তামান্না ঝুমু

মেঘলা মানুষ এর ছবি

উদারভাবে বিষয়টা নেবার জন্য ধন্যবাদ।

ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: ধরুন, আমি গান গাইতে পারি না, সাধারণ একজন শ্রোতা। কিন্তু, গান শোনার আসরে বসলে হয়ত গায়ককে বলে বসতে পারি, এবার একটা রবীন্দ্র সংগীত ধরুন না হয়, অনেক কয়েকটা আধুনিক গানই তো করলেন।

আপনাকে আবারও শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রকাণ্ড সোনার থালার মতন চাঁদ উদিত হতো পূর্ব দিগন্তে।
চাঁদের জায়গায় পড়ুন সূর্য।
তামান্না ঝুমু

এক লহমা এর ছবি

প্রতিটি স্তবক-ই সুন্দর। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এক-মাত্রিক হয়ে রয়ে গেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি শুধু প্রকৃতি নিয়ে আমার একান্তের কিছু অনুভূতি। তাই হয়ত এক-মাত্রিক। ধন্যবাদ আপনাকে মতামতের জন্য।
তামান্না ঝুমু

অতিথি লেখক এর ছবি

কয়েকবার পড়তে বাধ্য হলাম; ভালো লিখেছেন।

সদস্যনাম: Jon Rulz

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ
তামান্না ঝুমু

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আগামাথা কিছু বুঝলাম না। প‌্যানপ্যানানি মনে হলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

তাই?
তামান্না ঝুমু

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা হাত অসাধারণ ।শুধু প্র্যকটিস বাড়াতে হবে।লেখাটা কেন জানি আটকে থাকা মনে হয়েছিল।দয়া করে নেগেটিভলি নিবেন না
~ধ্রুবক

অতিথি লেখক এর ছবি

নেগেটিভভাবে অবশ্যই নিইনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

পদ্যময় সাবলীল গদ্যরচণা ভালোই লেগেছে যদিও শুরু থেকে শেষ বিষয় বস্তু এক থেকে গেছে। প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে স্মৃতি চারণ এর সাথে মানুষের সংযোগ আসলে সেটা হয়তো স্বার্থক হতো। যেমন সময় কে বুঝা যায়নি লেখায়, কোন সময় নিয়ে স্মৃতিচারণ এটি।

কিছু শব্দ প্রয়োগে, লেখার বর্ণনা ধারায় লেখাটিকে অনেক বেশি হুমায়ুন আজাদ প্রভাবিত মনে হয়েছে। যদি তাই হয়েও থাকে তারপরও বলতে হবে আপনার নিজের শব্দ ভান্ডার যথেষ্ট শক্তিশালী। শুভেচ্ছা।

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

এই সুযোগ পেলেই একা একা প্রকৃতি উপভোগের অনুভূতি ও স্মৃতিগুলি আমার একান্তের। সে সময় ও ভালোলাগাগুলির আসলে কোনও সঙ্গী বা অংশিদার ছিল না। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্যও।
তামান্না ঝুমু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।