বিশ্বজিৎ মুণ্ডাদের জীবনচরিত

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৩/১০/২০১৪ - ১২:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বছর চারেক আগে!
চুনারুঘাটের সীমানা থেকে ফিরছিলাম আমরা!
বাহন ছিলো মোটরসাইকেল!
তাই মন চাইলেই থামছিলাম, মন চাইলেই ছুটছিলাম!
এমন করতে করতে চোখ পড়েছিলো সুরমা টি এস্টেটের সুরম্য বাগানে! মনেও বেশ ধরেছিলো বাগানটা!
তাই মটরসাইকেলের মাথা ঘুরিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে বাগানের ১০ নং বিভাগের দানবাকৃতির বটগাছের সামনে এসে বিস্ময়ে থামিয়েছিলাম পথচলা!
সেখানে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে পরিচয় হয়েছিলো একজন মানুষের সাথে!
নাম তার বিশ্বজিৎ মুণ্ডা!

বিশ্বজিৎ মুণ্ডা সুরমা চা বাগানের ১০ নং বিভাগের বেসরকারী প্রাইমারি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক!
অল্প যেটুকু সময় কথা হয়েছিলো, তাতে বিচ্ছিন্নভাবে উঠে এসেছিলো চা শ্রমিকদের কিছু সমস্যার কথা!
কিন্তু সময় কম থাকায় বেশিদূর এগোয়নি সেসব আলাপ!
ফিরে আসার আগে বিশ্বজিৎ মুন্ডাকে কথা দিয়েছিলাম, বেশি সময় হাতে নিয়ে আরেকদিন আসবো!
কিন্তু মুখে বললেও অনেক কিছুই করা হয়ে ওঠে না নাগরিক মানুষের পক্ষে! তাই হয়ে ওঠেনি আমাদের আসাও! তবে মনে একটা ইচ্ছে সুপ্তভাবে ছিলোই- কাছাকাছি কখনও এলে খুঁজে নেবো বিশ্বজিৎ মুণ্ডাকে!

এবার হবিগঞ্জ ঘুরতে এসে মনে পড়লো বিশ্বজিৎ মুণ্ডাকে দেওয়া কথার বিষয়টা!
সুরমা চা-বাগানের এতো কাছাকাছি যেহেতু এসেছি, সেহেতু ঘণ্টাপাঁচেক সময় হাতে নিয়ে ছুটলাম তাকে দেওয়া কথা রাখতে!
তবে এক্ষেত্রে সমস্যা ছিলো দুটো!
এক, সেদিন তাড়াহুড়োয় ঠিকানাটা রাখিনি তার!
দুই, এতো অল্প সময়ের পরিচয়ে তিনি কি মনে রেখেছেন আমাদের কথা?

সে যাই হোক, ভবিষ্যতের সমস্যা নিয়ে আগাম মাথা না ঘামিয়ে চলে গেলাম সুরমার ১০ নং বিভাগে!
সেখানে থেমে ‘বছর চারেক আগে চা খেয়েছিলাম যে দোকানে’, তার পাশের ছোট একটা মুদিখানায় জানতে চাইলাম বিশ্বজিৎ মুণ্ডার কথা!
হ্যাঁ, একনামে ‘স্যার’কে চিনলো সবাই এবং জানালো, তার বাড়ি রেঙ্গুটিলায়!
অতএব মিটলো সমস্যার প্রথমটা!

রেঙ্গুটিলা যেতে তেলানিয়া ছড়ায় পা ভিজাতে হয়!
তারপর ভেজা পায়ে বাঁশঝাড় পাড় হয়ে, বেলতলা-ফুলতলার নিচ দিয়ে লালচে মাটির পথ মাড়িয়ে পৌঁছতে হয় বিশ্বজিৎ মুণ্ডার বাড়ি!
সে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে মাটি লেপা উঠানের তুলসি বেদীর সামনে দাঁড়ালাম আমরা!
ভেতরে খবর পাঠালাম!
কিন্তু জানা গেলো, উনি বাড়ি নেই- গিয়েছেন ক্ষেতে!
সুতরাং এবার এগোলাম ক্ষেতের দিকে!

মিনিট পনেরো হাঁটতেই আবার পৌঁছলাম তেলানিয়া ছড়ার অন্য একটা অংশের সামনে!
সেখানেই ক্ষেত! সেই ক্ষেতে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করছেন বিশ্বজিৎ মুণ্ডা!
আমাদের অপ্রত্যাশিত আগমন আলোড়ন তুললো বিশ্বজিৎ মুণ্ডার স্মৃতির ধূসর কোষে!
সেখানে কী বর্ণহীণ বিস্মরণ?
না, বিস্মরণের বাঁধা অনায়াসে অতিক্রম করলেন তিনি!
স্বেদ-ক্লেদভরা বুকের উষ্ণতায় আমাদের জড়িয়ে ধরে উঠে এলেন কাজ ফেলে, বসলেন একটি চায়ের দোকানে! তারপর শুরু হল গল্প!
জীবনের গল্প!

বিশ্বজিৎ মুণ্ডার ঠাকুরদা বনমালি মুণ্ডা পেশায় কৃষক ছিলেন! বাবা অমৃতলাল মুণ্ডা ছিলেন চা শ্রমিক! শুধু তাই নয়, তিনি ইউপি মেম্বারও হয়েছিলেন একবার, হয়েছিলেন সুরমা চা বাগানের শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি! নিজের জীবনের গল্প থেকে একসময় সরে এলেন বিশ্বজিৎ মুণ্ডা!
শুরু করলেন চা বাগানের গল্প, চা-শ্রমিকের মানবেতর জীবনযাপনের গল্প!

বিশ্বজিৎ মুণ্ডার সাথে কথা বলে জানা গেল, হাতে কাজ থাকলে একজন চা-শ্রমিক বাগানে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে যে মজুরি পায়, এই মজুরিতে পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই ৮ ঘণ্টা শ্রম কিনতে পারা যায় না!
একটা পশুকে ৮ ঘণ্টা খাঁটিয়ে যে পরিমাণ যত্ন করতে হয়, তার অর্থমূল্য নিশ্চিতভাবেই একজন চা-শ্রমিকের মজুরির চাইতে অনেক বেশি, বলতে বলতে একটা তিক্ত দীর্ঘনিঃশ্বাস নেমে এল বিশ্বজিৎ মুণ্ডার বুক চিড়ে!

বিশ্বজিৎ মুণ্ডার সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে চায়ের দোকানে প্রবেশ করলেন মাখনলাল ভূইয়া!
পঞ্চাশোর্ধ বয়সের প্রাক্তন এই ইউপি মেম্বারও যোগ দিলেন আলোচনায়!
তিনি জানালেন রেশনের কথা- একজন চা শ্রমিক ব্রিটিশ আমলে যে পরিমাণ রেশন পেত, বাংলাদেশ আমলে কি সেই রেশনের পরিমান বেড়েছে গ্রহণযোগ্য হারে?

কথায় কথায় উঠে এল ভূমির কথাও!
যে ভূমিকে বাপ-দাদার আমল থেকে আঁকড়ে আছেন চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী, সেই ভূমিতে তিল পরিমাণ জন্মেনি তাঁদের স্বত্ব!
বঞ্চিত এই মানুষগুলো সকালে ঘুম থেকে ওঠে, লাইন চৌকিদারের নির্দেশনা অনুসারে বাগানের কাজে যায়, কাজ থেকে ফিরে কিছু একটা মুখে দিয়েই তারা সারা দিনের বঞ্চনা ভুলে যেতে উপস্থিত হয় নেশার আখড়ায়- রোজগারের সিংহভাগ, কখনওবা পুরো রোজগারই বিকিয়ে দেয় তারা লাঙ্গি কিংবা হাড়িয়ায়!
তবে একেবারে কিছুই যে পায়নি তারা সেটাও ঠিক নয়!
দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবের কাছ থেকে ভোটের অধিকার পেয়েছে তাঁরা!
কিন্তু সে অধিকার প্রাপ্তির পরও যদি জীবনমান আটকে থাকে পশুত্বের প্রান্তসীমায়, তবে কি লাভ তা পেয়ে?
এসব প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আমাদের!

একসময় চায়ের লিকারকে বলা হতো ‘চা শ্রমিকের রক্ত’! কিন্তু এখন আর বলা যাবে না সেটাও!
কারণ, ক্রমাগত অনাহার-অর্ধাহার, অবহেলা-অপমান তাঁদের শরীরের রক্তকে পরিণত করেছে টলটলে জলে! আর সেই জলের দিকে তাকিয়ে দেখার অবসরও আজ কারো নেই!

দীপংকর চন্দ

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ একটা লেখা চলুক

ফাহিমা দিলশাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ ফাহিমা দিলশাদ।

আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ উপস্থিতিতে।

শুভকামনা। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চলুক 'দি মোটর সাইকেল ডায়েরী'!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

'দি মোটর সাইকেল ডায়েরী'

না, ভাই!
তেমন লেখার স্বপ্ন দেখি না কখনও!
সীমিত সাধ্যের সাথে সাদামাটা লেখার সমন্বয়ের চেষ্টা কেবল!
অনেক ভালো লেখেন আপনি।
শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

মেঘলা মানুষ এর ছবি

কেই বা ভাবে ওঁদের কথা। ওদের তোলা পাতাতেই প্রতিদিন সকালে চা হচ্ছে, কিন্তু মনাবেতর জীবন থেকে ওদেরকে বের করে আনার কেউ নেই মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

কেই বা ভাবে ওঁদের কথা। ওদের তোলা পাতাতেই প্রতিদিন সকালে চা হচ্ছে, কিন্তু মনাবেতর জীবন থেকে ওদেরকে বের করে আনার কেউ নেই

অনেক মন ছোঁয়া মন্তব্য!

অনেক সাধারণ মানুষ আমি।
জানি লেখার চেষ্টার মানও সাধারণ!
মন ছোঁয়া মন্তব্য অনুপ্রাণিত হতে সাহায্য করে ভীষণ!

শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।