আমাদের গল্পগুলো - ১ম পর্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/১২/২০১৪ - ৯:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[b]স্বপ্নের জোনাকিপোকা[/b]

১০ ডিসেম্বর

আমার মনে হচ্ছে আমি একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছি। আমার আম্মুর ভাষায় আমার জ্ঞান-বুদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু এই বড় হয়ে যাওয়াটা কেন যেন আমার ভালো লাগছে না। আমার ইদানিং খুব ইচ্ছে করে আম্মুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে কিন্তু পারছি না। সেদিন অনেক বুদ্ধি করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আম্মুর পাশে শুয়ে শুয়ে বলেছিলাম -

" আচ্ছা, আমাদের ফ্যামিলির মতো কি আরো অনেক ফ্যামিলি আছে?

আম্মু কেমন রাগী রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো। দেখে মনে হচ্ছিলো আমাদের স্কুলের সমাজ ক্লাস নেয় তাহেরা মিস তাকিয়ে আছে। বললো -

আমাদের ফ্যামিলির মতো মানে? আমাদের ফ্যামিলিটা কেমন ?

এই যে আমরা যেভাবে থাকি আর কি ! একটু নিচু স্বরে বললাম আমি।

আম্মু মুখ শক্ত করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো - আমরা কীভাবে থাকি ?

আমি আম্মুর চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের নখ খুঁটতে থাকি। আমি জানি আম্মুর বড় বড় চোখ গুলো এখন আরো বড় লাগছে দেখতে। আর এরকম ঠাণ্ডা গলার আওয়াজে আমার পেটের ভিতরটা কেমন তিরতির করে কাঁপতে থাকে।

কী হলো বুবুন, বলছো না কেন আমাদের ফ্যামিলিটা কেমন ?

এই যে আমাদের তিনজনের বাসা - আমি, তুমি আর নানী !

এতে সমস্যা কোথায় হচ্ছে তোমার ?

কোনো সমস্যা নেই। এমনিতেই জানতে চাচ্ছিলাম এমন আরো ফ্যামিলি আছে কিনা !

হুম আছে তো। মুনাফদের ফ্যামিলিটা এমন, আদিবারাও ওর নানীকে নিয়ে থাকে। কয়দিন পর পর যত সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথ বলো !"

আমি আর পরে আম্মুর সাথে কথা বাড়াইনি। আমার হাতে এখন হুমায়ুন আজাদের " বুক পকেটে জোনাকিপোকা " বইটা। এই বইয়ের শেষের গল্পটার নাম - গাড়লস্তানে এক বিকেল। পুরো গল্পটা এখনো পড়িনি। এই গল্পের শুরুটাই হয়েছে স্বপ্নের কথা দিয়ে। আমি এখন চাইলেই চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখতে পারি কিংবা চোখ খুলেও। এখন শীতকাল আসি আসি করছে। পুরো শীত গত বছরের মতো পড়েনি। বিকেলটা কেমন টুপ করেই ফুরিয়ে যায়। আমি জানালার পর্দাগুলো টেনে ঘরের মাঝে একটা অন্ধকার ভাব এনেছি। এবার আমার বুক পকেট থেকে মুঠো মুঠো জোনাকিপোকা ছেড়ে দিবো। ওদের আলোটা অনেক নরম, সবুজ!

আমার রোজনামচা পর্ব

" প্রিয় শ্রাবণ,

অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম ঘুমোতে। ঘুমটাই চটে গেলো বুবুনের কথা শুনে। আজকাল ও অনেক কিছুই আমার কাছে জানতে চায় অনেক কায়দা করে। কিন্তু বুবুনকে সবকিছু বলার মতো সময় এখনো আসেনি। ঘুমোবার চেষ্টা করতে গিয়ে উলটো ফল হচ্ছে আমার এখন প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। নিশ্চয়ই বলবে - ঘুম না এলে জোর করে ঘুমোবার দরকার কি। বই বা ম্যাগাজিন পড়, পুরনো লেখালেখির অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনো! হুম চাইলে এসবের কিছু একটা করা যেতো কিন্তু তুমি তো জানো আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলসেমি ভর করেছে। এই যে এখন শুয়ে শুয়ে যে ডায়েরি লিখছি তাতেই ঘাড় ব্যথা করছে। ক'দিন ধরেই ঘাড় ব্যথা হচ্ছিলো বলে ওষুধ খাচ্ছিলাম। কিন্তু একটুও কমেনি ব্যথা। তোমাকে বলতে খেয়াল ছিলো না আমার পুরনো ভয়াবহ ধরণের মাথা ব্যথাটাও আবার ফিরে এসেছে। খোঁচা দিয়ে দিয়ে দুই পাশে চাপ দিয়ে ব্যথা। থাকুক আমার ব্যথার খবর।

বিকেল সোয়া চারটা বাজে। মা গ্রামের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এখনো ফেরেনি। অথচ আজকেই ফেরার কথা ছিলো। কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিলাম, বলেছে ড্রাইভারকে সন্ধ্যায় পাঠাতে।

মা বাসায় ছিলো না, স্বাধীনতা অনুভব করছি
মা বাসায় ছিলো না, বকা খাই নাই কারো কাছে, শূন্যতা অনুভব করছি!
আমাদের মন কতো অদ্ভুত তাই না ?

বুবুনের জন্য সন্ধ্যার নাস্তা রেডি করতে হবে। ও বলেছে আজ আলু পরোটা আর চিকেন ফ্রাই খাবে। এসব করতে হবে ভেবেই আরেক পাক আলসেমি এসে আঁকড়ে ধরতে চাইছে! আমি এমন হয়ে যাচ্ছি কেন বলো তো ?

আজ অনেকদিন পর মাথায় কিছু সাইকো টাইপ গল্পের লাইন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এগুলো লিখে না রাখলে হারাইয়া যাইতে পারে জানি কিন্তু লিখতে হবে ভেবে আঙুলও এডভান্স ব্যথা করতেছে। খ্যাক খ্যাক টাইপের হাসি আসতেছে ভেতর থেকে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নিজেই ভেতরে ভেতরে একটা সাইকো !!! এখন জিজ্ঞেস কইরো না " সাইকো আবার কী ?"

তোমার ফাপর-কুইন "

বৃত্তবন্দী শূন্যতা অথবা চতুরতা

বাইরে তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস! এটাকেই শৈত্যপ্রবাহ বলে নাকি! তাপমাত্রা মাইনাসের ঘরে এখন। কাচের জানালার বাইরে থোকা থোকা বরফ জমে দেয়ালের শুভ্রতাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের এমাথা ওমাথা হাঁটতে হাঁটতে শফিকের ভেতরে এসব দৃশ্যের সৌন্দর্য অবশ্য বাড়তি কোনো জায়গা করতে পারে না। বরং তীব্র রাগের একটা ঝলক ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করছে। উড স্ট্রীটের লেনে ঢুকতে না ঢুকতে বিষ্ণুদা গাড়িটা থামিয়ে বললো - কি ভাই দাওয়াত পানি দিবেন না ? শুনলাম আপনার এক্স ওয়াইফ বিয়া করতাছে ? রাইতে আপনার বাসায় আসতাছি, কথা আছে - বলেই চোখ টিপে। হারামজাদা মালাউনের বাচ্চাটা দেখা হলেই শফিকের পুরনো ক্ষতে খোঁচাখুঁচি করে। বাংলাদেশ ছেড়ে নিউইয়র্কে এসেও শফিক তার অতীতকে পিছু ছাড়াতে পারেনি। এখানে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি দেখলে মনে হয় শালারা এক একটা শকুনের দল, যেখানেই যায় সেখানেই মনে হয় হাগে। নিউইয়র্কে আসার পরপর এই বিষ্ণুদাই শফিক কে তার বাসায় থাকতে দিয়েছিলো, একটা কাজও জুটিয়ে দিয়েছিলো। তাই মুখের উপর তাকে কিছু বলতেও পারে না। একটু আগেই বিষ্ণুদা শফিকের রুম থেকে বের হয়েছে। জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও শফিক জানতে চেয়েছে -

আপনে কই থিক্যা জানলেন বুবুনের মায় বিয়া করতাছে?

আরে মিয়া আমার ছোট শালী তো পান্না ভাবীর এলাকাতেই থাকে। অইখান থেইকাই শুনছে মনে হয়।

হারামজাদী মাগীর সাহস কত্তো বিয়া করতাছে!

হ, আর কতো দিন, এমন জুয়ান বয়সে কি একলা থাকন যায়! তাও তো আপনেগো ডিভোর্সের ছয় বছর পর হেয় বিয়া করতাছে আর আপনে মিয়া পাঁচ দিনের মাথায় বিয়া কইরা ফালাইলেন! বলে বিষ্ণুদা হাসতে থাকেন।

ঐ মাগীর তেজ বেশি। সততা, মূল্যবোধ বালছাল লইয়া বেশি হিসাব করে। ক্যান রে ভাই একলগে থাকতে গেলে জামাই বৌয়ের কি ঝগড়াঝাঁটি ভুল বুঝাবুঝি হয় না? এক্কেবারে মুখ দিয়া যেইডা বাইর করবো হেইডাই ওর করন লাগবো। ভালো হইছে ওরে ডিভোর্স দিয়া। বলতে বলতে শফিকে মাথার পেছনে দুই হাত দিয়ে হেলান দিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে।

মিয়া বেশি প্যাকপ্যাক কইরেন না। আপনেগো তো আর ঝগড়াঝাঁটির কারণে ছাড়াছাড়ি হয় নাই। আপনের মিয়া খাউজ বেশি। ঘরে এমন টসটসা বৌ থুইয়া আপনে রাস্তাঘাটের মাইয়াগো যাইয়া পোন্দাইবেন আর আপনেরে পান্না ভাবী কি সেলাম করবোনি ? আর ডিভোর্স তো হেয় আপনেরে দিছে। হালা আপনে বেডা জাতির কলংক। বেডি হইয়া হেয় আপনেরে গোয়া মাইরা গেলো গা।

বিষ্ণুদা ভুল কিছু বলেনি কিন্তু এই সত্যগুলো শফিকের গায়ে কম জ্বালাও ধরাচ্ছে না। পান্না আবার বিয়ে করবে শোনার পর থেকে অসহ্য এক বুনো রাগে হাসফাঁস লাগছে শফিকের ভেতরটায়। তাই বিষ্ণুদাকে বলে ওঠে -
ধুর মিয়া আজাইরা কথা না কইয়া কামের কথা কন। বিয়াতে ক্যামনে প্যাঁচ লাগানি যায়। বিয়াডা বন্ধ করা দরকার।

এহ আপনে যহন বিয়া করছেন হেইডায় সমস্যা হয় নাই, এহন ভাবী বিয়া করলে আপনের এতো জ্বলে ক্যান। গা জ্বালানো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বিষ্ণু তাকিয়ে থাকে শফিকের দিকে। আপনে সত্যিই বুদ্ধি চান ?

আপনের লগে মিয়া মশকরা করি নি ?

মিয়া আপনে আবার আমার বুদ্ধির লইগা বইয়া থাকোনের মানুষ ! আমারেও কইলেন আর আমিও বিশ্বাস করলাম? আপনের প্রাক্তন শাশুড়ির লগে কাইন্দা কাইট্যা মিডা সুরে কথা কন দেখবেন পান্না ভাবীর বিয়া বন্ধ। এর আগেও তো যা যা চিপা দেওনের আপনের শাশুড়িরে ফুসলাইয়া ফুসলাইয়া করাইছেন। শাশুড়িরে কয়ডা টেকা পয়সা পাডান দেখবেন সব সমস্যার সমাধান।

বিষ্ণুদার প্রস্তাবটা মন্দ লাগে না শফিকের। শফিকের প্রতি তার প্রাক্তন শাশুড়ির দুর্বলতাকে প্রতি মুহূর্তেই শফিক জিইয়ে রেখেছে এই বলে - " আমার মা বেঁচে নেই। আপনাকেই মা বলে জানি"। এই লাইগ্যাই তো কই ওইদিন আমার শাশুড়ি কেন বুবুনরে আমেরিকায় আমার কাছে পাডাইতে চায়!

আপনে কি কইলেন?

কি আবার কমু ! কইছি বুবুনরে আমার কাছে আনলে ওরে দেখাশুনা করনের লাইগা তো তাইলে আমার তানিয়ারের আনন লাগবো। এহন বুঝলাম বুবুনরে ক্যান আমার কাছে পাডাইতে চায়। মাগী আরেকটা হাঙ্গা করবো!

তানিয়া জানি কে ? আপনের নতুন বৌ নাকি? যাই হোক ভাই এইবার উডি। নাইলে আপনের শায়লা ম্যাডাম রাগ করবো।

শায়লা আর তুহিন ভাইয়ের ফ্ল্যাটে শফিক একটা রুম নিয়ে সাবলেটে থাকে এখানে। বাসায় গেস্ট আসা আবার পছন্দ না শায়লা ভাবীর। শায়লা ভাবীর নাম শুনেই তার স্লিম ফিগার আর শাইনি রিবন্ডিং চুলের ছবিটা শফিকের মনে ভেসে ওঠে চকিতে।

চলবে

====

অপর্ণা মিতু


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

প্রথম অংশের বিষণ্নতা ভর করে অাছে। এক টা কিশোরের মনের অনেক গল্পের ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগাতে পরের অংশ দুটিতে মন দিতে পারছি না। পরে অাসবো। হ্যাপি ব্লগিং। সচলে নিয়মিত থাকো।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

ফাইনালি লেখা প্রকাশ হলো। বুবুনদের বয়স টা এমনই অনেক কিছু বুঝলেও তারা বলতে পারে না, তাদের বেদনা ক'জনেই বা আমরা অমন করে বুঝি!

অপর্ণা মিতু

তিথীডোর এর ছবি

নীড়পাতায় একই লেখকের দুটো লেখা পরপর, কাহিনি কী! অ্যাঁ

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

পারুলের সংসার গল্পটা আরো আগে পোস্ট করেছিলাম। এক সাথে কেন দুইটা লেখা পাব্লিশ হয়েছে আমিও জানি না তিথিডোর। শুভ কামনা রইলো।

অপর্ণা মিতু

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা চলুক চলুক

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ নাহিয়েন।

অপর্ণা মিতু

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মেঘলা

অপর্ণা মিতু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।