দুবাইয়ের পথে পথে - পর্ব ৪

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০২/০৫/২০১৫ - ২:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার ছোটবেলায় মাসুদ রানা পড়াটা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হত না - ইঁচড়ে পাকা বলে মনে করা হত ৷ তবুও লুকিয়ে চুরিয়ে প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই পড়া শুরু করলাম ৷ অ্যাকশন, এডভেঞ্চার আর লাস্যময়ী নায়িকা ভরপুর কাজী আনোয়ার হোসেনের এই অসাধারণ সিরিজ নিশ্চয়ই অনেকের মনে দাগ কেটেছে ৷ আরেকটু বড় হয়ে যখন ইংরেজিতে নানা থ্রিলার পড়া শুরু করলাম, তখন আবিস্কার করলাম এ গল্প তো আমার পড়া ! কাজীদা মাসুদ রানার বোতলে ভরে আগেই খাইয়ে দিয়েছেন ৷

দুবাইতে জেমস বন্ড বা মাসুদ রানার গল্পে পড়া অনেক "কর্মকান্ড"-ই করা সম্ভব, খালি পকেটটা ভারী হতে হবে আর কি ৷ তবে আজকের লেখাটা সেসবের বর্ণনা দেয়ার জন্য নয় - সেটা অফ টপিক ৷ ভেবেছিলাম আজকে আরেক মাসুদ রানার গল্প শুনাব - গল্পই, সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে ৷ কিন্তু পরে মনে হলো মন খারাপ করা গল্প বলতেও ভালো লাগবে না, পাঠকের পড়তেও ভালো লাগবে না ৷ তারচেয়ে বরং আপনাদের প্রথমে একটু দুবাইয়ের অলি গলি ঘুরিয়ে আনি ৷

প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ছবিগুলোর খারাপ মানের জন্য - আসলে যখন তুলেছিলাম তখন লিখব ভেবে তুলি নি - কয়েকটা ছবি ওয়েব থেকে নিয়েছি জায়গাটার চাল চরিত্রের একটু পরিস্কার ধারণা দিতে।এ জায়গার নাম হচ্ছে না'ইফ - একে দুবাইয়ের চকবাজার বলতে পারেন। অনেক ছোট মাঝারি ব্যবসায়ী হরেক রকমের দোকান খুলে বসেছে এখানে। গাড়ি আর প্লেন ছাড়া দুনিয়ার সব কিছু পাবেন এখানে। দুবাই বলতে যে আলিশান শপিং মল, আলোর ঝলকানি আর চকচকে মডেলের গাড়ি চোখের সামনে ভেসে উঠে তা এখানে পাবেন না। এখানে সব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ভীড় - কারো হয়ত নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, কারো হয়ত নুনই জুটে না !

ছোট ছোট খুপরির মত ঘরে অনেকে পরিবার নিয়ে থাকেন, অনেকে পরিবার পরিজন দুরদেশে রেখে ব্যাচেলর মেসে পরিবারের মত থাকেন। দুবাই জীবনের শুরুর দিকে প্রথম যখন এই এলাকায় আসি তখন বাংলায় হোটেল, বাঙালি সেলুন, সবজির দোকান দেখে অবাক হয়েছিলাম - আর মানুষের জীবনের গল্প শুনে হয়েছিলাম বাকহীন। কত দেশের কত মানুষ বাস করে এই এলাকায় - হয়ত একই ঘরে বাঙালি, পাঠানের সাথে থাকছে এক নাইজেরিয়ান। সারারাত নাইট ক্লাবে বাউন্সারের কাজ করে সারাদিনমান ঘুমিয়ে কাটায় - সন্ধ্যায় বাঙালি রুমমেটের রান্না করা ভাত মুরগি খেয়ে আবার ক্লাবের বেযাদপগুলোকে শায়েস্তা করতে বেরিয়ে যায়। এ এক আজব সহাবস্থান !!


ছোট বড় অনেক দোকানের মাঝে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা চলে এই এলাকায় (ছবি - ওয়েব)


এখানে পুরনো ধাঁচের অনেক দোকান এখনো সাজিয়ে রাখা আছে - প্রচুর পর্যটক আসেন এখানে অতীতের ছোঁয়া পেতে। (ছবি - ওয়েব)


এরই ফাঁকে চোখে পড়বে কোনো বাংলাদেশী দোকান (ছবি - ওয়েব)



দু' পাশে পসরা সাজিয়ে বসেছে নানা দেশের ব্যবসায়ীরা- দুইটা দশ তিনটা বারো, ডেকে চলেছে তারা বারোয়ারী ক্রেতাদের।


এরই মাঝে ঠেলা গাড়িতে মাল চাপিয়ে টেনে চলেছে মজুর - এদের প্রায় সবাই পাঠান বা আফগান। অধিকাংশেরই পাসপোর্ট বা ভিসা নেই, পুলিশের নজর এড়িয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যায় এই মানুষগুলো। দুবাইয়ের ঝাঁ চকচকে শান শওকতের মাঝেই এদের সংগ্রাম চলছে - যা হয়ত এত বেশি প্রচারিত হয় না।


এসব উজিয়ে একটু এগিয়ে গেলে সরু গলিতে পুরোনো বিল্ডিং - ছোট ছোট এপার্টমেন্টগুলো অনেক বড় বড় স্বপ্ন ধরে রাখে। এরকমই একটি বাসায় রানার স্বপ্নগুলো বন্দী থাকে।

এই না'ইফে এক বন্ধুর বাসার নিচে বাঙালি হোটেলে মাছ ভাত খাওয়ার সময় দেখা হলো রানার সাথে। বন্ধুর বিল্ডিংএই থাকে - সেই সুত্রে বন্ধুটি পরিচয় করিয়ে দিল। খেতে খেতেই আলাপ, পরিচয়, সখ্যতা। পরিচয় আরেকটু বাড়ার পর একদিন সে খুলে দিল তার গল্পের ঝাঁপি।

রানা বেশ উচ্চশিক্ষিত - দেখতেও বেশ, ছ'ফুটের মত লম্বা, দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ থেকে পাস করা স্মার্ট ছেলে ৷ রানার বাবা মারা গেছেন ছোট থাকতেই, ভুতের গলিতে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগে পাওয়া চার তলা বাড়ি আর চাচাদের ছায়া থাকায় খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি রানা ও তার ভাই বোনদের ৷ তবুও দায়িত্বশীল ছেলের মত ইন্টারের পর থেকেই টিউশন পড়িয়ে নিজের হাত খরচটা চালিয়ে নিত ৷

চৌকস এই ছেলের অনেকদিনের গার্লফ্রেন্ড মারিয়া - একই পাড়ার মেয়ে তাই অনেকেই ওদের সম্পর্কটা জানত ৷ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে মারিয়াকে নিয়ে সুখের সাগরে ভাসবে এই ছিল রানার পরিকল্পনা ৷ পাস করার পর বিদেশী একটা ব্যাঙ্কে ভালো একটা চাকরিও হলো রানার ৷ সব গুছিয়ে নিয়ে আর দুটি বছর - ব্যস ৷ কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আরেক; মারিয়ার বিয়ে হয়ে যায় কানাডা প্রবাসী কোনো চার্টার্ড একাউন্টেন্টের সাথে ৷ এই ধাক্কাটা দিশেহারা করে তোলে রানাকে - ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে মরিয়া হয়ে উঠে সে৷

এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে জুটিয়ে ফেলে দুবাইয়ের এক মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিতে কাউন্টার ক্যাশিয়ারের চাকরি। বেতন খুব বেশি নয় - এই হাজার পাঁচেক দিরহাম (দেড় হাজার ডলার) হবে সব মিলিয়ে। কিন্তু হতাশা আর লোকলজ্জা থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া রানা সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার ছেড়ে চলে এলো এই চাকরি নিয়েই স্বর্ণ নগরী দুবাইতে। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটি - সপ্তাহে একদিন ছুটি।

দুবাইয়ের ঝলমলে আলোকমালা আর বিলাসিতার হাতছানি যেন বদলে দিল রানাকে - মনের হতাশা ঢাকতে ভাসিয়ে দিল নিজেকে আয়েসী জীবনের স্রোতে ৷ বেতন তার তেমন বেশি ছিল না, কিন্তু রয়ে সয়ে চললে টিকে যাওয়া যায়৷ সচরাচর দুবাইতে যারা আসেন তারা অধিকাংশই সুস্থির এক জীবনের সূচনা করতে চান - দেশে বা দুবাইতে ৷ কিন্তু রানার মাথায় তখন "মাসুদ রানা" সওয়ার হয়েছে৷ এক মারিয়াকে হারিয়ে রানা এখন তাকে খুঁজে ফিরে হাজারো মারিয়ার মাঝে - নাইট ক্লাবের আলো আঁধারির ডিস্কোতে, সাদা গ্লাসের রঙিন পানিতে। জীবনের সব না পাওয়ার বেদনাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলে থাকতে চায় রানা।ভবিষ্যতের ভীত গড়া হয় না রানার - এক ঝোঁকের মাথায় দেশ ছেড়ে আরেক ঝোঁকের বশে সপে দিয়েছে তার জীবনকে।

প্রশ্ন করলাম - এভাবে আর কতদিন রানা? দেশে তোমার মা অপেক্ষা করে আছেন - ফিরবে না তুমি? বিষাদভরা দৃষ্টি নিয়ে চুপচাপ সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে যায় রানা। আমাদের দেশের কত তরুণ এরকম ঝোঁকের মাথায় জীবনটাকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা ভাবতে ভাবতে আমরা নেমে আসি আল রহমানিয়া হোটেলে মাছ ভাত খাওয়ার জন্য - পিছে পড়ে থাকে রানার সিগারেটের ধোঁয়া আর একরাশ স্বপ্ন।

মরুচারী


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

রানার বর্তমান জীবনে মারিয়ার স্মৃতিটা অজুহাত বলেই মনে হলো। লেখা ভালো লাগলো, মরুর জীবন আরো আসুক সবিস্তারে।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে - অজুহাত হয়ত রানা দিচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে এমন এক চক্র ছিন্ন করার মত মানসিক শক্তি রানা হারিয়ে ফেলেছে ৷ রানার মত তরুনদের নব উদ্যমে চলার প্রেরণা আমাদের মত স্বদেশী বন্ধুদেরই দিতে হবে ৷

মরুচারী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।