পাথরশ্রমিকের জীবন-জীবিকা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২২/০৫/২০১৫ - ৩:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তেঁতুলিয়া জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর দক্ষিণে বিনোদনকেন্দ্র। এগোলাম সেদিকে।
আপাতত জনবিরল সেই বিনোদনকেন্দ্রের কাছেই মো. ফরিদুল ইসলামের ছোট্ট দোকান। রকমারি খাদ্যসামগ্রীতে সাজানো সেই দোকানের পেছনেই তেঁতুলিয়ার প্রধান নদী মহানন্দা। এগিয়ে গেলাম নদীটির কাছে! এত কাছে যে চাইলেই স্পর্শ করা যায় এর জল! অথচ এলাকার মানুষজনের ভাষ্যে, মহানন্দার যে অংশটার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে এখন, আন্তর্জাতিক সীমারেখা আইন অনুযায়ী সে অংশের মালিকানা নাকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের!

নদীটিতে জল বেশি নেই! কোথাও কোমর সমান, কোথাও বুক সমান, কোথাও গলা সমান কিংবা তার চাইতে কিছু বেশি জল দু-এক জায়গায়! যত্রতত্র চর জেগেছে নদীটির বুক জুড়ে!
এই অবস্থা কেন মহানন্দার?
দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি ফুলবাড়ি এলাকায় মহানন্দার ওপর ভারতের স্লুইস গেট নির্মাণের কারণে, জানালেন স্থানীয় সংবাদকর্মী আবু তাহের আনসারী।

নম্র স্বভাবের এই সংবদকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঈদগাহ অতিক্রম করলাম আমরা। অতিক্রম করলাম থানা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকঘর। উপজেলা ভূমি অফিস পেছনে ফেলে জিয়ানগরে প্রবেশ করলাম। দু’কদম হাঁটতে না হাঁটতেই মহানন্দা আবার এসে দাঁড়াল সামনে। কাছেই জিয়ানগর ঘাট। এই ঘাট দিয়েই বেশ কিছু শক্ত-সমর্থ মানুষ কী যেন তুলে আনছে মহানন্দা নদী থেকে!
কী ওগুলো?
পাথর, নির্বিকার ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন আবু তাহের আনসারী।

প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে এ অঞ্চলের ভূমি খুঁড়লেই পাওয়া যায় প্রচুর পাথর! খানিকটা কষ্ট করে এই পাথর তুলতে পারলে সহজেই অর্থ উপার্জন করা যায়, জীবিকা নির্বাহ করা যায় স্বচ্ছন্দেই।
কিন্তু এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই ভূমিহীন। সুতরাং ভূমিই যাদের নেই, জীবিকা নির্বাহ করার উপায় কী তাদের?
তাদের প্রতি সদয় মহানন্দা নামের মাতৃসম নদীটি।
সীমারেখা অনুযায়ী যে দেশেরই হোক না কেন, এই নদীর তলদেশে পাওয়া যায় বিভিন্ন আয়তনের পাথর। বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি থেকেই এই অঞ্চলের অভাবী মানুষগুলো নদীতে নামে, সীমান্তরক্ষীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই নদী থেকে পাথর তুলে আনে।

কালো হাফ হাতা গেঞ্জি, বেগুনি রঙের হাফ প্যান্ট পরিহিত আবদুল হামিদ তেমনই একজন। আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এই পাথরশ্রমিকের বাড়ি জিয়ানগরেই। মহানন্দার গলাসমান জলে দাঁড়ানো আবদুল হামিদের সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বললাম আমরা।
কী করছেন?
পাথর খুঁজি। উঁচু গলায় জবাব দিলেন আবদুল হামিদ। তার হাতে দুই ফুট লম্বা লৌহদণ্ড। সেটা দিয়ে তিনি খুঁজছেন পাথরের অস্তিত্ব। জলের নিচে যখনই খোঁজ পাচ্ছেন পাথরের, বড় একটা হাত-কোদালের সাহায্যে তুলে আনছেন বালিসহ পাথর।
আবদুল হামিদের কোমরে বাঁধা কুনিজালসদৃশ লোহার শক্ত নেট। বালিসহ পাথর তুলে এনে তিনি ঢালছেন সেই নেটে। মহানন্দার পলিমিশ্রিত বালি নেটের ফাঁক গলে মিশে যাচ্ছে জলে। কিন্তু পাথরগুলো রয়ে যাচ্ছে ঠিকই। এবার তিনি নেট থেকে পাথর ঢালছেন ফোলানো একটা বিশালাকার টিউবের মাঝখানে। পাড়ে দাঁড়িয়ে আবার জানতে চাইলাম, কিসের টিউব এটা?
ক্ষীণ উত্তর ভেসে এল নদী থেকে, ‘ট্র্যাক্টরের বড় চাকার।’
টিউবটির মাঝখানের শূন্যস্থান আটকানো আছে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে। তাই সেখানে জমিয়ে রাখা যাচ্ছে তুলে আনা পাথরগুলো এবং টিউবটি ফোলানো বলেই এত এত ওজনের পাথর নিয়েও সেটি দিব্যি ভাসছে জলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো টিউব পাথরে পূর্ণ করে আবদুল হামিদ এলেন পাড়ের কাছাকাছি। এবার পাথরগুলো ভাঁড়ে ভরে কাঁধে তুলে পাড়ে নেবার পালা।

প্রতিটি টিউবের মাঝখানে কতটুকু পাথর জমা করা যায় প্রতিবারে? জানতে চাইলাম আমরা।
পাঁচ থেকে সাত সিএফটি।
প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে চারটা পর্যন্ত কাজ করেন আবদুল হামিদরা। এই সময়ের মধ্যে নদী থেকে তুলে আনা যায় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ সিএফটি পাথর।
তারপর?
তারপর সেই পাথর বিক্রি করে দেই মহাজনের কাছে।
মহাজন কী করেন এই পাথরগুলো নিয়ে?
মহাজন নিয়োগ করেন মহিলা শ্রমিক। তারা রাতদিন নেটিং করে আলাদা করেন বিভিন্ন আকৃতির পাথরগুলো। পরে এই আলাদা করা পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করেন মহাজন- যা প্রধানত ব্যবহৃত হয় রাস্তা নির্মাণে, ব্লক তৈরিতে, কার্পেটিং করার কাজে, বলতে বলতে একগাল হাসেন আবদুল হামিদ।
এরই মধ্যে আমাদের কথাবার্তায় যোগ দেন তেলিপাড়ার পাথরশ্রমিক মাহবুব, সাজু।
দুপুরের তপ্ত রোদ অগ্রাহ্য করে পাথর ভর্তি ভাঁড় বহন করে ওপরে ওঠাতে থাকেন মনসুর আলী। ভাঁড় ওঠাতে ওঠাতে গুনগুনিয়ে গানও গান একসময়।
বোঝা যায়, পাথর ঘিরে জীবন-জীবিকা আবর্তিত হলেও এখনো পাথর হয়নি তাদের মনগুলো!

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

নদীর স্রোতের সঙ্গে পাহাড় থেকে বয়ে আসা পাথর বছরের পর বছর ধরে জমেছে নদীর তলদেশে। এখন সেগুলো তুলে বিক্রি হচ্ছে। এই পাথর তুলতে গিয়েই সিলেট অঞ্চলের নদী এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের এখন বেহাল দশা। মহানন্দার অবস্থাও সেদিকেই যাচ্ছে?

লেখকের নাম কী?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

মহানন্দাই শুধু নয়, আমাদের প্রাকৃতিক আবর্তনচক্রের অবস্থা প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে হতাশাজনক।

নদী থেকে পাথর উত্তোলন নতুন কিছু নয় এবং সেটা পরিবেশ বিপর্যয়ের অধিপতি কারণও নয়।

উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর প্রবাহস্রোত বয়ে আনে বিভিন্ন আকার-প্রকারের পাথর, পলি, কাঁকর, বালি! নদীর প্রবহমানতা এবং জলজ প্রাণবৈচিত্র্য নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত রাখতেই প্রয়োজন পাথর উত্তোলন, কাঁকর-পলি-বালি নিষ্কাশন।

প্রকৃতি একটি সুনির্দিষ্ট আবর্তণচক্রকে লালন করে আন্তরিকভাবে। জীব ও জড়ের, পরিবেশ ও প্রাকৃতজনের সুষ্ঠু সমন্বয় বিরাজমান সেখানে।

প্রকৃতির এই আবর্তণচক্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই পুরুষানুক্রমে কিছু মানুষের জীবিকা হিসেবে উদ্ভুত হয়েছিলো নদী থেকে পাথর উত্তোলন। নদীর সাথে আত্মীয়তার সুবাদে দীর্ঘযুগ ধরে তাঁরা জানতেন কখন পাথর উত্তোলন করতে হয়, কীভাবে পাথর উত্তোলন করতে হয়, কী ধরনের পাথর উত্তোলন করতে হয় এবং কী পরিমান পাথর উত্তোলনে নদী ও নদীসংলগ্ন পরিবেশে সুস্থিতি বজায় থাকে!

নির্ধারিত কিছু মানদণ্ডকে নির্দিষ্ট ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে যে সমাজকে সভ্য বলা হয়, সে সমাজ সংগঠন প্রক্রিয়ায় পাথর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পুরুষানুক্রমিকভাবে পাথর উত্তোলন পেশায় নিয়োজিত মানুষ পরিবেশের ক্ষতির কারণ হয় না কখনওই। ক্ষতির কারণ হয় আদর্শবিবর্জিত অপেশাদার মানুষ, যারা সর্বোচ্চ মুনাফার প্রত্যাশায় পুঁজি বিনিয়োগ করে পাথর উত্তোলনে। এইসব মুনাফাকাঙ্ক্ষী অন্ধ মানুষের নীতিনৈতিকতাবিহীন, অপরিণামদর্শী আচরণে মূলত বিনষ্ট হয় পরিবেশ।

সচলায়তয়নে অচলদের লেখার নিচে যে নাম লিখতে হয়, ভুলে গিয়েছিলাম ভাই। এবং সেই ভুল সংশোধনের ব্যবস্থা সচলায়তনে খুঁজে পাইনি আমি।

আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।

ভালো থাকবেন। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধন্যবাদ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা সুলেখক। পুনরায়। অনিঃশেষ।

ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নদীর প্রবহমানতা এবং জলজ প্রাণবৈচিত্র্য নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত রাখতেই প্রয়োজন পাথর উত্তোলন, কাঁকর-পলি-বালি নিষ্কাশন।

অগ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা। প্রকৃতির কোন ব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য মানুষের হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল নয়। নদী থেকে পাথর উত্তোলন না করায় নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বা তার জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে এমন উদাহরণ একটাও দেখাতে পারবেন না।

বোমা মেশিন চালিয়ে পাথর তুললে যে নদী পাঁচ বছরে মরবে, ডুব দিয়ে তুলে টিউব ভরলে সেখানে ১০/১৫ বছরে মরবে।

প্রকৃতির এই আবর্তণচক্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই পুরুষানুক্রমে কিছু মানুষের জীবিকা হিসেবে উদ্ভুত হয়েছিলো নদী থেকে পাথর উত্তোলন। নদীর সাথে আত্মীয়তার সুবাদে দীর্ঘযুগ ধরে তাঁরা জানতেন কখন পাথর উত্তোলন করতে হয়, কীভাবে পাথর উত্তোলন করতে হয়, কী ধরনের পাথর উত্তোলন করতে হয় এবং কী পরিমান পাথর উত্তোলনে নদী ও নদীসংলগ্ন পরিবেশে সুস্থিতি বজায় থাকে!

অগ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা। একথা সত্যি যে মানুষ বহুকাল ধরে নদী থেকে পাথর তুলে আনছে। সেই সাথে একথাও সত্যি যে বহুকাল ধরে মানুষ নদী হত্যা করে চলেছে। গত চল্লিশ বছরে দেশে ১৮,০০০ কিলোমিটারের বেশি নদী হত্যা করা হয়েছে। বোমা মেশিন তো এই সেদিনের কথা, টুকরি ভরে বালি-পাথর তুলে হত্যা বহু কালের। বালি-পাথর তোলা বিলে মাছ ধরার মতো ব্যাপার নয়। এটা সব সময়েই সংঘবদ্ধ ব্যবসায়। বালি-পাথর ব্যবসায়ীরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বালি-পাথর উত্তোলন করিয়েছে, নদীর অবস্থা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায়নি। তাদের শ্রমিকরা পুরুষানুক্রমিকভাবে এই কাজ করে গেছে, কারণ বালি-পাথর তুলে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা অনিঃশেষ ষষ্ঠ পাণ্ডব।

ষষ্ঠ পাণ্ডবকেই তো প্রথম পাণ্ডব বলা যায় এক অর্থে, তাই না?

আপনার মতো একজন সুলেখকের উপস্থিতি ‘হয় কিংবা নয় ভ্রমণ’ এর মতো সামান্য লেখায় যুক্ত করে অনন্য মাত্রা।

প্রকৃতির কোন ব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য মানুষের হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল নয়।

বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতায় সম্পূর্ণভাবে আস্থা প্রকাশ করতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি ভাই।

মানুষ প্রকৃতির একটি অপরিহার্য এবং অতীব প্রয়োজনীয় প্রপঞ্চ। প্রকৃতির প্রতিটি প্রপঞ্চই জীবনচক্র ক্রিয়াশীল রাখার জন্য একে অপরের পরিপূরকসূত্রে নির্ভরশীল।

জীবনচক্র মানে শুধু আপাতদৃষ্টিতে জীবের জীবনচক্র নয়। জড়ও এই চক্রের সাথে ওতোপ্রোতভাবে অন্তর্ভুক্ত।

কোন কিছুই অবিনশ্বর নয় পৃথিবীতে। প্রাণীর যেমন জন্ম আছে, যৌবন আছে, আছে বার্ধক্য শেষে মৃত্যু- বিভিন্ন জড়পদার্থের ক্ষেত্রেও সেই অলঙ্ঘনীয় নিয়ম প্রযোজ্য। যেমন আপনার আমার পরনের জামাটিরও আছে একটি সুনির্দিষ্ট জীবনকাল। আপনি ব্যবহার করেন কিংবা তুলে রাখেন দীর্ঘযুগ যত্নে আলমারির আপাদনিরাপদ কোণে, একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে যেটি পরিণত হবে কালের উচ্ছিষ্টে।

নদীও ঠিক তেমনই সুনির্দিষ্ট জীবনচক্রের ব্যতিক্রম নয়। জীবনচক্রের নিয়ম অনুসৃত পথেই নদীর জন্ম হয়, উন্মাতাল শৈশব অতিবাহিত করে নদী, উপভোগ করে উদ্দাম যৌবন, তারপর বার্ধক্য, তারপর অন্তর্জলী যাত্রায় বিলীন।

মানুষের আয়ুষ্কাল এবং নদীর আয়ুষ্কালের মধ্যকার অপরিমেয় ব্যবধানের কারণে নদীর জীবনচক্র সহজে অনুধাবন করতে বেশ কষ্ট হয় আমাদের।

প্রসঙ্গ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করি এবার।

নদী থেকে পাথর উত্তোলন না করায় নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বা তার জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে এমন উদাহরণ একটাও দেখাতে পারবেন না।

গতিপথ রুদ্ধ হওয়া কিংবা জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কথায় পরে আসি। পাথর উত্তোলন প্রসঙ্গে এতটুকু বলতে পারি প্রথমত, মানুষ নদী থেকে পাথর উত্তোলন করুক আর না-ই করুক, প্রকৃতির নিয়মেই নদীর মৃত্যু হবে একদিন। নদীর মৃত্যু হলে গতিপথ রুদ্ধ হওয়া না হওয়ার সংশয় অবান্তর, অবান্তর নদীর প্রবহমানতায় জলজ জীববৈচিত্র্য অবস্থিতির প্রশ্ন!

ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস কিংবা বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নদীর যদি আকস্মিক মৃত্যু না ঘটে, তবে মানুষের পক্ষে কিন্তু সম্ভব নদীর অনিবার্য মৃত্যুপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নদীর জীবনকালকে দীর্ঘযুগ সজীব রাখা, প্রফুল্ল রাখা, প্রাণবন্ত রাখা।

বিভিন্ন দেশে নদীর জীবনকে নতুন জীবনদান কিংবা মরনোন্মুখ নদীর জীবনের পুনরুত্থানের দৃষ্টান্ত বিরল নয় আমাদের কাছে। নিয়মমাফিক নদীখননের মাধ্যমে, অপ্রয়োজনীয় পলি-বালি নিষ্কাশনের মাধ্যমে, সুপরিকল্পিত নদীশাসনের মাধ্যমে, নদীর তলদেশ এবং উপরিতলের আবর্জনা অপসারনের মাধ্যমে, নদীকে বিভিন্ন ধরনের দূষণ থেকে রক্ষার মাধ্যমে করা হয়ে থাকে নদীর আয়ুষ্কাল দীর্ঘায়িত করার কাজ। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সুনির্দিষ্ট পরিমান পাথর উত্তোলন গুরুত্বপূর্ণ এই কাজের একটি অঙ্গ।

নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সুনির্দিষ্ট পরিমান পাথর উত্তোলনের ফলে নদী ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা বয়োপ্রাপ্তির আগেই নদীর অকালমৃত্যু হয়েছে এমন উদাহরণ কতগুলো দেখাতে পারবেন আপনি?

পরিণামদর্শীতাকে প্রাধাণ্য দিয়ে পাথর উত্তোলন করা না হলে আমাদের তথাকথিত সভ্যতার অনেক স্মারক, অনেক সৌধই কিন্তু নির্মাণ হবে না! এমনকি নির্মিত হবে না সহজে দৃশ্যমান সুশোভিত পথ-রাজপথগুলো, যাদের ধারাস্রোত অনুসরণ করে বিভিন্ন যানবাহনে পরিবাহিত হচ্ছি আমরা, পরিবাহিত হচ্ছে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, বাণিজ্যিক সামগ্রী।

অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার দ্বিতীয় পর্যায়ে আসি।

গত চল্লিশ বছরে দেশে ১৮,০০০ কিলোমিটারের বেশি নদী হত্যা করা হয়েছে। বোমা মেশিন তো এই সেদিনের কথা, টুকরি ভরে বালি-পাথর তুলে হত্যা বহু কালের। বালি-পাথর তোলা বিলে মাছ ধরার মতো ব্যাপার নয়। এটা সব সময়েই [b]সংঘবদ্ধ ব্যবসায়। বালি-পাথর ব্যবসায়ীরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বালি-পাথর উত্তোলন করিয়েছে, নদীর অবস্থা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায়নি।[/b]

গত চল্লিশ বছরে নদী হত্যার পরিসংখ্যান তুলে ধরে যে বক্তব্য আপনি উপস্থাপন করেছেন, এই হীন কর্মকাণ্ডের নেপথ্যচক্রকে আপনিই সুনির্দিষ্ট করেছেন বিশেষ শব্দাবলীতে।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মোটাদাগে বলা চলে, গত চল্লিশ বছরে শুধু নয়, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর থেকে আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের মানুষের চরিত্রস্খলন, অপরিনামদর্শী অন্যায় সংঘটন প্রবণতা ক্রমবর্ধমানহারে প্রকৃতির প্রতিটি অঙ্গকে বিনষ্ট করেছে, ধ্বংস করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনচক্রকে, বাঁধাগ্রস্ত করেছে প্রাকৃতিক জ্ঞান আহরণ প্রক্রিয়াকে।

উল্লেখ্য, নিবন্ধটি ইতঃস্তত ঘুরে-বেড়ানো প্রক্রিয়ার সামান্য উপজাত মাত্র। নিবন্ধে উল্লেখিত শ্রমজীবী চরিত্রদের কেউ-ই পুরুষানুক্রমে পাথর উত্তোলনের সাথে যুক্ত নন। ঘটনার গতিপ্রকৃতি অনুধাবনের চেষ্টার এক পর্যায়ে কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ পাথর উত্তোলকের সাথে কথা বলতে সমর্থ হই আমরা। কথা বলতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, নদীর সাথে তাঁদের আত্মীয়তার বাঁধনটি ছিলো ভিন্ন মাত্রার। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম নানাবিধ কারণে পূর্বপূরুষের পেশা থেকে বিতারিত হয়েছেন, কেউ কেউ আবার অব্যক্ত কারণে বিতারিত হয়েছেন দেশ থেকেও।

আমার শুভকামনা জানবেন পুনরায় শ্রদ্ধেয়।

ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনি যা বললেন তার উত্তর দেয়া যেতো, যুক্তি এবং উদাহরণসহই। তবে আমার অভিজ্ঞতায় আমি জানি কোন বিতর্ক কোথায় থামাতে হয়। তাই আমি এখানেই থামলাম। ভালো থাকবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনিঃশেষ শুভকামনা শ্রদ্ধেয়।

সামান্য একজন মানুষ হিসেবে মিথষ্ক্রিয়ায় অজ্ঞানতাপ্রসূত ভুল থাকতে পারে আমার। সেক্ষেত্রে ক্ষমাপ্রার্থণা করছি সবিনয়ে।

এবং আমি যদি অসচেতনে আপনার মনোবেদনার কারণ হয়ে থাকি কোন ভাবে, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির অনুরোধ রইলো সেক্ষেত্রেও।

প্রার্থণা করবেন, আমি যেন আমার ত্রুটিগুলো শনাক্ত করতে পারি এবং শুধরে নিতে পারি দ্রুত।

ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয়। অনেক। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

রানা মেহের এর ছবি

পাথর শ্রমিকের জীবন জীবীকার বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার হলোনা।
আরেকটু লিখতে পারতেন।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।

বিষয়বস্তু প্রাঞ্জল করতে না পারার ব্যর্থতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

হয়তো আরেকটু লিখবো ভবিষ্যতে! কিংবা আর কখনওই নয়! কিংবা লিখবেন অন্য কেউ!

শুভকামনা পুনরায় সকলের জন্য।

ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।